ছোটগল্প।। সোনার পাথরবাটি।। দীলতাজ রহমান

ধুম বৃষ্টি-বাদল বা খুব গরম পড়েছে তেমন নয়। খুব স্বাভাবিক একটি রাত। তবু নেবুলার ঘুম ভেঙে গেল। এরকম ঘুম তার প্রায়ই ভাঙে। কোনোকালেই তার ঘুম অত গাঢ় নয়। কিন্তু সে রাতে ঘুম ভেঙে তার খুব ছটফট লাগছিল। এর নামই কি তবে উদাস লাগা! সন্ন্যাসরোগ কি এরই নাম! যা তার কখনোই লাগে না। প্রতি রাতেই বেশ ক’বার করে তার ঘুম ভাঙে। পানি খায়। বাথরুমে যায়। ঘুম আসুক না আসুক আবার শুয়ে পড়ে। বা টিভি দেখতে দেখতে অথবা বই পড়তে পড়তে তার কত রাত পার হয়ে গেছে। আর সে জন্য যে সারাদিন তাকে ঘুমিয়ে কাটাতে হবে, নেবুলার ধাতটা তেমনও নয়। সংসারে সবার প্রতি কর্তব্য পালনে নেবুলা অতন্দ্র প্রহরীরর মতো। নিজেরটুকু করে তো করেই, যে দায় তার নয়, তাও সে করে! কিন্তু নেবুলা সে রাতে বুঝতে পারছিল না সে কি করবে! সে কি বাড়িময় হাঁটাহাঁটি করবে, না কি টিভি ছেড়ে দেখতে বসবে! ছাদে যেতে মন চাইছে। কিন্তু পরে যদি লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। তাই সে ইচ্চের লাগামটি টেনে ধরে! এক ঘুমে রাত পার হয়, এরকম ঘুম সে বহুদিন ঘুমায় না! পাশের ফ্ল্যাটে তারই মতো পয়তাল্লিশ পেরোনো মহিলার সাথে, যতবার দরজা খোলার পর দেখা হয়ে যায়, ততোবারই সে পানের লাল রসে ভেজা ঠোঁটে বলে ওঠে, ‘ওমা, আইজও আপনি এল্লাহ?

এত এল্লাহ এল্লাহ মানু থাহে কেমনতারা?’ মহিলার কথায় নেবুলা মনে মনে চটে ওঠে। মুখে বিরক্তির ভাব প্রকট হয়ে উঠতেই তাড়াতাড়ি ঠাস্ করে দরজা বন্ধ করে দেয়! কিন্তু নিজের সংসার ছেড়ে মেয়ের কাছে থাকা সাদাসিধে স্বভাবের, নাতিপুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকা ওই মহিলার কথা মাঝরাতে তার কানে প্রবলভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। নিজেকে নিয়ে সে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। নেবুলা খুব ভাল করেই জানে একাকীত্ব থেকে মানুষের নানান রোগ হয়। মানুষ আত্মহত্যাও করে এবং সে সংখ্যার একটা অংশ পুরুষও। নেবুলা গুম হয়ে বিছানায় বসে থাকে। চেনা, পরিচিত থেকে দূরের ভুলে যাওয়া মুখ থেকেও মনে করতে চেষ্টা করে, কার সাথে সম্পর্কে জড়ানো যায়, যে তার বাকি শূন্য জীবনটি কাছাকাছি থেকে ভরিয়ে তুলতে পারে! সম্পর্কে জড়ানো মানে বিয়ে। নেবুলা যে দুএকটি প্রেম বা পরকীয়া করেনি তা নয়। কিন্তু ও দেখেছে, কিছুদিন ঘনঘন ফোন বা দেখা করার বিষয়টি থাকলেও পরে তা আর থাকে না। যদিও সে সম্পর্ক সম্পর্কের জায়গায়ই ঠিকই থাকে। কিন্তু তা প্রাণহীন হয়ে থেকে যায়! নেবুলার এখন দরকার জলজ্যান্ত একজন মানুষের প্রত্যক্ষ অস্তিত্ব! খণ্ডখণ্ডভাবে প্রহরগুলো শূন্য মনে হলেও নিজের জীবনটাকে নেবুলার কখনোই একটানা অর্থহীন মনে হয় না। যেন বেঁচে থাকতেই তার ভালো লাগে। তা যে কোনো অবস্থাতেই!নেবুলা মনে মনে ভাবে, কালই পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দেবে! তার প্রভুর মতো স্বামীর দরকার নেই। সহযাত্রীর মতো তার একজন বৈধ প্রেমিকের দরকার! কারণ তার তো কারো কাছে ভাত-কাপড়, আশ্রয়, পরিচয় কিছুরই দরকার নেই। বরং বিত্তহীন হলেও সেরকম শিক্ষিতি,
ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কাউকে পেলে সে নিজেই তাকে পালতে পারবে! নেবুলা ভেবেছিল, সেরকম মানুষের বুঝি অভাব নেই।
পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দেয়ার পর জোয়ারের মতো মেসেজ এসে ফোনের স্ত্রিণ ভরে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপণে লেখাই ছিল, মেসেজে তথ্য দিতে হবে। তাই মেসেজের মাধ্যমেই নেবুলা তথ্য আদান-প্রদান করে। অনেকদিন পার হওয়ার পর একদিন ফোনটা বারবার বেজে ওঠে। কিন্তু নেবুলা তখনো পর্যন্ত অচেনা কোনো নাম্বার থেকে আসা ফোন ধরে না! ক্ষেপার পরশ পাথর খোঁজার মতো যোগ্য লোকটিকেও হয়ত নেবুলা অযোগ্য ভেবে ভুল করেছে।

অথবা তাকে পেলে যার বর্তে যাওয়ার কথা ছিল, সেও হয়ত নেবুলাকে চিনে নিতে পারেনি! নেবুলা কোনো বিষয় বাছ-বিচারেই অত দক্ষ নয়। তবে দু’জন মানুষের মুখোমুখি সে হয়েছিল এই বিজ্ঞাপণের বদৌলতে। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই নেবুলার নিজের বড় ছেলে শোয়েব কানাডায় লেখাপড়া করে সেখানেই ভাল চাকরি পেয়ে যায় এবং বিয়ে করে সেখানেই সেটেল হয়েছে। তবে বউ বাংলাদেশেরই মেয়ে। শোয়েবের থেকে পাঁচ বছরের ছোট শামীম সপ্তাহ খানেক হলো সেও কানাডার অন্য আরেক প্রান্তে লেখাপড়া করতে চলে গেছে। দু’ভাই একত্রে থাকবে এতদিন এই ভেবে আসছিল নেবুলা। কিন্তু নৈকট্য শব্দটি তার জীবন থেকে উবে যাচ্ছে। দুই ছেলের কেউই মায়ের অত ন্যাওটা নয়। আবার কারো সাথে মন্দ সম্পর্কও নয়! বড় ছেলে কানাডা যাওয়ার পরই ওদের বাবা আচমকা মারা যান। ভদ্রলোক অকালে মারা গেলেও নেবুলার কোনো কষ্ট হয়নি ছোট ছেলেকে মানুষ করতে। চলার মতো টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করা আছে। আছে নিজস্ব ফ্ল্যাটও। সব মিলিয়ে গোছানো একটি সংসার রেখে সরকারের সাবেক আমলা তার স্বামী কিছুটা অকালেই মারা গেছেন। বড় ছেলে কানাডা যাওয়ার সময় নেবুলা আর ওদের বাবা খুব কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু ছোট ছেলে চলে যেতে তার তার অতো কান্না আসেনি। শুধু মন কিছুটা খারাপ হয়েছে। যোগাযোগ ব্যাবস্থা বৃদ্ধির কারণে পুরো পৃথিবীটাই এখন একটা দেশ মনে হয় নেবুলার! নেবুলার এখন কারো জন্য কান্না আসে না। বরং নিজের জন্য তার বড় করুণা হয়। সে হিসেব মিলিয়ে দেখে কেউ কোনোদিন তার জন্য একটু দুঃখ করেনি। অনেক কষ্ট করে সে সংসারকে আজকের এই অবস্থায় এনেছে। কখনো কারো বিরুদ্ধে তার কোনো কৈফিয়ত ছিলো না। নেবুলা সৎছেলেরও ভাল মা, বয়সে বেশ ব্যাবধান নিয়েও স্বামীর ভাল স্ত্রী হতে চেয়ে তার নিজস্বতা বলতে কিছু নেই। বয়সে ব্যবধান এবং স্বামীর মৃত্যু স্ত্রী’র অবাধ্য এক সন্তান মানুষ করে তুলতে দীর্ঘ সময় ধরে তার নাভিশ্বাস উঠে গেছে। তবু সে কখনো ক্ষোভ প্রকাশ করেনি! একসময়ের টানাপোড়েনের সংসার সামলে নিতে নেবুলা হিমসিম খেয়েছে। তবু নিজের সন্তানদের সাথে স্বামীর আগের স্ত্রী’র সন্তানকেও সমান স্নেহে নেবুলা যত্ন করেছে। যে কিনা, তার নিজের থেকে মাত্র দশ বছরের ছোট। তাতে অবশ্য নেবুলার কোনো দু:খ নেই। কিন্তু নেবুলাকে না জানিয়ে তার স্বামী বড় ছেলেকে আলাদা করে সম্পত্তির একটি অংশ লিখে দিয়ে গেছেন! সেই থেকে নেবুলার ক্ষোভ। কারণ নেবুলা তিনজনকে সমান চোখে দেখেছে। আর পিতা হয়ে তিনি একটি বিভাজন প্রকট করে দিলেন। আর তা ভাইয়ে ভাইয়ে যতখানি, নেবুলার মনে অনেক বেশি!যে মানুষটিকে নেবুলা ঠিকই ভালোবেসেছে, শ্রদ্ধা করেছে। কিন্তু তিনি নিজের কাজ ছাড়া নেবুলার দিকে কখনো মনোযোগ দেননি! কোনোদিন নেবুলাকে নিয়ে তিনি কোথাও একটু বেড়াতেও যাননি। বুকের অলিন্দ থেকে আতিপাতি করে নেবুলা স্মৃতির ঝুলি খুলে বসে সেই রাতের মরণদশার ভেতরে। না, তার জীবনে অতৃপ্তি আর গাধার মতো সবার চাপিয়ে দেয়া বোঝার ভার ছাড়া আর কিছুটি নেই তাতে, যা একটু ছায়াদায়ী মেঘ হয়ে এমন ভয়ঙ্কর মুহূর্তে তাকে রক্ষা করে। নেবুলা জানে, তার নিজের বড় ছেলেটি কানাডা গিয়ে যখন আর ফিরে আসার চেয়ে না আসার অবস্থাই পাকাপাকি করে ফেলেছে, সেখানে ছোট ছেলেও কি ফিরে আসবে?

তাহলে কি তার নিজের জীবন নিঃষঙ্গতায় এভাবেই মরুভূমি হয়ে থাকবে! শেষ জীবনে কি হবে তা নিয়ে অবশ্য নেবুলা ভাবে না। ছেলেদেরও তো সে খালি স্বপ্ন দেখিয়েছে আকাশ ছুঁতে। পিছনে ফিরে তাকাতে তো সে-ই তাদেরকে শেখায়নি! তাই তারা পিছুটান হতে তার নিজেরও ভূমিকা আছে।সংসারের কোনো কাজও কোনোদিন কারো সাথে পরামর্শ করে করেনি নেবুলা। আর আজ তার এই বিজ্ঞাপণ দেয়ার কথাও সে কাউকে বলেনি! কার কাছেই বা বলবে সে। তার তো তেমন কেউ নেইও। যারা আছে, তারা শুধু খুঁটে খেতে আসে! এত সূক্ষ্ম এত সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কি যার তার সাথে কথা বলা যায়! মা-বাবাও তো শুধু জামাইয়ের ঐশ্বর্য-প্রতিপত্তি দেখেছে। অবশ্য এত বছর পরে এ নিয়ে আর কারো প্রতি তার অভিযোগ নেই। সেনিজগুণে সব মানিয়ে নিয়েছিল।নেবুলা জানে, বন্ধুদের কারো সাথে এ নিয়ে পরামর্শ করতে গেলে সে-ই হয়ত ঢিঢি ফেলবে! তবু একদিন বিষয়বুদ্ধিতে পাকা তার থেকে দশ বছরের বড় এক বান্ধবী তার বাসায় এলে, নেবুলার মোবাইলে কতক্ষণ পরপর টুং টুং করে মেসেজ আসতে দেখে, সে কপাল কুঁচকে বললো, তোর এত মেসেজ আসছে কেন রে?
নেবুলা তাকে বলে ফেলল, জানিস সুরমা আপা, আমি পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপণ দিয়েছি!সুরমা স্বাভাকিক স্বরে বলল, কিসের? এই ফ্ল্যাট বিক্রি করে তুইও কি ছেলেদের কাছে চলে যাবি নাকি? নাকি কোনো জমি বিক্রি করবি? সুরমার কথা নেবুলার কানে ঢোকে না। সে নিজের কথা বলে যায়-জানিস্, আগে কোনোদিনও আমার এরকম হয়নি, কয়েকদিন আগে রাতে আমার খুব হাঁসফাঁস লাগছিল। আমার তখন মনে হচ্ছিল এই যে আমি একা। সমস্ত জীবন গেল আমার একাকীত্ব বয়ে। তাতে কার কি? আবার কেউ একজন যদি আমার পাশে থাকত, তাতেই বা কার কি ক্ষতি হত?সুরমা বললো, তোর হাজবেণ্ডের ওই ছেলেটা কোথায়?
: হাজবেণ্ডের একা ছেলে হবে কেন, ত্রিশ বছর ধরে তো আমারও ছেলে ঋভু।
: তুই একা বললে হবে?: আমারটুকু তো আমি বলবোই। অন্যেরা অন্যেরটুকু বলুক!
: ও তোকে দেখতে আসে না?: নিজের থেকে আসে না বলে আমিও এখন আসতে বলি না! তবে ও ভালো আছে! মা-বাবার একমাত্র মেয়ে বিয়ে করে সুখেই আছে।
: আচ্ছা শোন, তুই অকাল বিধবা মানুষ। আমার চোখের সামনেই তো তোর বিয়ে, বৈধব্য সব ঘটলো। তুই যদি আরেকটা বিয়ে করতি তোর ছেলেরা তা মেনে নিতো?
: না রে, ওইরকম করে ভাববার সাহসই তো পাইনি। আমি তো তাদের লেখাপড়া ছাড়া আর কোনো বিষয়-আশয়ের সাথে ইনভলব পযর্ন্ত করিনি! এমন কি ঋভুকেও না! আমরা সবাই কেমন জানিস তো, কারো জন্য কেউ মরিয়া নই। ছেলেরা এমন নয়, যে বলবে মা কোথাও যেও না, তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। কিন্তু আমি নিজ দায়িত্বে কোথাও যাই না। মনে হয়, ওরা নাড়ির বন্ধন থেকে ছুটে গেলে, ওরা স্বাবলম্বী হয়ে গেলে ওদের জীবনে আর আমার কি দরকার থাকবে! তাই তো নিজের গরজে নিজের ভাললাগা থেকে এই সংসার আর
সন্তান দুটি নিয়ে নিমগ্ন থেকে গেলাম। ঋভু তো বড় হয়ে তার মামা-খালাদের কথায় আমার সাথে বিবাদে মত্ত হয়ে উঠেছিল।
পরে তার বাবা তাকে ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটটি লিখে দেয় এবং বন্ধুর মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবু ঋভুর জন্যও কিন্তু আমার টান কম ছিল না জানিস! কিন্তু রাগটা ওদের বাবার ওপর।
:কিন্তু সব টান ছিঁড়ল তো?
: হ্যাঁ! যা বলছিলি, আমার এইরকম মনে হয়, মানানসই কাউকে পেলে আমার ছেলেরা বোধহয় আপত্তি করত না।
: তোর আসলে শামীমকে বিদেশ পাঠানো ঠিক হয়নি!
: ধুর, আমার জীবনের আর এত কিই বা দাম যে আমি আমার সন্তানদের খর্ব করে রাখব!
: খর্ব বলছিস কেন? এদেশে কি লেখাপড়া হচ্ছে না?: হবে না কেন? কিন্তু যে যেখানে যেতে চায়, সামর্থ থাকলে তো যেতে দিতে হয়। সামর্থ না থাকলে যেতে চাইলেও পাঠাতে পাঠাতাম না। যেমন ঋভু কখনো চায়নি। আর ওরা দু’ভাই-ই তো স্কলারশীপ পেয়ে গেছে। আমার খুব একটা খরচ হয়নি!
: কিন্তু দেখিস, তোর জন্য কেউ ফিরে আসবে না!
: না আসুক! ওই যে রবী ঠাকুর লিখেছেন, ‘নিজের সে বিশ্বের সে বিশ্ব দেবতার/ সন্তান নহে গো মাতা সম্পত্তি তোমার…।’
কি জানি লাইন দু’খানা ঠিকঠাক বলতে পারলাম কি না!
: না পারলি ঠিকঠাক! তুই তো আমার চোখ খুলে দিয়েছিস। আমি সব এক জায়গায় বেঁধে রেখে প্রতিদিন চুলোচুলিতে ভুগছি! দুই ছেলেই উদগ্রীব কাকে কি দেয়া হবে। মেয়েও কম যায় না। আসলে তোর মতো স্বপ্ন দেখিয়ে তো বড় করিনি।
নিজেও তো কোনো স্বপ্ন দেখলাম না। ছেলেমেয়েদের খালি আঁচলে বেঁধে রেখে বড় করেছি!
: সে জন্যই তো দুঃখ করতে করতে থেমে যাই! যা অনেকে পারে না, আমার ছেলেরা সেরকম একটি জায়গা নিজের নিজের জন্য করে নিয়েছে। আর কি মনে হয় জানিস, পৃথিবীটা এখন হাতের মুঠোয়। তোমার বন্ধু সাদিয়াকে দেখো, মা একা বাসায়, ছেলে পাশের আরেক ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে।
: তাই নাকি? আমাকে বলেনি তো!: বড় ছেলে বিদেশ থেকে ফিরে এসে মায়ের কাছেই উঠেছিল। কিছুদিন যেতেই বউ মুখ ভার করে থাকত। শেষে সাদিয়া বলল, সাদিয়াই নাকি ছেলেকে বুঝিয়ে বলেছে, এমনিতে বৌমার পেটে বাচ্চা থাকছে না।
উচ্চশিক্ষা শেষে বাচ্চা নিতে মেয়েদের যা সমস্যা তার সবই প্রকট মেয়েটির ভেতর। তাই সাদিয়া ছেলেকে বলেছে, ও যা চায়, তাই করো। তোমরা আলাদা বাসা নিয়ে থাকো। আমার কথা ভেবো না। আমি বেশ আছি।

তোমার বাবা মারা যাওয়ার পর তোমাদেরকে যেটুকু বড় করে দিতে পারছি, সেটুকুই আমার শান্তনা!’
: সাদিয়ার মতো ঘটনা ভুরি ভুরি! তুই তোর কথা বল্, পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিয়ে পেলি কাউকে?
: অসংখ্য পাই! তবে যাকে আমার পছন্দ, আমাকে তার পছন্দ না! আর বেশির ভাগের সমস্যা আমি অমন তিন ছেলের মা!
শেষে তারা কোন লাঠালাঠিতে পড়ে!
: আসলে এসব ক্ষেত্রে প্রার্থী তো সব ঘরপোড়া গরু! তাই তারা ঝালিয়ে জানতে চায়। আচ্ছা আমি বলি কি, শোন,
তুই বিয়েটিয়ে করে নতুন ঝঞ্জাট না বাঁধিয়ে বরং লিভ টুগেদার কর!
: সুরমা আপা, তুই বলিস্ কি? শোন্, হাজবেণ্ড মারা যাওয়ার পর থেকে আমার সেই কাঁচা বেদনার ভেতরই তোর মতো
এইরকম পরামর্শ দেখি অনেকে আমাকে সেধে সেধে কানে গুজে দিয়েছে। কারণ কি রে? আমি কি আল্ট্রা মডার্ণ?
: সেটাই নির্ঝঞ্জাট যে! কেউ জানলো না…।
: শোন, সুরমা আপা, একটা কথা কখনো ভেবে দেখেছিস?
: কি?: কলমা পড়ে একটি সম্পর্কের পরে তারা যা-ই করুক, পুরুষমানুষ কখনো কোথাও কারো কাছে গিয়ে বলে না,
যে আজ বউয়ের সাথে এই এই করলাম। তাছাড়া, যতই ভাল মানুষ হোন, যতই তিনি পার্রোনালিটিসম্পন্ন, ইনটেলেকচ্যুয়াল হোন, তিনি কোথাও না কোথাও তার অবৈধ সম্পর্কের কথা উগরে দেন!
: কারণ কি?
: পরের বৌকে করার ভেতর পৌরুষ নিহিত আছে কি না…। হয়তো কিছুই করার মুরদ নেই। হয়ত শুধুই দরজা বন্ধ করা পর্যন্তই সার ছিল। তবুও।
: যাহ্!
: যাহ্, কি রে? বাজারে যে এত এত মানুষ সম্পর্কে যত রটনা, তোর মনে হয় সুরমা আপা, কেউ বেড়া ভেঙে দেখতে গিয়েছিল, ওইসব ঘটনা ঘটানোর সময়? কে কাকে সাথে নিয়ে বিদেশে গিয়ে কোন হোটেলে কি করেছে, তা এদেশের কেউ দেখে এসেছিলো?
: তাহলে রটে কি করে?
: সব নিজেরা রটায়! মানে পুরুষটিই রটায়! শোন্, সুরমা আপা, আমি ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে এই বুঝেছি, প্রয়োজনে যারা বিয়ে করে, তাদের যে বদনাম রটে, তা কিন্তু বিয়ে করা নিয়ে নয়!
: তাহলে?
: যদি মানুষটি যদি একজন আরেকজনের জন্য মানানসই হয়, তা নিয়ে আর বেশি কথা ওঠে না। আর এখানে একটি অধিকারবোধেরও তো বিষয় আছে। কোন জোরে তুই আস্ত একটি মানুষকে কোনো দায়বদ্ধতা ছাড়া অধিকার করে রাখতে চাইবি?
: তাই তো! আমাদের তো সমাজ নামের ক্ষুদ্র একটি গণ্ডির ভেতর বসবাস করতে হয়! এমন কিছু করা উচিৎ নয়, যে গর্তে গিয়ে লুকিয়ে বাঁচতে হয়।
: সমাজকে তোয়ক্কা না করলে সেটা অন্যকথা। একজনের সাথে বনিবনা হলো না, আবার আরেকটাকে জুটিয়ে নিলাম! আর একবার এই খেলায় নামলে কেউ আর ফেরে না!
: সেটাও যারা পারে, তাদেরও আমি দোষ দিচ্ছি না।
তাদেরও তুড়ি মেরে চলার যোগ্যতা থাকে। কিন্তু তুই তো ওই সমাজের না!
: বাহ, তোর দেখি অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেছে! আমি তোর এতোটা ধার এত তাড়াতাড়ি আশা করিনি!
: আরে আমার তো তোর মায়ের বন্ধু হওয়া উচিৎ ছিলো। তাই আমি একটু সেকেলে না? ভাগ্যিস তোর কর্তা আমার কর্তা দুই ভাইয়ের মতো ছিল। তবু কিন্তু আমরা জা হইনি! এখন খুলে বল, তুই কি চাস্?
: তুই তো আমার বোনও হতে চাইলি না! শোন্, আমি চাই, আমার নিজের বয়সের থেকে কম তো নই-ই। আবার বেশিও না! কারণ আমি এখন দুনিয়াটা ঘুরে কাটাতে চাই। বুড়ো বিয়ে করে তার সেবা করে মরবো নাকি? আজ বাত, কাল দাঁতে ব্যথা। বসে বসে নুনের পোটলা গরম করে সেক দাও…! সুরমা হাসতে হাসতে গড়িয়ে বলে, যদি অতো টাকাওয়ালা কাউকে না পাস্?
: আরে অন্যের গোয়ালে তাজা গরু দেখে আমি দড়ি পাকাই না! আমার নিজের তো আর দায় দায়িত্ব নেই। আমারটুকু নিয়ে আমার এখন হিসেব।
: দেখ, তোর এই আশা যেন পূর্ণ হয়!
: তাই বলে ভাবিস না ছোটভাই বা দেবরের মতো কাউকে বগলদাবা করে ঘুরতে চাই। কারণ আমার ছেলেরা বাবা ডাকবে না ঠিকই, কিন্তু আঙ্কেল যেন ডাকতে পারে। নিজেকে আমার লুকিয়ে রাখতে হয়, তেমন কোনো কাজই আমি কখনো করবো না, সুরমা আপা!
: কিন্তু পাচ্ছিস না তো!: ওই যে বললাম, যাদেরকে পছন্দ হয়, তাদের হয়তো সব মিলানো হিসেব থেকে আমি ছুটে যাই!
: আমার তো অতো বুদ্ধিসুদ্ধি নেই রে! জীবন থেকে তুই অনেক শিক্ষা নিয়েছিস। যে শিক্ষা নেয়ার ধাৎ আমার নেই। তবু আজ মাথায় করে কিছু নিয়ে গেলাম! খালি তো সংসার নামক চরকিতে খুরপাক খেয়ে জীবন গেল। চাকরি করতে ঢুকে দেখি যাদের জন্য চাকরি করবো, তারা বখে যায়। শেষে ষোলআনাই গিন্নী…। এই যে একটি মানুষের চলে যাওয়ার পর তার অভাব কত প্রকটভাবে বুঝতে পারছিস্। অথচ ভালবেসেই আমি বিয়ে করেছিলাম…।
: শোন্, শোন, খুব গোপনে একটি কথা বলি আপা, অভাব প্রকটভাবে বুজছি মানে, নেবুলা দেয়ালের ছবির দিকে আঙুল তুলে বললো, মাঝে মাঝে আমার মনে হয় উনি নিজে মরে বেঁচেছেন অথবা আমাকে বাঁচিয়েছেন! খুব সূক্ষ্ম সূ্ক্ষ্ম আচরণ ব্যাখ্যা করে বুঝতে পারতাম, উনি যে সাধারণ পরিবার থেকে একটি কম বয়সী মেয়েকে ধরে এনেছিলেন, তার সে জায়গা থেকে মেয়েটি যে বহুদূরে সরে গেছে, এগিয়ে গেছে, ওনার বেয়াড়া সন্তানের মা হয়ে ওঠার প্রানান্ত চেষ্টা করেছে, তার একটিও উনি মূল্যায়ণ করতে পারতেন বলে আমার মনে হয় না! মাঝে মাঝে ওনার আচরণে আমার কাছে তাই মনে হতো! একাকী কষ্টে গুমরে মরেছি।
: ঠিক এই কথাটিই আমি বলতে চাচ্ছি। আমারও এখন আমাদের সম্পর্কটা বিষের মতো ঠেকে! কেউ কারো সাথে ভাল করে দুটো কথা বলি না। আর এই ভাল করে কথা না বলাটাই দু’জনের অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন নাদিমকে আমার কাঁটার মতো লাগে। কারণ পরোক্ষভাবে সব সময় আমাকে ইনসাল্ট করেই চলে…! আমি যে টানাপোড়েনের সংসারটিতে সারাক্ষণ খেটে মরি, আমার জন্য তার কোনো দরদই নেই। প্রতিদিন আমার ছেলেমেয়ের সামনে আমার সম্মান ক্ষয় করে চলছে।
: একদিন নিয়ে আসিস্, বুঝিয়ে বলবো। অন্য কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে কাজ হয়।
: অরে না, এই বয়সে বোঝাতে গেলে কি ভাববে? আর তার দরকারই কি? জানিস্ এই মানুষটাই জোয়ানকালে আমাকে জান দিয়ে আগলে রাখত। একটু ভারী কাজ করতে দেখলে আমাকে সরিয়ে নিজে করত! আরে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমরা ক্লাসমেট ছিলাম! তখনকার প্রেমের ঠোলা দেখিলে তুইও পাগল হয়ে যেতি!
: তোরা সমবয়সী বলেই তো আচরণ একটু ওরকম হয়। তবু তুই একদিন সাথে করে নিয়ে আসিস আপা। বোঝানোর দরকার আছে! আর বোঝাবো, মানে, শিশুদের যে ভাবে বোঝায় মাস্টারেরা, সেভাবে বোঝাবো না কি? তোরাই তো বলিস্, আমার কথা নাকি কথা কথাশিল্পীর মতো…।
: সব কথা শুনতে ভাল হলেই যে সব কথার ফল ভাল হবে, তা নয় রে! এই যে তুই এত কথা বলছিস্, শুনতে সব ভাল লাগছে।
কিন্তু ফলাফল কি হয়, আমার কিন্তু একটু ভয়ও হচ্ছে। কারণ সব কদর্য সর্বনাশগুলো সুন্দর পথ ধরেই আসে।
:শোন সুরমা আপা, শুধু বিপরীত চিন্তা করিস না! আজ থেকেই তাকে বাগে আনার চেষ্টা করবি।

তার পছন্দের কিছু নাস্তা বানিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে বলবি, আমার কাছে কখানা গহনা আছে। আমি গোপনে গড়িয়েছি।
তোমাকে বাইরে নিয়ে দেখাব। তারপর কোনো পার্কে একটি চাদর বিছিয়ে কড়া করে দুধ জ্বাল দেয়া ঘন চা বের করে দিবি!
তারপর একে একে যা নাস্তা বানিয়েছিস্, তা বের করে দু’জনে খুঁটে খুঁটে খেতে থাকবি।: গহনা ক’খানা দেখতে চাইলে কী বলব, তাই বল?
: গাঢ়ো চোখে তখন তাকিয়ে বলবি, আরে আমিই তো তোমার আস্ত সোনা! বলবি, বেঁচে আছি তো, তাই বোঝো না! মরলে,
গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে যে ভাবিদের সাথে সাথে হেসে হেসে কথা বলো, ফোন এলে আমার কাছ থেকে উঠে বারান্দায় যাও,
তুমি মরলেও ওদের কিছু যায় আসে না। আর আমি মরলে ভাবিরা-আপারা সব পালাবে। কারণ, তখন ভাববে মাথা গরম করে কোনটাকে আবার জাপটে ধরো!
: আরো কিছু শিখিয়ে দে!
: আরো? বেশি ঝাঁঝ দেখালে বলবি, জোয়ানকালে তো তুমি আমাকে ভালবেসে বাড়িটি একা আমার নামেকিনেছিলে।
আমি তা চার ছেলেমেয়ের নামে সমান ভাগ করে রেজিষ্ট্রী করে দিয়েছি। আমি মরলে যে চার আনা ফেরত পেতে, তাও তোমার অফেরতযোগ্য! ভালভাবে বাঁচতে চাইলে আমাকে বাঁচাও। কোরবানীর গরুর মতো নাইয়ে পুঁছিয়ে রাখো!
: কিন্তু ছেলেমেয়েদের নামে তো বাড়ি লিখে দিইনি?: মিথ্যে কথা বলবি…। ছেলেমেয়েকে শিখিয়ে দিবি তোকে সহযোগিতা করতে! মা-বাবার ভেতর মিল না থাকলে সংসার পুরোই নরক!
: হা হা হা…।উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে সুরমা দ্রুত বেরিয়ে যায় বিদায়ের সময় অনেক আগে পার হয়ে যাওয়াতে। দরজার বাইরে গিয়ে লিফটের বোতাম টিপে আবার ছুটে এসে নেবুলার মাথাটা নিজের বুকের ভেতর টেনে নিয়ে জোরছে এক চাপ দিয়ে বলে‘ তোর ভেতর প্রচণ্ড একটি মা মা ভাব আছে। যা কামুক পুরুষকে আকর্ষণ করবে না। আকর্ষণ করবে যারা স্নেহের কাঙাল, ক’দিন দেখে তোকে বুঝবে, তাদেরকে…। বুঝলি? কথাটা মনে রাখিস…!
’কথা শেষ না হতে হতে লিফট এসে পড়লে সুরমা ক্ষীপ্র বেগে তাতে ঢুকে পড়ল। লিফটের দরজা বন্ধ হতে হতে নেবুলা সুরমার কাশতে কাশতে হাসির গমকও শুনতে পায়…।


দুই.

বিজ্ঞাপণ দিয়েছিল নেবুলা প্রায় ছমাস আগে। এর ভেতর মেসেজ আসা কমতে কমতে কখনো সখনো একটি আসে।
তার বেশির ভাগই উত্তর না দেয়ার মতো! একদিন একজন বারবারই মেসেজ পাঠাচ্ছেন ফোন করার অনুমতি চেয়ে।
নেবুলা দীর্ঘ নীরবতার পর একসময় অনুমতি দিল। ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম হায়দার! সেনাবাহিনীতে ছিলাম।
মেজর হিসাবে রিটায়ার করতে যাচ্ছি…। নেবুলা একটু রেগেই বলল, স্ত্রী’র কি হল তাই আগে বলেন?
: আপনি আমার কথা বাদ দিয়ে আগেই স্ত্রী’র কথা শুনতে চান?
: আসলে এতজনের এতকথা শুনে ফেলেছি, আর শুনতে ইচ্ছে করে না। অযথা কথার খরচ। ঘরের তথ্য বের করে দেয়া…।
: আচ্ছা, শোনেন। আমি মিশনে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে এসে দেখি, বউ ঘর খালি করে যা নেয়ার মতো এবং ছেলেমেয়ে দু’টিকে নিয়ে তার পুরনো প্রেমিকের সাথে চলে গেছে…!: থামুন! থামুন! আচ্ছা, আপনার ওয়াইফ যার সাথে গেছেন, তিনি কি আপনার বস্?
: না! এমন প্রশ্ন করলেন কেন বলেন তো?: মেজরের বৌ তো সাধারণ মানুষ নেয়ার কথা নয়! আর প্রেমিক যে পুরনো, তা জানলেন কি করে?
: নাহলে এভাবে যায়?
: যায়! কারণ তার ভেতর যে সুকুমারবৃত্তিগুলো আছে, তা সারাজীবনে কাছে থেকেও যারা না দেখে, মূল্যায়ণ না করে,
আর তাই যদি কেউ অবেলায়ও এসেও দেখে, তখন অতীতের সবাইকে ছেড়ে ওকেই তার নিজের বলে মনে হয়। মনে হয়,
ওর জন্যই তো এতদিন পথ চেয়ে ছিলাম!
: দারুণ বলেন আপনি? তা লেখেন টেকেন নাকি?
: লিখি না। পবে পড়ার অভ্যাস আছে। দূরে বসবাস করা আত্মীয়-পরিজন, চেনা সবাইকে আমার চিঠি লিখে খোঁজ নিতে ভাললাগে!
: বাহ্! যেখানে পোস্ট অফিসগুলো মরতে বসেছে সেখানে আপনি চিঠি লিখে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখেন!
: তারপর, আপনার স্ত্রী’র সাথে আইনত ছাড়াছাড়ি হয়েছে?
: নাহলে সে বিয়ে করলো কি করে?: কিন্তু আমি তো কোনো স্ত্রী পরিত্যাক্ত মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়াবো না!
: এত বাছলে পাবেন কাউকে?
: হয়ত পাবো না!
: তাহলে বিজ্ঞাপণ দিয়েছিলেন কেন?
: খুঁজলেও যে সবকিছু পাওয়া যায় না, তা অন্তত জানতে!
: একটি কথা বলি, রাখবেন?
: বলেন?
: আপনি আমাকে আধঘন্টা সময় দেন!
: আচ্ছা!
: কাল খুব সকালে আপনার বাসার সামনে থেকে আমি আপনাকে তুলে একসাথে কিছুটা সময় আমরা গাড়িতে ঘুরবো। তাতে আমাদের আরো কিছু কথা হবে, দেখাটাও হয়ে গেল।
: এত তাড়াতাড়ি?
: ঝেড়ে ফেলতে হলেও তাড়াতাড়ির দেখায় ফেলা যায়। দেখেন আমার কথা রেখে!
: কিন্তু আপনি আমার বাসা চেনেন কি করে?
: চিনি, তাই বলছি নাকি? ঠিকানা আপনি দেবেন এখন! নেবুলা হায়দারের কথায় রাজি হয়ে যায়! সারারাত ঘুম আসে না নেবুলার।

যেন সে অভিসারে যাচ্ছে। আরেক মন বলে, অভিসারই তো! ফজরের আজান শুনে সে নামাজ পড়ে নেয়। তবে আলাদাভাবে কোনো প্রার্থনা সে কোনদিনই করে না। মুখে একটু হালকা প্রসাধন মেখে ভোরের উপযোগী একখানা শাড়ি বাছতে বাছতে ফোনটা বেজে উঠল। রাতে হায়দার বলেছিল, আপনার সাথে কথা বলতে বলতে আমার ব্যালেন্স শেষ! একটি কল দেয়ার টাকা আছে। তাই ফোনটা বাজলে ধরবেন না কিন্তু। শুধু নিচে নেমে আসবেন। আমি আপনার বাসার উল্টো দিকের রাস্তায় থাকব! উত্তরা পাঁচ নাম্বার সেক্টরের সতেরো নাম্বার রোডের বাড়িটি থেকে নেবুলা রাস্তার ওপারে একখানা নীল রঙের গাড়ি দেখে, রাস্তা পার হতে হতে কেউ একজন দরজা খুলে দিলে নেবুলা কোনোদিকে না তাকিয়ে তাতে ঢুকে পড়ল। ভোরের খালি রাস্তা দিয়ে গাড়িখানা ফাঁকা মাঠ আর লেকের পাড় ঘেঁষে ঘেঁষে নেবুলাকে নিয়ে চলল। পাশের মানুষটির একটিও কথা নেই। বাকপ্রিয় নেবুলারও কণ্ঠ বোজা! শুধু পাশাপাশি দুজন মানুষের অস্তিত্বই দুজনের কাছে বিরাজমান। পাশে কে আছে জানে না নেবুলা! একবারও তাকায়নি নেবুলা তার মুখের দিকে। কিন্তু তবু তার মনে হচ্ছিল, অনন্তকাল এভাবেই ছুটতে থাকুক তারা! মাটির স্পর্শ ছেড়ে মেঘ ছুঁয়েও যদি চলতে হয়, তবু নীল এই টয়োটাখানা পঙ্খিরাজ ঘোড়া হয়ে যাক! কিন্তু পাশে যে আছে, সে কি চাইবে শুধু কোনো রাজকন্যার উদ্দেশ্যে কোনো মেঘ ছুঁয়ে চলা পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়া রাজার কুমার হতে? একসময় গাড়িখানা থামল। হায়দার নেমে দরজা খুলে দিয়ে বলল, আমাকে পছন্দ হল?নেবুলা চমকে উঠে এই প্রথম হায়দারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এ কোথায় নিয়ে এলেন?
: আরে আপনার বাড়ির সামনেই! ওই দেখেন, ওই আপনার বাড়ি! কার ফ্ল্যাটের বাগান বিলাস বারান্দা উপচে ঝুলে পড়ছে!
: আসলে এতো সকালে কুয়াশা মোড়ানো অবস্থায় তো বাড়িটি কখনো দেখিনি! আর রাস্তাও এমন জনমানবহীন দেখিনি!
মনে হচ্ছে স্বপ্নের কোনো শহরে এসে নামছি। যেখানে মানুষ নয়, এলিয়েনরা থাকে।: বললেন না তো, আমাকে পছন্দ হল কি না?
: নেবুলা স্মিত হেসে হায়দারের মুখের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে উত্তর দিল, এতক্ষণ যে সে হায়দারের মুখের দিকে তাকাতেই পারেনি তা বোঝা গেল না। নেবুলা বলল, এমন পছন্দ তো উত্তম কুমারকেও হয়। তাই বলে তিনি চাইলেও তো আমি তার সাথে ঘর করতে যাব না!
: বড় ডায়নামিক উত্তর!
: আপনি কিন্তু এককাপ চা খেয়ে যেতে পারেন।
: আমি এমনি যেতে পারি। চা খাব না!ঘরে এসে সোফায় বসতে বসতে হায়দার বলল, এখানে আর কে কে থাকে?
: আমি ছাড়া থাকার কেউ নেই। তিন ছেলের বড়টি দেশে শ্বশুরের ব্যাবসার সাথে যুক্ত। চট্টগ্রামে থাকে তারা। আর দুই ছেলে কানাডায়। বড়টা লেখাপড়া করতে গিয়ে সেখানে সেটেল। আর ছোটটা মাত্র গেল!
: এই খা খা একা বাসায় আমাকে নিয়ে এলেন, আপনার সাহস তো কম না!
: কেন? একা বাসায় আপনি কি আমাকে খেয়ে ফেলবেন? আর ওই দেখেন দরজাটা, আপনাকে দখিণা বাতাস খাওয়ানোর উছিলায় খোলা রেখে আবার একটি চেয়ার টেনে কপাট চাপা দেয়া…।: তারপরও…।: তারপরও যদি কিছু থাকে,
সেটার জন্য আমার নিজের পাঞ্জার ওজন আমার জানা আছে। হাত বাড়ালেই নাকের ওপর ভিষুম!
: ওরে বাপরে! এত সাহস নিয়ে এইরকম ডানপিটে মহিলা আবার বিয়ে করতে চান কেন?
: কেন, বিয়ে কি কেবল ভীতুরা করে? তাহলে তো ভীতুদের ছেলেপুলেতেই জগৎ-সংসার ভরা থাকত। সাহসীরা সাহসী কর্মকাণ্ডের প্রেরণার জন্যও তো একান্ত একজনকে চাইতে পারে।
: এতকথা তো জানতাম না! দেয়ালের ওই ছবি আপনার হাজবেণ্ডের?
: হ্যাঁ।
: যিনি এঁকেছেন, ভাল এঁকেছেন! নাম কি শিল্পীর?
: কাছে গিয়ে দেখেন, লেখা আছে।
: নেবুলা রায়হান! কিন্তু এই নাম তো কোনো শিল্পীর শুনিনি!
: সব ফুলের নামই কি সবাই জানে?
: আচ্ছ, কাল থেকে আপনার নামটিই কিন্তু আমার জানা হয়নি!
: জানতে চাননি, তাই!
: প্রত্যেকটি কথার যা মারমুখি উত্তর আপনি দেন, তাতে ভড়কে যাই!
: দেখেন, প্রথম দেখাতেই অভিযোগ!
: আমার তো মনে হয় না কেউ মুখচোরা হয়ে আপনার সাথে একটি ঘন্টাও কাটাতে পারবে! তা নামটা বলে ফেলুন?
: নেবুলা!: নেবুলা? মানে ওই ছবি আপনি এঁকেছেন?
: সেরকমই! নেবুলার প্রতি হায়দারের দৃষ্টি ঘন হয়ে উঠল। সে বলতে বলতে উঠল, ‘নাহ, অনেক কাজ রেখে এসেছি সেগুলো সারতে হবে। এই এক সিটিংয়ে হবে না। আপনার সাথে আবারও বসতে হবে! হায়দার চলে গেলে দরজা বন্ধ করে নেবুলা নাস্তা বানিয়ে সেদিনের খবরের কাগজ নিয়ে বসল। কিন্তু অক্ষরগুলো তার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। কিছুই মাথায় ঢুকছে না! জীবনে এইটুকু সময়, সেই সোবেহসাদেক থেকে সকাল সাতটা পর‌্যন্ত, কেমন যেন একটি ঘোর পেয়ে বসেছিল। নেবুলা ভাবছিল, এইমাত্র এইটুকু সময় জীবনটা কেমন ভরা ভরা লাগছিল। একটা মানুষকে পরিত্যাগ করে তার স্ত্রী দুটি সন্তানও সাথে করে নিয়ে গেছে। আর কোনো দোষ ছাড়া সেই নারীটির তো এমনি যাওয়ার কথা নয়! আসলে কারো সবটুকু জেনে গেলে অত লাগে না। ক্ষণেকের পরিচিত মানুষটির সবটুকু চেনা হয়নি বলে ঘটনাটুকু রূপোলি পর্দার কাহিনীর মতো মনে হচ্ছে নেবুলার নিজের জীবনে, তা সে বুঝতে পারে!তারপর হায়দার হুটহাট আরো এসেছে নেবুলার ফ্ল্যাটে। আর যখনি এসেছে, নেবুলা মেইন দরজাখানা হাট করে খুলে রেখেছে। ডাইনিং স্পেসের সীমানার বাইরে পা রাখতে দেয়নি নেবুলা হায়দারকে। নেবুলা সহজেই মানুষের সাথে মিশতে পারে। কিন্তু হায়দারের সাথে নেবুলার পরিচয়টা বন্ধুত্বেও গড়ায় না। হায়দারকে তার খুব সংযমী খেলুড়ে মনে হয়। তাই গলগল গল্পের ভেতরও একটি কাঠিন্যভাব প্রকট করে রাখে নেবুলা হায়দারের প্রতি। আর ওইটুকু ভর করে একটা চোরাটানই বুঝি জমে উঠেছিল হায়দারের নেবুলার প্রতি। নেবুলা হিসেব করে বলেছে হায়দারকে
: আপনার থেকে আমি এক বছরের বড়। কিন্তু হায়দার বলেছে, আমি আপনার সমান। হতে পারি, বড়ও। কারণ আমার মা বলেছেন, আমার বয়স কমিয়ে লেখা! অনেক বলেকয়ে একদিন হায়দার নেবুলাকে ওদের বাড়িতে নিলেন। এর ভেতর মাঝে মাঝে যোগাযোগ রক্ষার্থে নেবুলার সাথে হায়দারের কথা হয়। একান্নবর্তী পরিবারটি একসময় ভেঙেছে ওদের মা মারা যাবার পর। একবাড়িতে অনেকগুলো ভাইবোন একেকটি ফ্ল্যাট নিয়ে সবাই যে যার মতো থাকে তারা। নেবুলা যাওয়ার পর হায়দার তার এক বোনকে ডেকে আনে।
অনেক গল্প হয় তার সাথে নেবুলার। এক পর্যায়ে সে বোন কথাচ্ছলে বলে ফেলে, হায়দারের প্রাক্তন ওয়াইফ একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। একনামে সবারই চেনে। বিয়ের পর থেকে তাদের সম্পর্কের ভগ্নদশা। সবাই বুঝিয়ে এতদিন রক্ষা করেছিল। আর বউয়েরও একা দোষ দেয়া যায় না,
হায়দারের বউয়ের গায়ে হাত দেয়ার দোষ আছে।নেবুলা চাইলে আরো তথ্য নিতে পারতো। কিন্তু‘কে হায় হৃদয় খুঁড়িয়া বেদনা জাগাতে ভালবাসে…।’
বোনটি চলে গেলে নেবুলা অনেক্ষণ হায়দারের ফ্ল্যাটে একা ছিল। দেখছিল, ঘরের দামি দামি সব শৈল্পিক জিনিসপত্রগুলোতে ধুলো জমতে জমতে কেমন করে কড় পড়ে গেছে। হায়দার তার ক্লিষ্টগোছের কাজের মেয়েটি নিয়ে টেবিলে খাবার সাজানোর তদারকি করছিলেন। এর ভেতর একে একে অনেকেই এসে পড়ল। একটি কম বয়সী মেয়ে আসার পর থেকে নেবুলার চোখ কেবলি তার পায়ে পায়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। হায়দার নিচুস্বরে বলল, মেয়েটি তার এক জুনিয়র বন্ধুর প্রেমিকা। নেবুলা মেয়েটিকে ডেকে বলে, এই মেয়ে, এদিকে এসো তো। মেয়েটি কাছে এলে নেবুলা তাকে প্রশ্ন করে, তোমার নাম কি? কি করো মা তুমি?
: আমার নাম সৌমি! ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সে মাস্টার্স করছি।’ বলে সে দ্রুত হায়দারের কাজে সহযোগিতা করতে চলে গেল। কিন্তু হায়দারের সংসার সাম্রাজ্যে সৌমির দক্ষ বিচরণ দেখে নেবুলার ভাল লাগল না। ও মেয়ে হায়দারের পুরো ফ্ল্যাটের কোথাও কোনো কাজে হোচট খাচ্ছে না। সব ঠিকঠাক চিনে করতে পারছে। নেবুলার মনে হল ও মেয়ে প্রায় কোনো উছিলায় এখানে আসে এবং ব্যবহার হয়। তবু নেবুলা ওদের আড্ডার শেষ পর‌্যন্ত ছিল নিজের ধারণাটা ঝালিয়ে নিত।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *