ঈদ সংখ্যার ছোটগল্প।। মর্মঘাতী অতীত।। ইসরাত জাহান
রায়না বারান্দায় বসে ঝরে যাওয়া বিকেল দেখতে দেখতে আদা চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো।তখনই শুনতে পায় কাঁচ ভাঙার শব্দ। ঠিক কোথা থেকে শব্দটা আসছে বুঝতে পারেনা।শব্দের ঝাঁঝালো রেশে বা- হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধ আঙ্গুলের মাঝে আটকে থাকা বইটা মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। আজকাল প্রায় এমন কাঁচ ভাঙা শব্দ শুনতে পায়। মাঝেমাঝে ঘুমের ঘোরেও এমন শব্দ শুনে। কিন্তু যখন ঘুম ভাঙে তখন চারিদিক শান্ত, নিরব,নিস্তব্ধ। একদিন জামিলা খালাকে স্বপ্নের ভিতরে যে কাচভাঙার শব্দে শুনতে পায় সেই কথা বলেছিলো। ওর কথা বিশ্বাস করেনা পঞ্চাশ উর্ধ্বে জমিলা খালা, টালাভাবে হেসে উড়িয়ে দেয়া।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের আধাঁর নামার আগে রায়নার বইটা তুলে নিয়ে বারান্দা থেকে উঠে আসে, বারান্দায় মৃদু আলোর শেডল্যাম্পেটা জ্বালিয়ে। এসময়টায় দোলনচাঁপা ফুটতে শুরু করে। এই ফুলের গন্ধটা ওর একদম সহ্য হয়না। রায়না মাকে বলেছিলো দোলনচাঁপার গাছগুলো না লাগাতে। মায়ের আবার অনেক পছন্দ। তাইতো মায়ের পছন্দের কারনে বেশী আপত্তি করেনা। বারান্দার মিষ্টি বাতাস কাছে এসির ম্যানুফ্যাকচারিং বাতাস অনেকটাই অসহায়, কুলিংটা একটু কমিয়ে এলিয়ে পড়ে বিছানায়। আজ অবশ্য সারাদিন অনেক গরম পড়েছিলো। রাতের স্নিগ্ধতা এখন দিনের উষ্ণতাকে ম্লান করে দিতে পারেনি। তাইতো চারিদিকে কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গরম।
আজকাল একটু বেশীই গরম পড়ছে। বৃষ্টি হচ্ছেনা একদম। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে গাছপালা কেটে ফেলছে, তাই বাতাসে কার্বনডাই-অক্সাইড পরিমান বেড়েই যাচ্ছে। পরিবেশের স্বভাবটাও দিনদিন খারাপ হচ্ছে।তাইতো আষাঢ় -শ্রাবণের বৃষ্টি এখন মাঘ -ফাল্গুনে টুপটাপ এসে মাথায় ঝরে পড়ে।দোলনচাঁপা ফুলের গন্ধটা আবার নাকে এসে লাগে, এই গন্ধের সাথে মিশে আছে ভয়, ঘৃনা, আর চাপা কষ্ট যা এখন আবারও বাড়ছে।রায়না মনে মনে পণ করে আর কখনো বারান্দায় গিয়ে বসবেনা, যতদিন দোলনচাঁপা ফুলগুলো ফুটবে।
রুমে এক কোনে জমিলা খালা ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে নামাজ পড়ছে। রায়না ফারহানা আহামেদের ও ইশতিয়াক আহামেদের একমাত্র মেয়ে। ওর ছোটো ভাই রায়হান, দার্জিলিংয়ে বোডিং স্কুলে পড়ে। ছুটিছাটা না হলে বাড়ী আসেনা। এতো বড় বাড়ীতে ওরা তিনজন ছাড়া আরো একজন আছে। রায়নার সর্বক্ষনের সঙ্গী জামিলা খালা। ও যখন এই বাড়ীতে আসে তার দুই বছর পর থেকেই জামিলা খালা এই বাড়ীতে।
রায়না জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিকসে পড়ছে। ফারহানা আহামেদ দেশের একজন স্বনামধন্য ল’ইয়ার। ইশতিয়াক আহামেদ ব্যস্ত তার গার্মেন্টস ব্যবসা নিয়ে। সাভারে গার্মেন্টেস আর বারিধারায় অফিস। সকালে বাবা মা দুজনে একসাথেই অফিসের জন্য বের হয়।মাঝেমাঝে রায়না ভার্সিটিতে যায় ওর বাবা সাথে। আবার মাঝেমধ্যে বাসার অন্য গাড়ী নিয়ে বের হয়। ওর বাবা মা মোটামুটি পুতুলের মতো করো মানুষ করছে ওকে। শোকেসে একটা পুতুল যেমন সাজিয়ে রাখা হয়, ঠিক ওমন করে। রায়নার গল্প শোনার একমাত্র মানুষ হচ্ছে ওর জামিলা খালা। খাবার টেবিলে বাবা মা তাদের জরুরি ফোনে ব্যস্ত থাকে, নয়তো কোন বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়া। তাইতো ওর কথা শোনার সময় হয়না ওদের।তবে এর মাঝেই ওর প্রয়োজনীয় কথা, আবদারগুলো সেরে নেয়।
─মা,আমার বান্ধবী সোমার বিয়ে। আমি একদিনের জন্য ওদের ওখানে গিয়ে থাকতে চাই।
─বান্ধবীর বিয়েতে তার বাসায় গিয়ে থাকার কি হলো? বাসা থেকে যাবে, আমি চাই না তুমি একদিনের জন্য বাসার বাহিরে থাকো।
─কিন্তু আমি তো কথা দিয়েছি, আমি ওদের সাথে যাবো। আর বিয়েটা ঢাকায় হচ্ছেনা।বিয়ের পুরো অনুষ্ঠানটি টাঙ্গাইলে সোমাদের
ফার্ম হাউসে হচ্ছে।
─তাহলে তোমার সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়া হবে না।
─মা, আমি যাবো। অবশ্যই যাবো।
মা, মেয়ের আসন্ন যুদ্ধ প্রস্তুতি দেখে ইশতিয়াক সাহেব মেয়ের দলে হাওয়া লাগিয়ে স্ত্রীকে আর কথা বলার সুযোগ দেয় না। নিজের সম্মতির কথা জানিয়ে দেয়। ফারহানা আহমেদ স্বামীর উপর রাগ করে খাবার অর্ধেক শেষ করে উঠে যায় টেবিল থেকে।বাবা, মেয়ে নিরবে খাবার শেষ করে। কিছু সময় বসে থেকে উঠে পড়ে টেবিল থেকে। নিরবতা নেমে আসে পুরো বাড়ী জুড়ে।
ঘরে এসে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। ঘুমে যখন চোখ লেগে আসছিলো,তখন একটি ঠান্ডা হাত মাথা নেমে আসে। মায়ের ছোঁয়া বুঝতে বাকি থাকেনা ওর। রাত গভীর হলে মা ওর রুমে আসে। কিছুসময় ওর পাশে বসে থাকে, রায়না সেটা জানে। কিন্তু কখনও আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে মাকে বিব্রত করেনা। মায়ের অন্তক্ষরন ও টের পায়, তবে সেটাকে প্রবাহের সুযোগ দেয়না রায়না। ছোট রায়না তখন যেমন মাকে সাহায্য করে ছিলো চুপ থেকে আজও চুপ করে আছে মায়ের সংসার রক্ষার স্বার্থে।
সকালে খাবার টেবিলে সবাই যখন নিরবতার মৌনব্রত পালন করছ, তখন হঠাৎ করে ইশতিয়াক সাহেব উচ্চস্বরে লাফিয়ে ওঠে।
ইমতিয়াজ আসছে…ইমতিয়াজ আসছে…এতোদিন পরে ও আসছে।
স্বামীর উচ্ছ্বাসে কিছুটা উচ্ছ্বসিত হয়ে ফারহানা জিজ্ঞেস করে
─কবে আসছে?
─আগামী পরশু…এবার আমাদের বাসায় উঠতে বলবো, তুমি কি বলো?
─ঠিক আছে…বলো, তোমার ভাই, না বললে দেখতে খারাপ দেখায়।
─তুমি কি গতকালের জন্য এখনও রেগে আছো?
─কই না তো,─ রায়না তুমি কবে যেতে চাও বান্ধবীর বিয়ের অনুষ্ঠানে?
─আমি তো যাবোনা….
সোমাকে ফোন করে বলেছি।
─যাও…কয়দিন ঘুরে আসো। আমি চাই তুমি এই কয়টা দিনের জন্য ঘুরতে যাও।
রায়না মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে সরে পরে মায়ের সামনে থেকে। মায়ের সাথে এখন ওর কাগজে বাবার বোঝাপড়া শুরু হবে। রায়না যখন এই বাড়ীতে আসে তখন ওর বয়স নয়।মাত্র পাঁচ বছর বয়সে এক সপ্তাহের ডেঙ্গু জ্বরে বাবাকে হারায় রায়না। ছোট মেয়ে, সংসার একার হাতে সব সামলাতে গিয়ে জীবনযুদ্ধে কিছুটা হাঁপিয়ে ওঠে ফারহানা আহমেদ, সেইসময় পরিচয় ইশতিয়াক আহামেদের সাথে। উকিলের কাছে আইনের মারপ্যাঁচ শিখতে এসে মনের মারপ্যাঁচে আটকে যায় ফারহানা ও ইশতিয়াক। ডিভোর্সি ইশতিয়াকের পরিবার রায়নাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনা একমাত্র দেবর ইমতিয়াজ ছাড়া। ইমতিয়াজ তখন সদ্য ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ভাইয়ের সাথে থাকে। রায়নাও সারাক্ষন চাচ্চু চাচ্চু বলে সারাঘরে মাতিয়ে রাখতো। প্রেগন্যান্ট ফারহানা অনেকটা নিশ্চিন্তে মেয়েকে চাচার কাছে রেখে নিজের কোর্ট, ডাক্তার সামলে চলছিলো তখন। তবে নিজের ভুলটা অনেক পরে বুঝতে পারে, কিন্তু ততদিনে জল অনেক দূর গড়িয়ে যায়। নিজের সংসার বাঁচাতে, পেটের সন্তানের কথা ভেবে স্বামীর কাছে সব গোপন করে লম্পট দেবর আর কৌশলি ননদের কথায় সায় দিয়ে ব্যাপারটা চেপে যায় ফারহানা নিজের অবুঝ শিশুর মুখে তালা লাগিয়ে। তখন থেকে মেয়েকে নানাভাবে সুরক্ষার রক্ষা কবচে আটকে রাখা শুরু করেন । সেই থেকে জামিলা রায়নার সাথে সাথে সারাক্ষণ।
রুমে এসে কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকে, ভেবে পায়না কি করবে। এই মুহূর্তে এখান থেকে সরে পড়াটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। রায়না এই পরিবারে উটকো ঝামেলা, এতোদিন পরে এই পরিবারের সদস্যদের মিলনমেলায় ওর না থাকাটাই শুভকর হবে।ঠিক করে বেরিয়ে পরবে আগামীকাল সবকিছু গুছিয়ে। মায়ের সাথে এই নিয়ে কথা বলে মায়ের চোখের কোনে জমে থাকা অসহায়ত্বটা দেখতে ইচ্ছে করেনা ওর। শুধু সোমাকে একটা মেসেজ দিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে কিছু সময় একা থাকার জন্য।
─রায়না…রায়না… রায়না কথা বলছো না কেন?
─শুনতে পাচ্ছি। বলো।
─তুমি কি আজই যাবে?
─না, আগামীকাল যাবে, আর কিছু বলবে?
─তুমি বেরিয়ে এসো।
─তুমি এই রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেই আমি বের হবো।
মাঝখানে দেয়াল,দুই প্রান্তে দুজন মানুষ একই ক্ষতে দগ্ধ হচ্ছে…
মুখের ভাষা হারিয়ে। রায়না ওর মাকে ক্ষমা করে দিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু ফারহানা নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনা। নিজের এখনকার এতো প্রভাব, জোশ সব ফিকে ম্লান হয়ে যায়, মেয়ের মুখের দিকে তাকালে।সবকিছু ভেঙেচুরে মেয়েকে বুকে নিয়ে চলে যেতে মন চায় কখনো কখনো। কিন্তু পারেনা সমাজ নামক বিশেষ আদালতের কারনে।
সারাটা দিন রায়না ঘরেই থাকে , টিভি দেখে, বন্ধুদের সাথে একটু চ্যাটিং, শুয়ে বসেই কাটিয়ে দেয়। অনেকবার ইশতিয়াক সাহেব এসে মেয়েকে ডাকে…মেয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে বিছানায়। জামিলার ব্যস্ততা ও দৌড়ঝাপ বেড়ে যায় রায়নার নিরবতার কারনে।
খুব সকালে ড্রাইভার আক্কাসকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগেই। ঘুমন্ত জামিলা খালা নাক ও ঠোঁটের কার্যক্রম দেখে ফিক করে হেসে ফেলে রায়না। ছোটবেলায় দুপুরে জামিলা খালা ঘুমিয়ে পড়লে ও খাটে উপুড় হয়ে জামিলা খালাকে দেখতো আর হাসতো। সিঁড়ি দিয়ে খুবই মৃদু তালে নেমে আসে নীচে ছোটো ব্যাগটা হাতে নিয়ে। গাড়ীতে ওঠার আগে একবার চোখটা বুলিয়ে নেয় বারান্দায়, তখনই মায়ের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় রায়নার। মায়ের চোখে লজ্জা ও স্বস্তি একসাথেই দেখতে পায়না ও।মাখা নিচু করে গাড়ীতে টুপ করে ঢুকে পড়ে।গাড়ীতে উঠেই ঘুমাবার চেষ্টা শুরু করে ড্রাইভারকে গন্তব্য বুঝিয়ে। কিন্তু ঘুম আসেনা।তবে টাঙ্গাইল পৌঁছানো একটু আগের ঘুমিয়ে পড়ে। সোমাদের খামার বাড়ীর সামনে গিয়ে গাড়ীর হর্নে ওর ঘুম ভেঙে যায়। চারদিকের সাজানো গোছানো দৃশ্যপট, সূর্যের আলো আর সবুজ পাতার আলো ছায়ার খেলা দেখে রায়নার মনের জমে থাকা কষ্টগুলো হঠাৎই হাওয়া হয়ে যায়। ঠিক করে এইসময়টা সবার সাথে আনন্দে কাটাবে সব ভুলে। ওর আসার খবর সোমার কাছে পৌছুতেই ছুটে আসে বান্ধবীকে আলিঙ্গন করতে। কোন এক কারনে, সোমা কেন যেন রায়নাকে খুবই পছন্দ করে যা কারন এখনও ওর অজানা।
─কি রে শেষ পর্যন্ত এলি।
─মা শেষে রাজি হলো, আসতে দিলো। আমি তোর বিয়ের পুরো সময়টাই এখানে থাকবো।সব পর্ব শেষ করে তবেই বাড়ী ফিরবো। তোর মা কোথায়, চলে দেখা করে আসি। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দে আমাকে।
সোমা অপলক রায়না দিকে তাকিয়ে থাকে, ওর মুখে একসাথে এতো কথা শুনে একটু অবাক হয়, যে মেয়ে হাজার প্রশ্নের একটি মাত্র উত্তরে সেরে ফেলে, সেই এখন যেচে পড়ে সবার সাথে পরিচিত হতে চায়। সোমার ভালোলাগে ব্যাপারটা আবার একটু কিন্তুও উঁকি দেয় মনে। রায়নার কি কোন কারনে মন খারাপ? সোমার ওর সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে রায়নাকে নিয়ে বাড়ীর ভেতরে যায়।
সারাটাদিন রায়নার বেশ আনন্দে কাটে। বিয়ে বাড়ীতে একসাথে এতো লোকজন, একেকজনের একএক রকমে ভাবনা, কথা, হাসাহাসি, রাগ, ঝগড়া সবই ওর ভালোলাগে।এর আগে কখনো এমনই করে মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হয়নি ওর, খাঁচার পাখি হয়েই কেটেছে এতোটা কাল।
বেশ বেলা করে রায়নার ঘুম ভাঙে, আজ সোমার গায়ে হলুদ। ওদের বিশাল বাগানের গাছগুলো মরিচবাতির তার দিয়ে প্যাচিয়ে ফেলছে।সন্ধ্যায় আলো ঝলমল করবে চারপাশ। হঠাৎ চিৎকার আর শোরগোলে রুম থেকে বেরিয়ে আসে । এসে দেখে সোমার মেজো খালা ঝগড়া করছে ওর মায়ের সাথে। আর আন্টি চেষ্টা করছে থামানোর। ঝগড়াঝাটি ওর কখনোই ভালোলাগেনা। তাই সরে পড়ে ওখান থেকে, সোমাকে পেয়ে যায় পাশের রুমেই। খালাতো বোনের কান্না থামাচ্ছে।
─কি হয়েছে সোমা?
─তেমন কিছুই না।
─লামিয়া কান্না করছে কেন?
─একটু ঝামেলা হয়েছে, তাই।
─কি? আমাকে বলা যায়?
─লামিয়ার সাথে গতকাল রাতে আমার চাচাতো ভাই একটু অসভ্যতা করেছে।
─কে? কখন? কি করেছে?
─সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অন্ধকারে নাকি জড়িয়ে ধরে ছিলো, আর নাকি…বু…
সকালে তো খালা এই কথা শুনেই পুরো বাড়ী মাথায় নিয়েছে। সন্ধ্যায় হলুদ, এখন যদি দুই পরিবারের মাঝে এই নিয়ে ঝামেলা হয়। কি হবে বলতো? মা এতো করে বোঝাচ্ছে খালাকে, খালা বুঝতেই চাচ্ছেনা। আমার চাচা চাচী না থাকলে বাবার মন খারাপ থাকবে। কি যে করি…এতো ঝামেলা। লামিয়াও আছে, সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করে। সবার নজর তো পড়বেই। তাছাড়া একটু বড়ও হয়েছে। সাবধানে থাকতে হবে তো এখন থেকে। কিছুই বোঝেনা মেয়েটা।
─লামিয়া সাথে অসভ্যতা করেছিলো সে কি এখনও এই বাড়ীতে আছে?
─আছে, কেন? তুই কি করবি?
─আজ পাথর সরাবো। লামিয়া আসো, শরীর সমস্ত শক্তি দিয়ে আজ তাকে চড় মারবে, পারবে তো?
কান্না থামিয়ে অকপটে লামিয়া বলে ওঠে,”পারবো রায়না আপু”
তাহলে চলো…
সোমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রায়না লামিয়ার হাত ধরে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।সোমা রায়না আর লামিয়ার পিছনে ছুটতে থাকে ওদের থামাতে।
বাবা আর ছোট চাচার সাথে লনে বসে চেয়ারে একটু গা এলিয়ে সকালের চা খাচ্ছিলো শিহাব। বিয়ের আয়োজন ঠিক মতো হলো কিনা, তাই নিয়ে কথা বলছিলেন তারা ,আর শিহাব শুনছিলো। তখন ওর সামনে এসে দাঁড়ায় লামিয়া।
লামিয়াকে দেখেই এলানো শরীরটা সোজা হয়ে যায় ওর মুহুর্তে । পিছনেই সোমা আপুর বান্ধবী, কিছু বোঝার আগেই গালের উপর কষে একটা চড়…
সবাই নিরব,একটি পিন পড়লেও শোনা যাবে এমন। মুহুর্তেই পুরো বাড়ীর সবার সত্যি বলার সাহস, সম্পর্কগুলোর প্রতি মায়া, মানবিকতা, দেখানো ভালোমানুষি রূপ সব অকপটে বেরিয়ে আসে।
রায়না অবাক হয় দেখে , সবাই শিহাবের দোষ না দেখে লামিয়ার ভুল খুঁজে বিচার শুরু করেছে । সময় এগিয়ে গেছে, কিন্তু সত্যকে আড়াল করার প্রক্রিয়া কখনো বদলায় না। সেই সময় ইমতিয়াজ চাচার অসভ্যতা জন্য ওর মা ওকেই চড় মেরেছিলো, মায়ের ননদের বাজে কথা। এখন কানে বাজে। আজ এই সময় সবাই লামিয়াকেই দুষছে, গুটিকয়েকজন ছাড়া। তবে লামিয়ার সৌভাগ্য এমুহূর্তে মাকে পাশে পাচ্ছে। যা তখন রায়না পায়নি। তাইতো মায়ের জন্য অনেক অভিমান জমিয়ে রেখেছে এতটা কাল ।
রায়না দুপুরের আগেই বেরিয়ে পড়ে সোমাদের বাংলো থেকে। চারদিকের পরিবেশ থমথমে, সোমার চাচা, চাচী ও খালা,খালু সবাই চলে গেছে। যাবার আগে সবাই রায়নাকে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেয়, এই অনুষ্ঠান পন্ড করার জন্য ওই দায়ী। গাড়ীতে উঠেই মনে পড়ে বাসায় গিয়ে সেই ইমতিয়াজ চাচার মুখোমুখি হতে হবে। অন্যকে প্রতিবাদ শিখিয়ে নিজের প্রতিবাদের ভাষাটা হারিয়ে ফেলে, আগে মুখচোরা রায়না হয়ে যায় । ঘর ফিরতে ইচ্ছে করে না ওর।
সন্ধ্যাে নামার আগে আজও বারান্দায় গিয়ে বসে রায়না। দোলনচাঁপার গন্ধটা আজ ভালো লাগে ওর। সেদিনের দোলনচাঁপার গন্ধের সাথে আজকের ফুলের গন্ধের কোন মিল নেই।
গতকালের নাটকীয়তা কথা ভাবছে রায়না অনমনে। এতোদিনে যত রাগ, ক্ষোভ, কষ্ট ছিলো সব এক নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে গেছে ওর।গতকাল বাসায় ফেরে সন্ধ্যার পরে। ঘরে ঢুকতেই উচ্চস্বরে হাসির আওয়াজ আসে বাসার ঘর থেকে। সেই হাসি হঠাৎ করে ওর কাছে ব্যঙ্গত্ব মনে হয়। নিজেকে নিজের কাছে ছোটো লাগে। নিজের নিজেস্বতা ওকে তাড়া দেয় কিছু বলার জন্য।
তাইতো কোনকিছু না ভেবে বসার ঘরে সবার সামনে দাঁড়িয়ে রায়না ইমতিয়াজকে চিৎকার করে বলে,
“আপনার লজ্জা করেনা এই বাসায় এসেছেন।আমার সাথে অসভ্যতা করে এখন উচ্চস্বরের হাসি আসে কিভাবে আপনার”
ফারহানা ছুটে আসে মেয়েকে থামাতে, কিন্তু রায়না থামেনা। ইমতিয়াজ দিনের পর দিন সবার আড়ালে ওর সাথে যা যা করেছে সব বলে ফেলে এক নিমিষে। মুহূর্তেই ভদ্রতার মুখোশ থেকে বেরিয়ে আসে কিছু মানুষের প্রকৃতরূপ। এতোদিন বাবা বলে পরিচয় দেয়া ইশতিয়াক তখন রায়নার প্রকৃত বাবা হয়ে উঠে। ঘাড় ধরে বের করে দেয় নিজের আপন ভাইকে। আত্মা সম্পর্কে কাছে রক্তের সম্পর্ক তুচ্ছ হয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে মেয়েকে।
ভাবনার মাঝে কোমল একটি হাত ওর মাথা উপর দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে জমিলা খালা চা নিয়ে আসে বাবা আর মেয়ের জন্য। চা রেখে যাবার পরে পাশের খালি চেয়ারটায় বসে পড়ে ইশতিয়াক সাহেব মেয়ের পাশে। রায়না ঝরে যাওয়া বিকেল দেখতে থাকে আদা দিয়ে চা খেতে খেতে সাথে ড্রাইভার আব্বাসের ডালিয়া গাছ লাগানো।
─বাবা যারা দূরে চলে যায় তারা বুঝি আমাদের আশেপাশেই ফুলপাতা হয়ে থাকে।
─হয়তো , তবে তারা ছায়া হয়ে পাশেই থাকে। আমরা জীবিতরাই আগাছা হয়ে জঙ্গল তৈরি করে। আর আসল ফুলগুলোকে পিষে মেরে ফেলি।
রায়না দেখে পরম মমতায় দুটো চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আজ আর কোথাও কাঁচ ভাঙা শব্দ শুনতে পায়না রায়না।