ছোটগল্প

ঈদসংখ্যার গল্প ।। দুঃখ প্রাইভেট লিমিটেড।। সাইফ বরকতুল্লাহ

ঝির ঝির বৃষ্টি হচ্ছে। বুকের মধ‌্যে ধরফর ধরফর করছে। রাস্তায় কোথাও লাইট জ্বালানো, আবার কোথাও অন্ধকার। এর মধ‌্যে তুমুল বেগে সাইকেল চালাচ্ছি। সামনে তাকাচ্ছি, সাইকেল চলছে।
কালশি ওভারব্রিজে উঠতেই শরীরটা একদম পাথর হয়ে গেল। সাইকেলের প‌্যাডেল ঘুরাতে পারছি না। পা চলছে না। আট ঘণ্টা গাঁধার মতো খাটুনি খেটে অফিস থেকে যখন বের হই তখনই শরীর ক্লান্ত। এরপর অলরেডি এক ঘণ্টারও বেশি সময় সাইকেল চালানো হয়ে গেছে। বিশ কিলোমিটার রাস্তা। করোনাকাল। রাত দশটার পর এই শহরে বাস পাওয়া যায় না। সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে ব্রিজ পার হচ্ছি। বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। আশেপাশে কেউ নেই। রাত তখন সাড়ে এগারটার কাছাকাছি।
ওভাব্রিজের ঠিক মাঝখানে যখন পৌঁছাই তখন হঠাৎ শা করে একটা মোটরবাইক পাশ দিয়ে চলে গেল। বাইকের শব্দ শুনেই তখন প্রচণ্ড ভয় পাই। বৃষ্টিস্নাত নিঃস্তব্ধ এই শহরে রাতে ছিনতাইকারি বেড়েছে। কয়েকদিন ধরে খবরের কাগজেও করোনার দুঃসময়ে চুরি, ছিনতাইয়ের উৎপাতের খবর নিয়মিত বের হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। চাকরি করতেই হবে। বউ, বাচ্চা, বাসা ভাড়া- অনেক খবর। বলা যায় চব্বিশ ঘণ্টাই খবচ। এক গ্লাস পানি খাবো-এরও টাকা হিসেব করতে হয়। এমনিতেই করোনাভাইরাসের কারণে দুইমাস অফিস বন্ধ ছিল। কি-যে দুঃসময় গেছে বলা কঠিন। দুইমাস পর অফিস খুলেছে। প্রতিদিন হাজিরা নিশ্চিত না করলে মাস শেষে সেলারি কমে যাবে। সংসারের কথা চিন্তা করে যত কষ্টই হোক অফিসে হাজিরা নিশ্চিত করতে হবে।
রাত বাড়ছে। বৃষ্টিও থামছে না। বাসায় দ্রুত পৌঁছাতে হবে। গায়ে টি-শার্ট থেকে টপটপ পানি পড়ছে। ঘাম আর বৃষ্টিতে পুরো শরীর একাকার। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। হাঁপাতে হাঁপাতে আবারও সাইকেলে উঠে যাই। ওভারব্রিজ অতিক্রম করে সামনের দিকে যাচ্ছি।
বাসাই পৌঁছাই রাত সাড়ে বারোটার দিকে। ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খাচ্ছি। পাশে বসে ডরোথি জিজ্ঞেস করছে
-‘ করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। তোমার জন‌্য খারাপ লাগে। এত কষ্ট করো।’
-আমি করোল্লা ভাজি দিয়ে রুটি খাচ্ছি। ডরোথির কথা শুনে বললাম, এলিয়টের কবিতা পড়ছ?
-না।
-বাইরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে।
-এই বৃষ্টি দুই তিনদিন থাকবে। এপ্রিলের বৃষ্টি।
-এপ্রিল নিষ্ঠুর মাস।
-কে বলল তোমাকে?
-এলিয়ট।
-ধুর!
-বিশ্বাস হয় না তোমার?
-ওয়েস্ট ল‌্যান্ড কাব‌্যগ্রন্থে এলিয়ট লিখেছেন- april is the cruelest month.
-কবিতা টবিতা এখন বাদ দাও। খাওয়া শেষ করো।
-হা হা হা।
দুই.
ডরোথি ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে বৃষ্টি আরো বেড়েছে। শেষ রাত। চোখে ঘুম আসছে না। বিছানা থেকে উঠে কিচেনে গিয়ে এক কাপ রং চা বানিয়ে জানালায় আকাশ দেখছি। হঠাৎ টুং টুং শব্দ। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি, কাল অফিসে একটু আগে যেতে একটা ম‌্যাসেজ এসেছে। অফিসে বিকেলে জরুরি মিটিং হবে। আমি চা খেয়ে আবারো ঘুমানোর চেষ্টা করছি।
পরের দিন সন্ধ‌্যা। অফিসে মিটিং শেষ করে বাইরে বের হই। এরই মধ‌্যে ডরোথির ফোন-‘আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি এসো। আসার সময় বাজার থেকে আটা, আদা, কাচামরিচ কিনে নিয়ে এসো।’ ফোনে কথা শেষ করে কাজলের চায়ের দোকানে গিয়ে বসি।
-কাজল দা একটা সিগারেট দাও, একটা রং চা বানাও।
-বসেন। কী খবর আপনার?
-আরে! বাইচ্চা আছি। আপনার চা বিক্রি কেমন চলছে?
-শান্তি নাই। নানা ঝামেলা। সন্ধ‌্যার পর দোকান চালাইতে পারি না। কখন এসে আইনশঙ্খলা বাহিনী দৌড়ানি দেয়। নানা নিয়ম।
-কি আর করবা, করোনা তো, এজন‌্য রাতে দোকান খুলতে দেয় না। সরকার একটা সময় বেধে দিয়েছে। এই সময় খোলা রাখতে পারবা।
-ভাই, দুইমাস দোকান বন্ধ ছিল। ঋণ করে চলছি। এখন তাও কিছুটা চলতে পারছি। সামান‌্য হলেও বেচা হচ্ছে।
-আসলে করোনা এখন আমাদের সবাইকে জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। এরই মধ‌্যে হঠাৎ হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। চা খাওয়া শেষ করে আমি বাসে উঠি।
তিন.
বাস যাচ্ছে। জিন্সের প‌্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের এফএম অন করতেই শুনতে পেলাম-হ‌্যালো লিসেনার, এখন শুরু হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘দুঃখ প্রাইভেট লিমিটেড’ । এই অনুষ্ঠানে আজ কয়েকজন অতিথি যুক্ত আছেন। যারা এই করোনা মহামারির সময়ে নিজেদের জীবনের গল্প তুলে ধরবেন। আশা করি আপনারা ততক্ষণ রেডিও আকাশ এফএম টুয়েন্টি নাইন পয়েন্ট ফাইভ এর সঙ্গেই থাকবেন।
বাস যাচ্ছে। আমি রেডিও শুনছি। এরই মধ‌্যে রানির ফোন।
-মুনির কেমন আছো?
-এই তো, কেটে যাচ্ছে। তোমার কী খবর?
-অসম্ভব ব‌্যর্থ একটি সময় যাচ্ছে। আমি যেনো লেখাই ভুলে গেছি। গল্প লেখা ভুলে গেছি। আজ সারাদিন বসে একটি লাইনও লিখতে পারলাম না। তবুও মুখের হাসি থেমে নেই আমার, এরকম ব‌্যর্থতার পরেও। চূড়ান্ত ব‌্যর্থতার পরেও। ব‌্যর্থ হয়েও কয়জন প্রাণ খুলে হাসতে পারে! আমি পারি।
-ঠিক বলেছো। আজ ফেসবুকে তোমার প্রোফাইল পিকে যে হাসিটা দেখলাম-অসাধারণ। ওই হাসি দেইখা ইনস্পায়ার হই।
-তাই নাকি! করোনাকাল কবে শেষ কে জানে।
-তোমার একটা স্ট‌্যাটাস পইড়া আমি হাসতে হাসতে শেষ।
-কোনটা?
-ওই যে সেদিন দিয়েছো-‘কারো সাথে ফোনে আপনার সর্বোচ্চ কতক্ষণ/ঘণ্টা ননস্টপ আলাপের রেকর্ড আছে? মানে হিসাব চব্বিশ ঘণ্টায় একদিন হিসাবে নিয়া কইবেন। আর ওই আলাপ একবারও কুট কইরা কাইট্টা না দিয়া চালাইছেন। দুইবার কাজ্জে লাগছে, তিনবার মিল হইছে, ছয়বার তার গলায় গান শুনছেন, ওয়াও ওয়াও, ওয়াও। য়‌্যু মাই হট বেইব কইছেন। শুধুমাত্র একবার আই লাভ য়‌্যু কন নাই তারে ভুলেচুকে তাই কাইট্টালামু টাইপ হুমকিও শুনছেন। ফোন রাইখা তোমার ওমুক বন্ধু সেইদিন আমারে নিয়া এই কেন কইলো আর তুমি তারচেয়ে বেশি সুন্দরী, মানে সবদিক দিয়াই, এই কইরা তারে আলাপে বিজি রাইখা একবার মুততে গেছেন, ফিরা আইসা ওহ! জান!জানটা রে জান কইছেন, মানে সে বুঝতে পারে নাই যে আপনি ছিলেন না সেখানে, তার নিজের পার্ট-লওয়াটুকু আপনার কানে ঢুকে নাই। তো এইরাম প্রেমালাপ করার অভিজ্ঞতা ও রেকর্ড আপনাদের কার কাছে আছে? আর কতক্ষণ জুড়ে?’
-ও, এইটা।
-হ‌্যাঁ, দারুণ চৌকস স্ট‌্যাটাস দিছ।
-ধন‌্যবাদ। করোনার দিনগুলোতে নিজেকে সতেজ রাখার চেষ্টা আর কি।
-শোন, পরশু এফবিতে নক দিয়ো তো, এটা প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করব।
-ধুর! প্রবন্ধ লেখার কী দরকার, তুমি তো গল্প অসাধারণ লেখো। আমার কাছে মনে হয় তোমার কিছু কিছু ক্ল‌্যাসিক।
-তাই নাকি!
-জী।
-ধন‌্যবাদ দোস্ত।
চার.
সোমবার সকাল। ডরোথি ডাইনিং টেবিলে নাস্তা দিয়েই বলল, দুঃসংবাদ আছে।
-কী?
-করোনায় আশরাফ ভাই মারা গেছে।
-হায় হায় কি বলো! গত সপ্তাহে আশরাফ ভাইয়ের বাবাও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাবার লাশ দাফন করতে তিনি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আশরাফ ভাইয়ের সঙ্গে কত স্মৃতি। ভালো ছবি তুলতে পারতেন। ভ্রমণে গেলেই ছবি তুলে দিতেন। আহারে! ওনার তিনটা মেয়ের কী হবে এখন? ভাবীর অবস্থা এখন কেমন? কীভাবে বড় হবে মেয়েরা। করোনা সব শেষ করে দিচ্ছে।
খবরটা শোনার পর থেকেই হৃদয়টা ভীষণ বিধ্বস্ত। আর নাস্তা খেতে পারলাম না। বাইরে হালকা রোদ উঠেছে। কিছুতেই ভালো লাগছে না। করোনার কারণে তিনমাস হোম কোয়ারেন্টাইন জীবন কাটালাম। করোনা জীবনকে থামিয়ে দিয়েছে । ডরোথিকে ডকালাম।
-আজকের পত্রিকাটা দাও তো.
-আজ পত্রিকা দেয়নি।
-ও, হকারের আবার কী হলো! করোনা হলো না তো আবার।
-করোনা আসার পর থেকেই তো পত্রিকা নিয়মিত দিচ্ছে না।
-গত কয়েকদিন পত্রিকা পড়িনি তো। ওকে।
কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর অফিসের উদ্দেশে বের হলাম। বাইরে আবহাওয়া ঠান্ডা। শরীর কেমন দুর্বল লাগছে। মাথা থেকে আশরাফ ভাইয়ের মৃত‌্যুর খবরটা কোনোভাবেই যাচ্ছে না। মনকে শক্ত করলাম। সিএনজি ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি সাবধানে চালাবেন, তাড়াহুড়োর দরকার নেই। আকাশ হঠাৎ মেঘলা হয়ে গেল। আমি যাচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *