ছোটগল্প।। পুরুষ।। জাকির তালুকদার

পুরুষ

[বাসররাতে কমল সওদাগর তার নয়াবিবি কুলসুমরে চারখান শর্ত দিয়া পরের ভোর বিহানে রওনা দিল বাণিজ্যযাত্রায়। মৈমনসিংহ গীতিকা খুইলা দেখেন পরের বিবরণ। কমল সওদাগর পরীক্ষা লয় বিবি কুলসুমের। তার বিবি কুলসুম যদি সত্যিকারের সতীলক্ষ্মী হয়, তাইলে এই চার কঠিন শর্ত পূরণ কইরা অর্জন করবো পতির সোহাগ। এক শর্ত, দুই শর্ত, তিন শর্ত পূরণ করার পরে চার নম্বর শর্ত লইয়া কুলসুম পরে বিষম ফাঁপড়ে। সতী থাইকা পুতের জনম ক্যামনে দেওন যায়?
বিবি কুলসুম তখন বুদ্ধি পাকায়। বেশ্যার ভেক ধইরা যাত্রা করে দিলালপুর বাজারে। সেই গঞ্জে কমল সওদাগরের কুঠি। মাগিপাড়াত ঘর নিল কুলসুম। গোটা গঞ্জে হৈ হৈ। এমন রূপসী ছিনাল আগে তো আসেনি কুনোদিন। গোটা গঞ্জ ভাইঙ্গা পড়ে কুলসুমের দুয়ারে। কিন্তু কাউরে ঘরে নেয় না কুলসুম। দাসি তার দুয়ার থাইকা বিদায় করে শেঠ-সওদাগর-জমিন্দার খইদ্দারগুলানরে। মুখে এক রা— যারে-তারে খইদ্দার হিসাবে লইতে নারাজ তার মালকিন।
এক রাইত কাটে, দুই রাইত কাটে, তিন রাইত কাটে…। অবশেষে এক রাইতে নইড়া উঠে কড়া। কুলসুম দাসিরে কয়— শিগগির দুয়ার খুইলা দ্যাও। আমি চিনবার পারছি এই কড়া ঝাঁকাইবার আওয়াজ।
দুয়ারের পাল্লা হাট কইরা খুইলা যায়, আর ঘরে ঢুকে কমল সওদাগর। আন্ধার ঘরে দেহমিলন। স্বামীর বীজ গর্ভে নিয়া ঘরে ফিইরা চলে পুলকিত হরষিত সতী কুলসুম বিবি।]

কিন্তু আমাদের কুলসুমের আখ্যান এত মধুর নয়।

পালের বাগানের মাঝখানের পদ্মপুকুরে পড়ন্ত দুপুরে রোদ তেমন একটা চমকায় না কোনোদিনই। বাপ-দাদারা বলত পালের বাগান ছিল নাকি প্রায় ছোট-খাট একটা বন। মেছোবাঘ, শেয়াল, দাঁড়াশ, বনবেড়াল ছিল চিরাচরিত অধিবাসী। এখন গাছ কাটতে কাটতে অনেক জায়গা ফোঁপড়ার মতো বেআব্রু। মাঝে মাঝে গাছের ঠাসবুনোট আর মাঝে মাঝে বিরান। উপর থেকে দেখলে মনে হবে উঠতি টাকপড়া মাঝবয়সী যুবকের মাথা। তবে পদ্মপুকুরের চারপাশ এখনো বড়বড় গাছে ঢাকা থাকায় সেখানে খাড়া দুপুর ছাড়া অন্য সময় রোদ পাওয়া দুষ্কর। গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু রোদ পানিতে পড়ে, তা অন্য ঋতুতে তো দূরের কথা, চোত-বোশেখ-জষ্টি মাসেও পানিকে তেমন একটা উম দিতে পারে না। এলাকার ছেলেরা এখনো নিরুপদ্রবে গাঁজা-মদ খাওয়ার জন্য, কিংবা আকালি-মরিয়ম-ডলি-ছবি নামের ভাসমান পতিতাদের নিয়ে রাতে, কখনো কখনো দিনেও স্বচ্ছন্দে বাগানে ঢুকে পড়তে পারে। তাই একলা একটা যুবতীর জন্য পড়ন্ত দুপুরের পাল-বাগানকে মোটেই নিরাপদ বলা চলে না। ভদ্রশোভন তো নয়-ই। কিন্তু একলা কুলসুমকে মোটেই তা নিয়ে ভাবিত বলে মনে হয় না। সে তখন তার দুই হাত চোখের সামনে নিয়ে বিভোর দৃষ্টিতে দেখছে সোনার রং। রোদ ঝলকে পড়ুক আর না পড়ুক, সোনা তো সোনাই। সোনা দেখলে মেয়েদের চোখের মণিতে সোনার যে প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠার কথা, কুলসুমের চোখে সেই মুগ্ধতার চিহ্নমাত্র নেই। আবার বিষাদও নেই। আছে শুধু শূন্যতা। বুকের মধ্যে আকাশ-পাতাল বিস্তারি হাহাকার থাকলেই কেবল মানুষের চোখে এমন শূন্যতা ফুটে উঠতে পারে। তার পায়ের কাছে চার-পাঁচ বছর বয়সের একটা মেয়েশিশুর মৃতদেহ। একেবারে সদ্য। যতখানি সদ্য হলে তাকে তাজা মৃতদেহ বলা চলে। কেননা মাত্র কিছুক্ষণ আগেই কুলসুম তাকে গলা টিপে খুন করেছে। খুন করার পরিশ্রমে-উত্তেজনায়-ভীতিতে তার বুকে যে হাপর চালু হয়েছিল, তা এখনো পুরোপুরি থিতিয়ে এসে সারেনি। সেই উত্তেজনাকে সরিয়ে সোনার উত্তেজনায় মনোনিবেশ করার ইচ্ছাতেই বোধকরি সে সোনার দুলজোড়া চোখের সামনে মেলে ধরে রেখেছে। মেয়েটিকে খুন না করে তার কোনো উপায় ছিল না। একে তো সে কিছুতেই নিজের কানের দুলজোড়া কুলসুমকে খুলে নিতে দিচ্ছিল না, আছাড়ি-পিছাড়ি করছিল নিজের অলংকার রক্ষা করার জন্য, কেড়ে নেবার পরেও কুলসুমের মনে এই ভয় বাসা বেধেছিল যে মেয়েটি নিশ্চিতই বাড়ি ফিরে তার বাপ-মা কিংবা ফুপুকে, যাদের বাড়িতে তারা বেড়াতে এসেছে, বলে দেবে কুলসুম কর্তৃক তার দুলজোড়া ছিনতাই হওয়ার কথা। তাই কুলসুম খুন করেছে বাচ্চা মেয়েটিকে গলা টিপে।
এখন তার কেমন লাগার কথা! যে কুলসুম পাশের বাড়ির চোরা বিড়ালটাকেও কোনোদিন জোরে আঘাত করেনি তার দুপুরের অন্নে মুখ দেবার অপরাধে, যে কোনোদিন নিজের ছোট ভাই-বোনদের গালে-পিঠে থাপ্পড় মারলে পরের চব্বিশ ঘণ্টা অনুশোচনায় কেঁদে ভিজিয়েছে আঁচল, সেই কুলসুম এখন নাম লিখিয়ে ফেলেছে জলজ্যান্ত খুনীর খাতায়। তার এখন মনের অবস্থা কেমন! চেহারা দেখে মনে হয় পুরোপুরি বিকল। এখন কী করতে হবে তা তার মনে আসছে না। লাশটি গুম করতে হবে হয় পুকুরের পাঁকের নিচে পুঁতে, নয়তো জংলাঝাড়ের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে। কিন্তু তার শরীর কোনো কর্মেই অগ্রসর হয় না। সে শুধু চোখের সামনে সোনার দুলজোড়া মেলে ধরে বসে থাকে। এই-ই সেই সোনার দুল! এর জন্যই এত কিছু!
এখনো আরো বাকি। বাপ বিয়ের আসরে ছেলেপক্ষের দাবিতে আবেগে আবেগে বলে ফেলেছিল নাকের-কানের-হাতের-গলার সোনা সে তার বড় মেয়েকে দেবেই দেবে।
দিতে পারেনি। তাই কুলসুম এখন বাপের বাড়িতে। তাই মরিয়া কুলসুম এখন যে কোনো প্রকারে স্বামীর ঘরে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় যা হোক করতে রাজি।
দুলজোড়া চোখের সামনে ধরে সদ্য খুন করে ফেলা লাশটিকে পায়ের কাছে রেখেও অনুশোচনা-ভীতি-বিহ্বলতার পরিবর্তে নিজের মধ্যে নিজে ফিরে আসার মুহূর্তে তার মনে মাত্র একটা চিন্তাই খেলে যায়— কেবল কানেরটা হলো। এখনো নাকের বাকি হাতের বাকি গলার বাকি!
স্বামীর ঘরের জন্য এত উতলা কেন কুলসুম?
এ কী কোনো প্রশ্ন হলো! বিয়ের পর নারীর ঘর মানে স্বামীর ঘর। সেখানে না থেকে কুলসুম থাকবে কোথায়! সেখানে না ফিরে কুলসুম ফিরবে কোথায়! স্বামী থেকেও যার জোটে না স্বামীর ঘরে বাসের ভাগ্য, যে পায় না স্বামীর সোহাগ, যে পারে না স্বামীকে খেদমত করতে, তার জীবনকে কি নারীর জীবন বলে ডাকা যায়? এই সবই হয়তো কুলসুমের জন্য সত্যি। কিন্তু আরো একটি সত্যি আছে কুলসুমের। তা হলো বাপের কথার সম্মান। বাপ তার কথা দিয়েছে। পাকে পড়ে হোক আর বিপাকে পড়ে হোক। সেই ওয়াদা রক্ষার ক্ষমতা যে বাপের নেই তা কুলসুমের চেয়ে ভালো করে আর কে বুঝবে? কুলসুম বোঝে। কিন্তু বাপের সম্মান রাখাটাই এখন তার সবচেয়ে বড় ভেতরের তাগিদ।
শুনে কেউ কেউ হেসেও উঠতে পারে। আব্দুল ওহাবের যে কোনোকালে সম্মান বলতে এলাকায় কিছু ছিল তা কেউ সেভাবে লক্ষ করে দেখতে পায়নি। এলাকার কেউকেটা হতে হলে যা যা থাকতে হয়, তার কোনোটিই আব্দুল ওহাবের আয়ত্তে নেই। শারীরিকভাবে খুব অশক্ত লোকটা নির্বিবাদে একাকি থাকতে ভালোবাসে, কারো সাতে-পাঁচে যায় না, এমনকি এলাকার সালিশ-বিচারেও তার উপস্থিতি ধর্তব্য নয়। সে হাঁটে কুঁজো হয়ে, অথচ মাজা পড়ে যাওয়ার বয়স তার হয়নি বলেই মনে হয়, বুকে ব্যথা হয় কোনো সামান্য জোরের কাজ করতে গেলে, প্রায় শারীরিক প্রতিবন্ধীই বলা চলে। এই অসুখের ও অশক্ততার কারণই তার বড় মেয়ের কাছ থেকে মাতৃস্নেহ পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কারণ মেয়েরা বাপকে এমনিতেই ভালোবাসে বেশি, তার ওপরে বাপকে শারীরিকভাবে অশক্ত দেখলে মেয়ের ভেতরের মাতৃস্নেহ যে ফল্গুধারা থেকে অবিরল স্রোতোধারায় পরিণত হয়ে যায় তা শরৎচন্দ্রের উপন্যাস না পড়েও অনেকে বিলক্ষণ বুঝতে পারে। কিন্তু বাপের ওপর কুলসুমের যে শ্রদ্ধামেশানো টান, তা বাপের অসুস্থতা নয়, অসুস্থতার পেছনের কারণ। নিজে দেখেনি কুলসুম। শুনেছে দাদির কাছ থেকে। সেই তখন থেকেই বাপের প্রতি তার শ্রদ্ধামেশানো মাতৃস্নেহ।
আব্দুল ওহাব একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই তার গড়ন ছোট-খাট, অপুষ্টিআক্রান্ত চেহারা। তার যুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ দেখে মা বলেছিল– তোর এই শরীল লিয়্যা কীভাবে যুজ্জু করবু বাপ?
যুজ্জু করতে শরীল লাগে না। লাগে হিম্মত। শরীলের তাকদ না, লাগে কলজ্যার তাকদ।
তাদের যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে আসা ঢাকার যুবক হাবীবুল আলমের বাক্যটি মাকে শুনিয়ে দেয় আব্দুল ওহাব। তার সমস্ত অন্তর-মন তখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য টগবগিয়ে ফুটছে।
কিন্তু মেলাঘর ক্যাম্পে পৌঁছে দেখা গেল যুদ্ধের জন্য শরীরের তাকদেরও প্রয়োজন। থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল চালানো শিখতে গিয়ে দেখা গেল ট্রিগার টেপার পরে যে পেছন-ধাক্কাটি আসে, তা সহ্য করার মতো ক্ষমতা আব্দুল ওহাবের দুর্বল কাঁধের নেই। প্রথমবারের ধাক্কায় হাত-কাঁধ অবশ হয়ে ছিল পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা। এসব ব্যথায় ধন্বন্তরি ওষুধ হচ্ছে বন্দুকের তেল। তা ডলে ডলে ব্যথা মরার পরে পরবর্তী ট্রেনিং-এ নেমে এক গুলি ছুঁড়ে সটান অজ্ঞান হয়ে পড়ল আব্দুল ওহাব। এরপরে আর ঝুঁকি নিতে রাজি নয় তার নায়েক সুবেদার ওস্তাদ। এই ছাওয়াল যুদ্ধের অনুপযুক্ত।
কত কষ্ট করে বর্ডার পেরিয়েছে আব্দুল ওহাব। এখন তাকে ফিরে যেতে হবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েই! চোখ ফেটে কান্না আসে। অপমান তো অপমান, তার ওপরে আছে ভয়ও। এখন এলাকায় তার অনুপস্থিতির কথা এতদিনে নিশ্চয়ই চাউর হয়ে গেছে। আর এই সময় জোয়ান কোনো ছেলের এলাকায় না থাকা মানেই হলো রাজাকার-আলবদররা ধরে নেয় যে সে মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখিয়েছে বর্ডার পাড়ি দিয়ে। সে এখন এলাকায় ফেরামাত্র তাকে তুলে নিয়ে যাবে রাজাকার-বিহারির দল। এই ব্যাপারটি সেক্টর কমান্ডারের কাছে গিয়ে নিজে বুঝিয়ে এলেন আলম ভাই। ঠিক হলো আব্দুল ওহাব ক্যাম্পেই থাকবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশও নেবে। তবে প্রত্যক্ষ যোদ্ধা হিসাবে নয়। খটকা লেগেছিল প্রথমে। এ আবার কী রকম যুদ্ধে অংশ নেওয়া! হাবীবুল আলমই বোঝালেন, যুদ্ধ মানে শুধু বন্দুক বাগিয়ে শত্র“র মুখোমুখি হওয়াই নয়। যুদ্ধের সময় শত্রুর ক্ষতি হয় এমন যে কোনো কাজ করা যেমন যুদ্ধের শামিল, তেমনই মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে যে কোনো কাজে যোগ দেওয়াও হচ্ছে যুদ্ধই। চোখের সামনেই তো দেখা যাচ্ছে শাহাদত চৌধুরীকে। কাঁধে রাইফেল সে আর কয়দিন ঝোলায়! কিন্তু যোদ্ধা হিসাবে এই সেক্টরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন শাহাদত চৌধুরী। পত্রিকা বের করা, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা, স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য শিল্পীদের নিয়ে গান তৈরি করা— এসবের জন্যই না শাহাদত চৌধুরীর গুরুত্ব এত বেশি।
এই পর্যন্ত ঠিকই বোঝা গেল। কিন্তু আব্দুল ওহাবকে ক্যাম্পের রান্নাঘরে পানি টানা আর বাবুর্চিকে সাহায্য করার কাজে লাগানো হলো, তখন সে চুপসে গেল ফুটো বেলুনের মতো। ক্যাম্পের রান্নাঘরে কাজের মাধ্যমে যুদ্ধে অংশগ্রহণ! এবার তার মন গলাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল স্বয়ং সেক্টর কমান্ডারকে। সেই একবারই তাঁকে এত কাছ থেকে দেখেছিল আব্দুল ওহাব। সেক্টর কমান্ডার তার কাছে আসতেই এমনিতেই গলে গিয়েছিল আব্দুল ওহাব। কিন্তু সেক্টর কমান্ডার এইটুকুতে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যাওয়ার মানুষ না। রান্নাঘরের পুরো টিম নিয়ে বসলেন তিনি। তাঁর হাতে একটা সুন্দর বই। ‘লং মার্চের স্মৃতি’। চীনদেশে মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ যে মহান বিপ্লব করেছিল, সেই বিপ্লবের বাছাই করা ঘটনাগুলির বর্ণনা নিয়ে এই বই। মাও সে তুং-এর খুব প্রিয় একজন সহচর, কিংবদন্তির বিপ্লবী সিয়ে ফাং ছি নিজে একটি বিষয় নিয়ে লেখেছেন এই বইতে। তার লেখাটির নাম– ‘লং মার্চের রান্নার কাজে।’ সেক্টর কমান্ডার নিজে পুরো লেখাটি প্রায় সোয়া ঘণ্টা ধরে পড়ে শোনালেন আব্দুল ওহাব ও তার রান্নাঘরের সঙ্গীদের। ছিয়ান, লিউ আর ওয়াং-এর বিবরণ পড়তে পড়তে আবেগে তাঁর গলা বারকয়েক কেঁপেও উঠেছিল।
সেই মুহূর্ত থেকে নিজের কাজের গুরুত্ব নিয়ে আর কোনো অভিযোগ নিজের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠতে শোনেনি আব্দুল ওহাব। ষোলই ডিসেম্বর পর্যন্ত নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছে চরম নিষ্ঠার সাথে।
স্বাধীনতার পরে ফিরে এসেছে নিজের ভিটায়। তখন সেক্টর কমান্ডার আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিলেন ইন্ডিয়ার লখনোউ-র এক হাসপাতালে। বেশ কয়েকমাস পরে সুস্থ হয়ে নিজের স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখেছিলেন সেক্টর কমান্ডার। দেশে ফিরে প্রথমেই তিনি খোঁজ নিয়েছিলেন তাঁর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আব্দুল ওহাবসহ রান্নাঘরের সবার নাম উঠেছে কি না এবং তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সনদপত্র পেয়েছে কি না।
সেই সনদ পাওয়া আর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম থাকাটাই কাল হয়েছিল আব্দুল ওহাবের।
তিয়াত্তর সালে গ্রামের বাড়িতে একট্রাক রক্ষীবাহিনী এসে হাজির। কী কারণ? আব্দুল ওহাব ষোলোই ডিসেম্বরের পরে অস্ত্র জমা দেয়নি।
তা আব্দুল ওহাব অস্ত্র জমা দেবে কোত্থেকে! তার কাছে অস্ত্র থাকলে না জমা দেবে!
সেকথা মানতে রাজি নয় রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার। প্রশ্ন আসে– তুমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলে?
হ্যাঁ ছিলাম। সগর্বে উত্তর দেয় আব্দুল ওহাব।
সার্টিফিকেট আছে না?
আছে।
নাম-ঠিকানা মিলিয়ে নিশ্চিত হয়ে নেয় রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার। তারপরে বজ্রাঘাতের মতো প্রশ্ন– তুমি যে অস্ত্র জমা দিয়েছিলে যুদ্ধের পরে, সেই রশিদ কই? দেখাও!
রশিদ তো নাই।
নাই কেন?
আমাক তো কুনো অস্তর দেয় নাই। আমি তো আছিলাম…
রান্নাঘরের কথা বলতে গিয়েও থমকে যায় আব্দুল ওহাব। কে জানে, এসব লোক মুক্তিযুদ্ধে রান্নাঘরের কাজের গুরুত্ব তার সেক্টর কমান্ডারের মতো বুঝবে কি না। হয়তো নাহক হাসাহাসি করবে।
জ্বে, আমি অস্ত্র ধরার যুদ্ধ করিনি। আমার আছিল ক্যাম্পে অন্য কাম।
ততক্ষণে তাদের বাড়ির তিনপাশের তিন পুকুরে লোক নেমে গেছে অস্ত্রের সন্ধানে। তারা পানি-কাদা ছেনে খুঁজে চলেছে অস্ত্র।
অস্ত্র পাওয়া যায় না। রক্ষীবাহিনী এবার পুরো মনোযোগ দেয় আব্দুল ওহাবকে টর্চারের কাজে— অস্ত্র কোথায়?
আরে আমি অস্ত্র কুন্টি পাব!
অস্ত্র জমা দিসনি ক্যান?
অস্ত্রই তো আছিল না। জমা দিব কী!
দড়াম করে ঘুষি পড়ে আব্দুল ওহাবের মুখে— শালা নকশাল, যুদ্ধের সময় অস্ত্র বাগিয়ে নিয়ে সেই অস্ত্র দিয়ে এখন ডাকাতি করে বেড়াও! বল হারামি কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস অস্ত্র?
তার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে। তারপরে যে টর্চার, তার বর্ণনা দিতে গেলে এখনো গা শিউড়ে ওঠে! মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে গায়ে আঁচড় পড়েনি আব্দুল ওহাবের। পাকবাহিনী তার ওপর কোনো অত্যাচার করতে পারেনি। স্বাধীন দেশে নিজেদের বাহিনীর হাতে তার চরম নির্যাতনের অভিজ্ঞতা। তার হাত-পায়ের হাড়-গোর ভেঙে দিয়ে, বুকের পাঁজরের হাড়গুলো ভারি বুটের লাথিতে থেঁতলে থেঁতলে দিয়ে, শরীরটাকে বাইরে অক্ষুণ্ন রেখে ভেতরে ভেতরে ঝুরঝুরে কিমা বানিয়ে তাকে তিনদিন তিনরাত পরে বাড়ির উঠোনে ফেলে দিয়ে গেল রক্ষীবাহিনী।
নড়তে-চড়তে পারার মতো সুস্থ হয়ে আব্দুল ওহাব প্রথমেই যে কাজটি করল তা হলো মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটটি ছিঁড়ে কুটিকুটি করে চুলোর আগুনে ফেলে দেওয়া। আর বাপের জীবনের এই কাহিনীটাই বাপের প্রতি কুলসুমের অন্ধ ভালোবাসা ও ভক্তির কারণ। আব্দুল ওহাব সার্টিফিকেট কুচি কুচি করে চুলোতে দিয়েছিল বটে, কী কারণে কে জানে, তখন চুলোতে আগুন ছিল না। টুকরোগুলো কুড়িয়ে একটা পরিষ্কার ন্যাকড়ায় বেঁধে রেখে দিয়েছিল দাদি। সেটা দিয়েছে কুলসুমকে। কুলসুমও বাপকে বলেনি সেকথা, কাউকেই বলেনি, সে যক্ষের ধনের মতো রেখে দিয়েছে সার্টিফিকেটের টুকরোগুলো।

তো কানেরটা নাহয় হলো, এখনো যে বাকি গলার, নাকের, হাতের। কুলসুম এখন কী করে! ছোট নিষ্পাপ একটি শিশুকে খুন করার পরেও তার প্রয়োজনের সামান্য অংশও যে পূরণ হয় না!
নিজেকে ঘৃণা করার অবসর পাওয়াও যাচ্ছে না। বাপের কথার দাম দিয়ে স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে হলে আর কী করতে হবে কুলসুমকে! যাই করতে হোক না কেন আপত্তি নেই। খুন যখন করতে পারিছি! পাঁচ বছরের বাচ্চাটির জন্য বুকফেটে চোখফেটে জল আসতে চায়। তার উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বলে কুলসুম— সোনারে! তুইতো এখন ইব্রাহীম নবীর কোলে বস্যা বেহেস্তের মেওয়া খাচ্চু। আমি ঠিক ঠিক তোর কাছে পরকালে হিসাব দিব। তোর বাপ-মায়ের কাছে হিসাব দিব। আমার যতদিন দোজখে থাকার কথা, আল্লার কাছে কবো যে আল্লারে তুমি এই নিষ্পাপ দুধের শিশু খুন করা আর তার বাপ-মায়ের কলজ্যা ছ্যাঁদা করার গুনার অপরাধে আমাক আরো হাজার বছর দোজখের আগুনেত পুড়াও।
কিন্তু অনুশোচনার চাইতে বড় চিন্তা বাকি গহনাগুলো কীভাবে জোগার করা যায়।

হোসেন আলী আর তার বউ হাজেরা যে আড়কাঠি, একথা সন্দেহ করে এলাকার মানুষ। তাই তার কাছ থেকে নিজেদের ছেলেমেয়েদের সামলে-সুমলে রাখে সবাই। কিন্তু তাদের কাছে হাত পাতার জন্য অল্প আয়ের প্রায় সবাইকেই যেতে হয়। ঐ দুইজনাও অদ্ভুত মানুষ। তারা জানে যে আড়ালে-আবডালে সবাই তাদের গালিগালাজ করে বদনামের কেচ্ছা ছড়ায়, কিন্তু কেউ গিয়ে হাত পাতলে তারা পারতপক্ষে খালিহাতে ফেরায় না। আসলে তারা যে কাউকে এভাবে পেলে খুশিই হয়। যে সাহায্য তারা করে, সেটি আসলে তাদের লগ্নি। বলা যেতে পারে কাজের শুরুর ধাপ।
ওরা সুযোগ পেলে শিকারকে আভাসে-ইঙ্গিতে ডাকে। কিন্তু কুলসুম ডাক পাওয়ার আগে নিজেই হাজির– আমার হাতের নাকের গলার সোনা না হলে সোয়ামির ঘরে ঢুকার উপায় নাই। কী করলে ট্যাকা পাওয়া যাবি?
হাজেরা কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায় যে এত টাকার কাজ তারা তাকে দিতে পারবে বলে মনে হয় না। তারা কুলসুমকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে চায় না। শহরে তারা কুলসুমকে ঠিকই নিয়ে যেতে পারে, জুটিয়ে দিতে পারে কোনো বাড়িতে ঠিকা কাজ কিংবা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির কাজ। কিন্তু সেগুলির যে বেতন, নিজের খাওয়া-পরা চালিয়ে ঐ পরিমাণ গহনা যোগার করতে করতে কুলসুম নির্ঘাত বুড়ি হয়ে যাবে।
হাজেরার কথা শেষ হয় বটে। তবে এমনভাবে শেষ হয় যে আরো কিছু তার থলের মধ্যে যে আছে তা পরিষ্কারই বোঝা যায়। এমনকি কুলসুমও তা বুঝতে পারে। সে সোজাসুজি বলে ফেলে– আমার দরকার ট্যাকা। দরকার খুব তাড়াতাড়ি। নিজে বুড়ি হওয়ার আগে। বাপ মরেযাওয়ার আগে। কুনো না কুনো নিদান তোমার দেওয়া লাগবি। যা-ই করা লাগে আমি করতে রাজি।
ব্যাস আর কী বলতে হবে!
সরাসরি কথা পেড়ে ফেলে হাজেরা। নানা জায়গায় ব্যবসা, মানে কাজ করা যায়। কুলসুম ইচ্ছা করলে ইন্ডিয়াতে যেতে পারে, ইচ্ছা করলে ঢাকাতে থাকতে পারে। এছাড়া যে কোনো বড় শহর বা গঞ্জে ব্যবস্থা করা যায়।
দেশত্যাগে রাজি নয় কুলসুম। কারণ সে তো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাতের-নাকের-গলার সোনা জোগাড় হলেই সোয়ামির ঘরে ফিরবে। তার মুখের উপর ছুঁড়ে মারবে গহনাগুলো। বিদেশ গেলে সেখান থেকে ফেরা অনেক ঝামেলার বিষয় হতে পারে। ঢাকাও অনেক দূরে। তার চেয়ে কাছের বড় গঞ্জই ভালো।

২.
খালা না খালা না, মাসি কইবি বুঝলি! এইহানে খালা চলে না চাচি চলে না। মাসি চলে আর মামু চলে।
ক্যান?
ক্যান আবার! যেই জায়গার যা দস্তুর!
আপনের নাম নাকি শবনম। এডা তো মুসলমানি নাম।
মাগিপাড়াত আবার হিন্দু-মুসলমান কিয়ের। এই জাগাত আমি মাসি। আমার মতোন হগলডিই মাসি। আর হোন, তর আসল নাম কাউরে কইবি না। এইখানে তর আলাদা নাম রাখা হইছে। তর নাম প্রিয়াঙ্কা।
প্রিয়াঙ্কা!
হ এহন খুব চলতাছে। বোম্বাই ছিনামার হট নায়িকা।
এমন অভিজ্ঞতা শবনম মাসিরও কম। এখানে যেসব মেয়েদের আনা হয়, তাদের পোষ মানাতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। স্বেচ্ছায় এসেছে এমন মেয়ের সংখ্যা এতই কম যে তার স্মৃতিতেই প্রায় নেই। শুনেছে বটে যে ঢাকাতে ইদানিং অনেক বড় ঘরের মেয়েরা হাতখরচের জন্য কিংবা ইউনিভার্সিটির ছাত্রীরাও খ্যাপ মারছে। কিন্তু ঢাকা হলো ঢাকা। তার সঙ্গে তো আর মফস্বলের এই গঞ্জের তুলনা করা যায় না। এখানে যারা আসে তাদের অনেক ভুলিয়ে-ভালিয়ে জোর-জবরদস্তি করে আনতে হয়। সেখানে কুলসুম স্বেচ্ছায় হাজির। আর গা-গতরের সয়-সম্পদ এবং চেহারাও মাশাল্লাহ! ফাটাফাটি ব্যবসা হবে। কুলসুম অবশ্য বলেছে যে সে ছয়মাসের বেশি থাকবে না। কিন্তু তাতে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। এখানে একবার ঢোকার পরে কোনো মেয়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছে, এমন ঘটনা তো সে সারাজীবনে একটাও দেখল না। সে যতখানি পারে সৎ পরামর্শ দিতে চায় কুলসুমকে। যেমন একদিনে বা একরাতে পাঁচজনের অধিক খদ্দের না নেওয়াই ভালো। তাতে শরীরের ওপর ধকল যায় কম। শরীরের চেকনাই বেশিদিন টেকে। প্রত্যেক খদ্দের নেওয়ার পরে ভালো করে অঙ্গ ধুয়ে নিতে হবে। রাতে জেগে দিনের বেলা বেশি ঘুমানো ঠিক না। তাহলে মুটিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। মুটিয়ে গেলে শরীর থলথলে হয়ে গেলে ব্যবসা কমে যাবে। আর খদ্দের টাকা বেশি দিতে চাইলেও তাকে বুকে-মুখে খামচা-খামচি করতে দেওয়া চলবে না। তার ফলে শরীরে খালি যে দাগ পড়তে পারে তা-ই নয়, বরং শৃঙ্গারের কারণে তার নিজের শরীরও সাড়া দিতে শুরু করতে পারে। তাহলে কাজ-কাম দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে। আর যতটা পারা যায় নতুন খদ্দের বেছে নিতে হবে। নতুন মানে যারা এই পাড়ায় নতুন। উঠতি বয়সী ছেলে-ছোকরা হলে তো খুবই ভালো। ওরা এত উত্তেজিত হয়ে থাকে যে বুকের ওপর টেনে নিতে না নিতেই রস খসে যায়। আর পুরনো ঘাগু খদ্দের না নেওয়াই ভালো। কিছু আছে হারামি পারদ-খাওয়া মাল। হাইঞ্জা রাইতে শুরু কইরা রাত পোহায়া গেলেও বুকের উপর থাইকা নামবার নাম করে না। এইসব ঘাগু মালের পাল্লায় পড়ন যাইব না।
শবনম মাসির সব পরামর্শই মনে ধরে কুলসুমের। খালি একটা ছাড়া। একরাতে পাঁচজনের বেশি খদ্দের না নেবার কথাতেই তার আপত্তি। পাঁচজন কেন, একরাতে যদি পঞ্চাশজনকে পার করা যায়, কুলসুম তাতেই রাজি। সে তো আর চিরস্থায়ীভাবে বেশ্যার খাতায় নাম লেখাতে আসেনি। তার দরকার হাতের-নাকের-গলার গহনা। তা যদি দুইমাসে হয়ে যায়, সে এখানে ছয়মাস থাকতে যাবে কোন দুঃখে।
কুলসুম ব্যবসা শুরু করতে না করতেই সাড়া পড়ে যায় গঞ্জে।
একমাসের মধ্যে কুলসুমের নাকের সোনা কেনা হয়ে যায়। দুইমাসের মাথায় হাতের মকরমুখি বালার অর্ডার চলে যায় স্যাকরার দোকানে। সোনাকাঞ্চন জুয়েলার্সের মালিক অখিল পোদ্দার নিজে এখন কুলসুমের প্রায় প্রতিরাতের কাস্টোমার। কুলসুম খালি সোনা সোনা করে দেখে তার মনে হয় সোনার প্রতি মেয়েটির বেজায় লোভ। সে কাজে লাগাতে চায় লোভটিকে– তোমার যদি সোনা এতই পছন্দের তো চলো আমার সাথে। বারোভাতারি না হইয়া বান্ধা থাকবা একলা আমার কাছে। সোনা দিয়া তোমার পায়ের তলা থাইকা মাথার চুল তক মোড়াইয়া দিমু।
কুলসুমের আচরণে তার প্রস্তাবের কোনো আছর পড়তে না দেখে অখিল পোদ্দার মনে মনে ভাবে— বেশ্যা মাগিরা নাকি কারো কাছে বান্ধা থাকবার চায় না। এমনকি কেউ তারে নিকা কইরা উঠাইয়া নিলেও সেইখানে সে তিষ্টাইতে পারে না। তার অব্যেস হইয়া যায় হাজার মরদের হাজার সাইজের লিঙ্গ খাওনের। একটা দিয়া তার তহন আর চলে না। এই মাগিও নিশ্চয়ই সেই কারণেই তার প্রস্তাবে রাজি হইবার চায় না।
কুলসুম তার প্রস্তাবে রাজি না হলেও অখিল পোদ্দারকে খাতির-যত্ন কিন্তু ঠিকমতোই করে। কাজের কাজ তো করতে দেয়ই, মুখেও যথেষ্ট মিষ্টি করে কথা বলে। তাতেই গলে যায় অখিল পোদ্দার। শুধু এই কারণেই তার গহনা বানানোর মজুরি কখনো অর্ধেক কখনো পুরোটাই মাফ হয়ে যায়।
এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পুরুষ মানুষ কুলসুমের কাছে আরো বেশি ধাঁধার বস্তু হয়ে গেছে। মরদরা যে কী চায়! কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরে! দাদি বলত মরদের যখন বাই মাথাত চড়ে, সোনা ফেলায়া কাচ ধরে। সোনা ফেলে এমনভাবে কাচের পেছনে ছুটতে পারে শুধু পুরুষরাই! পুরুষদের মাথায় নাকি ঘিলু বেশি। বুঝতে শেখার বয়স থেকেই এমন কথা শুনে এসেছে কুলসুম। কিন্তু এখন মেলাতে গিয়ে বার বার হোঁচট খায়। পুরুষের নাকি মেয়েমানুষের শরীর ছাড়া চলেই না। শবনম মাসি বলে, অন্য মেয়েরাও বলে একথা। মাগির শরীরের ওপর বাহাদুরি ফলাতে না পারলে মরদ না কি নিজেকে মরদ বলে ভাবতেই পারে না! দ্যাখ না কয়েক মিনিটের কামের জন্য কত টাকা খরচ করে, কত সময় খরচ করে, কত পরিকল্পনা খাড়া করে! ভাবতে গিয়ে রীতিমতো ঘেমে ওঠে কুলসুম। মরদের এই একবারের খাউজানি মিটানোর পয়সা দিয়ে পুরা একটা সংসার কয়েকদিন চলে যেতে পারে। ধরো তার কাছে যে খদ্দের আসে, সে যে টাকা খরচ করে, তা দিয়ে চলে কুলসুম নিজে, শবনম মাসি, দালালের দল, মোড়ের পান-বিড়িঅলা, কনডোমের দোকানদার, বাংলা চোলাইয়ের কারখানা, গর্ভ ফেলানোর ডাক্তারনি, ডিউটি-পুলিশের সিপাই-দারোগা… আরো কতজনা। কয়েক মিনিটের নারীসম্ভোগের জন্য এত টাকা খরচ করে মরদরা! নারীসঙ্গম পুরুষের জীবনে এতই অপরিহার্য এক চাহিদা! তাহলে আমজাদ তাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিল কেন? তার শরীরে কি মদন দেবের কামড় নাই? যৌতুকের লোভ কিংবা টাকার লোভ কিংবা সোনার লোভ তার কাছে কি নারীমাংসের লোভের চেয়েও বেশি? অন্তত শরীরের কারণে হলেও তো আমজাদ তাকে ঘরে রেখেই তার বাপের ওপর টাকা-গহনার জন্য চাপ দিতে পারত। তা না করে সে বাপ-মায়ের পরামর্শমতো বাড়ি থেকে বিদায় করে দিয়েছে কুলসুমকে। হাতের-নাকের-গলার সোনা নিয়ে ফিরতে পারলে তবেই কুলসুম স্বামীর ঘরে ফিরতে পারবে। যতদিন তা না পারছে ততদিন সে যেন স্বামীর উঠোনে পা না দেয়। এখন কুলসুমের যদি এসব যোগার করতে বছরের পর বছর সময় লাগে ততদিন কী আমজাদের পুরুষশরীর উপোস দিয়ে রইবে! এখানকার মেয়েরা তো বলে যে যতদিন একজন মরদ কোনো মেয়ের শরীরের স্বাদ না পায়, ততদিন হয়তো কোনোরকমে সহ্য করে রাত কাটাতে পারে, কিন্তু একবার নারীর স্বাদ পেলে সেই পুরুষকে আর গলায় দড়ি বেঁধেও খোঁয়াড়ে রাখা সম্ভব নয়। দেখিস না কোনো মরদের বউ মরলে চল্লিশা পার করার আগেই সেই মরদ আবার নিকে করে ফেলে! দেখিস না কোনো মরদের পোয়াতি বউ বাচ্চা বিয়োতে বাপের বাড়ি গেলে বা আঁতুর ঘরে ঢুকলে সেই মরদ হামলে পড়ে বাড়ির কাজের বুয়ার উপর, নাহয় সাঁঝ হতে না হতেই ছোটে মাগিপাড়ার দিকে!
এইসব কথাগুলিকে এখন সত্যি বলেই মনে হয় কুলসুমের। নিজের চোখেই তো সে এখন দেখতে পাচ্ছে এমন অনেক ঘটনা। কিন্তু তাহলে আমজাদ কেন কাম-কাতরতার জন্য হলেও তাকে ঘরে ডেকে নিচ্ছে না! সে এখন কীভাবে সে কাটাচ্ছে তার কামজর্জর দিনরাত্রি?

উত্তরের জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না। সদলবলে আমজাদের পা পড়ে গঞ্জের মাগিপাড়ায়।
না, তার ঘরে সরাসরি আসেনি আমজাদ। এলেও আসতে পারত। কত রকমের সম্ভাবনাই তো ছিল বেশ্যাগমনের নামে নিজের বউয়ের কাছেই আমজাদের হাজির হয়ে যাওয়ার। এতখানি নাটকীয়তা না থাকলেও আমজাদের বন্ধু তসলিম যখন ঘরে ঢুকে কুলসুমকে দেখে, এবং কুলসুম তসলিমকে, তখন তারা দুজনেই এমন হতচকিত হয়ে পড়ে যে ঝাড়া অন্তত মিনিট পাঁচেক কেউ মাটিতে গেঁথে যাওয়া তাদের পায়ের পাতাকে উঁচু পর্যন্ত করতে সমর্থ হয় না। সম্বিৎ ফিরে পেতেই দুইহাতে মুখ ঢাকে কুলসুম, আর বিলের মধ্যে দাঁড়াশ সাপতাড়ানো মুনিষের মতো ছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় তসলিম।
তসলিম বেড়িয়ে গেলেও মেঝেতে পা গেঁথে দাঁড়িয়েই থাকে কুলসুম। তার সর্ব অঙ্গের মতো সমগ্র চেতনাও যেন অবশ-বিবশ হয়ে গেছে। যে কোনো বিপদকে তুচ্ছ ভাবার মনোভাব নিয়েই এই পথে নেমেছিল কুলসুম। কিন্তু এমন কিছু যে ঘটতে পারে সে ভাবনা তার মনে কস্মিনকালেও উঁকি দেয়নি।

মাগিপাড়া মাথায় তুলে ফেলে আমজাদ। এমন পরিস্থিতির সাথে শবনম মাসি বা মাগিপাড়ার পরিচালকরা একেবারে অপরিচিত নয়। এসব তাদের সামলাতেই হয়। কিন্তু আমজাদের দলকে বশ মানানো যায় না সহজে। আমজাদের সাফ দাবি, তার বউকে এই মুহূর্তেই তার হাতে তুলে দিতে হবে।
তার আব্দার হেসেই উড়িয়ে দিতে পারত শবনম মাসির দল। আমজাদ যদি তার দলের শক্তির ভয় দেখাত, পুলিশের ভয় দেখাত, এমনকি সাংবাদিকের ভয়ও দেখাত, তবুও গা করত না এপাড়ার কেউ। কিন্তু আমজাদ বলে বসল সে যাবে বড় হুজুরের কাছে। তাকে জানাবে যে তার বউকে চুরি করে নিয়ে বেশ্যাপাড়ায় আটকে রাখা হয়েছে। আজ বিষ্যুদ বার। যদি আগামীকাল সকালে এসে আমজাদ তার বউ কুলসুমকে ফেরত না পায়, তাহলে জুম্মার নামাজের পরে মুসল্লির মিছিল নিয়ে সে আসবে এপাড়ায়। বেশ্যাপাড়া তাহলে মিশে যাবে মাটির সাথে।
এ-কথায় ভয় না পেয়ে উপায় নেই।
শবনম মাসি ফিসফিসায়— ও কুলসুম অহন কী করবি?
আমি যাব না। কুলসুমের সোজা-সাপ্টা জবাব।
আমজাদ যে তাকে এখান থেকে নিয়ে ফের ঘরে অন্তত তুলবে না, এটুকু বোঝার মতো ঘিলু কুলসুমের মাথায় রয়েছে।
শবনম মাসি আমজাদকে আড়ালে ডাকে— তুমি তো বাবা মাইয়াডারে আর ঘরে নিবা না!
প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়ে আমজাদ— ঘরে লিব! একজন বেশ্যামাগিক আমি ঘরে লিব এমন কথা তুমি কেমন করে কও!
তাইলে মাইয়াডারে নিয়া টানাটানি করতাছো ক্যান! আমি বরং তোমারে যা পারি কিছু ট্যাকা-পয়সা দিতাছি।
পয়সা লিয়্যা নিজের বৌয়েক বেচব!
আমজাদের একথা শুনে আরো ধন্দে পড়ে যায় মাসি— ঘরেও নিবা না, আবার তারে ছাইড়া দিয়া ট্যাকাও নিবা না!
না।
ক্যান?
আমার বউ হয়া বেশ্যাবাড়িত নাম লেখাইছে, দশজনার সামনে আমার নাক কাটিছে। আগে ঘরে লিয়্যা মাগিক দুড়মুশ করব মনের ঝাল মিটায়, তারপরে দেখা যাবি কী করা যায়। হারামজাদি আমার বউ হয়া নিজে নিজে যা খুশি করে পার পায়া যাবি, আর তার বিহিত আমি করব না, এমন মরদ আকরাম শেখের বেটা আমজাদ না।

শত শত, বলা চলে হাজার হাজার পুরুষ-ঘাঁটা শবনম মাসি হতভম্ব চোখে আমজাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরুষ জাতকে চিনতে পারা একজীবনে কোনো নারীর পক্ষেই বোধহয় সম্ভব নয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *