ছোটগল্প।। দেশ ও একটি জঠরের মৃত্যু।। জয়শ্রী দাস

সৈয়দ মাহাবুবুল বাসিত তুলি। সাতক্ষীরা মহকুমা শহরের সৈয়দ বাড়ির ছোট ছেলে। লম্বা-চওড়া- তাগড়া জোয়ান সে। তুলি মেধাবী। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই কলেজে পড়া ছেলে পড়াশোনায় মনোযোগী নেই। মনোযোগ অন্যদিকে। অন্যদিকটা হলো বিশেষ একটা বাড়ি। বাড়ির সামনে তার আড্ডাটা বেশ জমিয়ে রাখা তার চাই চাই, আর সঙ্গে আছে গলা ছেড়ে গান গাওয়া। ওই বিশেষ বাড়িটি এক অধ্যাপকের বাড়ি। অধ্যাপকের মেয়ে মহসিনা দেখতে সুন্দরী ও মেধাবী। অধ্যাপকের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটি বড়। দশম শ্রেণির ছাত্রী। দুই পাশে বেণী দুলিয়ে সে যখন স্কুলে যায়, ঝোপঝাড়ের আড়ালে থেকে তুলি তাকে খেয়াল করে।
মহসিনার ছোট ভাই বাবাই। বাবাইয়ের কাছে তুলি একটা চিঠি লিখে পাঠায়। ঘরের মধ্যে টিম টিম করে হারিকেন জ্বলছে। সেই আলোতে মহসিনা তুলির চিঠি পড়তে লাগল। চিঠি পড়তে পড়তে সে হেঁচকি দিয়ে কান্না শুরু করল। মহসিনাদের ছোট দোতলা বাড়ি। বাড়ির বাইরে কুয়াশার চাদরে ঢাকা রাত। মফস্বলের ছোট্ট শহর শুনশান নিরবতার চাদরে ঢাকা।
-আপা তোর কি হল? আব্বা কান্না শুনলে তোর পিঠের ছাল তুলে ফেলবেন। কান্না থামা। জয় বাংলা করা ওই ব্যাটা তোরে কি এমন লিখছে? যা দেখে তুই এত কাঁদছিস!
– ভাই রে আমি তুলিরে ছাড়া বাঁচব না।
-তাহলে তুই মর! কী লিখছে, ওই ফাজিলটা?
– আমাকে দেখতে ইন্দিরা গান্ধীর মত সুন্দর বলছে। আমাকে ছাড়া সে খুব একা। সে আমাকে বিয়ে করতে চায়।
-আপা লোকটা মিথ্যাবাদী। তোর চেহারা এত সুন্দর না। গায়ের রংটা একটু ফর্সা। তোর চেহারার মধ্যে গ্রাম্য গ্রাম্য ভাব আছে।
মহসিনার গায়ের রং ফর্সা। দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী। কিন্তু তাকে ক্ষ্যাপাতে বাবাইর ভালো লাগে। বাবাই ও মনে মনে চায় মহসিনা আর তুলির বিয়ে হোক। কারণ তুলি অনেক শক্তিশালী।
সে ছাত্র ভালো। রাজনীতি করে। মিছিলে সবার আগে থাকে। দেখতেও সুন্দর। এ যদি হয় তার বোনের স্বামী তবে তাকে কে পায়। অধ্যাপক বাবা আগেই ঠিক করে রেখেছেন কলেজে উঠলেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেবেন।
চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাদের প্রেম চলছে জোরেশোরে। মাঝে মাঝে দোতলা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে মহসিনা। আর বাড়ির সামনের গাছের নিচে আড্ডা চলে তুলির। অধ্যাপক সাহেবের হাতে একদিন চিঠিসহ ধরা পড়ে বাবাই। অনেকদিন যাবতই এলাকার এক বড়লোকের ছেলের সাথে মহসিনার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছিল। এতদিন সে বিয়েতে বাবা রাজি না হলেও এ বার রাজি হয়ে গেল। সেদিন সন্ধ্যায় মহসিনার বিয়ের আয়োজন হল। তুলির কাছে একখানা চিঠি পৌঁছে দিল বাবাই। মুহূর্তের মধ্যে প্রায় বিশ জন লোক নিয়ে তুলি হাজির হল বিয়ে বাড়িতে। তুলি শহরের খুব বড় একজন ছাত্র নেতা। শহরের সবাই তাকে ভালোবাসে। সমীহ করে। গরিবের বন্ধু সে। ছাত্রনেতা এসে এবার অধ্যাপকের পা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল।
-স্যার, আমি মহসিনাকে বিয়ে করতে চাই।
এটা বলার পর সে কান্নাকাটির আরও বাড়িয়ে দিল। তার দেখাদেখি বিয়ের আসরে বসা বরও কান্না জুড়ে দেয়। বর বলে উঠলেন-চাচা আপনি তুলির সঙ্গে মহসিনার বিয়ে দেন আমার কোন আপত্তি নাই।
তুলির সাথে মহসিনার বিয়ে হলো। বিয়ে শেষে সৈয়দ মাহাবুবুল বাসিত তুলি নিজের বাড়িতে বউকে নিয়ে এল। আগেই তাদের বাসর ঘরের জানালায় ছিদ্র করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সবাই হতাশ হয়ে দেখল ঘণ্টা তিনেক ধরে শুধু একখানা হাত জড়িয়ে দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
বউ পাগল তুলিকে তার বাবা ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় দুই ভাই বিয়ে করেনি। তোমার মা বেঁচে নাই। বোনকে তো আগেই বিয়ে দিয়েছি এখন আমার ঘরে একমাত্র লক্ষ্মী হলো তোমার স্ত্রী। এর দায়িত্ব আমার তুমি এবার ঢাকায় যাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করো।’
কিছুদিন পর নতুন বউকে রেখে তুলি ঢাকায় চলে এলো ।
তুলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা শুরু করল। সে দিনে দুটো টিউশনি করে। রাতের বেলায় মিছিল মিটিং এর প্রস্তুতি নেওয়া শেষে, স্ত্রীকে প্রতিদিন একটি করে চিঠি লিখে তার মধ্যে একটু আতরের সুবাস দিয়ে রেখে দেওয়া তার নিত্যদিনের কাজ। এভাবে চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাদের প্রেম ভালোই চলছিল। তুলি একদিন রাতে খুব দুঃস্বপ্ন দেখল পরের দিনই বাক্স-পেটরা নিয়ে চলে এলো তাঁর নিজের শহর সাতক্ষীরায়। আসার পর থেকে সে স্ত্রীকে এক মুহূর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করল না। স্টুডিওতে গিয়ে সে তার সাথে তিনখানা ছবি
তুলল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সবসময় গোপন কিছু থাকে। তুলি তার স্ত্রীর পেটে চুমু দিতে খুব পছন্দ করে।
দুদিন পরে বাবা জোর করে তুলিকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলো। দুজনের বিরহ কাল আবার শুরু হল। তুলি বড়াসড়ো একজন ছাত্রনেতা হয়ে উঠল। তুলি কোন মুনাফালোভী ছাত্রনেতা নয়, দেশকে ভালোবাসে, ভালোবাসে
রাজনীতিকে। ভালোবাসে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ধূলিকণাকে। মাঝে মাঝে মাঠে ময়দানে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে দেশের জন্য সবাইকে উজ্জীবিত রাখে। পাকিস্তানীদের শোষণ নিপীড়ন তাকে ভীষণ ভাবে পীড়া দেয়। দেশের জন্য, কিছু একটা করতে ভেতর থেকে সে সব সময় একটা তাগিদ অনুভব করে। খুব মন খারাপ হলে তিনি তার স্ত্রীর ছবিটি বের করে বারবার দেখে। ইতিমধ্যে তুলি জেনে গেছে তার মহসিনা সন্তানের মা হতে চলেছে।
তুলি বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একনিষ্ঠ সাধক হলেও  বাম ধারার রাজনীতির করা তার কিছু বন্ধু আছে। তারা তাকে অনেক ভালোবাসে। তেমন একজন বন্ধু হল আজমল।
আজমল তার প্রাণের বন্ধু। হল থেকে তুলি বন্ধুদের নিয়ে একাত্তরের ৭ই  মার্চ, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে গেল ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে। ভাষণের প্রতিটি বাক্য তাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করল । গায়ের রক্ত গরম হয়ে গেল। একই রকম অবস্থা হল আজমলেরও। তুলি বড় ধরনের নেতা হওয়ায় তারা মঞ্চের বেশ কাছাকাছি বসে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে লাগল।
২৫শে মার্চ আজমলের ভাইয়ের বিয়ে। তুলিকে দাওয়াত দেওয়া হল। আজমলের ভাইয়ের বিয়ের পর, সে বাড়িতে তুলিসহ কয়েকজন বন্ধু থেকে গেল। রাতে তারা হলে ফিরে গেল না। ২৫শে মার্চ ১৯৭১, যখন রাতের আঁধারে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা বের হয়ে নির্বিচারে নিরীহ বাঙালিদের মারতে লাগল, সেদিন তুলির যে বন্ধুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার হলে ছিল তারা অনেকেই শহীদ হল। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেল তুলি।
২৭শে মার্চ ইকবাল হলে এসে তুলি লাশের স্তুুপের মধ্যে নিজেকেই যেন বারবার আবিষ্কার করতে লাগল। তুলি বার বার করে কান্নায় ভেঙে পড়তে লাগল। এতটা নির্দয় এতটা নির্মম পাকিস্তানী সৈন্যরা। সে না হয় দেশের জন্য স্লোগান তুলেছিল কিন্তু তার সবচেয়ে পড়–য়া বন্ধুটি যার চোখে থাকতো অনেক পাওয়ারের চশমা, সে কি দোষ করেছিল। তার হৃদপিন্ড কেন এভাবে খুবলে খাওয়া হলো।
তুলি সিদ্ধান্ত নিল, যে করেই হোক ঢাকা থেকে বের হয়ে সীমান্ত পার হয়ে ইন্ডিয়া যাবে। তুলি গোপনে পাগলের বেশে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কিছু খবর জোগাড় করতে লাগল। রাতের বেলা কাকরাইল মসজিদে গেল, তাবলীগ জামাতের সাথে থাকা শুরু করল। একটাই উদ্দেশে নিরাপদে ঢাকা থেকে বের হয়ে যাওয়া।
তুলির মুখ দাড়ি। সে পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা শুরু করল। দশ বারোজন তাবলীগের জামাতের লোকসহ তাদের যাত্রা শুরু হল। মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টিতে গিয়ে তুলিদের নৌকা ভিড়ে দুপুরবেলা। চারিদিকে নিরব। সেখানে উড়ছে স্বাধীন বাংলার পতাকা। চৈত্র মাসের গরমে সবাই অস্থির হলেও হিন্দু মুসলিম সবার মধ্যে হাসিখুশি ভাব। তখনো মুন্সিগঞ্জ মুক্তাঞ্চল। সবাই মিলে দিঘীর পাড় মসজিদে উঠল। তাবলীগ জামাতের আমীর হালকা-পাতলা হাসিখুশি মানুষ। তিনি তুলিকে খুব খাতির যত্ন করে।
-সৈয়দ সাহেব মন খারাপ করবেন না, ভয় পাবেন না । আপনি যে জয় বাংলার লোক এখানে কেউ জানে না । আল্লাহর নাম করেন তিনি মালিক, তিনি দেশকে রক্ষা করবে। রক্ষা করবে আপনাকে।
-আপনাকে ধন্যবাদ আমির সাহেব।
-আচ্ছা সৈয়দ সাহেব যিনি আপনার পাশে বসে আছেন তার নাম জানেন?
-না।
-উনার নাম নিকুঞ্জ চক্রবর্তী, আমার ছোটবেলার শিক্ষকের ছেলে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে চায়। আপনি বুদ্ধিমান লোক। যে করেই হোক আপনি তাকে সীমান্ত পার করে ইন্ডিয়া পৌঁছে দেবেন।
তৃতীয় দিন তাবলীগ জামাতের কয়েকজন মিলে মুন্সীগঞ্জ শহরে এলো শহর ঘুরে দেখার জন্য।অবাক হয়ে তারা দেখল শহরের দোকানে দোকানে উড়ছে পাকিস্তানের পতাকা। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তারা দেখল নদীতে ভাসছে লাশ আর লাশ। ভয়ে তাদের বুক কেঁপে উঠল। শহরের এখানে সেখানে আগুন। তারা বুঝল পাকিস্তানি সৈন্যরা মুন্সিগঞ্জ আক্রমণ করেছে ।
এবার তারা লঞ্চে করে রওনা হলো বরিশালের দিকে। লঞ্চটি বারবার থামানো হচ্ছিল তাবলীগ জামাতের লোকদের দেখে পাকিস্তানি সৈন্যরা ছেড়ে দিলেও। সকলে বুঝতে পারল মরণ তাদের খুব কাছেই আছে।
এবার বরিশাল থেকে স্টিমারে করে তুলি আর নিকুঞ্জ চক্রবর্তী রওনা হল খুলনার উদ্দেশ্যে। খুলনা থেকে সাতক্ষীরা। এ সময়ে বুকের মধ্যে তুলির শুধু একটা নামই গুঞ্জন করছিল ‘মহসিনা, মহসিনা’ । শুধু একটা বার শুধু একটা বার যদি সে তার হাতটা একটু ছুঁতে পারত। পেটের উপরে একটা চুমু দিয়ে যদি বলতে পারত যেই আসুক তাকে ভালো রেখ। কিন্তু তুলি নিজেকে সংযত করল দেশ আগে, স্ত্রী নয়।  
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ বর্ডারে ইছামতি নদীর পাড়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ধরা পরল তুলি। কিন্তু তিনি বাঁচিয়ে দিলেন নিকুঞ্জ চক্রবর্তীকে। ছোট নৌকায়  করে সবাই যখন ওইপারে বসিরহাটে যাচ্ছিল, তখন সেই নৌকায় সবার আগে পাঠিয়ে দিলেন নিকুঞ্জ চক্রবর্তীকে এবং শহর অন্যান্য অসহায় নারী পুরুষদের যারা দেশ ছেড়ে অজানা অচেনা গন্তব্যর উদ্দেশে যাচ্ছে। আর তুলি অপেক্ষা করতে লাগল আবার নৌকাটি ফিরে আসার জন্য ঠিক সে সময়ই পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে আসলো যশোর ক্যান্টনমেন্টে।
লাঠি দিয়ে সৈন্যরা তাকে মারতে লাগল। তাদের একটাই কথা তোর সাথে কে কে আছে? তারা কোথায় আছে?
যখন নরপশুরা জানতে পারল সৈয়দ মাহাবুবুল বাসিত তুলি একজন ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নেতা, তখন তার উপর অত্যাচারের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে গেল। তার মুখ ভর্তি দাড়ি একটা একটা করে টেনে তোলা হল। গোঁফগুলো পর্যন্ত টানতে লাগল। প্রতিদিন তাকে রক্তাক্ত করা হতো। হাতের নখ, পায়ের নখ হেজবল দিয়ে টেনে তুলে ফেলা হল। শুধুমাত্র জিভটা কাটা হলো না।
একই প্রশ্ন তোর সাথে আর কে কে আছে? তারা কোথায় আছে? তুলি নিরব। সারাদিন রাত তুলি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলতে লাগল ‘আল্লাহ আমাকে মেরে ফেলছে না কেন, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’
তুলির চোখ তখন রক্তাক্ত। সে শুনছে কে যেন খুব উৎসাহিত হয়ে কাকে বলছে ‘স্যার এর বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পাওয়া গেছে। তার বাড়ি সাতক্ষীরায়।’
তুলির খুব শীত করতে লাগল। তার মনে হলো একটা শীতল স্রোত তার মেরুন্ডের মধ্যে দিয়ে বেয়ে চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে দূর থেকে কেউ একজন গান গাইছে ভরাট কন্ঠে ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু।’
চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে তুলি দেখল, একটু দূরে তার বন্ধু আজমল বসা তার সমস্ত শরীর রক্তে ভিজে যাচ্ছে। এত তীব্র যন্ত্রণার মাঝে সে গান গাইছে। কিছুক্ষণ পরে আজমলকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল। কাছে পিঠে হয়তো কোথাও গুলির শব্দ হল। এই পৃথিবী ছেড়ে কে চলে গেল সে কথা তুলির জানা হলো না। তুলির বোন আর ভগ্নিপতিকে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে যশোর ক্যান্টনমেন্টে।
মার্চ মাসে দেখা হয়েছিল আর এখন সেই ৭১এর’ই অক্টোবর মাস, এরই মধ্যে তুলির ভগ্নিপতির মুখে লম্বা দাড়ি, মাথায় টুপি। সে থর থর করে কাঁপছে। নাম-ঠিকানা রেখে কোনো এক অজানা কারণে বোন আর ভগ্নিপতিকে  ছেড়ে দেওয়া হল। তুলি জ্ঞান হারানোর আগে শুনতে পেল, ‘স্যার এর ভগ্নিপতির বন্ধু শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, এজন্যই ভগ্নিপতিকে ছেড়ে দিতে বললাম, কিন্তু এর বাড়িতে সুন্দরী স্ত্রী আছে। চলেন যাই।’
অক্টোবর মাস তুলির আট মাসের গর্ভবতী স্ত্রী মহসিনা সব দরজা-জানালা বন্ধ করে তুলির একখানা ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সে জেনে গেছে তুলি পাকিস্তানি সৈন্যদের  হাতে ধরা পড়ে, বন্ধি অবস্থায় আছে ।
দুপুরবেলা তাদের বাড়ির সামনে একখানা পাকিস্তানি সৈন্যদের জিপ এসে থামল। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানসহ আরও অনেকে সেখানে উপস্থিত হল। চিৎকার-চেঁচামেচিতে মহসিনা দরজা খুলে বের হল, ইতিমধ্যে তার শ্বশুর তার দুই ভাসুরকে গুলি করা হয়েছে। তার শ্বশুরের মাথাটা ধর থেকে আলাদা করে ফেলেছে পাকিস্তানি নরপশুরা।
প্রথম দেখাতেই পাকিস্তানি কয়েকজন সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল মহসিনার উপর। তারা চলে যাওয়ার সময় মহসিনার দেহটিকে দ্বিখন্ডিত করে রেখে গেল। মহসিনা শহীদ হলো। যে রমণীর জঠরে একটি মানব শিশু প্রতিক্ষায় ছিলো পৃথিবীর আলো দেখার, মহসিনার দেহটি খন্ডিত হবার সাথে সাথে সেই শিশুর হৃদস্পন্দন থমকে গেল।
রক্তে ভেসে যাওয়া মরা দেহের উপরে মাছি ভনভন করে উরতে লাগল। হয়তো তারা গুনগুন করে বলছিল, কে আপন, দেশ না স্ত্রী?
অক্টোবর মাসে সাধারণ ক্ষমায় গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে দুলাভাইয়ের চেষ্টায় মুক্তি পেল তুলি।
স্বাধীনতার পরে শহরের আনাচে কানাচে একজন পাগলকে দেখা যেত যার নাম তুলি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *