ছোটগল্প।। উপহার।। মোহিত কামাল

মোহিত কামাল

হোস্টেল-জীবন আনন্দের, ভালো লাগার। তবু সবসময় হোস্টেলে থাকা যায় না। ঈদের ছুটিতে যেতে হয় বাড়িতে। হল বন্ধ হয়ে যায়। দারোয়ান ছাড়া তখন কেউ থাকে না, যেতে না চাইলেও যেতে হয়। বাধ্যতামূলক যাওয়াটা মেনে নিতে পারে না তনিমা। ছুটির আগে হোস্টেলের সবার মনে কেমন উল্লাস কাজ করে, ব্যাগ গোছায়, প্রয়োজনীয় বইপত্র ঢোকায় ব্যাগে। কেনাকাটাও করে সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী। তনিমার মন থাকে না কেনাকাটায়। তার কাছে বাড়ি মানে আতঙ্কের জায়গা। সংসারে টানাপড়েন না থাকলেও বাবা-মার সম্পর্কের সংঘাত ভয়াবহ। নিত্য ঝগড়া, মারপিট, হইচই চলতেই থাকে। চাপ আসে বিয়ের, উটকো ঝামেলা মোকাবিলা করতে করতে সময় কাটাতে হয়। ভালো লাগে না এসব। ভাবে, যদি একটা বাসা ভাড়া করা যেত, তাহলে ছুটির সময় ছুটতে হতো না বাড়িতে। স্বাধীনভাবে থাকা যেত ঢাকা শহরে। ঢাকা শহরে টিকে থাকা সহজ নয়, কঠিন। কঠিন সমস্যা মোকাবিলা করার শক্তি নেই, তা নয়। শক্তি আছে, জোর আছে মনে। কিন্তু সামাজিক চোখ উপেক্ষা করে একা থাকার সামর্থ্য নেই। ভাবতে ভাবতে ব্যাগ গোছাতে হয় তনিমাকে।

রুমমেট সাদিয়া প্রশ্ন করল, বাড়িতে যেতে তো ইচ্ছা করে না তোর। কোথায় যাবি এখন? সবকিছু কি ইচ্ছা মেপে চলে? কামনা বাসনা জলাঞ্জলি দিতে হয়। বাস্তবের খোলা তলোয়ারের ঘা থেকে বাঁচতে হলে ইচ্ছামতো কি চলা যাবে? বাড়িতেই যাব আমি। এক কাজ কর, চল আমার সঙ্গে। আমাদের বাড়িতে ঈদ করবি এবার। আমারও ভালো লাগবে। খাপ খোলা তরবারি থেকে নিজেকেও বাঁচাতে পারবি। যাবি? প্রপোজালটা শুনে লাফিয়ে ওঠে মন। যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল তনিমা। ছোট বোন নিমার কথা মনে পড়ল। মায়ের কথা মনে পড়ল। ঘরে যতই অশান্তি থাকুক না কেন, মমতার সুতোয় টান খেল। ওদের রেখে অন্য কোথাও যাওয়া কি ঠিক হবে ঈদে? স্বার্থপরতা হবে না বিষয়টি? নিজের ভালো লাগার জন্য ওদের অপেক্ষার প্রতি অবিচার করা হবে না? সাদিয়ার প্রস্তাবটাও আন্তরিক। তবু ফিরিয়ে দিল প্রস্তাব। ভদ্রতার জবাব তনিমা ভদ্রভাবে দিল, তোর সঙ্গে যেতে ইচ্ছা করছে, নিমার জন্যও টানছে মন। বল তো, কী করি? না, থাক। আমার সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না, নিমার কাছেই যা। বাড়িতে অশান্তি থাকলেও, বাড়িতে যাওয়াটাই ঠিক হবে তোর। সাদিয়ার জবাব পেয়েছে নিজের ভেতরের চাহিদা অনুযায়ী। যাক, সাদিয়াকে সম্মান দেখানো হলো, নিমার মনও রক্ষা হবে। ভাবতে ভাবতে ব্যাগ গোছানো শেষ করে তনিমা বলল, রেডি। একসঙ্গে বেরোই। বের হবি এখন? হ্যাঁ, বের তো হতেই হবে। টিকিট কাটা আছে না? ঠিক সময়ে স্টশনে পৌঁছতে হবে। বললেও বের হতে চাইছে না সাদিয়া। এটা-ওটা করে টাইম কিল করছে।

তনিমা বলল, তোর তো বাস ছাড়ার সময় বাকি এখনও। বরং আমি আগে বেরোই। আমাকে কেউ নিতে আসবে না। তোর জন্য তো অনেক সুহৃদ আছে, এসে নিয়ে যাবে।
একটু কেঁপে উঠল সাদিয়া। ‘সুহৃদ’ শব্দটি কাঁপিয়ে দিল ওকে। ‘অনেক’ শব্দটিও খোঁচা দিল। সহজভাবে বলেছে তনিমা। সহজ কথাটা জিলেপির মতো প্যাঁচ বসিয়ে দিয়েছে গলায়। কথা থেমে গেল সাদিয়ার। চুপ হয়ে গেল।

হঠাৎ চুপ হয়ে যেতে দেখেও টনক নড়ল না তনিমার। সাদিয়াকে জড়িয়ে ধরে ঈদ মোবারক জানাল। কিছুটা পাথরের মতো রেসপন্স করেছে সাদিয়া। কোল্ড রেসপন্সটা টের পেয়ে গেল তনিমা। তবে কি কথার কথায় সাদিয়া নিমন্ত্রণ করেছিল ওকে? মন থেকে করেনি? নাকি, প্রপোজাল রিফিউজ হয়েছে দেখে এমন শীতল হয়ে গেল সে? বুঝতে পারল না তনিমা। সাদিয়ার কথাটা আবার কানে ভেসে এল, ‘না, থাক। আমার সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না। নিমার কাছেই যা। বাড়িতে অশান্তি হলেও বাড়িতে যাওয়াটাই ঠিক হবে তোর।’

এটা কি সাদিয়ার আসল উপলব্ধি, নাকি অভিমানের কথা, বুঝতে পারল না তনিমা। রুমমেট হিসেবে যে আন্তরিকতা ছিল বা আছে, গত দুমাসে সেটার ঘাটতি দেখেছে তনিমা। সেই হিসেবে তাকে নিমন্ত্রণ জানানোর কথা না। তবু কেন যেতে বলল ওদের বাড়িতে? আবার কেন চুপ হয়ে গেল? ভাবতে ভাবতে হল থেকে বেরিয়ে এল তনিমা।

দুই.

হল থেকে জনস্রোতের মতো ছাত্রীরা বেরিয়ে আসছে, সবার চোখেমুখে বাড়িতে যাওয়ার আনন্দ। হলের বাইরের গেটে অপেক্ষমাণ নিকটজনেরা গাড়িতে উঠিয়ে নিচ্ছে অনেককে। বাইরে এসে হতভম্ব হয়ে গেল তনিমা। আশপাশে একটা রিকশাও নেই। অথচ হলের গেটে লেগে থাকে রিকশাজট। লম্বা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। হাতের ব্যাগটা বড় নয়। তবু এতটুকু পথ পাড়ি দেওয়া কম কথা না। ও এদিক-ওদিক তাকাল। ছাত্রীদের পুরুষ-স্বজনেরা গেটের বাইরে জটলা করে আছে। কারোর কানে সেলফোন, কথা বলছে ভেতরে থাকা ছাত্রীর সঙ্গে। নিজের অবস্থান কোথায় তা বুঝিয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে চোখ গেল ডানে। রাস্তার পাশে বড় শিশুগাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে এক চেনামুখ।

চমকে উঠল তনিমা। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে জুয়েল। মুঠোফোনে কথা বলছে গাছের গুঁড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে। হলের গেটে কার জন্য অপেক্ষা করছে জুয়েল? সে ছাড়া আর কে আছে তার প্রিয়জন? কখনও তো বলেনি? তবে কি ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল? কই, তাকে তো কল করেনি! নিজের সেট এনগেজড নয়, ভাবতে গিয়ে সেলফোনের দিকে তাকাল একবার। আবার তাকাল জুয়েলের দিকে।

এখনও কথা বলছে জুয়েল। কিছুটা সরে গিয়ে আড়াল থেকে জুয়েলকে অবজার্ভ করতে লাগল তনিমা। জুয়েলের কথা শেষ হয়েছে দেখে নিজেই কল করল ওকে। রিং হচ্ছে, ধরছে না জুয়েল। অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর মনিটরে ভেসে উঠল ‘নো আনসার’।

কল ধরল না কেন জুয়েল? দূর থেকে তনিমা স্পষ্ট দেখল, মনিটরের দিকে তাকিয়েছিল জুয়েল। কল না ধরে তাকিয়েই ছিল কেবল। আবার কল করল। আবারও ভেসে উঠল ‘নো আনসার’। আবারও কল করল। এবার কল অ্যাটেন্ড করেছে জুয়েল। তনিমা প্রশ্ন করল, কোথায় তুমি? নারায়ণগঞ্জের পথে আমি।

ঠাস্ করে একটা চড় খেল তনিমা। এমন নির্মম মিথ্যা বলতে পারল জুয়েল? স্তব্ধ হয়ে গেল ও।
জুয়েল প্রশ্ন করল, রওনা হয়েছ? কোথায় তুমি? বাড়িতে পৌঁছেছ?

কখন রওনা হব, তোমাকে বলিনি তো? রওনা হওয়ার প্রশ্ন এল কেন? বাড়িতে পৌঁছানোর খবর নিচ্ছ কেন? তনিমার কথা শুনে কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেল জুয়েল। জবাব দিতে পারছে না প্রশ্নের। নিজেকে সামলে নিল তনিমা। ওর হলের গেটে কার জন্য অপেক্ষা করছে জুয়েল, দেখার কৌতূহল জাগল মনে। নিজেকে আড়ালে রেখে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেট এখনও ধরা আছে কানের কাছে।

জুয়েল বলল, পথে আমি। বাড়িতে পৌঁছে কল করব তোমাকে। এখন রাখি।

ঠাণ্ডা গলায় তনিমা বলল, রাখো। লাইন কাটার সঙ্গে সঙ্গে উদগ্রীব হয়ে হলের গেটের দিকে একবার তাকাল জুয়েল। আবার তাকাল সেলফোনের দিকে। বাটন টিপে সেটটা ধরল কানের কাছে। অর্থাৎ কাউকে কল করেছে সে, বুঝতে পারল তনিমা। কেউ নিশ্চয় আছে ভেতরে, ওর চেয়ে কাছের, ওর চেয়েও আপন! কে সে?

দেখা ও জানার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল তনিমা। ছাত্রীরা বেরিয়ে যে যার মতো মিশে যাচ্ছে জনস্রোতে। এক হলে এত ছাত্রী থাকে! সাধারণত একই সময়ে সবাই বেরোয় না। জরুরি কারণে হল ভ্যাকেন্ট করার নির্দেশ এলে, খালি হয়ে যায় হল এভাবে। তখন থাকে উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠা। উদ্বেগের সময় খেয়াল করে দেখা হয় না হল খালি হওয়ার দৃশ্য। অন্য ছুটিছাটাতেও কখনও দাঁড়িয়ে এভাবে দেখার সুযোগ হয়নি হলের গেট। জমজমাট একটা হল শূন্য হয়ে যাচ্ছে। এ শূন্যতার মধ্যেও থাকে এক ধরনের পূর্ণতা। সেই পূর্ণতা হচ্ছে হলে থাকার অনুভব, হল থেকে বাড়িতে যাওয়ার আনন্দ, আবার বাড়ি থেকে হলে ফেরার তাগিদ। মনে আনন্দ নেই এখন। মনে আছে বিস্ময়। মিথ্যা বলছে জুয়েল! কার জন্য? দেখার নেশায় অপেক্ষা করতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল তনিমা।

তিন.

সেলফোনে রিংটোন হচ্ছে। সাদিয়ার কল।
কল অ্যাটেন্ড করার সঙ্গে সঙ্গে সাদিয়া বলল, কত দূর তুই?
কিছুক্ষণ আগে হল থেকে বেরিয়েছে, কত দূর যেতে পারে ও। এখনও তো হলের গেটে। ভুলে গেল গেটে অবস্থানের কথা। কিছু না ভেবেই ঘোরলাগা সময়ের তলদেশ থেকে বলল, অনেক দূর…।
অনেক দূর কী? বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছেছিস?

তনিমা বলল, বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছা কি এত সহজ? এটা ঢাকা শহর না? ঢাকার যানজট, মানবজট পেরিয়ে কি সহজে পৌঁছানো যায় লক্ষ্যস্থলে? শিগগিরই পৌঁছে যাব। ভাবিস না। বলেই লাইন কেটে দিল ও। মনে হতে লাগল, এসব জটের পাশাপাশি মানবিক জট আর মূল্যবোধের জটও প্রকট। অবিশ্বাসের পাহাড়সমান চাপ সব জটের কষ্ট ম্লান করে দেয়, তুচ্ছ করে দেয় নিজেকে।

স্তম্ভিত, হতভম্ব সময় কাটাতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তনিমার। সেলফোন কানের কাছে ধরে উদ্বিগ্ন চোখে গেটের দিকে তাকিয়েছিল জুয়েল। হঠাৎ মুখে হাসি ফোটে তার। গেটের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। ওর এগিয়ে যাওয়া দেখে তনিমাও তাকাল গেটের দিকে। হাসিমুখে বেরিয়ে আসছে সাদিয়া। সাদিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জুয়েল। এগিয়ে গিয়ে সাদিয়ার হাত থেকে বড় ব্যাগটা তুলে নিল নিজের হাতে। আনন্দজোয়ার দুজনের চোখেমুখে।

কী দেখল তনিমা!

বুলেট এসে আঘাত হানল বুকে। বুক থেকে রক্ত ঝরে পড়ল না। কোনও ইনজুরি নেই বাইরে। রক্তক্ষরণ নেই। ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে, গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। টের পাচ্ছে তনিমা, ভেঙে যাচ্ছে ও। শিশুগাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে খোলা আকাশ। আকাশে কি বাতাস নেই! শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন! বাতাসের অক্সিজেন কি নিঃশেষ হয়ে গেছে! অক্সিজেন ছাড়া কি বাঁচা যায় না! ও তো বেঁচে আছে! বেঁচে আছে কীভাবে! কেন থেমে যাচ্ছে না বুকের স্পন্দন! দিগন্তজোড়া ছিল চনমনে রোদ। আকাশে ভাসছিল পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ। ঝলমলে আকাশে হঠাৎ ভেসে এল উড়াল মেঘের ঢেউ। রোদের আড়ালে লুকিয়ে ছিল মেঘ! কোথায় ছিল মেঘের ঢেউ? মেঘ ফেটে ঝরছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এই রোদ! এই বৃষ্টি! দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ছোঁয়া নিচ্ছে তনিমা। সবাই ছুটোছুটি করছে আশ্রয়ের আশায়। সেদিকে খেয়াল নেই ওর। আরও বেড়ে গেছে বুকের স্পন্দন। স্পন্দনের ভেতর থেকে ভেসে উঠল শৈশবের এক স্মৃতি: তখন মাত্র দশ বছর বয়স ওর। শখ হয়েছিল দুর্গাপূজা দেখার। পূজা দেখতে গিয়েছিল ব্রহ্মপুত্র নদীর পূর্ব পাড়ে। শরতের শুভ্র আকাশের বিশাল মাঠজুড়ে ছিল কাশবন। সাদা কাশবনের পাশ দিয়ে যেতে হতো পূজামণ্ডপে। আকাশে তখন ভাসছিল শারদীয় মেঘ। দুর্গাপূজার সঙ্গে সাদা কাশের রয়েছে গোপন সম্পর্ক, গোপন আত্মীয়তা। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, কাশফুলকে সঙ্গী করে আসে দুর্গাপূজা। মা-দুর্গাকে অবনত ভঙ্গিতে শ্রদ্ধা জানায় কাশফুল। দুর্গাপূজা দেখে ফিরছিল তনিমা। সঙ্গে ছিল পাশের বাড়ির পাড়াতো ভাই চন্দন। কিশোর চন্দন বলেছিল, দেখ! কী সুন্দর কাশফুল! বাতাসের তালে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে আমাদের! সালাম জানাচ্ছে। অবুঝ তনিমা বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করেছিল, আমাদের সালাম জানাচ্ছে?

হুঁম, আমাদের সালাম জানাচ্ছে। ঢুকবি ভেতরে।
তনিমা বলেছিল, ভয় করছে। ভেতরে যাব না।

ভয়ের কিছু নেই! আমি আছি না। বলেই হাত ধরে কাশের ডাঁটা সরিয়ে তনিমাকে নিয়ে ঢুকে গিয়েছিল ভেতরে। কাশের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিল দুজন। ফুল তাদের মাথা ছাড়িয়ে আরও ওপরে। কাশের ডাঁটা টেনে নিচে নামিয়ে মুখে ফুলের ছোঁয়া লাগিয়ে চন্দন বলেছিল, মজা না!

ভীত গলায় তনিমা জবাব দিয়েছিল, হুঁ, মজা। তারপর চন্দন যা করেছিল, ভাবতে গিয়েই শিউরে ওঠে তনিমা। জীবনে প্রথম পোড় খেয়েছিল ওই দিনই। শরতের প্রথম মাসটি শেষ। আশ্বিনের শেষ পর্যায় এখন। শরতের বৃষ্টি মনে করিয়ে দিল সেই দিনের কথা। ওই দিনও বৃষ্টি এসেছিল হঠাৎ। বৃষ্টিতে ওই দিন চন্দন খুলেছিল তার গোপন সিন্দুকের তালা। এখন দাঁড়িয়ে আছে হলের সামনে। ঝিরঝিরে বৃষ্টির ছাটে ভিজছে শরীর। জুয়েলের বিশ্বাসঘাতকতার পোড় পুরনো দিনের ক্ষতের চেয়েও ভয়ংকর। এত কৌশলে এমন মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে মানুষ! দীর্ঘ তিন বছরের সম্পর্ক জুয়েলের সঙ্গে। অথচ গোপনে সে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে রুমমেট সাদিয়ার সঙ্গে! সাদিয়া তো সব জানত। জুয়েলের সঙ্গে মেলামেশার গোপন সাক্ষী সে। অথচ সেই সাদিয়াই এমন কাজটা করতে পারল? কে দায়ী? সাদিয়া, না জুয়েল? হ্যাঁ, সাদিয়া তার চেয়েও সুন্দরী। ভালো পরিবারের মেয়ে। হোক তবু জেনেশুনে গাঁট বাঁধতে পারে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর ফিয়ান্সের সঙ্গে!

হায়! কোথায় শুভ্রতা? তনিমার মনে হলো, কাশবনের শুভ্র ফুলের আড়াল থেকে ও ছুটছে, যেমন করে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল চন্দনের হাত থেকে, তেমনি করে বেরিয়ে যাবে জুয়েলের পাতানো ফাঁদ থেকে। ভালোবাসার নাম করে, বিয়ের প্রপোজাল দিয়ে ইতোমধ্যেই সব গোপন ঐশ্বর্য কেড়ে নিয়েছে জুয়েল! তবে কি ও উচ্ছিষ্ট হয়ে গেল! ফেলনা হয়ে গেল! নষ্ট হয়ে গেল!

ভাবতে ভাবতে কান গরম হয়ে গেছে। ঝাঁ ঝাঁ করছে মাথা। জল নেই চোখে। চোখ থেকে বেরোচ্ছে আগুন।

আগুনের তাপে ঝলসে বেরোচ্ছে মনের ক্রোধ। নিজেকে পরাজিত ভাবতে চায় না ও। বিট্রেয়ারের কারণে কেন পরাজিত ভাববে নিজেকে? জোরালো প্রশ্নটা ঢুকে গেল অন্তর্জগতে। নাড়া দিল ওকে। তেজস্বী অভিঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে নতুনভাবে জেগে উঠল তনিমা। নতুন তনিমার ভেতরের জগৎ স্মরণ করিয়ে দেয়, লাইফ ইজ নট অ্যা বেড অব রোজেস। জীবন পুষ্পশয্যা নয়। কাঁটার ঘা খেতে হবে, তাজা রক্ত ঝরবে চলার পথে। রক্ত দেখে থেমে থাকলে চলবে না, মাথা উঁচিয়ে চলতে হবে, এগোতে হবে সামনে।
মনে চোট খেলেও নতুন উদ্যম জেগে উঠল মনে। হাঁটতে লাগল সামনে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল অনেক দূরে। খালি রিকশা পেয়ে বলল, যাবেন, রিকশা ভাই?

কই যাবেন আফা?
গুলিস্তান, যাবেন?
না, আফা। সম্ভব না যাওয়া। অনেক ঘুরেটুরে যাওন লাগব।
ঘুরেঘুরেই যাবেন। সম্ভব না কেন?
ভাড়া বেশি দেওন লাগব আফা।
ওহ, এই কথা! এজন্যই সম্ভব না?
হ, আফা। কী কমু। বেবাকই তো বুঝলেন।
তো, কত টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে?
বাড়ায়া দিয়েন খুশিমতো। বাড়ায়া দিলেই হইব। তো, বিশ টেহার কমে দিয়েন না বাড়তি ভাড়া।
কেন? বিশ টাকা বেশি নেবেন কেন?
ওই যে কইলাম, ঘুইরাটুইরা যাওন লাগব।
অন্যদিন হলে খেপে যেত তনিমা। প্রতিবাদ করত। আজ রাগ এল না। কিছুক্ষণ আগে মনে চোট খেয়েছে।
ভয়ংকর ঘা খেয়েছে। সেই তুলনায় রিকশাঅলার দাবি তো তুচ্ছ। বড় আঘাতের তলে চাপা পড়ে গেল তুচ্ছ সমস্যা। রিকশায় উঠে বসল তনিমা।

চলতে শুরু করেছে রিকশা। প্যাডেল ঘোরাচ্ছে তরুণ চালক। উড়ে যাচ্ছে রিকশাটা। যানজটের শহর ঢাকায় এভাবে উড়ে যাওয়া যাচ্ছে কেন? এ পাশের রাস্তা প্রায় পুরোটা ফাঁকা। ভালো মনে হচ্ছে না সংকেতটা, সামনে নিশ্চয় বিপদ। হয় অবরোধ অথবা ভিআইপির আগমনের কারণে রাস্তা বন্ধ আছে। বিপদ কাঁধে নিয়েই ছুটছে চালক। না, অবরোধ নেই, ভিআইপি জটিলতা নেই। রাস্তার মাঝে মুখোমুখি সংঘর্ষ বেধেছে এক মাইক্রোবাস ও এক বাসের। মাইক্রোটা দুমড়েমুচড়ে গেছে। কখন ঘটেছে অ্যাকসিডেন্ট? এখনও পরিষ্কার করা হয়নি রাস্তা। রক্ত ঝরেছে রাস্তায়। রক্তের রং লাল নেই এখন। কিছুটা কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। গাড়ি সরানো হয়নি কেন? পুলিশ কি খবর পায়নি? আশপাশে পথচারীরা কৌতূহল মেটাচ্ছে। দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গাড়ি দুটো দেখছে। রক্তের দাগ দেখে ইশ্ শব্দ করে কপালে তুলে রেখেছে ভাঁজ। খুব কাছে গিয়ে রক্তের দাগ দেখল তনিমা। রক্তের দাগ তাকে ব্যথিত করল না। নামতে হয়েছে রিকশা থেকে, বিরক্ত হয়নি। নিজের মনের ভেতর চলছে দাবানল, সেই আগুনের দহনের কারণে অ্যাকসিডেন্টের বীভৎসতা দাগ কাটছে না মনে। অভিব্যক্তিহীন তনিমা রিকশাচালককে প্রশ্ন করল, ফুটপাতের ওপর দিয়ে টেনে রিকশাটা কি ওপারে নিতে পারবেন? নইলে তো অনেক হাঁটতে হবে।

রিকশাচালক বলল, হ আফা, দেহি। তবে কষ্ট অইব, ভাড়া বাড়ায়া দিয়েন।
ভাড়া ছাড়া কি আপনার মুখে আর কোনও কথা নাই?
থাকব না কেন আফা, আছে। তয় পেটের ধান্দায় ভাড়া ছাড়া অন্য কথা মনে আহে না। আফনা গো তো পেটের ধান্দা নাই। পেটের খবর রাখার দরকার না থাকলেও মনের খবর রাখতে হবে। পেটের জ্বালার চেয়ে মনের জ্বালা অনেক বড়, জানবে কীভাবে রিকশাঅলা।

ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল পেছন থেকে আরও কয়েকটি রিকশা এগিয়ে আসছে। একটা রিকশায় বসে আছে জুয়েল ও সাদিয়া। ওদের চোখ দুমড়ানো গাড়ি দুটির ওপর। ওরা খেয়াল করছে না ওকে। আর একবারও পেছনে তাকাল না তনিমা। ফুটপাতের ওপরই রিকশায় চেপে বসে। রিকশাঅলাকে বলল, চলুন। ভাড়া বাড়িয়ে দেব।
আপনার কষ্টের চেয়েও আমার কষ্ট অনেক বেশি। মনে মনে বলল, পাহাড়সমান কষ্ট বুকে নিয়ে যাচ্ছি আমি।
আপনি তো কেবল দৈহিক শ্রম দিচ্ছেন। মনের কষ্টের দহন কীভাবে বুঝবেন আপনি!

চার.

দোতলা বাড়ির পেছনে আছে বড় পুকুর। পুকুরের পাড়ে সবজির চাষ করা হয়েছে। ছাতিনি বেয়ে উঠে গেছে লাউগাছ। বড় বড় লাউ ঝুলে আছে ছাতিনির নিচের দিকে। পুকুরের পাড়ে আছে নানা জাতের গাছ, ঝোপঝাড়।

পুকুরের পূর্বপাড় থেকে শুরু করে যত দূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে রয়েছে ধানখেত, সবুজের সমুদ্র। কচি ধানগাছ ঘন সবুজ রং গায়ে মেখে বাতাসের দোলায় ঢেউ তুলছে মাঠে। অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্যটিতে চোখ গেঁথে গেল তনিমার। এ দৃশ নতুন নয়। গ্রামে বড় হয়েছে ও। বাড়িতে পাকা বিল্ডিং থাকলেও চারপাশজুড়ে গ্রামীণ পরিবেশ, আর হু হু বাতাসের স্রোত নতুন করে টানে তনিমাকে। বুক ভরে নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে পেরে ও কিছুটা স্বস্তি পেল। বড় বোনকে কাছে পেয়ে উল্লসিত নিমা বড়শি নিয়ে বসেছে বাড়ির পেছনের পুকুরে, কিশোরী নিমার মাছ ধরা দেখছে বড় বোন তনিমা। এইমাত্র একটা বেলে মাছ গেঁথেছে বড়শিতে। উল্লসিত নিমার মধ্যে আনন্দজোয়ার আসে। পুকুরের পাড় থেকে চিৎকার করে বলল, আপু, নিচে এস! দেখো, কত বড় বাইল্যা!

টোপ খেতে গিয়ে বড় সাইজের বেলেটি গেঁথে গেছে বড়শিতে। জ্যান্ত মাছটা এখন শূন্যে ধড়ফড়াচ্ছে।
উল্লাস করছে নিমা। তনিমার মন খুশি হলো না। আনন্দে শরিক হতে পারল না, খারাপ হয়ে গেল তার মন।
নিজেকেও মনে হচ্ছে বড়শিগাঁথা মাছ। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে জুয়েল বহুবার নিয়ে গিয়েছিল ওদের হলে।
নিজেকেও মনে হচ্ছে জুয়েলের পাতানো বড়শিতে গেঁথে যাওয়া মাছের মতো; ধড়ফড়াচ্ছে, ছটফট করছে ও।
তনিমা চিৎকার করে বলল, মাছটা ছেড়ে দাও পুকুরে।
আরও জোরে চিৎকার দিয়ে নিমা বলল, না, ছাড়ব না। তোমাকে খাওয়াব। নিজ হাতে ভাজা করব টাটকা মাছ। ভাজা মাছ খেতে ভীষণ মজা, আপু!
দ্রিম করে একটা বুলেট এসে বিঁধে গেল নিজের বুকে। জুয়েল হলে নিয়ে ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছে ওকে।
কী এক অমোঘ টানে গেছে ছুটে। সাধ পূরণ করে জুয়েল বলত, আহ্! ভীষণ মজা তোমাকে খেতে!
টনটন করে উঠল মাথা। হু হু বাতাসের মধ্যেও ঘেমে উঠল কপাল। মাছটার দিকে তাকাতে পারল না ও। চোখ গেল পুকুরপাড়ের ঝোপঝাড়ের দিকে। অনেকগুলো পাখি দেখা যাচ্ছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে অভ্যস্ত তনিমার চোখ গেল ভিন্ন রকম একটা পাখির ওপর। আকারে শালিকের মতো দেখতে পাখিটার নাম যেন কী? মনে করতে পারছে না। গাঢ় হলুদ শরীর ও মাথা, গলা লেজ ও পাখার কিছু অংশ ঘন কালো, ঠোঁট লাল।

চঞ্চল প্রকৃতির পাখিটার নাম বেনেবউ, হঠাৎ মনে পড়ে গেল নামটা। মিষ্টি করে ডাকে বউ। হঠাৎ সচল হয়ে উঠল বেনেবউটি, চট করে ঠোঁট দিয়ে লুফে নিল একটা পোকা। তারপর উড়ে গিয়ে ঢুকে গেল ডালে ঝুলন্ত গোলাকার বাসায়। গাছের ছাল ও নানা রকম শুকনো ঘাস দিয়ে বানানো ছোট্ট বাসাটার দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে প্রশ্ন এল, বাসায় কি পাখির ছানা আছে?

না, নেই। আর একটা বেনেবউয়ের মাথা দেখা যাচ্ছে। এটা পুরুষ বেনেবউ। পুরুষ বেনেবউটা উড়ে এসে বসল আরেকটা ডালে, ক্ষিপ্র গতিতে ঠোঁটে গেঁথে নিল একটা পতঙ্গ। দুম করে আবার একটা বুলেট এসে গেঁথে গেল চোখে। মনে হলো জুয়েল নামক শিকারি পুরুষ এভাবে কীটপতঙ্গের মতো ঠুকরে ধরেছে ওকে। পুকুরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয় ও। যেদিকে তাকায় সেদিকেই কেবল জুয়েলের স্মৃতি ভেসে ওঠে! জুয়েলের নির্মম আচরণের সাদৃশ্য দেখতে পায় সবখানে। কেন কষ্ট বাড়ে, আনন্দ খুঁজে পায় না কেন, নিমার আনন্দে ও কেন অংশ নিতে পারছে না!

বাসার ভেতর ঢুকে দেখল ছোট ফুপি, কুলসুম বানু এসেছেন ওকে দেখতে। ফুপি উল্লসিত। বুকে জড়িয়ে ধরে তনিমাকে বললেন, কবে পড়া শেষ হবে তোমার? এখনও শেষ হচ্ছে না কেন পড়াশোনা?
ফুপির আদর পেয়ে কিছুটা নরম হলো মন। শান্ত হয়ে হাসিমুখে তনিমা বলল, আপনি বুঝবেন না ফুপি,
সেশনজটে আটকে আছি। কবে যে শেষ হবে পড়াশোনা, নিজেও জানি না।
সেকি রে! বিয়ে করবি না? আইবুড়ো হয়ে গেলে তো মুখের লাবণ্য কমে যাবে। মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়া ভালো। নইলে ভালো বর পাওয়া যায় না। হাসতে হাসতেই আরও বললেন, বুড়ো বর জুটবে কপালে।

তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেল।

ফুপির কথায় কোনও শ্লেষ নেই, খোঁচা নেই। কথায় কথায় মনের কথাটা বলেছেন তিনি। এ কথার মধ্যে আছে গ্রামীণ দৃষ্টিভঙ্গি, আছে নিজেদের মেয়ের মঙ্গল কামনা। তবু কথাটা মেনে নিতে পারেননি সামনে দাঁড়ানো জরিনা বেগম, তনিমার মা।

চট করে তিনি ননদকে বললেন, কী বলছ তুমি? বুড়ো জামাই জুটবে কেন? মেয়ে শিক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষিত ছেলে, প্রতিষ্ঠিত জামাই দেখে বিয়ে দেব আমরা। তনিমা কি নিজেই বিয়ে করবে নাকি? ওকে নিজে নিজে বিয় করার কুমন্ত্রণা দিচ্ছ নাকি? কিছুটা রেগেই বললেন জরিনা বেগম।

পাশের ঘরে ছিলেন মুশফিক আহমেদ, তনিমার বাবা। স্ত্রীর কথা শুনেছেন তিনি। নিজের বোনকে ধমকে কথা বলছে শুনে বেরিয়ে এসে উত্তেজিত গলায় বললেন, কুলসুমকে ধমকাচ্ছ কেন? ও কি নিজের ভাইজিকে কুমন্ত্রণা দিতে পারে?
তুমি চুপ করো। ধমকে ওঠেন জরিনা বেগম।
চুপ করব কেন? আমার বোনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে, আর চুপ করে থাকব আমি? তোমার আচরণের জন্যই তো ওরা এ বাড়িতে আসা কমিয়ে দিয়েছে। তুমি কি চাও না, ওরা আসুক এ বাড়িতে?
কী কথার মধ্যে কী বিষয় ঢোকাচ্ছ? আবারও তেড়ে ওঠেন জরিনা বেগম।
তুমি যা বোঝাতে চেয়েছ, তা-ই বলছি। নতুন কিছু ঢোকাচ্ছি না।
জরিনার হাতে ছিল ঝাড়ু। ঘর ঝাড় দিচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ রেগে উঠে ঝাড়ুটা ছুড়ে দেন দরজার বাইরে।
হনহন করে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। স্তব্ধ হয়ে গেছে তনিমা।
স্তব্ধ হয়ে গেছেন কুলসুম বানু।
মুশফিক আহম্মেদও গটগট করে ঢুকে গেলেন নিজের ঘরে।

পাঁচ.

ঈদের ছুটি শেষ। ঢাকায় যেতে ইচ্ছা করছে না, আবার থাকতেও পারছে না বাড়িতে। পরিবেশ ভালো না বাড়ির।
পড়শিরা ওর বিয়ে নিয়ে নানা কটু কথা বলে। তখন খারাপ হয়ে যায় মায়ের মন। খারাপ হয় ওর মনও। এ গুমোট আবহাওয়ায় বেশি দিন থাকলে বিপর্যস্ত হয়ে যাবে ও। গ্রামে ষোলো বছরের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায় সব মেয়ের।
কেউ আঠারো পেরোতে পারে না। অথচ আঠারো বছর দেখিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি হয় মেয়েদের। বাল্যবিবাহ রোধ করার কোনও উদ্যোগ নেই। যারা পড়াশোনা করতে চায়, তাদের কপালেও জোটে দুর্ভোগ। নানা কথার বাণে আক্রান্ত হয় পরিবার।

হল খোলার দিনই ঢাকায় ফিরে এসেছে তনিমা। নিমার জন্য মন খারাপ হয়। শঙ্কিত মনে ভাবে, না জানি কী ঘটে নিমার জীবনে! যা হবার হবে। কী ঘটে, ভবিষ্যতে দেখা যাবে। বর্তমানের বড় কাজ হচ্ছে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সব ব্যর্থতার জবাব দেওয়া। প্রত্যয় নিয়ে হলে ফিরে দেখে, ফিরে এসেছে সাদিয়াও। সাধারণত দেরি করে ফেরে সাদিয়া। প্রতিবার তনিমাই আসে সবার আগে। এসে রুম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখে। এবার কাজটা করে রেখেছে সাদিয়া।

রুমে ঢুকে স্তব্ধ হয়ে গেল তনিমা।
তনিমাকে দেখে ছুটে সাদিয়া ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। উল্লাসের ঘাটতি নেই। সাদিয়ার আগের আচরণের কোনও পরিবর্তন নেই এ মুহূর্তে।
এমন দুর্ধর্ষ হতে পারে মানুষ!
এমন ক্রিমিনাল হতে পারে!
ভেতরে ভেতরে সবকিছু লুটে নিয়ে এমন সহজ স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে কেউ! বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে তনিমা প্রশ্ন করল, কখন এলি?
সকালেই চলে এসেছি।
ওহ! এত তাড়াতাড়ি এলি যে?
বাসায় মন টিকছিল না। তাই তাড়াতাড়িই এলাম।
বিশেষ কোনও কারণ আছে তাড়াতাড়ি আসার?
প্রশ্ন শুনে থতোমতো খেয়ে সাদিয়া বলল, বিশেষ কী কারণ থাকবে?
কারণ থাকতে পারে না? কত কিছু ঘটতে পারে জীবনে। নতুন কিছু ঘটেছে মনে হচ্ছে তোর জীবনে!
হ্যাঁ। ঘটেছে।
কী? কী ঘটেছে? কিছুই জানে না, বোঝেনি এমন ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল তনিমা।
যা ঘটেছে, তোকে বলা যাবে না।
কেন? বলা যাবে না কেন? আমার জীবনের সব ঘটনার সাক্ষী তো তুই। তোর ঘটনার সাক্ষী বানাবি না আমাকে?
একটা অপরাধ করে ফেলেছি। বলতে পারব না তোকে। জিগ্যেস করিস না তুই। আই’ম সরি, দোস্ত।
প্রেমে পড়েছিস?
না, প্রেমে পড়া তো অপরাধ নয়।
তো, অপরাধ কী? প্রশ্ন করে চমকে ওঠে তনিমা।
শুনলে ঘৃণা করবি তুই, বলতে চাচ্ছি না তোকে।
ঘৃণা করব আমি তোকে! এমন অপরাধ করেছিস?
হ্যাঁ।
হিসেব মেলাতে পারল না তনিমা। প্রেমে পড়েনি সে জুয়েলের সঙ্গে! অথচ ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার দিন মনে হয়েছিল তারা নতুন জুটি। সাদিয়ার এক্সপ্রেশনে নেই সেই কথা। জানার কৌতূহল তীব্র হতে লাগল।
জোর করে ধরে বলল, কী অপরাধ করেছিস? বলতে হবে তোকে। নইলে কঠিন কষ্ট পাব আমি। টেনশনে থাকব।
যা করেছি, সইতে পারবি না তুই! জানতে চাস নে প্লিজ।
না, জানতে হবেই আমাকে। বল সাদিয়া, নির্ভয়ে বল। সইতে হবে আমাকে।
অনেকক্ষণ ভেবে ইতস্তত করে অপরাধীর মতো সাদিয়া বলল, ছেলেদের হলে গিয়েছিলাম আমি। সেক্স করেছি।
সেক্স করেছিস! সে তো আমিও করেছি। জানিস তুই। নিজেকে অপরাধী ভাবিনি আমি। তুই অপরাধী ভাবছিস কেন?
কারণ, ঢোক গিলে সাদিয়া বলল, যার সঙ্গে সেক্স করেছি, আমার বয়ফ্রেন্ড নয় সে। তুই তো তোর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে করেছিস। অপরাধবোধ নেই তোর মধ্যে। আমি করেছি নিজের তীব্র কৌতূহলের কারণে।
ফোনে কথার ফাঁকে একদিন ছেলেটি জেনে যায় আমার গোপন সেনসেশনের কথা। সে প্রশ্ন করেছিল, ‘স্বাদ নেবে?’ উত্তরে বলেছিলাম ‘নেব।’ গোপন এক দানব কাজ করেছিল আমার দেহে, ছেলেটি হলে নিয়ে গেল আমাকে। ঘটে গেল সব। বিশ্বাস কর, ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটা ঘটাইনি আমি।
ছেলেটিকে তুই ভালোবাসিস না?
তখন বাসতাম না, এখন বোধ হয় একটু একটু করে ভালো লাগছে তাকে।
তোকে ভালোবাসে ছেলেটি?
জানি না, তবে আমাকে আরও পেতে চায়, প্রতিদিন চায়। এ চাওয়া, ভালোবাসা কি না জানি না আমি।
তুই কি চাস তাকে? হান্ড্রেড পার্সেন্ট পেতে চাস?
জানি না।
ভালো করে ভেবে দেখ। শিওর হয়ে জানা আমাকে। পেতে চাইলে ব্যবস্থা করে দেব আমি।
কীভাবে ব্যবস্থা করবি?
কারণ, ছেলেটিকে চিনি আমি। তুইও জানিস সে কথা।
হতবাক হয়ে গেল সাদিয়া। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ কেঁদে উঠে বলল, দোস্ত, আমি বিট্রেয়ার, শাস্তি দে আমাকে তুই।
তনিমা হাসল। হাসির ভেতর দাবিয়ে দিল মনের কষ্ট। অস্বাভাবিক উল্লসিত হাসিতে ফেটে পড়ে কিছুক্ষণ পরই শান্ত হয়ে গেল। শান্ত গলায় বলল, ঈদে একটা উপহার দিতে চেয়েছিলাম, জুয়েলকেই উপহার হিসেবে দিয়ে দিলাম তোকে। খুশি? কান্না থেমে গেল সাদিয়ার।
বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল, দিতে পারবি? ঘৃণা করবি না আমাকে?
অত্যধিক শীতল গলায় তনিমা বলল, অবশ্যই দিতে পারব। দিয়ে দিলাম তোকে।
মনে মনে বলল, একটা বিট্রেয়ারের মুখোশ খুলে দিয়েছিস তুই। সেই সঙ্গে খুলে দিয়েছিস আমারও চোখ।

বুঝতে পারছি, বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কোনওমতেই যাওয়া উচিত হয়নি ছাত্রদের হলে। উচিত ছিল নিজেকে শক্ত রাখা, পারিনি। কালো পর্দার আড়াল থেকে দেখছি আমি, নতুন রোদ দেখছি। এ রোদে ধুয়ে নেব আমাকে, জেগে উঠব নতুন করে। বিট্রেয়ারের জন্য আবার দুঃখ কী! আমাকে বড় হতে হবে আমার জন্য, বড় হতে হবে তনিমার জন্য, পরিবারের গ্লানি মুছে দেওয়ার জন্য বড় হতে হবে। ভাবতে ভাবতে সাদিয়াকে জড়িয়ে ধরে, ঘৃণায় না ভালোবাসায়, জানে না ও। হু হু করে কাঁদতে থাকে দুই বান্ধবী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *