ছোটগল্প।। আমিনা।। দিলীপ কুমার ঘোষ
দিলীপ কুমার ঘোষ
যত সহজে গফুর আমিনাকে নিয়ে ফুলবেড়ের চটকলে পৌঁছল, তত সহজে কিন্তু কাজের সংস্থান করে উঠতে পারল না। কাজ জোটাতে গিয়ে তাকে চটকলের কত জায়গায় কত জনের সঙ্গেই না দেখা করতে হল! কোথাও সরাসরি প্রত্যাখ্যান, তো কোথাও প্রতিশ্রুতি। দিনের দিন কাজ কিন্তু জুটল না। কাজ না পেয়ে সে লাচারে পড়ে গেল। সমস্যা তার জীবনে নতুন না হলেও এবারের অসুবিধাগুলো তার বড় অচেনা বলে মালুম হল।
মাথা গোঁজার ঠাঁই জোটানো যে ভাববার বিষয়, তার আগে মনে হয়নি। ভেবেছিল চটকলে কাজ জুটিয়ে নিয়ে সেখানেই থাকার একটা বন্দোবস্ত করে নেবে। এখন চটকলে কাজ না মেলায় কোথায় থাকবে ভেবে ঠিক করে উঠতে পারল না। একা থাকলে ভাবনা ছিল না। গতরাতের মতো গাছের তলা বা যেখানে হোক রাত কাটিয়ে দিতে পারত। কিন্তু
সঙ্গে আমিনা থাকায় সেটা ঠিক হবে না। মেয়েটা যদিও খুব বড় নয়। কিন্তু মেয়ে তো বটে! দিনকাল যা তাতে সে ঠিক ভরসা পেল না। রাতে আমিনাকে নিয়ে যাবে কোথায়, সেটা ভেবে না পেয়ে গফুর মেয়েকে নিয়ে এসে দাঁড়াল খোলা আকাশের নীচে।
তারপর কী ভেবে ধীর পায়ে হেঁটে একটা বটগাছের নীচে।
খিদের জ্বালায় পেট চোঁ চোঁ করছে। পোড়া পেট তো আর কোনও কথা শোনে না! গ্রামে পঞ্চ ব্যঞ্জন বা প্রত্যেক দিন দু’বেলা দু’মুঠো না জুটলেও বেশিরভাগ দিনই গরম ভাত একবার অন্তত পেটে পড়ত। কিন্তু কাশীপুর ছাড়ার পর থেকে পেটে আর ভাত ঢোকেনি। কবে একমুঠো ভাত জুটবে তারও নিশ্চয়তা নেই। বড় অসহায় বোধ করতে লাগল
গফুর। চাঁদের আবছা আলোয় অসহায়ভাবে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমিনা বলল, চলো বাবা, ফিরে যাই।
কোথায়?
কেন, কাশীপুরে!
না।
কেন?
আর ফেরা যায় না বলে।
কেন ফেরা যায় না?
ও তুই বুঝবি না!
মহেশের জন্য তোমার মনখারাপ করছে বাবা?
মনখারাপ…! আমার সমস্ত মন-ই পড়ে রয়েছে মহেশে। যে-কাশীপুর আমার মহেশকে বাঁচতে দেয়নি, সেই কাশীপুরে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না রে মা!
কিন্তু আমরা এখানে থাকব কোথায়? খাব কী?
কালকে রাত থেকে কলের জল ছাড়া পেটে আর কিছু পড়েনি। আমার খুব খিদে পাচ্ছে বাবা। গাছের তলায় শুয়ে মশার কামড়ে সারারাত ছটফট করেছি, একটুও ঘুমোতে পারিনি। আজ রাতে আর এভাবে আমি থাকতে পারব না।
আর কয়েকটা দিন দেখি আমিনা। চটকলে না হলেও অন্য কোনও কল-কারখানায় একটা কাজ ঠিক জুটে যাবে।
ততদিন না খেয়ে থাকতে হবে?
আমিনার কচি মুখের দিকে তাকায় গফুর। আলো-আঁধারিতে মুখটা ঠিক ঠাহর করতে পারে না। কানে ভেসে আসে মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি।
আমিনা, মন্দিরে যাবি?
আমিনা কেঁপে ওঠে, মন্দিরে…!
হ্যাঁ, মন্দিরে।
আমরা মোছলমান হয়ে হিঁদুর মন্দিরে যাব!
কেন, গেলে কী হয়েছে? আর আমাদের সেখানে মোছলমান বলে চিনছে কে?
কী বলছ, চিনতে পারবে না! তোমার লুঙ্গি-দাড়ি দেখে ঠিক চিনে নেবে।
চিনতে পারলে সেখান থেকে আমাদের কি তাড়িয়ে দেবে?
বাবা, দেখছি মহেশের শোকে তোমার মাথাটা সত্যিই গেছে! তুমি জিগ্গেস করছ, তাড়িয়ে দেবে কি
না! মন্দিরে ঢুকতে হবে না… মন্দিরের সামনে আমাদের ঘোরাঘুরি করতে দেখতে পেলেই দুর-দুর করে কুকুর-তাড়া করবে।
গফুরের মাথা গরম হয়ে গেল। বলল, কেন, আমরা কি মানুষ নয় নাকি?
মানুষ! আমরা? আমরা তো বিধর্মী।
কে বলেছে তোকে আমরা বিধর্মী?
আমরা কি এখানে থেকে ধম্মকম্ম করি না?
সে তো হিঁদুরা করতে দেয় বলে করি। ওদের যদি ইচ্ছা হয় আর করতে দেবে না, তখন ধম্মকম্মও হয়তো আর করতে পারা যাবে না।
বললেই হল, এ কি মগের মুলুক নাকি!
মগের মুলুক কী! এ তো হিঁদুদের আপন দেশ। তাদের যা ইচ্ছে তারা তাই করবে। এখানে থাকতে হলে অন্যকে মুখ বুজে সব সহ্য করতে হবে। না’লেই দেশছাড়া!
হুঁ, করলেই হল দেশছাড়া! কাদের দেশ থেকে, কারা আমাদের দেশছাড়া করবে? এ দেশ তো আমাদেরও।
মোদের বাপ-দাদা কি অন্য দেশ থেকে এয়েছে?
ওসব নিয়েই তুমি এখনও বসে থাকো বাবা। অতই যদি সব সোজা হত, তা’লে এই রাতে আমাদের গাছতলায় কাটাতে হত না, আমরা কাশীপুরে নিজের কুঁড়েঘরেই থাকতে পারতুম!
কিন্তু… কিন্তু তুই তো সেই কাশীপুরেই ফিরে যেতে চাইছিস!
হ্যাঁ, চাইছি তো। অচেনা বিদেশ-বিভুঁইয়ে ঘোরাফেরা করার থেকে নিজের চেনা মাটিতেই থাকা ভাল বাবা।
চেনা মাটিই বা কী দিয়েছে আমাদের?
চেনা মাটি শত কষ্টের মধ্যে হলেও তবু বাঁচতে দিয়েছে। চেনা লোকগুলোর মধ্যে দু’-চারজনও আমাদের দয়ামায়া দেখ্খেছে, ভালবেসেছে… মানুষ ভেবেছে।
সে সব জায়গাতেই গরিব মানুষের জন্য কিছু সত্যিকারের মানুষের অমন দরদ থাকে।… কিন্তু কাশীপুরে গেলেই খালি আমার মহেশের কথা মনে পড়বে, আমি সেখানে টিকতে পারব না রে মা!
মহেশকে মনে পরবে বলেই তো সেখানে আমরা ফিরব বাবা। চলো, আর দেরি কোরো না।
গফুর ইতস্তত করছিল। সেই সময় যেন মাটি ফুঁড়ে হাজির হল তিনজন। আমিনা চমকে উঠে ভয়ে বাবার হাতটা চেপে ধরল। গফুরও রীতিমতো থতমত খেয়ে গেল। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, তোরা কে বল তো? অনেকক্ষণ ধরে তোদের এখানে ঘুরঘুর করতে দেখছি!
গফুর বলল, আমি চটকলে কাজের খোঁজে এয়েছি।
দ্বিতীয়জন আমিনার দিকে চোখ রেখে বলল, সঙ্গে এটা কে?
লোকটার গলার আওয়াজ এবং কথা বলার ভঙ্গি গফুরের ভাল লাগল না। সে চুপ করে থাকল। জবাব না পেয়ে রুক্ষস্বরে প্রথমজন বলল, কী রে, কথা
কানে যাচ্ছে না বুঝি! বলছি মেয়েটা কে?
আমার মেয়ে।
সত্যি বলছিস তো? না, কোনও গন্ডগোল আছে!
গন্ডগোল মানে! কী যে কন আপনারা!
এতক্ষণ কোনও কথা না বলা তৃতীয়জন আমিনাকে লক্ষ করে খনখনে গলায় প্রশ্ন করল, কী রে, লোকটা ঠিক বলছে তো? ও সত্যিই তোর বাবা?
খিদে-তেষ্টায় সাড়া হতে থাকা গফুরের মধ্যে আবার মহেশকে মারার সময়কার রাগটা ফিরে আসতে থাকে। বাবার হাত চেপে থাকা আমিনা সেটা বুঝতে পেরে বাবার হাতটা আরও জোরে চেপে ধরে বলল, তোমরা তো ভারী মজার মানুষ! কিছুই বোঝ না দেখছি! আমাদের দেখেও বুঝতে পারছ না যে আমরা বাপ-বেটি?
লোকগুলো কিছু না-বলে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে থাকল। একজন ফস করে বলে বসল, তোরা মোছলমান?
গফুর মুখ খোলার আগে আমিনা বলল, কী করে বুঝলেন কত্তা?
তোর বাপের দাড়ি-লুঙ্গি দেখে।
ওঃ, তোমরা মোছলমান।
এই কী বললি? আমরা মোছলমান! কে বলল তোকে?
তোমরা লুঙ্গি পরে আছ, আর তোমাদেরও দু’জনের দাড়ি আছে দেখে বলছি।
আমরা মোছলমান নয়, আমরা বাঙালি।
আমরাও বাঙালি।
অঃ, বাঙালি! কিন্তু তোর বাবার লুঙ্গিতে ওই কালচে দাগটা কীসের? রক্তের নয় তো!
রক্ত! এ তা’লে মহেশের রক্ত।
মহেশ কে?
মহেশ হল আমার কলিজা। মহেশ হল…
তুমি চুপ করো বাবা।… মহেশ আমার দাদা। জোঁকে ধরেছিল দাদাকে। হাতের কাছে নুন না পেয়ে জোঁকটাকে ছাড়াতে গিয়ে কাস্তে দিয়ে কেটে দেয় বাবা। জোঁকের রক্ত ছিটকে লেগেছে লুঙ্গিতে।
আর মহেশের কী হল?
রক্ত বন্ধ না হওয়ায় দাদা বাঁচেনি।… সেই শোকেই বাবা গ্রাম ছেড়ে আমার হাত ধরে বেড়িয়ে পড়েছে।…
বাবা, চলো আমরা ফিরে যাই।
হ্যাঁ, চল আমিনা।
গল্পটি ভারতীয় লেখকের এবং ভারতীয় প্রেক্ষাপটে লেখা। সেকারণে গল্পের কিছু বানান বাংলাদেশের বানানরীতির সাথে মিলবে না, এটা স্বাভাবিক। এছাড়া বাংলাদেশে “হিঁদু” শব্দটি অপমানজনক বলে গণ্য করা হয়, যে কারণে লিখিতরূপে শব্দটি পরিহার করা হয়। লেখক দিলীপ কুমার ঘোষ আমাদের পরিচিত মহেশ গল্পের গফুর ও আমিনাকে যে রকম সাবলীলভাবে নতুন রূপে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন তা প্রশংসাযোগ্য।