ঈদ সংখ্যা ২০২১- এর ছোটগল্প।। উৎকোচ।। আহমেদ আববাস
‘কিরে আঠারো হাজার কেন? মহাজন কি কম দিয়েছে?’
নাজিমদ্দি কাতরকন্ঠে আবদারের সঙ্গে জানায়, ‘স্যার আমি দুই রাইখ্যা দিছি।’
‘তোর জ্বালায় আর পারি না। সব জায়গায় তুই হাত মারিস’।
‘কী করবো স্যার? গরিব মানুষ, আপনাদের দয়ায় উপরই তো বাঁইচে আছি।’
‘ফাজলামো করিস না। এইসব উপরি’র কথা কাউকে কখনো বলবি না। না হলে লাভের গুড় পিঁপড়েয় খাবে।’
‘কী-যে কন স্যার, আমি কি পাগল নাকি?’ আশ্বস্থতার সঙ্গে জবাব দেয় নাজিমদ্দি।
ওসি এলএসডি’র মোবাইল স্ক্রিনে মহাজনের মোবাইল নাম্বার ভেসে ওঠে, ‘স্যার আপনার বিশ আমার ম্যানেজারকে দিয়্যা পাঠায় দিছি, পাইছেন তো?’
’হ্যাঁ সবকিছু ঠিকঠাক বুঝে পেয়েছি। কোনো অসুবিধা নাই।’ আঠারো হাজার পেয়েও সম্পূর্ণতার স্বীকৃতি দেয়।
সৌম্যদর্শন এবং চটপটে স্বভাবের তরুণ বয়সি নাজিমদ্দিকে ওসি এলএসডি বেশ পছন্দ করে। বিভিন্ন সময় ব্যক্তিগত সুযোগ সন্ধানে তাকে ব্যবহার করে। আর এই পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর ভর করেই নাজিমদ্দি প্রশ্রয়টা নেয়।
কেয়ারটেকার শাসনামলের শেষদিকে হঠাৎ বাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। এ সময় ন্যায্য ও স্বল্পমূল্যে চাল বিতরণের জন্য বিজিবি কর্তৃক ‘ডাল-ভাত’ নামে একটি কর্মসূচিও চালু করা হয়। সরকারি নির্দেশে গুদামজাতের জন্যে ২৮ টাকা কেজি দরে চাল সংগ্রহ অভিযান চলছিল। তখন ধান-চালের উঠতি মরসুম। বাজারে চালের মুল্য কম অর্থাৎ কেজি প্রতি ছাব্বিশ টাকা হওয়ায় মিল মালিকদের মাঝে সরকারি গুদামে চাল সরবরাহের হিড়িক লেগে যায়। প্রাথমিকভাবে প্রতি মিল মালিকের জন্যে ৫১৭ বস্তা চাল জমা দেবার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু মুনাফালোভী এবং অতি উৎসাহী ব্যাবসায়ীগণ ওসি এলএসডি’র যোগসাজশে তিন থেকে চার হাজার বস্তাা চাল গুদামে জমা দিতে সক্ষম হয়। নিয়মমাফিক সমস্ত চালই স্থানীয় গোডাউনে সংগ্রহ করার কথা। কোনো খাদ্যগুদামে জায়গা না হলে তখন অন্য বড় গোডাউনে স্থানান্তর করা করা হয়।
নাজিমদ্দি চাল স্থানীয় গোডাউনে না এনে ওসি এলএসডি’র সঙ্গে আঁতাঁত করে মিল থেকে সরাসরি জেলা কেন্দ্রীয় গোডাউনে জমা দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এতে মহাজনের লাভ স্থানীয় খাদ্যগুদামে চাল গুনগতমান যাচাইয়ের সম্মূখীন হতে হচ্ছে না। আর ওসি এলএসডি’র লাভ বিশ হাজার টাকা।
কিছুদিন পর নাজিমদ্দি ঢাকা বাবুবাজার আড়তে চাল নিয়ে যায়। মাসখানেক বাদে বাড়ি ফেরে। তাকে পেয়ে মহাজন আবার চাল নিয়ে ওসি এলএসডি’র কাছে পাঠায়।
‘কিরে এতদিন ঢাকায় থেকে তো ভালোই কামিয়েছিস।’
‘না স্যার, কতই আর। শালা মহাজনের চার চোখ।’
‘আজ চুঙি (উপরি) নিয়ে কোনো ডান-বাম করবি না।’
‘চুঙি পুরা লিলে বস্তায় বুঙা লাগাতে দিবো না স্যার।’
‘আরো গাধা বুঙা না লাগালে বুঝবো কীভাবে, তুই চাল দিলি না মাটি দিলি।’
‘তাইলে স্যার চুঙি থাইক্যা চা-পানের জন্যে আমার সামান্য কিছু আবদার আছে।’
চুঙি হলো অবৈধ উৎকোচের সাংকেতিক বাচন এবং বোঙা হলো চালের নমুনা পরীক্ষা করার জন্য অগ্রভাগ সুঁচালো অর্ধ গোলাকার ধাতব ছুরি।
ওসি এলএসডি হতাশ হয়ে বলেন, ‘শালা তোর সাথে আর পেরে উঠি না। তুই তো জানিস না, আমি এখানে প্রতি বস্তায় ছয় টাকা চুঙি নিলে কী হবে। আমার খরচ আছে। এই টিসিএফকে দাও। ডিসিএফকে দাও। আরো আছে চা-পানি খরচ। আমি তো শালা শুধু গাধার মতো টাকা গুনি।’
‘তাওতো স্যার, দিন যদি কমপক্ষে চার হাজার বস্তা চাল লেন। তাতেও চব্বিশ হাজার ট্যাকা আসে।’
‘কয়দিন পর চালের বাজারদর যখন বেড়ে যাবে, তখনতো শালা তোরা চুঙি দিবি না। চাল দিতেই তোদের মহাজনের জান ফেটে যাবে।’
একসময় চালের বাজার স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বেড়ে সরকার নির্ধারিত দর টপকে যায়। মিল মালিকগণ আর খাদ্য গুদামে চাল দিতে রাজি নয়। কারণ এক বস্তা চাল মানে ছিয়াশি কেজি। ৫১৭ বস্তা মানে প্রায় আড়াই হাজার টাকা লোকসান। সচিবালয় থেকে নির্দেশ আসে কেউ চাল দিতে রাজি না হলে চাতাল-মিলের বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। এই ভয়ে ব্যবসায়ীগণ গা মোড়া দিয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে তালিকাভুক্ত প্রত্যেককে চাল সরবরাহে বাধ্য হয়।
বাড়তি বাজার দরের সময়েও আবার চাল নিয়ে আসে নাজিমদ্দি। মহাজন জানে, নাজিমদ্দি অত্যন্ত চালাক-চতুর ছেলে। অধীনস্থ অনেক লোক থাকলেও মহাজন তার প্রতি সকল কাজেই নির্ভরশীল।
‘আমি আগেই বলছিলাম, বাজার দর বাড়লে তোদের মহাজনের কলজেটা ফেটে যাবে।’ ওসি এলএসডি তার ভবিষ্যৎবাণী পুনর্ব্যক্ত করে।
‘কী করবি স্যার, মহাজনও তো ব্যাবসা কর্যা খায়।’
‘কিন্তু এখনতো শালা আমার লোকসান। কোনো পয়সাই নাই। চুঙিটাই আমার উপরি। উপরি না পেলে সংসার চলে কীভাবে! আমরা ছাপোষা চুনোপুঁটি মানুষ।’ একটু থেমে আবার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘জানিস এই দেশে সব জায়গায়ই উপরির খেলা। পরপর তিনবার দেশটা দুর্নীতিতে হ্যাট্রিক করলো। কেন করবে না, আমার মা’র আপন চাচাত ভাই অর্থাৎ আমার মামার ঢাকায় চারটে বহুতল বাড়ি। সে সামান্য একজন কাস্টমস ইন্সপেক্টর।’
‘নরসিংদীর নাকি কোন ফকিন্নির ছাওয়াল গ্যাসমিটার বেইচ্যা কয়েক’শ কোটি ট্যাকা কামাইছে। আর আমি তো স্যার গরিব মানুষ, ছোটোবেলা থাইক্যা চায়া-চিন্তাই বাঁইচা আছি।’ বলে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে থ মেরে যায় নাজিমদ্দি।
মনেপড়ে, কিশোর বয়সেই সে বিড়িতে দম রাখে। ছোটোবেলায় মানুষের বাড়িতে বিনি পয়সায় হুকো টানার কথা। পয়সা না থাকলে রাস্তায় কাউকে সিগ্রেট টানতে দেখলেই তার পিছু নিতো তখন। কখন সে পথচারি মাটিতে সিগ্রেটের বাটটা ছুঁড়ে ফেলে দেবে। সেই অবশিষ্টাংশ মুখে দিয়েই মনেহতো অমৃত পান। তাছাড়া প্রতিবেশি এক ধুমপায়ী আতœীয়ের খোলা আটচালা ঘর থেকে সকাল বেলা সবার অলক্ষে সিগ্রেটের বাট সংগ্রহ।
একবার দুরের কোনো গ্রাম থেকে বাড়ি ফিরতে দেখে পকেট একেবারে শুন্য। সাথে আরো দুজন থাকলেও কারো কাছেই টাকা ছিল না। চরম নেশা ধরে যায় তার। সন্নিকটে বাজারমতো একস্থানে কয়েকটা টং দোকান চোখে পড়ে নাজিমদ্দির। দেখে একটু ফাঁকা স্থানে এক কিশোর পান-বিড়ির দোকানে বসে আছে। ফন্দি আঁটে সে এবং আচমকা বলে ওঠে, ‘এই ছোঁড়া তোর টাকা খুচরা হইছে।’
‘কীসের টাকা’ দোকানি যেন আকাশ থেকে পড়ে।
‘কেন ঐ যে এক প্যাকেট বিড়ি লিয়ে দুপুর বেলায় তোক্ পাঁচ টাকা দিয়ে গেনু, দুই টাকা দিয়্যা তুই কইলি আসার সময় দেড় টাকা লিয়েন, এখন ভুলে গেলে হবি, দে আর এক প্যাকেট বিড়ি দে।’
দুজনের বাক-বিতন্ডা এবং হৈ-হুল্লোরে পথচারিসহ আশপাশের লোকজন কৌতুহুল নিয়ে ছুটে আসে। নাজিমদ্দির দুজন শক্তিশালি সাক্ষী থাকায় আগত জনতার মধ্যস্থতায় দোকানি ছেলেটি তাকে এক প্যাকেট বিড়ি দিতে বাধ্য হয়।
‘কিরে ব্যাটা চুপসে গেলি কেন?’ ওসি এলএসডি’র ধাক্কায় যেন সন্বিত ফেরে।
‘যা আমার জন্যে এক প্যাকেট বেনসন সিগ্রেট নিয়ে আয়।’
খুচরা টাকা না থাকায় ওসি এলএসডি তার হাতে পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দেন। নোটটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়েই তিনি চিন্তায় পড়ে যান। কিছুক্ষণ পর নাজিমদ্দি এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসে তার হাতে দেয়। কিন্তু পঁচাশি টাকা বাদে অবশিষ্ট টাকা ফেরত দেয় না। চাইলে বলে, ‘স্যার কিছুদিন ধইরে একেবারে নিরামিষ। মহাজন হারামজাদা খরচাপাতি কমায় দিছে। আপনার পায়ে ধরি স্যার, এইডা আর চাইয়েন না। এইডা আমার চুঙি।’
অনেকদিন পর প্রাপ্তির আনন্দে চুঙির চারশ পনের টাকার ওপর ক্রমাগত চুমু খেতে থাকে নাজিমদ্দি।