ঈদ সংখ্যা ২০২১-এর ছোটগল্প।। দুধ-সেমাই।। নুসরাত সুলতানা
আজ রাফিন খুব খুশি। বাবা তার জন্য আজ বড় একটা পাখি বেলুন কিনে এনেছে। সেই বেলুনটা বন্ধু জাকিরকে দেখানো চাই। বায়না ধরে মায়ের কাছে যেয়ে। বলে মা আমি এই বেলুন নিয়ে আমার বন্ধুর সাথে খেলতে যাব। লিজা(রাফিনের মা) কাজের মেয়ে মনিকে বলে, ওকে রেডি করে পানির বোতলে পানি নিয়ে জাকিরদের বাসায় নিয়ে যা। ওখানকার পানি ওকে দিস না। আর আসরের নামাজের পর পরই ফিরে আসবি। আর এই চিড়া আর ছোলার প্যাকেট ২ টা জাকিরের মাকে দিস।
রাফিনের বাবা খুলনা সোনালী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপক। আর মা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।
রাফিনের জন্ম হয়েছে ছয়ত্রিশ সপ্তাহে। কারণ রাফিনের মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ ছিল। তাই ডাক্তার রাফিনকে সিজার করে দ্রুত বের করে ফেলে। সিজারের পরে দেখা গেল; হাত-পা গুলো অতিরিক্ত চিকন হয়ে জন্মেছে রাফিন।
আর এত দুর্বল যে দুধ চুষে খেতে পারত না। তাছাড়া
ডায়বেটিস এর কারণে লিজার বুকে তেমন দুধ আসত না। রাফিন কৌটার দুধ খেয়ে বেড়ে উঠছে। তিন-চার বছর বয়সে যখন স্কুলে ভর্তি করা হল। দেখা গেল; রাফিন কারো কথার উত্তর দেয় না সহজে। আর কথাও কম বলে। রাফিনকে নেয়া হল স্পীচ থেরাপিষ্ট এর কাছে। স্পীচ থেরাপিষ্ট বললেন। রাফিনকে টিভি, মোবাইল জাতীয় গ্যাজেট কম ব্যবহার করতে আর বেশি বেশি বাচ্চাদের সাথে মেশাতে। সেই থেকে লিজা খুব চেষ্টা করে সবসময়ই একটু স্পষ্ট কথা বলা আর চটপটে বাচ্চাদের সাথে রাফিনকে মেশাতে।
এইরকম ভাবে একদিন বাসার পাশে খেলার মাঠে পরিচয় হয় জাকিরের সাথে। রাফিন পড়ে ড্যাফোডিল কিন্ডারগার্টেনে নার্সারিতে আর জাকির পড়ে ব্র্যাকের স্কুলে ওয়ানে। জাকির বয়সে প্রায় দেড় বছরের বড় রাফিনের। জাকির একটু কালো নাদুসনুদুস আর লম্বা রাফিনের চেয়ে। জাকিরের সঙ্গে মিশে খেলা-ধুলা করে রাফিনের কথা-বার্তা ও আচরণে বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন হওয়াটা শুরুতেই রাফিনের বাবা মায়ের দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর একদিন যেয়ে লিজা জাকিরের মায়ের সাথে দেখা করে আসে। আর রাফিনের সবকিছু খুলে বলে অনুরোধ করে জাকিরকে যেন মাঝে মাঝেই তাদের বাসায় আসতে দেয়। জাকিররা একটা টিনের ছাদের বাড়িতে থাকে। কথায় কথায় লিজা জানতে পারে ; জাকিরের বাবা ঢাকা-যশোর এর হাইওয়ে বাস এর ড্রাইভার। টিনশেডের বাড়ি হলেও খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছেন জাকিরের মা। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং রুচির ছাপ তাতে স্পষ্ট। বিছানার চাদর টান-টান।
আর পর্দাগুলো পুরোনো হলেও পরিস্কার আর আয়রন করা। এসব দেখে ভালো লেগে যায় লিজার। লিজা আশ্বস্ত হয় যে জাকিরের সাথে মিশলে রাফিনের কোনো ক্ষতি হবে না। রাফিনের বুদ্ধিমত্তার কোনো সমস্যা ছিল না। ছিল সামাজিক যোগাযোগ এর সীমাবদ্ধতার সমস্যা। থেরাপিষ্ট বলেছিলেন; যত অন্য বাচ্চাদের সাথে মিশবে তত দ্রুত রাফিন স্বাভাবিক ও স্বাবলম্বী হয়ে যাবে।
লিজা জাকিরকে বুঝিয়ে দিয়েছে কিভাবে রাফিনের সাথে মিশতে হবে। ফুটবল খেলার সময় জাকির যেন রাফিনের দিকে আস্তে বল মারে, ক্যারামবোর্ড খেলার সময় জাকির যেন ইচ্ছা করে হেরে যায় এসবকিছু।
জাকির বুঝে সেভাবেই রাফিনের সাথে খেলে। দুজন মিলে ওয়ার্ড গেইম খেলে, হাতের লেখা খেলা খেলে।
খুব খুশি হয় লিজা জাকিরের প্রতি।
করোনার দ্বিতীয় ওয়েবে লকডাউন চলছে। আর বন্ধ হাইওয়ে পরিবহন। বসে আছেন জাকিরের বাবা হাত গুটিয়ে বাসায়। এরই ভেতর ঢাকা এসে চেষ্টা করেছেন অন্য কাজ কর্মেরও কিন্তু বন্ধ সমস্ত পরিবহন। জাকিরের মা চেষ্টা করছেন জাকির আর জুঁই দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার চালিয়ে যাবার। খুলনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাসায় জাকিরের মা রান্নার কাজ নিয়েছেন। সেখান থেকে পান মাসে তিন হাজার। আর আছে একটা সেলাই মেশিন। ছোট বাচ্চাদের কাপড় বানানো আর মহিলাদের পেটিকোট, ব্লাউজ বানিয়ে কোনো কোনো মাসে প্রায় সাত-আট হাজার টাকা আসে আবার কোনো মাসে আয় একেবারেই কম থাকে। চারজন মানুষের খাওয়া দাওয়া তো একেবারে কম কথা না। এবার ইদে জোটেনি কোনো ছেলেমেয়েরই নতুন কাপড়।
জাকিরকে মাঝে মাঝেই ডেকে নিয়ে আসে লিজা ইফতারে। ইফতারের পর আবার মনিকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। একদিন দূর থেকে লিজা শুনতে পায়; দুই বন্ধু ইদের দিনের পরিকল্পনা করছে।
পায়ে পায়ে হেঁটে চলে আসে করোনাকালীন ইদ। ইদের দিন সকালে রাফিনের বাবা ঘন দুধে ভেজানো লাচ্চি সেমাই খেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরে বাসা থেকে জায়নামাজ নিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে চলে গেছেন। লিজাকে বলে গেছেন যে রাফিনকে গোসল করিয়ে রেডি করে রাখো আমি ওকে নিয়ে ম্যানেজার স্যারের বাসায় দেখা করতে যাব।
গোসল করিয়ে নতুন লাল পায়জামা পাঞ্জাবি পরে প্রথমে খুশি দেখা গেলেও একটু পরেই রাফিন মুখ গোমড়া করে বসে আছে। মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এসে শাহেদ (রাফিনের বাবা) দেখে ছেলে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। শাহেদ জিজ্ঞেস করছে; কি হয়েছে আমার পাপার? মা বেশি করে বাদাম আর কিশমিশ দিয়ে জর্দা সেমাই রান্না করেছে তুমি খেয়ে চল আমরা ম্যানেজার আঙ্কেলের বাসায় ঘুরতে যাব।
রাফিন বলছে; না আ আমি কোথাও যাব না। কথা ছিও(ছিল) জাকির আয়( আর) আমি আমাদের বাছায়(বাসায়) জর্দা সেমাই খেয়ে ওদের বাছায় যেয়ে দুধ সেমাই খাব। তালপর ( তারপর) আমাদের বাসায় এসে দুজনে খেব্ব( খেলব)। কিন্তু জাকির আছেনি( আসেনি)।
লিজা এসে বলে শাহেদকে বলে, তুমি ম্যানেজার স্যারের বাসায় যাও। আমি রাফিনকে নিয়ে জাকিরদের বাসায় যাচ্ছি।
জাকিরের বাসায় যেয়ে লিজা জাকিরের মাকে বলে;
আপা জাকিরকে পাঠাননি কেন? জাকিরের মা জানান আপা আমি যেতে বলছি কিন্তু উনি যাবেন না। কারণ আমি দুধ ছাড়া নারকেল দিয়ে সেমাই রান্না করছি কিন্তু উনি বন্ধুকে কথা দিছেন দুধ সেমাই খাওয়াবেন। আমি তো আপা দুধ যোগাড় করতে পারি নাই। আমার সাথে অনেক ঝামেলা করছে ক্যান আমি দুধ দিয়ে সেমাই রান্না করিনাই। ওর বাপ অনেক বকাঝকা করছে। বলছে এষ! আইছে আমার জমিদার! ওনার জন্য দুধ দিয়ে সেমাই রান্না কত্তি অবে! বাপের ধমক খাইয়া মুখ গোমড়া কইরা বইসা রইছে।
লিজা জাকিরের মায়ের হাতে এক প্যাকেট ডানো দুধ, চিনি, ২ প্যাকেট সেমাই, বাদাম আর কিশমিশ দিয়ে বলে আপা আপনি নিজ হাতে ওদের জন্য সেমাই রান্না করে নিয়ে আসেন।
এরই মধ্যে লিজা জাকিরের জন্য কেনা নতুন পায়জামা পাঞ্জাবি জাকিরকে দিয়ে বলে যাও চটপট করে গোসল করে জামা বদলে আস। গোসল করে নতুন পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে জাকির খুব খুশি। লিজা দুই বন্ধুকে বলে; কোলাকুলি কর। তৈরি হয়ে গেছে জাকিরের মায়ের হাতের দুধ সেমাই। দুই বাটি ভর্তি করে সেমাই নিয়ে আসে দেয় জাকিরের মা দুই বন্ধুকে। দুই বন্ধু হাসি-গল্পে মেতে ওঠে সেমাই খেতে খেতে।
জাকিরের মা দরোজার আড়ালে চোখের পানি মোছেন।
লিজা একেক পর এক ক্লিক দিয়ে চলে স্মার্ট ফোনে। ধরে রাখে ছেলের আনন্দঘন মুহূর্ত।