ঈদসংখ্যার গল্প।। গিন্নী।। শানজানা আলম

কলতলা থেকে রাতের এঁটো বাসনপত্রগুলো ছাই দিয়ে মেজে পরিস্কার করে ফেলে সরজু। শাশুড়ি বীণাবালা রসুইঘর থেকে হাঁক ছাড়ে, বলি ও মেজ বৌ, ক’খানা বাসন মাজতে এবেলা পার করলে চলবে? বাজার এসে উঠানে ঢেলে দিলো বলে। কুটনো কোটা, বাটনা বাটা সবই পড়ে রয়েচে যে, তা এসব করবে কখন শুনি!
বীণাবালা নাম খানি যতটুকু মিষ্টি, ব্যবহার বোধকরি অতটা মিষ্টি নয়! সরোজের বড় জা আলাদা হয়েছে গতবছর। শাশুড়ির এসব হাঁক ডাক তার সহ্য হচ্ছিল না৷ স্বামীর কর্মস্থলে সে “বাসা” করেছে। তবে এই “বাসা” করা নিয়েও অশান্তি কম হয়নি একেবারে। বীণাবালা এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার লোক নয়, বাড়ির বৌ গঞ্জে বাসা করে থাকবে, তার আয়ত্ত ছাড়িয়ে, এ নিয়ে কথা কম হয়নি ঘরে। সরোজের জা শ্রীরাধা গায়ে মাখেনি। অবশ্য তার বড় জোর আছে, স্বামীর রোজগার ভালো। এখানেই তো সরোজ চুপ করে যায়! দুটো ছেলে নিয়ে বেকার স্বামীসহ শ্বশুরের ঘাড়ে বসে আছে। হোক যতই ওদের ছেলে, চারটা মুখ তো কম নয়। শ্যামল কিছু করতে চায় না। বড়ই আলসে। পরিশ্রমের কাজ তার পছন্দ নয়।

তবে এই যে শ্যামল কোন কাজ করতে চায় না, তাতে বীণাবালার কোন সমস্যা নেই। নিজের সন্তান আর নাতিদের পাতে খাবার দিতে তার খুব একটা কষ্ট হয় না, সব কষ্ট এই পরের বাড়ির মেয়ে বিনা বেতনের গতরে খাটা ঝি সরজুর বেলায়। না, না খাইয়ে রাখে না। সে তো পুষ্যি মেনি আর ভুলুকেও খেতে দেওয়া হয়। সরজুর বেলায় কেবল কোনোদিন মাছ থাকে না আর কোনোদিন কেবল ঝোল ভাত তো কোনোদিন একহাতা ভাতে টান পড়ে।

সরজু মুখ ফুটে কিছু বলেও না কখনো। কোন মুখেই বা বলবে, তার স্বামীর রোজগার নেই, এক এক করে চারটে মুখ তো কম নয় বাপু! বুঝে শুনে খরচ করতে হবে তো! আর মেয়ে মানুষের এত নোলা ভালো নয়! ঘরের বউয়ের তে নয়ই! দুটো খেয়ে বেঁচে বর্তে আছে, এই ঢের বেশি।
এবাড়ির উঠানের দুপাশে দুটো ঘর। একপাশে একটা দোচালা ঘর। আর গেট সোজাসুজি চৌচালা টিনের ঘর। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, এ বাড়ির বউয়ের ভাতের পাতে এতো টানাটানি চলে। পেট পুড়ে কবে খেয়েছে মনে করতে পারে না সরজু। সব সময়ই মনটা ছোট হয়ে থাকে। পুজোর প্রসাদ ছাড়া কোন কিছু সমান ভাগ হয় না কখনো।
কলতলা থেকে ধোঁয়া বাসনকোসন নিয়ে ঘরে রেখে আসে সরজু।

-ও মেজ বৌ, বলি বেলা তো কম হলোনেকো, বাজার সদাই এয়েচে, সে খেয়াল আচে নাকি? দেখো কী কী দিলো তোমার শউর ঠাকুর?
সরজুর চোখ যায় উঠানের পানে। দুটো ব্যাগে করে সদাই আসে বাজার থেকে। একটা চটের ব্যাগে থাকে কাঁচা সবজি। অন্য ব্যাগে থাকে মাছ। মাংস এবাড়িতে কেউ ছোঁয় না। গুরু ঠাকুরের নিষেধ আছে।
সরজুর শ্বশুর মহাশয় ছিলেন রেজিস্ট্রার স্কুলের মাস্টার।
রিটায়ার করেছেন বছর তিনেক আগে। জমি জমা পৈত্রিক সূত্রে কম নেই একেবারে। আয় মন্দ নয় সেসব থেকে।
কোনো সমস্যাও নেই বাইরে থেকে। যাবতীয় সমস্যা হেঁসেলে পড়ে থাকে সরজুর ভাতের থালায়।
শ্বশুর মহাশয় সকালে উঠে ঘি চপচপে গরম ভাতে সিদ্ধ আলু চটকে খেয়ে নিয়ে বের হোন। চৌরাস্তায় মিত্তিরের মনোহারি দোকানে বসে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের জ্ঞান জাহির করেন। এক ফাঁকে বাজার থেকে সদাই কিনে ভ্যানে করে পাঠিয়ে দেন বাড়িতে। দুপুরে সাড়ে বারোটায় ফিরে কলে তোলা জলে স্নান সেরে ছেলে আর নাতিদের নিয়ে দুপুরের খাবার সারেন।
তাদের খাওয়া হয়ে গেলে পাত পেরে বসেন বীণাবালা।
তার খাওয়া হয়ে গেলে ভাত জোটে সরজুর কপালে।
শ্যামল বীণাবালার মেজ ছেলে, ছোটটি পাঁচ বছর বয়সে।নদীতে ডুবে মরেছে। সেই দুঃখ তার এখনো চাঙা। সময় অসময় সুর করে কাঁদতে বসে ইশ্বরকে শাপশাপান্ত করতে থাকে।

সরজু বাজারের ব্যাগটা খুলে ফেলে। চটের ব্যাগ থেকে পটল গড়িয়ে উঠানে ছড়িয়ে যায়। আর বের হয় একটা চাল কুমড়ো। এই কুমড়ো বলি দিয়ে সর্ষে বাটায় রাঁধতে হবে। পটোলের জন্য নারকেলের পুর করতে হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নেবে বীনাবালা।
অন্য ব্যাগটা থেকে জ্যান্ত কই মাছ ঘাড়ে ভর দিয়ে বের হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তেল কই হবে আজ।
নাকি ভাপে দেবে! একদম বিলের তাজা কই। গরম ভাতের পাতে দারুণ স্বাদ।
সরজু নিঃশ্বাস ফেলে, তার পাতে জুটবে না হয়তো। বিয়ের সময় বাবা বলে দিয়েছিলেন, এ বাড়িতে তুমি অতিথি হয়ে ছিলে, যাদের কাছে যাচ্ছ, তারাই তোমার আপন, সে ঘর তোমার নিজের। শ্মশানযাত্রার আগে বের হয়ো না মা!
আপনজনের ঘরের তার প্রতিবেলায় শুনতে হয়, পরের ঘরের মেয়ে! আচ্ছা তাহলে তার বাড়ি কোনটা? সে কোন বাড়ির গিন্নী হবে! যবে গিন্নী হবে, তবে কী সে পেটপুরে খেতে পাবে? সেদিন কবে?
বীণাবালা চোখ বুঝলে তবে কি? মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দেয় সরজু। পেটপুরে খাবার লোভে সে বীণাবালার মৃত্যু কামনা করছে! ছি ছি!
আর বীনাবালার প্রস্থান হলেও সে জায়গা নিতে শ্রীরাধা ঠিক হাজির হয়ে যাবে। গিন্নী হবার লোভ শ্রীরাধা ছাড়বে নাকি!
উঠানের এক পাশে একটা ডালিম ফুলের গাছ, টুকটুকে লাল ডালিম ফুল ফুটে আছে। তার ঠিক পাশেই কাঠ টগর আর রক্তজবার ঝোপ। বীণাবালা রোজ সকাল সন্ধ্যা জল বাতাসা আর গাছের ফুল দিয়ে গৃহদেবতাকে তুষ্ট রাখে।

-ও মেজ বউ, কচ্ছপের গতিও তোমার চাইতে ঢের বেশি। যাও যাও তাড়াতাড়ি মাচা থেকে দুটো নারকেল নিয়ে এসো। তোমার শউর ঠাকুর নারকেলের পুর ভরা পটোল খেতে চেয়েছেন। নারকেল নামিয়ে মাছগুলো কুটে দাও দেখি! ওমা ওমা, বাটনাও হয়নি যে, বলি চালকুমড়ো এনেচে, সে খেয়াল আচে? সর্ষে, মৌরি আর পোস্ত বাটতে হবে। সর্ষেতে দুটে কাঁচা ঝাল দিতে ভুলো না যেন!
সরজু কোন উত্তর দেয় না। সকাল থেকে দু পা একজায়গায় হয়নি। ছেলেরা গিয়েছে স্কুলে। ফিরে এসে নদীতে ডুব দিয়ে আসবে। শ্যামল বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইলে গান শুনছে। বীণাবালাও সকালে খেয়ে শুয়েছিলেন, তার নাকি কাহিল লাগছিল। কাহিল লাগেনা কেবল সরজুর। সারাদিন খেটেখুটে রাতে স্বামীর সাথে তাল মেলাতে না পারলে তখন আরেক বিপদ! পা টিপে না দিলে ঘুম হয় না শ্যামলের। কোন কোন দিন রাতে ঘুমে কেবল যখন চোখ লেগে আসে, তখন মোল্লাবাড়ির আজানের আওয়াজ আসে৷ ঘুম ভেঙে যায় তখনি! বীনাবালা ডেকে তোলে। সকাল হয়, আলো ফুটতে থাকে। রসুইঘরের পাশের কাঠবাদাম গাছটার পাতার আড়াল থেকে সূয্যিঠাকুর আলো ছড়াতে থাকেন, আর তখন ঘরের বাইরে সারারাত ধরে জ্বলা হলদে বাতির আলো ম্লান হতে থাকে।

সরজুর মাঝে মাঝে ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ে।
বাড়িভর্তি লোকজন। জ্যাঠাই আর কাকাইয়ের পরিবার একসাথেই থাকত। হই চই, খেলা, ঠাম্মার পুজোর ঘরের সামনে দল বেঁধে অপেক্ষা করা, পুজো শেষে একটা তুলসী পাতা আর একটা বাতাসা নমঃ করে খাওয়া!
চোখের সামনে ভাসে বড় হাড়িতে ভাত বসানো হচ্ছে, ঠাম্মা ভাত নামিয়ে হাড়ির গা মুছে দিয়েছেন ন্যাকড়া দিয়ে। তারপর রান্না চড়িয়েছেন ডালের মনোহরা আর কুমড়োর বড়ি দিয়ে রুই মাছ। মুকুন্দ মাস্টার পড়াতে এসেছে, দল বেঁধে জোরে জোড়ে পড়ছে, এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই!

ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ! বেস্পতিবারে লক্ষীর পাচালি শোনা! তিলের নাড়ু, মুড়ি মুড়কি, মোয়া, সন্দেশ! এরপরে চোখে ভাসে সবাই লাইন দিয়ে খেতে বসেছে, কাসার থালায় দুপদের তরকারি, তিন রকমের ভাজা! খাবারের কথা মনে হতেই সরজুর গলার কাছে খিদে দলাপাকিয়ে আসে।
-বউমা, তোমার শউর ঠাকুর আসার সময় হয়ে গেল, এখনো মাছ কুটে উঠতে পারলে না! তুমি বাপু বড্ড ধীরু!
দিচ্ছি মা, এখনি হয়ে যাবে-বলে সরজু উঠানে ছাই আর আঁশবটি নিয়ে বসে। কই মাছের প্রাণ কি সাধে বলে, কেটে ফেলার পরেও মাছের প্রাণ যায় না, লেজ নাড়তে থাকে।
বাটতে হবে নারকেলও, নারকেলের পুর পটলে ভরে দিতে হবে৷
মাছ কাটা শেষ হতেই বীণাবালার ডাক আবার, ও বউমা, যাও তো, পুস্কনীর পার থেকে গোটাকয়েক লাউয়ের পাতা তুলে আনো! কই ভাপে দেই আজ!
অগত্যা হাতের কাজ ফেলে সরজু ছুটলো লাউপাতা ছিড়তে। পেছনে একটা অগভীর পুকুর আছে, সেখানে কেউ নামে না৷ পাশ থেকে লাউমাচা তুলে দেওয়া হয়েছে।

সরজু ফিরে আসে লাউপাতা নিয়ে। বাটনা বাটা এরপরে, সরষে, হলুদ, মরিচ সব বেটে দেয় বীণাবালাকে। ও পাড়ার মালতী দি আশপাশ সব ঘরের বাসন মেজে দেয়, বীণাবালা তাকে রাখে না! সরজু একবার কথা তুলতেই বীণাবালা বলেছে, ক পয়সা দাও বাছা সংসারে! এক এক করে মুখ তো কম নয়! তোমার তো সে চিন্তে নেই! খালি পয়সা ওড়ানোর চিন্তে।
বেলা গড়িয়ে যায়, ভাত নামে। একে একে পুর ভরা পটল, ভাপা কই সবই নামে। স্বামী আর ছেলেকে খেতে দিয়ে বীণাবালা একটু রোয়াকে বসে, তার কেমন যেন বুক ধরফর করে হুট করেই। খেতে পারেনা আরাম করে। সরজুর কপাল ভালো আজ, পাতে ছোট একটা মাছ আছে। আরাম করে কয়েক নলা ভাত মুখে দিলো যখন, ধপ করে আওয়াজ হলো! সরজু হেঁসেল থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখে, বীণাবালা রোয়াক থেকে গড়িয়ে উঠানে পড়েছে। ভাত রেখে উঠতে ইচ্ছে করে না তার, গপাগপ কয়েক নলা মুখে পুরে দেয়।
ততক্ষণে শ্যামল উঠানে চলে এসেছে!
-মেজ বৌ! সরজু? কোথায় গেলে, শিগগিরি এসো দেকিনি, দেখো মায়ের কী অবস্তা হয়েছে! কোথায় গেলে, ও মা, মা গো, কতা বলো!
সরজু পাতের ভাত শেষ করে তবে ওঠে। ততক্ষণে বীণাবালার ইহলীলা সাঙ্গ হয়েছে!
আহা! বড় ভালো মানুষ ছিলেন, নরম মনের! কোনদিন কাউকে একটাও কটু কথা বলেননি! দান করতেন আঁচল ভরে! —এমন ভালো ভালো কথা ওঠে পাড়াপ্রতিবেশিদের মুখ থেকে, সরজু চুপচাপ শোনে।
সন্ধ্যার মধ্যে বীণাবালা চিতায় উঠে পড়েন!
সময় দ্রুত শেষ হয়। মায়ের মৃত্যুর পরে হবিষ্যি গ্রহন করে, ব্রহ্মাচার্য পালন, পূরক পিন্ড দান, মস্তক মুন্ডন করে অশৌচ পালন করে শ্যামল।
একসময় অশৌচকাল কাটে। শাশুড়ি ঠাকুরুন গত হয়েছেন, বড় বৌ কী সংসারের হাল ধরতে আসবে এবার!
সরজু মনে মনে শক্ত হয়, তার সংসার, কাউকে এসে জায়গা নিতে দেবে না সে। অবশ্য সরজুর এই ভয় অমূলক হয়ে যায় যখন শ্রীরাধা জানায়, সে গঞ্জের বাসা ছেড়ে আসবে না গ্রামে। কালে ভাদ্রে বেড়াতে আসবে, এটুকুই। বাড়ির সব দায়িত্ব সরজুরই এখন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সে গিন্নী হয়েচে। শউর ঠাকুরের বয়স বাড়ছে, তাকে সময় মতো খেতে দিতে হয়, স্বামী, দুই ছেলে নিয়ে সরজুর ব্যস্ততার শেষ নেই।
শ্রীরাধা বেড়াতে এসেছে এক বৈশাখে। তার যত্নের কোন ত্রুটি রাখল না সরজু। দুপুরে স্বামী, ভাসুর ঠাকুর, শউর মশায়, ছেলেদের খেতে দিলো পাত ভরে।
শ্রীরাধা আর সরজু দুই জা একত্রে বসে খাবে। খেতে বসে শ্রীরাধা দেখলো, বড় বড় দুটো কই মাছ দুই জনের প্লেটে।
শ্রীরাধা মনে করে দেখল, বড় মাছ ছিল গোটাকয়েক, তা বলে বাড়ির পুরুষমানুষদের অপেক্ষাকৃত ছোট মাছ দিয়ে খেতে দেওয়া, এ কেমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড ভাই!
সরজু হাসে। অনাসৃষ্টি নয়, বীণাবালার দিন শেষ, এখন এ সংসার সরজুর! গিন্নী হয়েচে সে। এখন নিয়ম পাল্টেচে।
পাল্টে যাওয়া নিয়মে বাড়ির মেয়েরা বড় মাছ খাবে, পেট ভরে ভাত খাবে। সারাদিন কাজ করে আধপেট খাওয়ার নিয়ম এখন আর চলবে না।
তাড়াতাড়ি খাও দিদি, মালতী দি ঢুকবে খানিক বাদেই। এঁটো বাসন ধুয়েমুছে তবে যাবে। ওবেলায় রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে তো! এতগুলো মানুষ, মুখ তো কম নয়!
শ্রীরাধা ভীষণ অবাক হয়ে সরজুর দিকে তাকিয়ে থাকে। সরজু সত্যিই গিন্নী হয়েচে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *