ছোটগল্পনির্বাচিত

ছোটগল্প।। চার যুবক।। মঈনুল আহসান সাবের

বাহাত্তরের এক বিকেলে চার যুবক মরিয়া হয়ে উঠল। আর এসপার নয় ওসপার। তাদের মনে হলাে এই অর্থহীন, অনির্দিষ্ট জীবন বড় ক্লান্তিকর, অনুশােচনা এবং অপমানে দগ্ধ হতে হয়; এর চেয়ে বরং সেই ভালাে, কিছু একটা ঘটে যাক, দারুণ কিছু একটা। শরীর এবং মনে ক্রমশ জং ধরে যাচ্ছে, সময় অসার এবং স্থির, কিছু করার নই, এভাবে জং বাড়তে বাড়তে সব শরীরের কলকজা একদিন বিকল হবে, তাই আজ কিছু ঘটে যাক, অন্যরকম— চার যুবক সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে উঠে একাগ্র হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রায় এক বছর কোনাে কাজ নেই। প্রথম প্রথম খুব ছুটাছুটি তাদের, এই পুরাে দেশটাই যেন তারা উল্টে-পাল্টে মনমতাে বানিয়ে নেবে। কিন্তু কোথায় কি তাদের এত হৈ-চৈ, আগ্রহ-উল্লাস সব বৃথা যায়, মনের মতাে একটা কাজেও হাত দিতে পারে না তারা কেউ, অথচ কি আশ্চর্য, নানারকম ভেলকিবাজি— সে তাে তাদের চোখের সামনেই হচ্ছিল। চারজনের চারজোড়া চোখ এবং কান, তারা তাে কেউ অন্ধ কিংবা বধির নয়। তারা দেখল এবং জানল, কিছু মানুষ। কি সুন্দর তরতর করে ওপরে উঠে যাচ্ছে তাে যাচ্ছেই, শুধু তারা চারজন একসময় দেখল তারা খুব নিচে, মাটির সঙ্গে লেগে আছে, যারা খুব উঠেছে তাদের ভারে তারা নুয়ে আছে।

এক বছর বড় দীর্ঘ সময়। কত কী ঘটে যায় পৃথিবীতে, এই ছােট দেশেও। হ্যাঁ এক ধরনের ওলােট-পালট বৈকি, খুব দ্রুত বদলে গেল চারপাশের সবকিছু, তারা তার কিছুই ধরতে পারল না। সময়টাই ঐরকম ছিল, কেউ কেউ সুযােগ পেয়ে যেত এবং তারপর শুধু ঝুলে পড়া। এটুকুই যথেষ্ট, যাকে নেওয়ার এবং যার ইচ্ছে আন্তরিক সময় এবং সুযোেগ তাকে ঠিক টেনে নিয়ে যায় গন্তব্যে। আর বাদবাকি যারা, তাদের জন্য সময় স্থির। তাদের জন্য সে কী নিশ্চিদ্র পরিস্থিতি, সে পরিস্থিতির কোনাে ফাঁক-ফোকর নেই যে, নির্বিঘ্নেই ফোকর গলে চলে আসা যাবে আকাক্ষিত কোন রাজ্যে। চার যুবক ক্রমশই তাই নুয়ে পড়ে, ন’মাসের যুদ্ধের পরও যে মনােবল ছিল অক্ষুণ্ন-অটুট তা ক্রমশ মােমের মতাে খুব সহজেই গলে গলে যায়। এখন যেন শেষাংশটুকু জ্বলছে, জোর বাতাস উঠলে যে-কোনাে মুহূর্তে নিভে যাবে, তখন চারপাশে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।

অথচ প্রথম কয়েকটি দিন কি উজ্জল ছিল। যুদ্ধ শেষে ছেঁড়া-ফাঁড়া শরীর আর পােশাক নিয়ে ফিরে এল তখন উৎসাহ ছাড়া ক্লান্তি নেই শরীরে। সে খুব সামান্য সময়ের ব্যাপার। তারা খুব অবাক হয়ে দেখল সবকিছু কেমন হাতের আঙুল গলে সহজে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের যেন হাতের মুঠো বন্ধ করা নিষেধ। হাতের মুঠোয় কিছু আটকে ফেলা তাদের হয়ে ওঠে না। না— তারা চায়ওনি। এর চেয়ে বরং ধীরে সুস্থে হােক সবকিছু, এত বড় একটা যুদ্ধ গেল দেশজুড়ে, তা একটু এদিক-ওদিক তাে হবেই, তারা ভাবত। তারা খুব বিশ্বাসী ছিল, এ-অবস্থা বেশিদিন থাকযছে না, যুদ্ধপরবর্তী এই হাঙ্গামা শেষ হলেই তারা প্রয়ােজনমতাে কোনাে-না-কোনো জায়গায় ঠিক সেঁটে যাবে। কিন্তু কোথায় কি, একটা একটা করে দিন যায়, দেশজুড়ে নানা ধরনের অশ্লীল নাচ ফুরােয় না। কোথাও তাদের ডাক পড়ে না। তারা নিজের এখানে-ওখানে ঢু মারে। না— নেই, কোথাও তাদের জন্যে ফাঁকা জায়গা নেই, সব ভরাট। তারা ন’মাসের যুদ্ধের সময়কার সহযােদ্ধাদের খুঁজে বের রার চেষ্টা করে, অনেকেই নেই, কে কোথায় ছিটকে পড়েছে, খোঁজ নেই। বাকি যে ক’জন আছে এখানে-ওখানে তাদের কারো কারো অবস্থা তাদের মতোই। আর কেউ কেউ কীভাবে তারা কউ জানে না, রঙ-চঙা, বিরাট অফিস খুলে বসেছে, বার দু’তিন ওসব অফিস থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে তারা আর ওদিক মাড়ায় না। এভাবে মাসের পর মাস যায়। তখন একসময় হতাশা ডানা মেলে উড়াল দেয়, সরে না, ডানা মেলে তাদের চারপাশে ঘিরে থাকে। শেষে বাহাত্তরের এক বিকেলে চার যুবক মরিয়া হয়েভাবল, এভাবে আর নয়, আজ এসপার নয় ওসপার।

তখন চার যুবকের অবশিষ্ট ছিল হতাশা, ক্রোধ, সামান্য অস্থিরতা। আর চকচকে ছ-ঘড়ার একটা পিস্তল। পিস্তলটি আগের, বাকিগুলাে গত এক বছরের সঞ্চয়। যুদ্ধ শেষে যখন তারা ফিরে এল তখন তাদের সঙ্গে ছিল, দু’টো এসএমজি, দু’টো স্টেন, রাইফেল এসব। তারা অস্ত্র-শস্ত্র জমা দিল নির্দেশমতাে। এখন তাদের মনে হয় সে সময়েই জমা পড়ে গেছে তাদের ইচ্ছে, আশা এবং গন্তব্যস্থল। সঙ্গে থাকল ছ-ঘড়ার পিস্তল, ইমামের বড় প্রিয় জিনিস। আবেদ বলেছিল, ‘ওটা জমা দিবি না?’ মাথা নেড়েছিল ইমাম, ‘তাের কিছু আছে, আমার নেই, এই পিস্তলটাই ন’মাসের স্মৃতি হয়ে থাক আমার কাছে।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় আবেদ গুলি খেয়েছিল ডান পায়ে, এখনো একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে, ওভাবেই হাঁটতে হবে সারাজীবন। মুনীরের শরীর ভেঙে গেছে ধরা পড়ার পর নিত্যনতুন কায়দায় মার খেয়ে, সে পালাতে পেরেছিল বটে, কিন্তু তার ভাঙা শরীর আর ঠিক হবে না। ইমাম আর ইসরাইল মোটামুটি অক্ষত, কিন্তু সুস্থ শরীর নিয়েও তারা আরাে বেশি নুয়ে পড়েছে।
পিস্তলটা থেকেই গেছে তাদের সঙ্গে, না তার কোনাে অপব্যবহার করেনি তারা, চকচকে পিস্তল— সে বড় প্রিয় জিনিস, তাকে তুলে রাখা হয়েছিল খুব সঙ্গোপনে। কখনাে চারজন ঐ দিনগুলোর গল্প করতে করতে বের করে আনত পিস্তলটা, নেড়ে-চেড়ে দেখত।

এখন শেষ বিশ্বাসের মতাে সে পিস্তল তারা বুকের মধ্যে আকড়ে ধরেছে। চার যুবকের মধ্যে আবেদ ছিল সবচাইতে নরম, এখন তার ক্রোধ যেন চারদিকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে দেবে, যেন তৈমুর লঙ্গের মতাে খোঁড়া পা নিয়ে সেও বিশাল এলাকা ধ্বংস করে দিতে পারে। তার ডান পায়ের যে অংশে গুলি লেগেছিল, সেই ক্ষতস্থানই যেন তারবসমস্ত ক্রোধ, অস্থিরতা আর অপমানের উৎস।

আর এক বিকেলে পিস্তলটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে প্রথমে মুনির মনস্থির করে ফেলল। ইমাম যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বাবা-মা , ভাই-বােন কাউকেই খুঁজে পায়নি। যেখানে ছােটখাটো বাড়ি ছিল তাদের, সেখানে ভাঙা ইট-বালি স্তুপ। হ্যা, বােঝা যাচ্ছিল, এখানে একসময় ছােট একটা বাড়ি ছিল, সামনে ছােট একটা সুন্দর বাগান। ইমাম শুধু একবার চিৎকার করে উঠেছিল, তারপরেই থেমে গিয়েছিল, কাঁদেনি, যেন সে জানতােই এরকম হবে। মুনীর আর বাড়ি ফিরে যায়নি, বাবার সঙ্গে তার বিশ্বাসে মেলেনি। আবেদ আর ইসরাইলের কোনাে পিছুটান ছিল না, তারা বাকি দু’জনের সঙ্গে থেকে গেল। ইমাম আর তারা তিনজন ইট-বালু সরিয়ে দু’টো ঘর তুলেছিল। তারা চারজন থাকত। মাঝে মাঝে ইমামের কি কিছু মনে পড়ত? সে যেমন মাঝে মঝে বলত — ‘বােনটার বড় জানালায় দাঁড়ানাের অভ্যাস ছিল, এমনিই দাঁড়াত, আমি ধমক দিতাম।’ এ ধরনের কোনাে কথাই তার কখনাে সম্পূর্ণ হতাে না, একটা দীর্ঘশ্বাস খুব সঙ্গোপনে প্রভাব বিস্তার করে তার গলার স্বর আটকে দিতাে।

সে বিকেলে শীর্ণ শরীরে চার যুবক সারাদুপুর ঘুরে এসে ম্লান মুখে বসে আছে, কেউ কারাে দিকে তাকাচ্ছে না। মুনীর উদাসীন চোখে পিস্তলটা নেড়েচেড়ে দেখছিল, তখন হঠাৎ কি আশ্চর্য, তার মনে হয় পিস্তলটা যেন বলে উঠলো, ‘ছেলেরা আমি তো আছি।’
শুনে মুনীর খুব চমকে যায়, তুমি আছ?
‘হ্যাঁ, আমিও আছি, স্থির একাগ্র’ পিস্তল বলল, দেখতে পাচ্ছ না?’
‘পাচ্ছি তুমি হাতের মুঠোয়, এটুকুই।’
‘শুধু এটুকু?’
‘হ্যাঁ আর কি?’
‘আর কিছু দেখছ না, বুঝছ না?’
মুনীর একটু ভাবে, মাথা নাড়ে— ‘হ্যাঁ দেখছি, বুঝেছি— কিন্তু …।’
কোন কিন্তু নয়, আমি যার হাতে আমি তার, সে আমাকে যেভাবে ব্যবহার করে আমি ঠিক সেভাবেই ব্যবহৃত হই।
মুনীর একটু মাথা ঝাঁকায়, ‘কিন্তু এইমাত্র বছরখানেক আগের কথা, তুমি তখনাে আমাদের হাতেই ছিলে, অন্য কাজে।’
পিস্তল যেন মুনীরের মুখে দিকে তাকিয়ে হাসে, তারপর খামোখাই আমাকে ফেলে রাখলে, এই এতটা সময় …!’
‘তুমি বলছ?’

মুনীর শুনল পিস্তল খুব গাঢ় গলায় বলল, ‘আমি বলছি।’
সামান্যক্ষণ ভাবে আবেদ, তারপর সে লাফিয়ে উঠে বাকি তিনজনের দিকে তাকায়, খুব জোর গলায় বলে, ‘আমাদের একটা পিস্তল আছে।’
বাকি তিনজন নিশ্চুপ।
মুনীর আবার জোর গলায় বলে, ‘আমাদের একটা পিস্তল আছে, আর আছে গুলি।’
বাকি তিন যুবক ম্লান-বিমর্ষ চোখ তুলে তাকায়, মুনিরের দিকে, পিস্তলের দিকে।
মুনীর এবার চেঁচিয়ে উঠল— ‘আর আমরা পিস্তল চালাতে জানি।’
আবেদ ক্লান্ত গলায় বলে, ‘আমিও ভেবেছি, কিন্তু …।’
মুনীর দু’হাতে পিস্তল আঁকড়ে ধরে হিংস্র গলায় বলে, ‘না— কোনাে কিন্তু নয়, বল তােরা রাজি?’
বাকি তিনজন ছিল গররাজি। ইসরাইল বলল, ‘এটা তাে কোনাে সমাধান নয়।’
মুনীর হাসে— ‘তবে তুই একটা সাজেশন দে, এক বছর তাে দেখলাম, এখন দেখি তুই কোনাে সমাধান দিতে পারিস কি না।’
ইসরাইল মাথা নাড়ে, ‘না আমি ঠিক কথা বলছি না, আমি বলতে চাচ্ছিলাম এরকম কিছু করব বলে আমরা যুদ্ধে অংশ নেইনি।’
মুনীর হাসে, ‘আমরাও নেইনিরে হারামজাদা, আমরাও অন্যরকম ভেবেছিলাম।’ ইসরাইল চুপ।
আবেদ তখন হঠাৎ হিংস্র গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হ্যাঁ আমি রাজি মুনীর, ইসরাইল তুই দ্যাখ, এই যে আমার ডান পা, গুলি লেগেছিল, ডান পায়ে গুলি খেয়ে সারাজীবন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটব আর মানুষের করুণা কুড়াব, এজন্যে যুদ্ধে যাইনি।’
ইসরাইল পরাজয়ের ভঙ্গিতে মাথা দোলায়, এদিক-ওদিক তাকায়, চুপ করে থাকে।
আবেদ বলল, ‘ধরে নিচ্ছি, তুই যাচ্ছিস আমাদের সঙ্গে … হ্যাঁ তােকে যেতে হবে।’
ইসরাইল হাসে, ‘যাব, ন’মাসের আদর্শকে আজ না হয় থােড়াই কেয়ার করব।’
মুনীর তার দিকে পিস্তল উচিয়ে ধরল, হ্যা, তাই করবি। আমাদের ন’মাসের ঐ আদর্শ ধুয়ে-মুছে যাওয়ার জন্যে গত একটা বছর কি যথেষ্ট নয়, তাের কি তা মনে হয় না ধীরস্থির ইমাম মৃদু অথচ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘ঐ আদর্শ ধুয়ে মুছে যাক, তুই কি তাই বলবি?’
মুনীর তার দিকে ফিরল না, ‘হ্যাঁ, আমি তাই বলব, আর সবাই যা ইচ্ছে করে বেড়াবে আর আমরা হাত ধুয়ে বসে থাকব——না, অমন বােকামির মধ্যে আমি আর নেই।’ ইমাম হাসে, ‘আমিও না, ঢের হয়েছে, আর নয়, হয়তো একা একাই কিছু একটা করে বসতাম, কিন্তু যখন সবার সামনেই কথা উঠল, তখন খুলে-মেলেই বলছি; হ্যাঁ আমি রাজি, আমি আর কিছুই ভাবব না।’
ইমাম এত সহজেই রাজি হয়ে গেল যে আবেদ আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, ‘আজ শালা দেখিস, সব উল্টেপাল্টে দেবাে।’

মুনীর তাকে থামায়, ‘অমন লাফাস না; বাঁ পা’টাও যাবে।’
ইসরাইল হঠাৎ মৃদু গলায় বলে, ‘আকবরের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল।’
আকবর ওদের বহুদিনের পুরনাে বন্ধু; সামনা-সামনি যুদ্ধে অসম্ভব নাম করেছিল,
অসম্ভব হাসতে পারত, নিজেও হাসত সেরকম। সেই আকবর এক বিকেলে হঠাৎ মরে গেল। বহুদূর থেকে এসেছিল দলছুট একটা গুলি, আকবর তখন এক বাঙ্কার থেকে ইয়ার্কি মারতে মারতে অন্য বাঙ্কার যাচ্ছিল, গুলি খেয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়ল, মুখে তখনাে হাসি।
ইসরাইলের কথা শুনে ইমাম মুহূর্তের মধ্যে ওর দিকে ফিরল, ‘কি বললি, আকবরকে মনে পড়েছে?’
ইসরাইল মৃদু হেসে বলে, ‘হ্যা তুই জানিস, ইমাম হেসে ওর কাঁধে হাত রাখে। ‘আকবর আমারও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল; আমাদের সবার … আর তুই জানিস যখন যুদ্ধ শেষে ফিরে এলাম, দেখলাম আমাদের বাড়িটা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, আমার বাবা মা, ভাই-বােন— কারাে কোনাে খোঁজ নেই, কেউ বেঁচে নেই; ওদের কথা আমার সবসময় মনে পড়ে; এই মুহূর্তেও মনে পড়ছে; তুই জানিস?’
ইমামের হাত ইসরাইলের কাঁধে ক্রমশঃই চেপে বসছিল। ইসরাইল আলগােছে সে হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি ওসব কিছু ভেবে বলিনি। ওর কথা মনে পড়ল তাই বললাম, ওসব কথা থাক… আমি বলছি আমি রাজি।’
মুনীর বলল, ‘সাবাস, কিন্তু তাের মনে যদি সামান্য দ্বিধাও থাকে তাই বলছি, তুই শুধু গত এক বছর আমাদের অবস্থাটা ভেবে দেখ, কিছু বাদ দিবি না, সেই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, আজকের দিন পর্যন্ত সবকিছু এক এক করে ভাব । আমরা কি কোনাে ভুল করছি?’
ইসরাইল অনেকক্ষণ ধরে হাসল— ‘আমাকে কি ছেলে মানুষ পেয়েছিস, এতকিছু বলার কি প্রয়ােজন, আমি যেন কিছু বুঝি না! সবকিছু আমার ভাবা আছে মুমীর, নিজেদের অবস্থা সে তাে প্রতিমুহূর্তেই অনুভব করছি। তবুও যদি ভুলের কথা ওঠে, বলব— আমাদের এই ভুলটা সবচেয়ে প্রয়ােজনীয় ভুল।’
আবেদ আবার আনন্দে লাফায়, ‘চমৎকার, চমৎকার।’
ধীর-স্থির ইমাম হাত তুলে সবাইকে থামায়, মৃদু হাসে, ‘একটা কথা… আমার কি পারব?’
ঘরের ভিতর সামান্য সময়ের জন্য নীরবতা নামে।
শেষ বাকি তিনজন একসঙ্গে বলে, ‘পারব, কেন পারব ন, পারব।’
‘পারব?’ —ইমাম আবার জিজ্ঞেস করে।
‘তুই বড় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিস’ —মুনীর তাকে থামায়– ‘এ এমন কিছু কঠিন নয়,
দিনে দশটা ঘটছে, আনাড়ি ছেলেদের হাতেও আর তুই বলছিস আমরা পারব কি না!’
‘তবে আরেকটা কথা, এভাবে নামছিস যখন তখন জেনে নেওয়া দরকার— আমাদের বােধহয় ফেরার পথ থাকবে না।’
‘সে প্রয়ােজনই নেই।’
‘আরেকবার ভাব।’
বাকি তিনজন ভাবে। শেষে মুনীর যেন তুড়ি মেরে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলে, ‘কে ফিরবে, কেন ফিরবে? না— আমাদের ফেরার দরকারও নেই… খুব বললি, যেন যে পথ ছেড়ে যাচ্ছি সে পথ কত আনন্দের।’
যে ইমাম মুচকি হাসে— ‘ক্ষেপেছিস কেন? আমি শুধু ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে নিলাম, এখন কাজে নামা বাকি।
আবেদ, কিছু ভেবেছিস?’

তাদের সময় নষ্ট করতে হয় না, খুব অল্প সময়েই একটা প্লান দাঁড়িয়ে যায়। তারা ঠিক করল, আজ সন্ধ্যের দিকে তারা কোনাে বিপণিবিতানের আশপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। সুযােগ পেলেই কোনাে ড্রাইভারের নাকে পিস্তল ধরে গাড়ি নিয়ে হাওয়া হবে। তারপর অপেক্ষাকৃত নির্জন এলাকায় গিয়ে সুযােগ-সুবিধে মতাে দু’একটা ছিনতাই, ব্যাস। সবশেষে গাড়ি ফেলে পকেটভর্তি টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসা। এই প্ল্যান চারজনের, তারা শীষ বাজায় মনের আনন্দে, কোনাে বিপদের সম্ভাবনা নেই, বাহাত্তরের ঢাকা শহরে এসব কোনাে ব্যাপারই নয়। বিকেলের পরপরই তারা বের হলাে। এখান থেকে তাদের গন্তব্যস্থল বেশি দূর নয়, এটুকু পথ গাল-গয়ে খুব সহজেই হেঁটে মেরে দেওয়া যাবে। তারা খােশ মেজাজে এগুলাে। তবে তারা কেউ চোখ-মুখ থেকে চাপা উত্তেজনা দূর করতে পারে না। আবেদের কোমরে গোঁজা পিস্তল, সে বারবার সেখানে হাত রাখে। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছে তারা রেকি করে নিলাে। এ খুব সহজ কাজ তাদের জন্যে। জায়গাটা খােলামেলা, কোথেকে গাড়ি হাইজ্যাক করতে হবে, তারপর কোন পথে তারা পালাবে, তা তারা খুব সহজেই ঠিক করে নেয়। এখন শুধু জায়গামত দাঁড়িয়ে থাকা এবং সময়মতাে কোনাে নাকে পিস্তল ধরা।
সন্ধ্যেবেলা, এদিকে লােকজন বাড়ছে। অধিকাংশ গাড়ি গিয়ে থামছে বিপণি— বিতানের একদম গেটের কাছে, ওদিকে ভিড় বেশি, মেরে-কেটে বেরিয়ে ও কঠিনই হবে। তার চেয়ে বরং একটু অপেক্ষা করাই ভালাে, এদিকটায় ভিড় হালকা-পাতলা, খুব সহজেই কেটে পড়া যাবে। তাদের অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলাে না। রাস্তার এপাশে দাঁড়িয়ে আর আবেদ আর ইমাম, কিন্তু তারা কেউ লক্ষ করেনি। উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে রাস্তার ওপাশ থেকে মুনীর দু’হাত তুলে নাড়লে আবেন আর ইমাম দেখল। হ্যাঁ এটাতেই দিব্যি কাজ চলবে, মাঝারি আকারের নতুন গাড়ি, ভালাে স্পিড তোলা যাবে। আর গাড়িটা বলতে গেলে প্রায় নাকের ডগায় এসে থেমেছে।
ড্রাইভার আরােহীদের নামিয়ে দিয়ে এসে গাড়ি ঘুরিয়ে নিচ্ছে, মাত্র হাত বিশেকের ব্যাপার।

আবেদ কোমরে গোঁজা পিস্তলে হাত রেখে এক পা এগিয়েছিল, কিন্তু পেছন থেকে ইমাম তাকে থামাল। হাত উঠিয়ে ইশারা করল মুনীর আর ইসরাইলকে। সামান্য কিছুক্ষণের অপেক্ষা, মুনীর আর ইসরাইল গাড়ির হাত বিশােকের মধ্যে এসে পড়লে। আবেদ আর ইমামও এগুলো।
ড্রাইভারের এদিকে খেয়াল নেই, সে তার সিটের দরজা খুলে বাতাস খাচ্ছে। তার চারজন প্রায় পৌছে গিয়েছিল, আর কয়েক পা’র ব্যাপার। এদিকে লোকজনও এত কম, তারা কেউ কিছু বােঝার আগেই নির্বিঘ্নে হাওয়া হয়ে যেতে পারবে। কিন্তু ঠিক মুহুর্তে কিছু দূরেই হঠাৎ কী যে ঘটল, তারা আগের মুহূর্তে টের পায় না। বিপণি-বিতানের। গেটের কাছ থেকে হৈ-চৈ চিৎকার ভেসে আসে, ‘গেল গেল, হাইজ্যাকার’ — একসঙ্গে অনেকের গলা শোনা যায়। তারা নিজেদের ভেতর কি ঘটে যাচ্ছে বুঝল না, ‘আবেদ ওদিকে, বলে ইমাম ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতাে ছুটে যায়। তার পিছনে বাকি তিনজন।
ওদিকে তিনটি যুবক ড্রাইভারকে নামিয়ে তারা গাড়ি প্রায় নিজেদের আয়ত্তে এনে ফেলেছিল। লােকজন চেঁচাচ্ছে বৈকি, ক্রমশই তাদের ভিড় বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তারা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে। ইমাম ছুটে গিয়ে গাড়ির চালকের দরজা আর স্টিয়ারিং হুইল ধরে ঝুলে পড়ে। ব্যাক সিট থেকে ছুরির ফলা এগিয়ে আসার আগেই আবে পেছনের জানালায় পিস্তল উচিয়ে ধরল— ‘উহ, অমনটি করতে যেও না নেমে এসাে বরং। আবেদের খোঁড়া পা, কিন্তু সে সমান দ্রুত এগিয়েছে; তার শীর্ণ অথচ রুক্ষ চেহারা, হাতে পিস্তল, ইমাম তখনাে গাড়ির দরজা আর স্টিয়ারিং হুইল ধরে ঝুলে আছে, গাড়ি থেমে গেল। পরমুহর্তে মুনীর আর ইসরাইল গাড়ির ব্যাকসিট খুলে দু’জনকে টেনে হিচড়ে বের করে আনে। কিন্তু সে দু’জনের খুব শক্ত-সামর্থ্য শরীর, তারা গা-ঝাড়া দিয়ে পালাবার পথ খোঁজে। কিন্তু আশেপাশের লােকজন নিজেদের আর ভয় নেই। বুঝতে পেরে এর মধ্যে বেশ সাহসী হয়ে উঠেছে। তারা চারদিক থেকে ছুটে এল।
ভিড় একসময় পাতলা হয়ে যায়। তারা মৃদু পায়ে বাড়ির দিকে এগােয়। ইমাম একসময় জিজ্ঞেস করে— ‘পিস্তলটা কি হলাে?’ আবেদ ফিকে হাসে, ভিড়ের চাপে কোথায় যে ছিটকে পড়ল পেলাম না।’
এখান থেকে বেশিদূর নয় চার যুবকের বাড়ি। এটুকু পথ সহজেই হেঁটে মেরে দেওয়া যাবে। আর আজ চমৎকার জ্যোৎস্না। পথে খান দুই রেস্তোরা পড়ে। তাদের একটু চায়ের তৃষ্ণা জেগেছিল, কিন্তু পয়সা নেই। তারা এগােয়। প্রথমে মুনীর ও ইমাম, ঠিক পিছনেই ইসরাইল, তার ধার ঘেঁষে আবেদ, একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *