ছোটগল্প।। যুদ্ধ যুদ্ধ খেইল।। বুলবুল চৌধুরী
দূতী হয়েছে কালাদাদী। ওদিকে ফুলতারা ঘােষণা দিয়েছে, খুনি মাজম বাগমারকে বিয়ে করা দূরে থাক, জ্ঞানে তার সামনেও কখনাে পড়তে গেলে তাে! তা সত্ত্বেও মুক্তিযােদ্ধার আকুতি বুঝে বুড়ি টায়ে টায়ে চলছে ওই মেয়ের পিছু পিছু। অবশেষে মাস দেড়েকের চেষ্টায় হয়েছে সিদ্ধি লাভ। তাই সুসংবাদটা মাজমের কানে পৌছে দিতে কালাদাদী তাকে টেনে নিয়েছিলেন আড়ালে। বলেছিলেন, ফুলতারারে আমি বশ লওয়াইছি। যা, কপালে আইজ হাইঞ্জাকালে তুই পাবি মাইয়ার দেখা।
ফুলতারার বাবা ইউনুস মুন্সি রাজাকার। দেশ স্বাধীন করে গ্রামে ফিরতেই বিষয়টা জানতে পারে মুক্তিযােদ্ধা মাজম বাগমার। তারই মেয়ে ফুলতারার সঙ্গে ভালােবাসার সম্পর্ক থাকলেও যুদ্ধের নিয়মে ইউনুস মুন্সি শত্রু গণ্য হওয়ায় তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছিল সে। তারপর অপরাধীর চোখ বেঁধে নেওয়া হলাে লক্ষ্যা নদীর পাড়ে। ওই সময়ে আশপাশের মানুষজন ভিড় করে এসেছিল রাজাকারের মৃত্যুদৃশ্য দেখতে। মাজম বাগমারের হাতে স্টেনগান। সঙ্গের অন্য দুই সহমুক্তিযােদ্ধা সােহরাব এবং মিনজুর কাঁধে ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল। তবে সে প্রেমিকার বাবার বুকে গুলি চালাতে চায়নি। কিন্তু আবার ওই দলনেতা আদেশ করতেই রাজাকারের বুক বরাবর প্রথম গুলি ছুড়েছিল মিনজু। দ্বিতীয়বারে সােহরাব। নিজের রক্ত নিজে ধুয়ে যেতে যেতে গুলিবিদ্ধ রাজাকার চিৎকার করে বলছিল, আল্লাহু আকবার। পাকিস্তান জিন্দাবাদ। তােমরা ভুল করতাছ বাবারা! পাকিস্তানই হইতাছে আমাগাে আসল দেশ।
ওই দৃশ্যে মুক্তিযােদ্ধা মাজম বাগমার ঘাবড়ে গিয়ে নিজের অজান্তে স্টেনগানের ব্রাশফায়ারে ঝাঝরা করে দিয়েছিল প্রেমিকার বাবা ইউনুছ মুসীর সর্বাঙ্গ। ফলে ফুলতার নাকি পিতার হন্তারক প্রেমিকের ফাঁসি চেয়ে রেখেছে আল্লাহর দরবারে। সৈই মেয়ে, কী একবার সব ভুলে নতুন করে পুরানো প্রেমিককে ধরা দিতে রাজি হয়েছে?
ঠিক যে, বুড়ির কাছ থেকে এমন সংবাদ শুনে খানিক সময় হতবাক ছিল সে। তবে আবার নিজেকে সামলে গা ঝাড়া দিয়ে প্রশ্ন করেছিল, ওর তাে ঘরের বাইর হওন মানা। তাইলে তুমি কেমনে পাওয়াইবা আমারে ফুলতার দেখা?
উত্তরে বুড়ি ফিসফিসানাে স্বরে বলেছিল, মাইয়া-পােলা রাজি তাে কী করব কাজী?
শুধু তাই নয়, মাজমকে আশ্বস্ত করতে বুড়ি আরাে জানিয়েছিল যে, কালাদাদীকে বিশ্বাস করে ফুলতারার মা। এই সুযােগে অভাগিনী মেয়েটিকে নিজের বানানাে পিঠা-পঠা খাওয়াবার নাম করে নিয়ে যাবে নিজের ঘরে এবং চলতি পথের মাকে দু’জনকে মুখামুখিই পৌঁছে দেবে কালাদানী।
অপেক্ষার প্রহর সহজে পেলােয় কই। বুড়ির কাছ থেকে মাজম বাগমার ইত্যকার খবর পেয়েছে বিকেলের ভাগে। সেই থেকে গুনে গুনে সময়ের পারাপার দিয়ে পশ্চিম আকাশের সূর্য গেল পাটে। ডুবার মুহূর্তে কাঁসার থালার মতাে বিশাল গােলাকার সূর্যখানা সারা অঙ্গে ধরেছিল কত যে লালের লালিমা! মুক্তিযুদ্ধে নেমে মাজম বাগমার রক্তের হরেক হােলি ছিটানােই দেখেছে। ওই সব শুনলে ফুলতারা বুঝত স্বাধীন দেশ পেতে বাঙালি বুকের কত রক্ত ঝরিয়েছে।
তারপর বেলা গিয়ে দুনিয়ায় সন্ধ্যার প্রলেপ নেমে আসতেই চুপি চুপি পায়ে সে বুড়ির নির্দেশ মােতাবেক গিয়ে বসেছে মুন্সীদের নতুন দেওয়া পুকুরের পশ্চিম-উত্তর কোণে। সত্যি, অপেক্ষার পালা ধুকপুকানিই শুধু জাগায় বুকের অতলে। তাতে নানা রূপের উত্তেজনা-দুর্ভাবনা এসে আষ্টেপৃষ্ঠেই জড়ায় মাজম বাগমারকে। ফুলতারা যেমন যেমন কথা দিয়েছে, তেমন তেমন দেখা হচ্ছে তাে দুয়ের? কই, সন্ধ্যা গিয়ে রাত ঘন হয়ে উঠলেও কোনাে পায়ের আওয়াজ নেই কেন! অন্যদিকে চারপাশজুড়ে জোনাকির জ্বলা-নেভার খেলাই একমাত্র জেগে থাকে দৃষ্টিপথে।
তারও বাদে ঘাটলার দিকটায় আবছায়া দুটি মানুষের উপস্থিতি সে লক্ষ্য করতে পারে। তবে স্পষ্ট করে বলা মুশকিল তারা নারী না পুরুষ? এদিকে শীত ফুরানাে আকাশের গা-জুড়ে মিটিমিটি তারা বিছিয়েছে বিছানা। মাঝে তিন দিন বয়সের ফালি নতুন চাঁদও দিয়েছে উঁকি। তবে ওর বুকে কতটুকুই আছে আলাে যে, পৃথিবীকে ভরায় জোছনায় জোছনায়। হলেও আলাে-অন্ধকারের এমনতর দ্যোতনায় বসে মাজম বাগমার মনে আশা ধরে, মানুষ দু’জনের একজন হচ্ছে ফুলতারা এবং অনাজন কালাদার্দীই আসলে। মুহুর্তেই সে মাটিতে শুইয়ে রাখা স্টেনগান হাতে তুলে নিয়ে পাড়ায় টানটান ভঙ্গিতে। মুক্তিযুদ্ধে ওই অস্ত্র দিয়েই সে কত হানাদার পাকসেনাকে খতম করেছে। দেশ স্বাধীন হলেও সেটা লগ্গা পােলার মতােই সঙ্গে নিয়ে ঘােরাফেরা কৱে মাজম বাগমার।
হ্যাঁ বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, আবছায়া আবছায়া মানুষ দুজন ঘাটলা পিছন ফেলে পুবের দিক থেকে পুকুরের ঠিক ঠিক উত্তরপাড় ধরে এগিয়ে আসছে পশ্চিমের পথে। কাছাকাছি হতেই স্পষ্ট হয় যে, তারা শাড়ি পরে আসা দু’নারী। তারপর সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে কালাদানী চাপা-স্বরে বলেন, নে, মাইয়ারে আমি তর জিগায় থুইয়া গেলাম কতখনের লাগি। যাই আমি ঘরে। পান মুখে দিয়াই কইলাম আমি ছুইটা আসমু মায়েরে ঝি মায়ের ফিরাইয়া দিয়া আসতে। বুড়ি বিদায় হতেই মাজম আর্দ্রকষ্টে ছেকে ওঠে, ফুল, ফুলতার … উত্তরে প্রেমিকের কাছে থাকা স্টেনগান ছুঁয়ে দিয়ে কঠিন প্রশ্ন ফেরায় মেয়ে। কয়, এই স্টেনগান দিয়াই না তুমি আমার বাবারে গুলি কইরা মারছিল?
হাজারাে দুশ্চিন্তা ডিঙিয়ে আশার আলােই সে ভেবেছিল ফুলতারা গােপনে তার সঙ্গে দেখা করতে আসার ঘটনায়। কিন্তু মুখােমুখি হওয়ার পরে যে আরেক ভাব ফুটে উঠেছে প্রেমিকার লক্ষণে। ওইসব আলাপে দুঃখই শুধু উথলে আসবে ঘন হয়ে। আসল কথা ঢাকা পড়বে তারই মাঝে। কিন্তু ঘাবড়ে গেলেও মুশকিল। ওতে যেন এখনকার এই তর্কের যুদ্ধে মাজম বাগমারের হার হবে।
পরমুহুর্তেই সে মুক্তিযােদ্ধার জ্ঞান দিয়ে গেরিলা কৌশল ফলায় মাথায় মাথায়। সিদ্ধান্ত নেয়, পাট জমিনের নিড়েন তুলবার সময়ে যেমন চারার বাছ গলিয়ে গলিয়ে ঘাস গুটিয়ে পালা তোলে গৃহস্থ, তেমনই সে এগোবে ফুলতারার ভাব বুঝে নিয়ে। তাই বলে, হ্যাঁ। তয় ওইতে তুই আমারে খুনি ঠাওরাইলে ভূল করবি। শােন, তুই তাে তুই, আমার বাবায় ওই রকম রাজাকার হইলেও আমি একশ একখান গুলি ফুজাইতাম তার বুকে।
অন্যজন কাঁদো কাঁদো স্বরে জবাব দেয়, তুমি-আমি এক লগে স্কুলে গেছি। কইতা, ফুল আমার পছন্দ। ওইতে বাগান করছি বাড়িতে। আসমানে ফুডি ফুজি তারাও পছন্দ আমার। কইতা, বিয়ার পরে দুইজনে বাগানে বইসা ফুলের ঘেরান লইতে লইতে দেখমু আসমানের চান-তারা কেমুন থাকে। আর দেখ দেখি, তরে যে ভালােবাইসা পাইলাম, হেও তাে আমার সাধের ফুল আর তারা মিইল্লা তর নাম হইল ফুলতারা!
প্রেমের আলাপে নড়ে ওঠে মাজম বাগমার। বলে ঠিক ঠিক। তুই আমার সব। ফুলতারারে পাইতে সামনের যত্ত শত্রু আছে, এই অস্ত্র দিয়া তুলেমূলে শেষ কইর দিতেই রাজি।
মাজম বাগমারের কন্ঠে নতুন জোয়ারের মতাে টলমলে আবেগ ঘনায়মান হলেও সঙ্গিনী অপ্রত্যাশিত এবং মরমের মূল কথাই যেন তােলে। বলে, তারও আগে আমার বাবায় মরণের কালে কি কি কইছিল শােনাও দেখি! রাজাকার হওয়ার কারণে ইউনুস মুন্সীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও মেয়ে পিতৃসুখ সামলে উঠতে পারেনি সে তাে স্পষ্ট ধরা যাচ্ছে। কিন্তু এই সত্য যেমন চিরকালের হয়ে আছে, তেমন তাে প্রেমিকাকে বুকে পেতে গিয়ে হু হু শূন্যতাই শুধু মিলছে। মাজম বাগমারের নির্দেশে ইউনুস মুন্সীর বুকে সঙ্গের দুই মুক্তিযােদ্ধা গুলি চালালেও লুটিয়ে পড়ার বদলে মানুষটা আরাে
টানটান দাঁড়িয়েছিল এবং জখম বেয়ে গড়িয়ে নামা রক্তে রক্তে পরনের সাদা-পাঞ্জাবি লুঙ্গি ভিজে চলার পাশাপাশি উপস্থিত লােকজন তার হেদানাে গলাই শুনেছে। মৃত্যুর আগ মুহর্তে ইউনুস মুন্সী বলেছিল, পাকিস্তানই আমার দেশ। আমি সইত্য। জানবা তোমরা হাজার গুলি করলেও আমার মরণ নাই।
মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে নেমে বহুধারার মরণ কাছ থেকে দেখেছে মাজম বাগমার। কিন্তু কেউ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও এমন যে অবিচল থাকতে পারে তাও প্রথম দেখা তার। সঙ্গে সঙ্গে অজান্তেই কমান্ডারের হাতে ধরে রাখা স্টেনগানের এক ঝাক গুলি ছুটে গিয়েছিল রাজাকার ইউনুস মুন্সীর দিকে। কিন্তু সেই সত্য বয়ান কোনােমতেই সে দিতে গেলে তাে প্রেমিকাকে। তাই বলে, থাম তাে, তুই থাম। তর বাবায় যে পাকিস্তানি সৈন্যগাে খবর দিয়া বাগাটুলী ক্যাম্পের এগারােজন মুক্তিযােদ্ধারে বেয়নেটে খোঁচাইয়া মারাইলাে, একবারনি খেয়াল করছস?
ফুলতারা তাও দায়ী করে প্রেমিককে। বলে, কইতে গেলে ধরন লাগে, দোষ তাে তোমাগােও আছে। কেমুন?
খালি আমার বাবায় ক্যান, দেশের কত্ত মানুষও না জানি পাকিস্তানেরে আপনা দেশ সমঝাইছে। তাইলে তাে তারাও রাজাকার। হিসাব করলে লাখে-বিলাখে ছাড়াইয়া পাইবা তাগাে নাম। তয় বাবার মরণ দিয়া আমি বুঝলাম কি, যুদ্ধ লাগনের আগে হাছা জ্ঞান আমরা দিলে পারতাম অবুঝ মানুষগুলানরে। বুঝাইতাম বাংলাদেশই আমাগে দেশ। আমরা বাঙালি।
মাজম বাগমার বুঝদারের মতাে উত্তর করে, হঁ, ভুল, ভুলই করছে তারা। ক্যান, যুদ্ধ লাগলে তুই না ওই রাজাকার বাপের মাইয়া হইয়া কইছিলি, যাও, দেশ স্বাধীন কইরা আসো। ওইতে বাঁইচা ফিরলে তুমি হইবা আমার সােয়ামি। শহীদ হইলেও তােমারে আমি জীবনে জীবনে ওই সােয়ামি মাইনা বিধবা হইয়া রইমু।
ফুলতারার রুক্ষ স্বর ফিরে আসে। ও বলে, না — তাও না, আগে কথা দিলেও আজই তুমি আমারে পাইলে তাে?
ক্যান? তর বারে মারণে?
উত্তর করে না ফুলতারা। ওর মুখামুখি দাঁড়িয়ে আছে মাজম বাগমার। এত কাছাকাছি যে, একে অন্যের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠা-নামা পরিমাপ করতে পারে। তবে এই আলাে-অন্ধকারের মেলায় কেউ কারাে মুখ স্পষ্ট দেখবার নয়। ফাঁকে চোখের ভাগে জোনাকির জুলা-নেভার খেলাটুকু আপনাতে বারেবারে ছাপ ফেলে। এদিকে দুয়ের অতলে জীবনের ওঠা-নামা জোনাকির মতােই আলাে-অন্ধকারের খেলাই তাে শুধু জমায়। তারই মাঝে অস্থির প্রশ্ন তােলে মাজম বাগমার। জানতে চায়, তরে পাইতে চাইলে মানা কিসের শুনি?
ফুলতারা বলে, জাননের ইচ্ছা হইলে শােনাে, বাবার কারণে যত না, হেরচে বেশি জানবা আমি অসতীর খাতায় নাম লেখাইছি। বিয়ার নামে অমুন ফুলতারারে তুমি ক্যান গছতে রাজি হইবা?
যুদ্ধক্ষেত্রে শক্রর গুলিতে মরতেও পারত মাজম বাগমার। তাতে দেহের যন্ত্রণা ছাপিয়ে মনে মনে শহীদ হওয়ার আত্মবিশ্বাস এবং সান্ত্বনা নিয়েই সে নিঃশব্দে বরণ ওই মৃত্যু। কিন্তু ফুলতাবার মুখে এ-কি কথা তার বেশি জটিল-কঠিন হয়ে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে বড়ই ভড়কানাে অরে সে প্রশ্ন করে, কি কস, তুই অসতী হইবি ক্যান? ছলনা করস আমার লগে, না? ফুল, ফুল, গাে, আমারে তুই আউলা করিস আর।
অন্যজন নির্বিকার জবাব দেয়, বিচার ধরলে দেখবা বাবারে যেমুন কম দোষে মরণ দিলা, আমিও কপালে হইছি গিয়া আর এক রকমের অসতী।
মাজম বাগমার অস্ফুট প্রশ্ন করে, ওই, আগে তাে তােরে এমুন পাই নাই। ভিত্রে ভিত্তে কি প্যাঁচ লাগাইলি মুখ না খুললে বুঝিও কেমনে?
সেই উত্তরে না গিয়ে ফুলতারা তােলে বাবার প্রসঙ্গ। তাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বুঝিবা বলে ওঠে, হাছা যে, পাকিস্তানের আপনা দেশ ভাবছিল ইউনুস মুন্সী। তয় জাইনাে, পাক সেনারা তারে মৌলবি ভাইবা সেলাম দিলেও বাবায় কিন্তু ভুলেও তাগো খবর দিয়া ক্যাম্পের ওই এগারােজন মুক্তিযােদ্ধারে শেষ করায় নাই। জোনাকির জ্বলে ওঠা মুহুর্তের আলাে যেমন দেখতে দেখতে মিলিয়ে যায়, পরের ভাগে তেমন নিতে আসাও তাে এক রহস্য। এদিকে ফুলতারা কথােপকথনে যেন অথৈ রহস্যেই মাজম বাগমারের ডুব-ভাস শুরু হয়ে যায়। বলে কি কস তুই? গেরামের বেকতেই কয়, ইউনুস মুন্সী আছিল … !
এতে বাদ সাধতে ফুলতারা চাপা স্বরে জবাব ফেরায়, না — এক্কেরে মিছা। আসল পাপী ফয়জুল।
ফয়জুল? ফয়জুল কেডা?
ক্যান, ভুইলা গেলা তারে? ওই যে আমার মায়ের সই, থাকে গােলপাড়া, তার পােলা? হেয় না আমারে বিয়া করতে পিছে পিছে কত্ত ঘুরছে। ডরাইছে একমাত্তর তােমারে।
উত্তেজনা বেশি জাগলে চেনা মানুষের নাম ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এই উত্তেজনা তাে আবার মিথ্যেও নয় মােটে। ফুলতারা যেমন শােনালাে, ফয়জুল কি তেমন তেমনই রাজাকারের পাণ্ডা?
তারপর মনের দুশ্চিন্তায় মাজম বাগমার বলে ওঠে, কই, কেউ তাে ফয়জুলের খবর আমারে কয় নাই। অখন বুঝতাছি দেশ স্বাধীন হইলেও বহুত রাজাকার রইয়া গেছে ফাঁকে ফোঁকে। দেখবি, এই অস্ত্র দিয়াই আমি তাগাে শেষ করমু।
ফুলতারা বলে, ফয়জুলে তাে রাজাকারেরও বড় রাজাকার। বাবায় পাকিস্তানি মিলিটারিগাে লগে ওঠা-বসা করলেও কেউর ক্ষতিতে যায় নাই। আসল খুঁডিনাডির মালিক ফয়জুল। ইউনুস মুন্সী রাজি না-থাকলেও তারে ডিঙ্গাইয়া বাগাটুলী ক্যাম্পে মুক্তিযােদ্ধা থাকনের খবর সে দিছিল পাকিস্তানিগাে। আর দোষ পড়ল গিয়া বেবাক বাবার কান্ধে
মাজম বাগমার অজান্তেই স্টেনগান এমন বাগিয়ে ধরে যেন সামনের পথ ধরে ছুটে যাচ্ছে রাজাকার চূড়ামণি ফয়জুল। আর এক্ষণই অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে তাকে গুলি-গুলিতে ঝাঝরা করতেই উদ্যত এক মুক্তিযােদ্ধা। সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার দিয়ে ওঠে, বাচন নাই, তর বাচন নাই ফয়জুল।ফুলতারা চাপা জবাব দেয়, আস্তে আস্তে কথা কও। দুনিয়া অখনাে হজাগ, সে খবর আছেনি?
মাজম বাগমার তাতে হুশ ধরলেও আরেকটি সত্য প্রশ্নের উঁকি দেখতে পায় মনের আয়নায়। সবকিছুর মাঝে সেটি তীব্র কাঁটা হয়ে বিঁধেও যায় অন্তরে। ফুলতারা অসতী হবে কেন! সেই প্রশ্নটা এবারে সে চমকে তােলে যেন গােপনে জরুরি আলাপ তুলবার মতাে করে। জানতে চায়, তুই যে অসতী কইলি নিজেরে, নিজের ইচ্ছায় পরপুরুষের গতর দিছিলি নাকি? ভাবছিলি তর বাবার শােধ লইতে মাইয়া ওই রকম করলেই মাজম বাগমারের উচিত সাজা দেওন সম্ভব?
না, ফুলতারা অসতী হইতে যাইব ক্যান?
তাইলে?
জবাব আসে, তুমি মুক্তিযুদ্ধে যাওনের পরে কোনাে খবর না থাকনে বেকতেই ধইরা লইছিল বাইচা নাই মাজম বাগমার।
মুহূর্তেই অতলের সন্দেহ ঘনীভূত রূপ পায়। তাহলে কি ফয়জুলের কারণেই অসতী ফুলতারা? সঙ্গে সঙ্গে অধৈর্য কণ্ঠ ফুটে ওঠে তার। বলে, আহ, অত্ত পোঁস ক্যান। কথারে? ফয়জুলে কি তরে জোর কইরা অসতী করল?
ফুলতারা তা শুনলেও প্রশ্ন তােলে অন্য রকমের। জিজ্ঞেস করে, আমারে তুমি পাইতে চাও?
হঁ, হঁ হের লাগিই না পাগলা হইয়া ছুইটা আসলাম তর সামনে।
প্রেমিকার আবেদনে প্রেমিক উত্তর করে, ধরাে আমারে কেউ অসতী বানাইয়া গেল, জাননের পরেও কি তুমি আমারে গছতে রাজি?
মুক্তিযুদ্ধে অনেক অনেক মা-বােন ধর্ষিত হয়েছে হানাদার বাহিনীর নারীলােভে। কপালে তেমন ধর্ষিত হয়ে ফিরলেও নিস্পাপ জেনেই আরাে বেশি বেশি ভালােবাসা দিয়ে ফুলতারাকে সে বুকে ধরতেই অধীর হয়ে আছে। মাজম বাগমার এতক্ষণ দূরত্ব বজায় রাখলেও প্রেমিকার জিজ্ঞাসায় ডান হাত আলত টেনে নেয় নিজের মুঠোয়। বলে, তাও জানবি, তুই আমারই।
না।
আমাৱে পাইতে হইলে শর্ত আছে।
কি শর্ত?
বাবারে তুমি খুন করণের কয় রাইত বাদে ফয়জুল আইসা আমারে জঙ্গলের আন্ধাইরে ফালাইয়া নারীর সতীত্ব লুট করেছে। আমারে পাইতে হইলে আগে ফয়জুলেরে বেয়নেটে খোঁচাইয়া মারণ চাই।
মুহূর্তেই মুক্তিযােদ্ধা মাজম বাগমার স্টেনগানের ব্রাশফায়ার করে চলে যেন-বা সামনের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা শত্রুকে ঘায়েল করতে। সঙ্গে সঙ্গে ফুলতারা চিৎকার দিয়ে ওঠে, করাে কি, করাে কি…?
মুক্তিযােদ্ধা তারাে বেশি অট্টহাস্যে বলে ওঠে, এইডা আমার যুদ্ধ যুদ্ধ খেইল গাে, যুদ্ধ যুদ্ধ খেইল…। তারপর গুলি ফুরিয়ে এলেও পাগলের মতাে বিরতিহীন হেসে চলে মানুষটা। বড়ই ভয় জাগে ফুলতারার। রাজাকারের খাতায় নাম লেখানাে পিতা উমেদ মুন্সীর মৃত্যু সত্য। সত্য রক্তে রক্তে পাওয়া মুক্ত স্বাধীন প্রিয় বাংলাদেশ। কিন্তু প্রেমিকের কাণ্ডে ধন্ধই অনুমান করে প্রেমিকা। এহেন অবস্থায় আত্মরক্ষা করতেই জোনাক-জ্বলা অন্ধকারের পর অন্ধকার হনহন পায়ে পেরিয়ে গিয়ে তক ঘাের অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়।
অন্যদিকে স্টেনগানের ব্রাশফায়ারের শব্দে লােকালয়ে একে অপরে কত প্রশ্নই না তােলে! তারা কোথেকে জানবে এসবের অতল। তবে একমাত্র কালাদানীই ঠাহর করতে পারেন মূলের বিষয়। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ছুট লাগান মাজম আলীর নাগাল পেতে। আর জোকারের মতাে উচ্চম্বরে না-হলেও বিড় বিড় স্বরে বলেন, আল্লাগাে আল্লা, আবারনি কোনাে সর্বনাশে পাইলাে কেউরে।