ছোটগল্প

ছোটগল্প-অকাজ মোহাম্মদ কামরুজ্জামান

যারা কাজ করে, কাজের দিন যা করে, অবসরের দিন তার চেয়ে বেশি। কাজের দিন যদি এক হাতে কাজ করে করে সারা হয়, তো অবসরের দিন দু-হাত চালাতে হয়; আর বিনোদনের দিন?—বিনোদনের দিন চারহাত পায়ে কাজ করেও কূল পায় না। ফলে অফিসের যেদিন পিকনিক হয়—নদীর ধারে খোলা হাওয়ায়, অথবা খোলা মাঠে গাছের ছায়ায়, অথবা ঘাসের উপরে সামিয়ানার নিচে—অফিসের ক্লিনার ছোকড়াগুলো দম ফেলার সময় পায় না, সেদিন এক্সিকিউটিভ আর অফিসারদের কেবল প্রয়োজনের কথা মনে পড়ে, আর ছোকড়াগুলো এক কাজের আনজাম দিতে এসে নতুন কাজের ফরমাশ নিয়ে যায়—কারোর পানির বোতল এনে দাও, কারোর ব্রেকফাস্টের প্যাকেটটা এনে দাও, কেউ সোয়েটার ফেলে এসেছে খেলার মাঠে, কারোর বাচ্চাকে ধরে টয়লেটে বসাতে হবে, কেউ হাঁক ছাড়ে, ‘ওই দৌড়াইয়া আয়্—অকাজ তো হইয়া গেছে, টিস্যু আন, টিস্যু!’ পিকনিক অফিসের ক্লিনারদের জন্য নয়। দিনটা ওরা ঘরে বসে যে-যার মতো কাটাতে পারত। কিন্তু অফিসাররা পিকনিক করতে গিয়ে দেখেছে, প্রতিবারই কিছু অঘটন হয়। ক্লিনার ছোকড়াগুলো ছাড়া, পিকনিকটা বলতে গেলে মাটিই হয়। তাই ওদেরকে দুই সিটের মাঝখানে মোড়া ফেলে ঢাকা থেকে বয়ে নিয়ে যায়। হাতের কাছে ফুটফরমাশ খাটার জন্য এমন অনুগত ছোকড়াদের পেয়ে, সেদিন এক্সিকিউটিভ-অফিসারদের কেবলই নতুন নতুন কাজের কথা মনে হতে থাকে—ছেলেগুলো কোনটা রেখে কোনটা করবে!

ছোকড়াগুলো পারেও—হাসিমুখে এদিক সেদিক ছুটছে নবীন-প্রবীণ স্যারদের খুশি করার জন্য। ওদিকে স্টেজ থেকে মাইকে ঘোষণা চলছে, ‘এখন শুরু হচ্ছে ছোট বাচ্চাদের দশ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতা…বাচ্চারা, তোমরা মাঠের উত্তরপাশে ভলান্টিয়ার আংকেলদের কাছে যাও।…প্রস্তুত থাকুন, অফিসার ও সিনিয়র অফিসারগণ। তাদের জন্য রয়েছে চোখবেঁধে হাঁড়িভাঙ্গা খেলা।… সব শেষ আয়োজন ভাবিদের ৫০০ মিটার দৌড়…যারা ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড হবেন, তাদের জন্য রয়েছে আকর্ষণীয় পুরস্কার।’

মাঠের বাইরে দৌড়াচ্ছে ক্লিনার ছোকড়াগুলো—এমনিতেই—কোনো পুরস্কার নেই। পুরস্কার থাকবে কেন? ওরা তো আর খেলা করছে না। কাজ করছে। কাজের জন্য পুরস্কার নেই, মজুরি আছে, পিকনিক শেষে অফিসে ফিরে গিয়ে পাবে, জনপ্রতি ১০০ টাকা করে। কিন্তু তাতে কী আর মন ভরে? মন ভরে, খেলার মাঠের দিকে তাকিয়ে থেকে। ছোট ছোট বাচ্চারা কেমন বুক টানটান করে আকাশের দিকে নাক তুলে দৌড়োচ্ছে। দৌড় শেষ হলেই বিজয়ীদের নাম ঘোষণা হচ্ছে মাইকে। ঘোষণা দিচ্ছেন অফিসের সবচেয়ে সুললিত কণ্ঠের অধিকারী কর্মকর্তা শাহ আলম সাহেব। তার কণ্ঠ ভালো, উচ্চারণও ভালো—দাঁত আর জিহ্বা নিয়ন্ত্রণে রেখে তিনিই বাংলার আদর্শ চলিত রূপটি খানিক উচ্চারণ করতে পারেন।

শাহ আলম সাহেব মাইকে দুইবার ভোঁস ভোঁস করে ফুঁ দিয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘তিরতিয় ইস্থান ওদিকার কইচ্ছে… ওদিকার কইচ্ছে…নাবিল। নাবিল আমাদের ফোরদান কার্যালয়ে কর্মরতো সিনিয়র অফিসার…সিনিয়র অফিসার…জনাব মোঃ আমজাদ সাহেবের পুত্র—মারহাবা! আমরা তাকে করতালি দিয়ে ওবিনন্দন জানাই।’ ঘোষণা শেষ হতেই মাইকে বিড়বিড় করে আওয়াজ শোনা গেল। মাঠের সবার নজর স্টেজের দিকে। স্টেজ থেকে নেমে ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর একরামুদ্দৌলা সাহেব ভিড়ের ভেতর দিয়ে ভুঁড়ি ঠেলে মাঠের দিকে এগিয়ে আসছেন—সকালের রোদের আলোয় ফাঁকে ফাঁকে ওনার দুইপাটি দাঁত দেখা যাচ্ছে। বছরে ওনাকে শুধু একদিনই হাসতে দেখা যায়—পিকনিকের দিন। আর সারাবছর থাকেন গম্ভীর। ওনার খসখসে কালো চোয়ালের দিকে তাকালে মনে হয়, ওই জায়গার স্নায়ুর উপরে ওনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। পিকনিকের দিন উনি যাকেই পান তার সাথেই সালাম দিয়ে করমর্দন করেন। সালামের উদ্দিষ্টজন সালামের উত্তর কী দেবে, ওইরকম রাবণসদৃশ লোকের মুখে হঠাৎ সালাম শুনে, উল্টো সালাম দিয়ে দুই হাত পিছিয়ে আসে, যখন একরামুদ্দৌলা সাহেব হয়তো হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন উদ্দিষ্টজনের দিকে। তার হাতের সাথে আজ পর্যন্ত যারা হাত মিলিয়েছেন, তারা কেউ বলতে পারবেন না, ওনার হাত নরম না শক্ত, খসখসে না তেলতেলে—ভয়ে সবার হাতের তালু দু-মিনিট অবশ হয়ে থাকে।

একরামুদ্দৌলা সাহেবকে আজ সকালে একবার দেখা গেছে লাল রঙের একটা হাওয়াই শার্ট পরে কালো রঙের রোদচশমা চোখে দিয়ে, নীল রঙের একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন, পা তুলে দিয়েছেন সবুজ রঙের আরেকটি চেয়ারের উপরে। পা দোলাচ্ছিলেন। মাইকে গান বাজছিল—
আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী
সাথী মোদের ফুলপরী
ফুলপরী লাল পরী লাল পরী নীল পরী
সবার সাথে ভাব করি॥…

একরামুদ্দৌলা সাহেব প্যাকেট খুলে মুখের কাছে ধরে পিকনিকের নাস্তা তুলে তুলে খাচ্ছিলেন, কেউ কাছে গেলে বলছিলেন, ‘পিকনিকের সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে নাস্তাটা। আপনাদের কাছে বিষয়টা কেমন, জানি না।’ আগন্তুকরা সমস্বরে বলছিল, ‘অবশ্যই, নাস্তার ওপরে আর কিছু নাই।’ একরামুদ্দৌলা সাহেব মুখে খাবার ঠুসে দিয়ে আগন্তুকদের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ঘুরাচ্ছিলেন। উনি মানুষের কথা শুনে, তাৎক্ষণিকভাবেই সত্যমিথ্যা বুঝতে পারেন। আর ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে মানুষ বুঝতে পারে, উনি মনে মনে কী ভাবছেন। আসলে উনি মনে মনে ভাবেন না, মনে মনে কথা বলে নেন। আজ বলছিলেন, ‘তাহলে নাস্তা খেয়েই চলে যেতেন, লাঞ্চ করে আবার অফিসের খরচ বাড়াবার কী দরকার ছিল?’ এই বাক্যদুটো মুখে বলতে যতক্ষণ লাগে, উনি ঠিক ততক্ষণই একেকজন মানুষের দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকছিলেন। একরাম সাহেব কিছুক্ষণ পরপর হাত তুলে পেছনে কাউকে কিছু ইশারা করছিলেন। দুইজন ক্লিনার দুইদিক দিয়ে এগিয়ে আসছিল। একজন পানির বোতল খুলে এগিয়ে ধরছিল, অন্যজন টিস্যু।

বাচ্চারা যখন দৌড় দিয়ে এসে একে একে ফিনিশিং রোপ ছুঁয়ে দিচ্ছে, একরামুদ্দৌলা সাহেবকে দেখা গেল, হাঁসের মতো কোমর মুচড়াতে মুচড়াতে মাঠের দিকে ছুটছেন।

‘নাবিল কে? কে আমার নাবিল বাবা?’ একরামুদ্দৌলা সাহেব চোখের ঘাম মুছতে মুছতে নাবিলকে খুঁজছেন। নাবিল দৌড় শেষ করে ততক্ষণে ওর বাবার কাছে চলে গিয়েছিল। ওর বাবা আমজাদ হোসেন একপ্রকার ঘাড়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ছেলেকে নিয়ে একরামুদ্দৌলা সাহেবের সামনে হাজির করলেন, হে-হে করে হেসে বললেন, ‘স্যার, আমার ছেলে নাবিল।…নাবিল সালাম দেও।’

’ নাবিল সালাম দেওয়ার জন্য কপাল বরাবর হাত তুলেছিল, কিন্তু ঠোঁট নাড়াবার আগেই একরামুদ্দৌলা সাহেবের হাতের দুই পাঞ্জার ভেতরে অতটুকু মুখখানা আটকে যাওয়ায়, ঠোঁট আর নাড়ানো হলো না। একরামুদ্দৌলা সাহেব, ত্বরিত ওর মুখটা টেনে এনে কপালে চুমু খেয়ে বসলেন—চকাস্। চারিদিকে হৈ-হৈ শুরু হলো। মাইকে শাহ আলম সাহেব ঘোষণা করলেন, ‘আমরা দ্যাখ্তে পাচ্ছি, আমাদের সম্মানিত বিজ্ঞ উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয় জনাব মুহাম্মদ একরামুদ্দৌলা স্যার ক্ষুদে দৌড়বিদগুলার মইদ্দে উপুস্থিত হইছেন…সজোরে করতালি হবে।’ আবার করতালি শুরু হলো। সমবেত করতালির শব্দ যখন স্তিমিত হয়ে চড়াৎ চড়াৎ শব্দ হচ্ছে, শাহ আলম সাহেব মাইকে ঘোষণা দিলেন, ‘দ্বিতীয় ইস্থান ওদিকার কইচ্ছে আমাদের ফোরদান কার্যালয়ের সিনিয়র অফিসার, জনাব হায়াতুদ্দিনের পুত্র…পুত্র…আবির।’ আবিরের বাবা ছেলের ঘাড় ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ঘোষণা শেষ হতেই, ছেলেকে ঠেলে দিলেন। একরামুদ্দৌলা সাহেব আবিরের মুখটা দুই হাতে লুফে নিলেন, আওয়াজ হলো—চকাস্। চারিদিকে করতালি।

প্রথম স্থান অধিকারীর নাম ঘোষণা করার আগেই, ছেলেটা একরামুদ্দৌলা সাহেবের সামনে এসে হাজির হলো। বেশ গাট্টাগোট্টা শরীরের একটা ছেলে। হাফপ্যান্টের কোমরে হলুদ রঙের কাপড়ের ফিতা বেরিয়ে ঝুলছে। প্যান্টের নিচে তালের আঁটির মতো দুটো হাঁটু—কোঁচকানো কালো চামড়ায় ঢাকা। ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যায়, বেশ কাজের—ও ফার্স্ট হবে না তো কে হবে? দৌড়ে ঘেমে গেছে একেবারে। ছেলেটার সাহসও আছে। ও একাই এগিয়ে গেল ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাহেবের দিকে। একরামুদ্দৌলা সাহেব ঘোষকের দিকে তাকালেন। শাহ আলম সাহেব এক হাতে মাউথপিচ আর অন্য হাতে চিরকুট ধরে মাথা নিচু করে আ-আ করছেন—তাড়াহুড়ো করে লেখা, বোধহয় পড়তে অসুবিধা হচ্ছে। শাহ আলম সাহেব আ-আ করতে করতে অবশেষে ঘোষণা শুরু করলেন, ‘ফোরথম ইস্থান ওদিকার কইচ্ছে…ওদিকার কইচ্ছে মুহাম্মদ বাবুল…।’ একরামুদ্দৌলা সাহেব তার পাঞ্জার ভেতরে বাবুলের ঘর্মাক্ত মুখটা ধরেই ছিলেন। ঘোষণা শুরু করতেই ওর ঘামাচিবিপর্যস্ত কপালে ঠোঁট বসালেন—চকাস্। শাহ আলম সাহেব ঘোষণা দিচ্ছিলেন, ‘…মুহাম্মদ বাবুল হচ্ছে, আমাদের ফোরদান কার্যালয়ের সাফ্লাই এন্ড সেনিটেশন বিবাগে কর্মরত…কর্মরত..ক্লিনার…।’ ইতোমধ্যে চুমু শেষ করে একরাম সাহেব দাঁত বের করে উপস্থিত জনতার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ঘোষণা শেষ হতেই ওনার দুই ঠোঁট হঠাৎ বুজে গেল, কালো মুখে মুহূর্তেই আরেক পোচ কালো মেঘের ছায়া খেলে গেল। কণ্ঠমণি গলার চামড়া কুঁচকে নিয়ে থুতনির নিচে গিয়ে ঠেকল, নিচের ঠোঁট উল্টে বেরিয়ে এল।

একরামুদ্দৌলা সাহেব হড়হড় করে বমি করছেন। সবুজ ঘাসের উপরে ছলকে ছলকে পড়ছে—ব্রাউন কালারের বানের টুকরো, আধা-হজম হওয়া কলার সাদা সাদা দলা, ডিমের হলুদ হলুদ কুসুম—। কে যেন ছুটে এসে পেছন থেকে একরামুদ্দৌলা সাহেবের কপাল ধরতে চাচ্ছেন। কিন্ত বমির তা-বে একরামুদ্দৌলা সাহেব তীর ছোড়ার আগে ধনুক যেমন বাঁকা হয়, একবার তেমন বাঁকা হচ্ছেন, পরক্ষণেই, তীর ছুঁড়ে দিলে ধনুক যেমন সোজা হয়ে যায়, সেই রকম টানটান হয়ে যাচ্ছেন। আগ্রহী সেবাদাতা ওনাকে আর নাগালে পাচ্ছিলেন না। একটু দূরে এক বালতি পানি হাতে দাঁড়িয়ে আছে ক্লিনার লুলু মিঞা। ওর পাশে নেকড়া আর বেলচা হাতে হাফ প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে ওর সহকারি ক্লিনার মুহাম্মদ বাবুল। উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয়ের অকাজ শেষ হলেই ওরা কাজ শুরু করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *