ঈদসংখ্যার।। অনুসরণ অথবা একটি পলায়নের গল্প।। দিলীপ কুমার ঘোষ
উঁহু বাবা, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নয়! তুমি ভাবছ আকাশের দিকে তাকিয়ে বেকুবের মতো তারা গোনার ভান করলেই আমাকে বোকা বানাবে! আমাকে বোকা বানানো এতই সোজা! আমি কি খেয়াল করিনি শেষ এক ঘন্টা ধরে আমি যেখানেই যাচ্ছি তুমি আমাকে অনুসরণ করছ? তুমি হয়তো বলবে, আমি আপনাকে অনুসরণ করছি, কে বলল? কিন্তু তা বললে তো হবে না! আমার যেখানে প্রয়োজন তোমারও সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন, এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? বললেই হল! একই দিনে একই সময়ে একই সঙ্গে কারও হসপিটাল, মন্দির এবং গোরস্থানে যাওয়ার দরকার হয়! আমাকে যেতে হয়েছে বলে তোমাকেও যেতে হবে? তুমি আমাকে কী ভেবেছ? গোলা পাবলিক! হিপোক্র্যাট পলিটিক্যাল লিডারের মতো যা বোঝাবে, তাই বুঝে যাব? না বাবা, অত সোজা নয়! তুমি এবার আমার পিছু নেওয়া ছাড়ো দেখি! না হলে আমাকেই বাধ্য হয়ে দেখতে হবে তোমার আমাকে পিছু নেওয়া কীভাবে ছাড়ানো যায়।
আচ্ছা, আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে এসব কী ভাবছি? আর খামোখা আমি আকাশের দিকে তাকিয়েই বা আছি কেন? এর আগে কোনও দিন কি আমি আকাশের দিকে তাকিয়েছি? আকাশ মানে তো শূন্য। আমি জীবনকে পূর্ণ করে রাখতে চেয়েছি। পূর্ণ করে রেখেওছি। কোনও দিন আমার শূন্যে তাকানোর প্রয়োজন পড়েনি। আর আজ এক ঘন্টার মধ্যে কী এমন ঘটল, আমাকে সব ছেড়ে শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে?
এ কী, আমার অনুসরণকারী তো দেখছি একদম আমার কাছে চলে এসেছে! এর উদ্দেশ্য তো ভাল মনে হচ্ছে না। এরপর তো দেখছি কুকুরের মতো গা শুঁকতে আরম্ভ করবে! কুত্তার বাচ্চা একটা! আচ্ছা, কুকুরটাকে আমি ঠিকমতো নিকেশ করে এসেছি তো? কুকুরটা আমাকে অনুসরণ করে এখানে এসে পৌঁছে যাবে না তো! কুকুরকে আমার বড় ভয়। ব্যাটারা কেমন অনেক আগে থাকতেই অনেক কিছু বুঝতে পারে। এমন তীব্র ঘ্রাণশক্তি ওরা পায় কোথ্থেকে? আর আমার নাকের ডগায় এতদিন ধরে এতকিছু ঘটে চলল, আর আমি টেরই পেলাম না! আমি কি তাহলে কুত্তারও অধম! সে তো বটেই। নাহলে কুকুরটা মরতে জুলি এত কান্নাকাটি করল, অথচ…
আমি কোনও দিন কাঁদতে পারলাম না। কেন জানি না আমার চোখে জল নেই। শারীরিক আঘাতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়েছে; কিন্তু মানসিক আঘাতে, দুঃখে আমার চোখে কখনও একফোঁটা জল আসেনি। কাঁদতে না পারা নিয়ে অবশ্য আমার কখনও কোনও মাথাব্যথা ছিল না। ভাবিইনি তো মাথাব্যথা! আজই প্রথম আমার কান্নার কথা মাথায় আসছে।
সমীরকে প্রথম ছ’মাস আমার এতটুকু সন্দেহ হয়নি। সে যে ভেতরে ভেতরে এতদূর এগিয়েছে, তা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। বরং ওর দেশপ্রেমের নমুনা পেয়ে আমি চমৎকৃত হয়েছি। দেশের পতাকাকে এতটা সম্মান জানানো সচরাচর চোখে পড়ে না। জুলি যখন থার্টি ফার্স্ট-এর পার্টিতে নেশায় টইটুম্বুর হয়ে বলছিল, “সমীরভাই, জানেন, আপনার দাদা ভীষণ বেরসিক। কবে থেকে বলছি, আমেরিকানদের মতো ফ্ল্যাগের ডিজাইনে আমাকে একটা থ্রি পিস সুইমস্যুট বানিয়ে দাও! ডিজাইনার বিকিনি পরে আমি সি-বিচে ঘুরে বেড়াব আর ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করব। কিন্তু জানেন, কিছুতেই ও করিয়ে দিচ্ছে না। আপনি একটু বলে দেখুন না!”
“এটা আপনি কী বলছেন ভাবী! দেশের পতাকাকে এমনভাবে অসম্মান করা তো গুনাহ। ছিঃ ছিঃ, এমন কথা আপনি বলতে পারলেন! আপনাকে দেখছি আমার পক্ষে আর সম্মান দেখানো সম্ভব হবে না।”
“সমীরভাই, আপনি কি তাহলে বলতে চাইছেন, আমেরিকানরা নিজেদের দেশকে ভালবাসে না, না, ওরা ন্যাশনাল ফ্ল্যাগকে রেসপেক্ট করে না?”
“সে সব আমি জানি না ভাবী! ওদের কালচারের সাথে আমাদের কালচারকে না মেশানোই ভাল।”
আমি কাছে দাঁড়িয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছিলাম। সমীরের কথা শুনে ওর কাঁধটা চাপড়ে দিয়েছিলাম। আমেরিকায় সাত বছর কাটিয়ে আসার পরও দেশের প্রতি সমীরের আবেগ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। ওর কথা শুনে আমার কেন জানি না হাবিলদার বাবার মুখ মনে পড়ে গিয়েছিল।
সমীর থাকত ক্যান্টনমেন্টের বাইরে পশ এরিয়ায় একটা ঢাউস ফ্ল্যাটে। ও আর ওর অ্যালসেশিয়ান। ফ্ল্যাটে আর কাউকে কখনও দেখিনি। এত বড় ফ্ল্যাটে আর কারও না থাকা নিয়ে আমি অবশ্য সমীরকে কখনও কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
সমীরের সাথে আমার আলাপ ক্লাবে। মেগাসিটির একই এলিট ক্লাবের আমরা মেম্বার। ও ক্লাবে এলে চুপচাপ একটা কোণে গিয়ে বসে থাকত। একদিন বড় একটা দাঁও ফসকে মুড অফ করে ওই কোণের এক টেবিলে পানপাত্র নিয়ে বসেছিলাম। তখনই ওর সঙ্গে পরিচয়। সে রাতে আমার সঙ্গে জুলি ছিল না। আমি যখন এসে বসি তখন সমীরও ছিল না। “কী ব্যাপার, মিস্টার জোয়ারদার? আপনি যে দেখি আজ আমার শান্তিকুঞ্জে এসে বসে আছেন!” মুখ তুলে দেখি সমীর হালদার। আমেরিকা-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ওকে ক্লাবের প্রায় সকলেই চিনত। আমি হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “চলবে না কি?” সমীর বলল, “ও মধুরসে আমি বঞ্চিত।” “তাহলে এ ক্লাবে আসেন কেন!” “চুপচাপ বসে আপনাদের মাতলামি দেখব বলে!” সমীরের গলায় শুধু মজা ছিল না, কেমন যেন একটা ব্যঙ্গের ছোঁয়াও ছিল। তবে ওর এর পরের কথা শুনে আমি আর ওসব ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। “আমার ফ্ল্যাটে যদি কোনও দিন আসেন, তবে দেখবেন আমি নিজে শরাব না ছুঁতে পারি, কিন্তু শরাব সার্ভ করে মেহমানগিরি দেখাতে আমি কারও থেকে কম যাই না!” আমি অবাক হয়ে সমীরের মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম।
সত্যিই ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে আমেরিকান ওয়াইন কিছু খেয়েছিলাম বটে! জুলি তো জামাইকান রামের একদম ভক্ত হয়ে পড়েছিল। ওর মুখে আর অন্য কিছু রুচত না।
গত মাসে সিনিয়র অফিসার আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, “মিস্টার জোয়ারদার, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি, যা ডকুমেন্টেড ফাইল হিসাবে আপনার পার্সোনাল ল্যাপটপে ছিল, তা হ্যাকড হয়েছে। সেগুলো ডিকোড করারও চেষ্টা করা হয়। যদিও এখনও পর্যন্ত সেই চেষ্টা সফল হয়নি। রেজিমেন্টেড অফিসার হিসাবে আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে , ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কোনও ফাইল পার্সোনাল ল্যাপটপে ডাউনলোড করা যায় না।…বাই দ্য বাই, এগুলো আপনি ল্যাপটপে ডাউনলোড করেছিলেনই বা কেন? আমাদের কাছে কিন্তু গোপন সূত্রে খবর আছে, আপনি বেশ কিছু টাউটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সাবধান, মিস্টার জোয়ারদার, কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হওয়ার মতো কিছু ঘটতে দেবেন না।”
মাঘের শীতেও আমার ঘাম ছুটে গিয়েছিল। সমীরের ফ্ল্যাটে পৌঁছে একটু স্থির হলাম। “কী মিলনদা, আপনার তো দেখি আজ একদম নাস্তানাবুদ অবস্থা। দাঁড়ান… আপনাকে আজ একটু কড়া ড্রিঙ্কস সার্ভ করি।… সেলারের চাবিটা…! ওঃ, ওটা মনে হয় ওয়ারড্রবে। সমীর ওয়ারড্রবটা খুলতে এমনিই আমার চোখ চলে গেল সেদিকে। যা চোখে পড়ল, সেটা ভুল দেখেছি বলে মনে হল।
বড় মাছ শিকারের নেশায় ইদানীং এমন নিমগ্ন ছিলাম জুলির প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছিলাম না। এটাও খেয়াল করিনি যে-জুলি আমাকে কাছে পেলেই দিনে-রাতের যে কোনও সময় ছিবড়ে করে দিতে এত পছন্দ করত, সে-ও আমার আকর্ষণ হারানো এত সহজে মেনে নিয়ে তোফা আছে। এদিকে ফেঁসে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখে আমি আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলাম। তাতেও আমি নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম কতৃর্পক্ষ জাল গুটিয়ে আনছে। আমাকে বাঁচতে গেলে আমার ওপর ক্রমশ নেমে আসা জাল ছিঁড়ে পালানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু পালালেও যে আমাকে অনুসরণ করা হবে, সেটা ভেবে আমি যথেষ্ট দুঃশ্চিন্তায় ভুগছিলাম। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না কী করব? এখানে থেকেই আত্মসমর্পণ করে ক্ষমা প্রার্থনা, না, পলায়ন?
এই টানাপড়েনের মাঝে একরাতে আমার প্রথম রিপু ভীষণ চাগাড় দিয়ে উঠল। এটা আমার ক্ষেত্রে আগেও ঘটতে দেখেছি। প্রচণ্ড চাপে থাকলে নিজেকে নিংড়ে বের করে না দেওয়া পর্যন্ত আমি ছটফট করতে থাকি। আর এসব ক্ষেত্রে জুলির থেকে ভাল পার্টনার আর হয় না। জুলিকে কাছে টানলাম। মাস তিনেক পর। জুলির তরফে কোনও সাড়া পেলাম না। একটু অবাক হলাম। কিন্তু সময় নষ্ট করার মতো ধৈর্য আমার আর ছিল না। জুলির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর মধ্যে প্রবেশ করতে গেলাম। বাধা পেলাম। সরাসরি জুলির থেকে নয়, ওর আবরণে। কিমাশ্চর্যম! জুলি অন্তর্বাস পরেছে। তা-ও কিনা আমার সঙ্গে এক বিছানায় শুয়ে! বিরক্তিতে ছিঁড়ে ফেললাম অন্তর্বাস যুগল। শুধু ছিঁড়লামই না, ছুঁড়ে ফেলেও দিলাম। তারপর… জুলির ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে এতটুকু পাত্তা না দিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে না ফেলা পর্যন্ত নিজের শরীরটাকে যন্ত্রবৎ একই ক্রিয়ায় নিযুক্ত রাখলাম। গরল না উঠে আসা পর্যন্ত এতটুকু থামলাম না।
বাথরুম থেকে ঘুরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাব বলে লাইটার যেখানে থাকে হাত বাড়ালাম। কিন্তু জায়গাটা হাতড়েও লাইটারটা খুঁজে পেলাম না। বাধ্য হয়ে ঘরের ডিম লাইটটা জ্বালালাম। আর লাইটটা জ্বালানোর সাথে সাথে মেঝেয় পড়ে থাকা অন্তর্বাসগুলোর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। একবার সেগুলোর দিকে, আর একবার উল্টো দিক ফিরে শুয়ে থাকা নগ্ন জুলির দিকে তাকালাম। প্রথমেই মনে হল নির্লজ্জ জুলির গলা টিপে ওকে শেষ করে দিই। কিন্তু এগোতে গিয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আতঙ্কিত হয়ে দেখলাম জুলির শ্বেতশুভ্র শরীরে আমেরিকান ফ্ল্যাগের ডিজাইনার অন্তর্বাস, যা আমি কিছুদিন আগেই সমীরের ওয়ারড্রবে দেখেছিলাম।
বুঝলাম শুধু চাকরি থেকে নয়, বাঁচতে গেলে জুলির জীবন থেকেও আমাকে পালাতে হবে। আমি তো পালাবই, কিন্তু তার আগে জুলি এবং সমীরকে অনুসরণ করে আসল সত্যটা আমাকে জানতেই হবে।
শহরের নির্জনতম ক্যাফেটেরিয়ায় আমন বাট আমার মাথাটা দিল বিগড়ে। “তা মিস্টার জোয়ারদার, সমীর হালদারের সাথে কত মিলিয়ন ডলারে ডিল হল? নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে যা রফা হয়েছিল, তার থেকে বেশি?” বাটের গলায় কৌতূহলের থেকে বেশি রসিকতা। আমি জানতে চাইলাম, ” আপনার এমনটা মনে হচ্ছে কেন?” বাটের গলায় ফুটে উঠল স্পষ্ট ব্যঙ্গ, “না, আমাকে তো শুধু আপনি জমিন বিক্রি করতে চেয়েছিলেন, আর সমীরকে তো আপনি জমিনের সঙ্গে জরুও তুলে দিয়েছেন দেখছি!” “মিস্টার বাট, ডোন্ট ক্রস ইয়োর লিমিট!” বাটের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখদুটো মিটিমিটি করে হাসছে। কিন্তু আমার কানে বেজে উঠল বাটের ‘খ্যাক খ্যাক’ করে হাসি।
অফিস যাওয়ার নাম করে আজ দুপুরের পর আমি বেরিয়েছিলাম। কিন্তু অফিস না গিয়ে আমি রোহনের ফ্ল্যাট থেকে আমার কোয়ার্টারের দিকে লক্ষ রাখছিলাম।
জুলি বেরোল ঠিক বিকাল চারটেয়। আমি তখন ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। জুলি গাড়ি নিয়ে হাজির হল ডেবোনিয়ারে। ডেবোনিয়ার এই মেট্রোপলিসের সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। দেখলাম ডেবোনিয়ারের বাইরে সমীরের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ঘন্টা খানেক পর দু’জনে নিজের নিজের গাড়ি নিয়েই বেরোল। গাড়ি দুটো গিয়ে থামল আমার কোয়ার্টারের সামনে। তারপর আমার গাড়ি গ্যারেজে রেখে জুলি উঠে বসল সমীরের গাড়িতে।
আমি রোহনের গাড়ি নিয়ে ওদের আগেই বেরিয়ে পড়লাম। আমি জানি ওরা এখনই সমীরের ফ্ল্যাটে যাবে না। ময়দানে চক্কর কেটে বায়ু সেবন করবে। তারপর ধীরে সুস্থে রওনা দেবে। অনেকটা সময় হাতে থাকায় আমি কিছু না ভেবেই একটা শিবমন্দিরের সামনে গাড়ি দাঁড় করালাম। তারপর সটান পৌঁছে গেলাম পাথরের বিগ্রহের সামনে। নিজেকে নমস্কারের ভঙ্গিতে শিবলিঙ্গের সম্মুখে দন্ডায়মান আবিষ্কার করে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। আর তখনই চোখে পড়ল লোকটাকে। দেখলাম একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গেলাম সমীরের ফ্ল্যাটে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। ওরা যে কোনও মুহূর্তে এসে যেতে পারে। মাস্টার কি দিয়ে খুলে ফেললাম ফ্ল্যাটের দরজা। ফ্ল্যাটে ঢুকে আশ্রয় নিলাম বড় ল্যাভিশ বাথরুমে। বাথরুম তো নয়, যেন ওয়েল ফার্নিশড্ বেডরুম। বক্স খাটের বদলে শুধু বাথটব!
সৌভাগ্যই বলতে হবে আমার ঢোকার সময় অ্যলসেশিয়ানটা পাশের ঘরে ছিল। আমার গন্ধ পেয়ে ছুটে এসেছিল এ ঘরে। কিন্তু আমি ওর থেকেও দ্রুত বাথরুমে ঢুকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পেরেছিলাম।
বাইরে দরজা খোলার আওয়াজে বুঝলাম সমীররা ফ্ল্যাটে ঢুকল। অ্যালসেশিয়ানটা তখনও বাথরুমের দরজা আঁচড়াচ্ছে। জুলির বিরক্ত স্বর কানে এল, “জিমিকে ওখান থেকে সরাও। বাথরুমে ঢুকব কী করে?” “ভয় পাচ্ছ কেন? জিমি তো তোমার ন্যাওটা!” “সে যতদিন শিকাগোতে আমার কাছে ছিল ততদিন। তারপর থেকে তো দেখি ও আমার থেকে তোমার কথাই বেশি শোনে।” “জিমি, সর ওখান থেকে, যা পাশের ঘরে যা।” “জিমি তো দেখছি আজ তোমার কথাও শুনছে না। ওর চোখ দুটোয় কেমন হিংস্র আক্রোশ ফুটে উঠছে দেখো!” “সত্যিই তাই! কী ব্যাপার বলো তো জুলি?” “বাথরুমের ভিতর ঢুকে কেউ বসে নেই তো!” “জুলি, তুমি ওয়ারড্রবের ওই পাশটায় গিয়ে দাঁড়াও। আমি দেখছি।”‘
বুঝতে পারলাম সময় হয়ে এসেছে। যে অ্যাকশানকে আমি চিরকাল অন্তর থেকে ঘৃণা করে এসেছি, যে অ্যাকশানে আমার হাবিলদার বাবা প্রাণ হারিয়েছে; আর যার ফলশ্রুতিতে আমাকে অনাথ করে দিয়ে আমার মা পালিয়ে নতুন সংসার পেতেছে সুবেদার পবন বর্মার সঙ্গে, সেই ঘৃণ্য অ্যকশান আজ আমার সামনে। অ্যাকশান দেখলেই বা অ্যাকশানের সম্ভাবনা তৈরি হলেই এতকাল আমি পালিয়েছি। আজও আমার অবচেতন চাইল পালাতে। কিন্তু সচেতন মন বুঝতে পারল অ্যাকশান ছাড়া আজ আর পালানো সম্ভব নয়। সার্ভিস রিভলবার বের করে আমি পজিশন নিলাম। সমীর বাথরুমের দরজাটা খুলতেই বাঘের মতো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল জিমি। কিন্তু তার আগেই সেকেন্ডের ভগ্নাংশে গর্জে উঠল আমার সেল্ফ লোডেড রিভলবার। জিমি থেকে রিভলবারের মুখটা ঘুরে গেল সমীরের দিকে। মেঝেয় পড়ে অ্যালসেশিয়ানটা ছটফট করছিল। জুলি জিমির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। যন্ত্রণায় কাতড়াচ্ছিল সমীর। আমি জুলির দিকে রিভলবার তাক করে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সেটা খেয়াল করে যন্ত্রণাকাতর সমীর জুলির উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “জুলি, ডোন্ট লেট দ্য স্কাউন্ড্রেল এসকেপ। শ্যুট হিম ফর কান্ট্রি’স সেক।” দেখলাম জুলির হাতে উঠে এসেছে আগ্নেয়াস্ত্র। সেটা ঝলসে ওঠার আগে আমার রিভলবার আবার গর্জে উঠল।
আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম হসপিটালে। চমকে গেলাম মন্দিরে দেখা সেই লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে দেখে। একটা অ্যালসেশিয়ানের ডাক শুনলাম কাছ থেকেই ভেসে আসছে।
তারপর গোরস্থানে পৌঁছে গিয়েও দেখলাম নিষ্কৃতি নেই। লোকটা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। কুকুরের ডাকও ক্রমশ এগিয়ে আসছে। যতই আমি পালানোর চেষ্টা করি না কেন আমার অনুসরণকারী এ দুটোকে নিকেষ না করলে আমি কিছুতেই পালাতে পারব না। আমি রিভলবার তুলে ধরলাম। তাকিয়ে দেখলাম আমার হাত দেখতে পাচ্ছি না। তার পরিবর্তে দেখতে পেলাম কুকুরের চেন আর একটু দূরের শহীদ স্তম্ভে উড্ডীয়মান দেশের পতাকা।