ছোটগল্প।। অস্ফুট কলির ঘ্রাণ।। দীলতাজ রহমান

সুনসান নীরবতা মৃদু তছনছ হতেই চমকে ঘাড় ফেরালেন নাহার। শ্যামলা নয়, কালো থেকে কিছুটা উজ্জ্বল, যাকে তামাটে বলা চলে। মাথার চুলও কমে কপালের প্রসারটুকু তার প্রজ্ঞাকে জাহির করতেই যেন সহায়ক হয়েছে। দীর্ঘ দেহের পঞ্চাশের কাছাকাছি এমনি একজন মানুষ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। কপাল জুড়ে গলগলে ঘাম। হাসফাস অবস্থা। ঠা ঠা চৈত্রের ঝিমধরা দুপুরের কয়েকটি সেকেন্ডমাত্র। তারপর অপরিচিত আসবাব, অন্যরকম গোছগাছ, আর অপরিচিত মানুষ দেখে ‘সরি’ বলে দ্রুত হাতে দরজা টেনে রেখে ফিরে গেলেন। ভ্যাবাচাকা খাওয়া নাহার বুঝলেন, ভদ্রলোক ভুল করে ঢুকেছিলেন। লিফটের নাম্বারই হয়ত তিনি ভুল টিপেছিলেন।
দশতলা বাড়ি। প্রতিটি ফ্লোরে চারটে করে ফ্ল্যাট। হয়ত নিচে অথবা উপরে নাহারদের ফ্ল্যাট বরাবর কোনো ফ্ল্যাটের তিনি বাসিন্দা। তাই এই ভুল। কিন্তু আসল ভুল তো নাহার নিজেই করে রেখেছিলেন। দরজাটা সকাল থেকেই ভেতর থেকে লক করা ছিলো না। নাহারের এরকমটি প্রায় হয়। এমন ছিমছিম, সুনসান পরিবেশে নির্জনতা ভঙ্গ না হওয়ার অবসাদেই তিনি সারাক্ষণ ভোগেন। তাই বলে হাঁফিয়ে ওঠেন না। কোনো কিছুতেই হাঁফিয়ে ওঠা তার ধাতে নেই। একমাত্র সন্তানকে তিনি তৈরি করেছেন, বলার চেয়ে বলতে হয়, সামিউল নিজেই তৈরি হয়েছে মায়ের ধারণার চেয়ে অনেক বড় হয়ে।
নাহারের ধারণা আর কতটুকু ছিলো। সাত ভাইয়ের একটি মাত্র বোন তিনি। কোনোরকম স্কুলের শেষের ক্লাসে উঠতে পেরেছিলেন। কিন্তু দাপট ছিলো। সদলবলে রাস্তা কাঁপিয়ে হাঁটতেন। গ্রামের উঠতিবয়সী ছেলেগুলো সব কোণঠাসা হয়ে থাকত তার সামনে পড়লে। তাকে পথে-ঘাটে প্রেম-ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়ে কারো কারো নাজেহাল হওয়ার ঘটনা মুখে মুখে ফিরতো তখন। তবু একদিন এমন নাহারের মতামতকে অগ্রাহ্য করে বাবা বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। বাবার কথার ওপর ভাইরা কেউ কথা বলতে পারে, বা স্বামীকে যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে মত ঘোরানো যায় এমনটি নাহারের মাও চেষ্টা করেননি।
মহাধুমধামের বিয়েটিতে ছ’মাস না যেতেই নাহারের জীবনে ভাঙনের ঘণ্টা বাজাতে লাগলেন। বউমাকে নিতে এসে স্বয়ং শ্বশুরও হাত কচলাতে কচলাতে একা ফেরার কথা ভাবেন। বাড়ির কর্তা, অর্থাৎ নাহারের বাবা প্রথম হুঙ্কার দিলেন-বেয়াদব মাইয়েরে আমি নিজে হাতে কাইটে টুকরা টুকরা কইরে মাটিতে পুঁইতে রাখপো! কুলাঙ্গার…! ভাইয়েরাও যে যার মতো বিয়েদারী বোনের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পক্ষে মন্তব্য ছোঁড়েন।
টুকরো টুকরো হতে রাজি নাহার, তবু ওই শ্বশুরবাড়ি ফেরা আর নয়। তার এই অনীহার কারণ ভাবীরা বলাবলি করে-মাঝবয়সী, অশিক্ষিত গোঁয়ার এট্টা মানুষ। আব্বা শুধু জামাইয়ের সম্পত্তিডা দ্যাখছে। কোনো শরিক নাই, বাপের কোনো কিছু ভাগাভাগি নাই কারো সাথে সেইডেই দ্যাখছে। কিন্তু বাঁইটে, কালা সারা মুখে বসন্তের খুবলানো দাগ যারে কয়…। তার ওপর বউয়ের মন বোঝার চিষ্টাটাও করে না। অন্য কারো আঁচে নিজের উত্তাপ কোনোদিন নাহার নির্ণিত হতে দেননি। তার ভালোলাগে না, তাই সে বাপের বাড়ি ছেড়ে যাবে না। যাওয়ার চেয়ে না যাওয়ার অধিকারকে বড় করে তুলতে নাহার একাই তখন অবিচল।
বাবা-ভাইয়েরা যখন তাকে চাপ সৃষ্টি করতেন-‘এবাড়ির কোনো ঘরে তোর জায়গা হবে না!’ শুনতে শুনতে একদিন নাহার নিজেই মুখিয়ে কোনো এক কোণা ছেড়ে বাইরে, একেবারে মাঝ উঠোনে দাঁড়িয়ে বললেন-এ বাড়ির কোনো গরে জায়গা আমি চাই না! আমি আমার নিজির একটা গর চাই…। লা-জবাব সবার চমকানো, থমকানো, গজরানো ভেঙেচুরে নাহার অটল হয়েই পড়ে থাকলো।
এরই মধ্যে অবশ্য খবরটা এসে গেছে-জামাই আবার একটা বিয়ে করেছে। এবার বাবার নিজের মাথার হাত মেয়ের গায়ে ওঠে। ঠেকাতে এসে মায়ের গায়েও দু-চার ঘা বসে যায়। এমনতরো বিড়ম্বনাকে শঙ্কায় নিয়ে যেতে নাহার আরো তরান্বিত হয়ে উঠলেন। মা জানতে চাইলেন, তোর পেট-পাছা ভার ভার লাগে ক্যানরে? মাসিক অয় তো?
-না!
চমকে ওঠেন মা। বলেন, কয়মাস মাসিক অয় না?
-বিয়ের পর একবার অইছে!
আঙুল গুনে ধরা পড়লো চারমাসের বাচ্চা পেটে। আবার সবার অনুনয়, বিনয়, হাতজোড়-ফিরে যা নাহার। কত মানুষই তো সতিনের সংসার করে। বাচ্চার জন্য মেয়েমানুষ কী না করে।
কিন্তু নাহারের সেই ‘না!’
তারপর বাবা মারা যাওয়ার আগে শামসুন্নাহার বেগম ওরফে নাহারকে আলাদা করে বাবা যা দিলেন, তাতে বাবার সম্পত্তি সমান আট ভাগ হয়ে গেলো। বড়সড়ো করে টিনের একখানা ঘরও তিনি নিজের বাড়ি ঘেঁষে এমনভাবে করেছিলেন, যেন সেটা একখানা ঘরের স্বয়ংসম্পূর্ণ আরেকটা বাড়ি। কারণ তিনি টের পেতে শুরু করেছিলেন, ছেলের ঘরে জন্ম নেয়া নাতিপুতিরা মেয়ের ছেলেটিকে তাদের বাবা-মার প্ররোচনায় কথা দিয়ে নাজেহাল করতে ছাড়ে না। খেতে বসে সামিউলের পাতে তরকারি দিতে সব বউয়ের হাত কাঁপে। যেন ঝিনুক থেকে বেশি পড়ে যাচ্ছে দেখে পুরো ডিস আলগে ধরে সরিয়ে নেয়।
নিজের জীবনে কোনো আকাক্সক্ষাকেই বাড়তে দেননি নাহার। অথবা আকাক্সক্ষার ভাষা তার মন শেখেনি। চোখ খুঁজে পায়নি স্বপ্ন। বছরের দুখানা আটপৌরে শাড়িই তিনি এমন নিপাটভাঁজে পরেছেন, তাতেই ঢেকে গেছে অভাবের স্বরূপ। ছেলের পড়ার খরচের জন্য নিজের হাতে ফলানো হাঁস-মুরগি, সবজীর বহর দেখে অন্যদের তাক লেগে যেত। গরু পোষার মতো হুজ্জৎও তিনি সামলেছেন প্রসন্ন মুখে। এত যার শক্তি-ধৈর্য্য, সেই মানুষটি কেন স্বামীর ঘর করলো না, এই গুজুর গুজুর-ফুসুর-ফাসুর তার কান না এড়ালেও যেন ‘শোনার সময় নেই’ ভাবে তিনি নিজের কাজে মগ্ন থেকে গেছেন।
তবু একদিন সামিউল বলেছিলো- মা, আমি আমার বাবারে একটু দেখতে চাই। একদিন গিয়া দিনে দিনে ফিরে আসপো…। আমাগের গ্রামতে যারা স্কুলে আমার সাথে পড়ে, তারা আমাগে বাড়ির কত গল্প করে!’
ছেলের কথায় বড় চোখ করে নাহার ছেলের দিকে চেয়ে থেকে বেশ খানিকটা দেরি করেই উত্তরে শুধু বলেছিলেন- ‘তোগে বাড়ি না? তোর বাবা কয়দিন আইছিলো তোরে দেখতে!’
মায়ের কথা শুনে সামিউল কিছুটা ভড়কালেও, একটু সরে গিয়ে বলেছিলো-তুমিই তো যাওনাই বাবার বাড়িতে?
-সেইডা অন্য কথা। তুই কি মনে করছিস, তুই গ্যালে ধান-দুর্ব্বা দিয়া তোর বাবা তোরে বরণ কইরে নেবে? মানুষের লান্ত মাথা পাইতা নিতে যাবি ক্যান? তোরে নিয়া যেমন আমি একা অইছি, তেমনি আমি চেষ্টা করছি তোরে এ বাড়ির ছাওয়াল মাইয়ার মতো সমানভাবে চালাতি। তোর বাপের গরে বড় অলি এতদিন তোরে আতে লাঙ্গল তুইলা দেতো। আমার বাপে তো আমারে বিয়া দিছিলো পঞ্চাশ বিঘা জমি দেইখা। কিন্তু তাগো আচার-ব্যবহার, মুখের ভাষা শুইনা আমার দম আইটকা আসতো। আর সেগুলো আমি কোনোদিন কেউরে কইনাই। আমার বিয়ার পরেও তোর দাদা তোর দাদিরে গরু পিডানো লাডি দিয়া পিটাইয়া দিন নাই রাত নাই যহন তহন বেঁহুশ করতো। তোর বাপে মাঝরাতে বাড়ি ফিরা দরজা খুলতে দেরি অলিই আমার গায়ে আগুন লাগাই মারার হুমকি দিতো।
-সত্যি সত্যি তো আর আগুন দিতো না। অইটা তোমারে ভয় দেখাইতো।
-দেহিস না আশেপাশে দুই এক ঘরে… কেমনে বউরে পিডায়, আর পোলাপানগুলা চিৎকার করে… প্রতিদিন আত্মারে এইবাবে মারনের চাইয়ে আমার এই জীবনই বালো!

  • তবু আমার তো নিজের মতো সব দেখতে ইচ্ছা করে।’ কথাটা বলে সামিউল আরো একটু পিছিয়ে যায়। সেই থেকে শুরু, মা শামসুন্নাহারের সাথে ছেলে সামিউল হকের দূরত্বের। নাহার ঝাঁপিয়ে এসে সে দূরত্বকে লাঘব করবেন, এমন ধাতের তিনিও নন। হোক না সে নিজের সন্তান। নাহারের ভেতরের তেজ এখনো গনগনায়। তাতে করে তার নিজের সব আবেগ ভস্মিভূত হয়ে গেছে। নাহলে বাবা আবার যখন ভালো ঘর দেখে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তখন তিনি কার কথা ভেবেছিলেন? নিজের সন্তানের মাথার ওপর অন্য আরেকজনকে তিনি প্রতিপালক রূপে দেখতে চাননি বলে। ব্রফে এটুকুই। শুধু আজ কেন, নাহার কোনোদিনই কাউকেই কোনো কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য নন। নিজের ক্ষোভও কারো মধ্যে সংক্রমিত করতে চান না তিনি। তবু সেদিন কিছুটা রূঢ়স্বরে ছেলের কপালে নজর ঠেকিয়ে নারাচের মতো বলেছিলেন- শোন্ আমার যা বালো, তা তোরও বালো! আর এইহানে বালো না লাগলে, যা! যাইয়ে দেখ, সৎ মা’র বাড়া ভাত খাতি কেমন মজা?’
    সেদিন মা’য়ের কথার প্রতিউত্তর খুঁজে না পেলেও, সামিউল কখনো অব্যাহতি দেয়নি মাকে। আর এমনি প্রতিপক্ষের মুখে নিজের আহার তুলে খাওয়াতে, তার অস্তিত্বকে নির্বিঘ্ন করতে, প্রতি পলে নিজের যে ক্ষয় তিনি নির্বিবাদে করেছেন, তাতে সবটুকুই তিনি বিসর্জনের আগুন হয়ে গেছেন। তাই আর নিজের কু-লির ছাড়ানোর চেষ্টা করেননি।
    তখনকার বারো বছরের সামিউলের যাওয়া হয়নি তার বাবার কাছে। আর সেটা মায়ের ভয়েই হোক, বা বাবার টানে ছিন্ন দোষেই হোক। কিন্তু একটা স্বার্থপরতার দুষ্ট আভাসে ক্রমেই ছেলে যেন মাকে ধোয়াচ্ছন্ন করে তুলেছে। নানার বাড়িতে মানুষ হওয়া একটা অ-সুখের খরা কোথায় যেন বিঁধিয়ে রাখে তাকে। তবু সব ভাইবোনদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড়ে, সমান তালে বড় হয়ে যায় সে। আগে-পিছে মাতুলবংশে কয়েকটা ছেলেমেয়ের ভালো রেজাল্টের মতো সামিউলও এগিয়ে আসে। শেষের দিকের সবগুলো পাশই তার প্রথম শ্রেণীর। ঢাকায় এসে উঠেছিল বড় মামার বাসায়। চাকরি পাওয়া পর্যন্ত কোথাও তেমন একটা অসুবিধায় পড়তে হয়নি। বাকিটা নিজের যোগ্যতায় উৎরে গেছে সে।
    নিজের মর্যাদাবোধের সাথে সন্তানের মঙ্গলচিন্তাও অঙ্গাগি জড়িত থাকে। এই বিশ্বাস সামিউলের মধ্যে জন্মাতে না পারলেও কখনো বিরোধে তীব্র হয়ে ওঠেননি নাহার। তবু ছেলে মা অন্তপ্রাণ হলো না, এ নিয়ে নাহারের একটা সূক্ষ্ম ক্ষোভ আছে। অবশ্য তা নির্লিপ্তই রয়ে গেছে। সামিউল ঢাকা শহরে বউ নিয়ে থাকবে, আর মা দূরে গ্রামে পড়ে থাকবে, ছেলে এতে গররাজি। তবু ছেলের এটুকু টানের চেয়ে, ছেলে-বউ দুজনের প্রয়োজনে নিজের হিম্মতটুকু প্রয়োগ করতেই গ্রামের সব গুটিয়ে চলে আসা। তার ওপর পিউ নটা পাঁচটার চাকুরে। শাশুড়িকে শাশুড়ি বলে মনেই হয় না বউমার। বউকেও সন্তানের চেয়ে অধিক জানেন নাহার। এতে সামিউল এখানে হয়ে ওঠে গৌণ। এ সংসারে বউটিই যেন নাহারের প্রাণের অপরিহার্য। ছেলের প্রতি সূক্ষ্ম ক্ষোভটি রাঙিয়ে তুলতে এবারযেন মাক্ষম অবলম্বন পায় নাহার। আর সামিউলেরও সুপ্ত অভিযোগুলো চাপা পড়ে যায় এই ঘেরাটোপে।
    ছুটির দিনেও ওদের দুজনকে বাড়িতে পান না নাহার। যেন প্রতিদিনই তাদের মধুচন্দ্রিমা। অফিস যাচ্ছে হেসে হেসে। ফিরছেও ক্লান্তিহীন। এ রোশনাই ভালোই লাগে নাহারের। নিজের ভাই, ভাতিজা কেউ এলে সেই ওরা দু’জন কখন ফিরবে সেই হিসাব করে আসে। তবু একাকিত্বের ধোয়া তুলে সারাদিনের দুরুমের নিজ্ঝুম বাসাটি ফেলে পালাতে চাইবেন, সে রকম টান বা বিঘ্নত্ব দুটোর কোনোটিই তিনি জীবনের কোনো কিছুতেই গ্রত্থিত করেননি। তাই তো সবাই অবাক এই অবিরোধিতায়। অথবা বিরোধের শক্তিমত্তি মাধুর্যকে তিনি এতোই ব্যাপক করেছেন, যা সাধারণ চোখে কারো দেখার নয়।
    সারাবাড়ি ঝাড়ামোছা, গোছগাছ করেও ক্লান্তি নেই নাহারের। পেটিকোট, ব্লাউজ, ব্রা এমনভাবে গুছিয়ে রাখা যায়, পিউ তা জানতোই না। তার নিজের মা’ও কর্তব্য হিসাবে তাকে বাধ্য করতেন সংসারের এটা ওটা করতে। কিন্তু শাশুড়ি নিজে এটুকুও করে দিতে পারলে বর্তে যান। কেক, পুডিংসহ শহুরে ডিসগুলো তিনি ছেলের বউয়ের থেকে শিখে রপ্ত করার চেষ্টা করছেন।
    সেদিনও এক কুলো চাল বাছতে বাছতে ভাছিলেন তেমন একটা কিছু করার। কিন্তু নীরব বাসায় কুলোয় চালের কাকরের চোখ গিয়ে উঠলো অচেনা একজন পুরুষের কপালে! আপাদমস্তক তাকে দৃষ্টির আওতায় আনার আগেই আবার সে হাওয়া। কিন্তু ঘাম, সিগারেট, পারফিউম, আর পুরুষালী গন্ধের দোলাটা ঠিকই রয়ে গেলো কোথাও। সে রাতে একটুও চোখ বন্ধ করতে পারেনি নাহার। অন্ধকারের ভেতর তাকিয়ে ছিলেন। খুব একটা এপাশ ওপাশও না করে। পিউ মাঝে মাঝেই বলে-চলেন মা আপনাকে বিউটি পার্লারে নিয়ে মুখটা একটু ফ্রেস করে আনি। চুলগুলো ছেঁটে নিলে তো কথাই নেই… আপনার চুলে স্ট্রেপকাট যা মানাবে না মা!
    ততদিনে নাহার বুঝে গেছেন আজকালকার শহুরে মা-শাশুড়িদের দেখে এসে, নিজের আনস্মার্ট, গেঁয়ো শাশুড়িকে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিতে তার ছেলের বউটি ঠিক জুৎ পায় না। তাই বলে এ বয়সে রূপসাধন? নাহার তাই হেসেই বলেন- জঙ্গুলে লতার একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে বউমা!’ বলে বিষয়টি কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু সেই দুপুরের পর থেকে খুব ইচ্ছে করছে পিউ তাকে আবার বিউটি পার্লারের কথাটি বলুক। এবার বললেই প্রস্তাবটা লুফে নেবেন।
    কিন্তু দিন কাটতে চায় না নাহারের। একদিন ছুটির আগের দিন নিজেই বলে বসলেন-আমার মুখে বোধ হয় মেসতা পড়ে যাচ্ছে বউমা। কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলে…।’ পিউ প্রস্তাবটি সত্যিই লুফে নিলো। প্রথমে আয়নার সামনে যেতেও বিব্রত বোধ করছিলেন নাহার। কিন্তু ছেলের সামনে পড়ার আগেই পিউয়ের নিজস্ব গলগলে তারিফে বিষয়টির হোতা যে সে নিজেই, স্বামীর কাছে তা প্রমাণ করে শাশুড়িকে বড়ধরণের বিড়ম্বনা থেকে রক্ষে দিলো। পিউ একটু প্রশ্রয় পেয়েই শাশুড়ির জন্য কেনা শুরু কওে দিলো, চওড়া পাড়ের শাড়ি। রঙের তারতম্যে যেন তাতে জীবনের সব ধূসরতাকে ঢেকে দেয়ার তীব্র একটা প্রয়াস থাকে বউয়ের। তারপর ক্রমে প্রতিদিন সকালে ছেলে, বউমাকে বিদায় অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে যাওয়া শুরু হলো কয়েক কদম করে। সকাল-সন্ধ্যা কিম্বা রাতে দরজা যখন খুলতে হয়, যেন আরও একটু বেশি গেলে ক্ষতি কী? কিন্তু ফেরার ক’পায়ে তিনি ধন্দে পড়ে যান- এ আমার কী হলো? আর এই আত্মজিজ্ঞাসাই নাহারের অভিনবত্বকে উস্কে দেয় প্রতিদিন। মুখের কঠিন রেখাগুলো ক্রমশ মিইয়ে এসে শরীরের ভাঁজগুলো ফুটে ওঠে তার নিজেরই চোখে। এতে বড় অস্থির লাগে তার।
    কত মানুষের আনাগোনা। লিফট, সিঁড়ি সমান চলে মানুষের পদচারণায়। কিন্তু দোলার সে সুবাতাস রহিত হলো কোথায়? তিনি কি তাহলে নিচের কোনো ফ্ল্যাটে থাকেন? নাহাররা থাকেন আটতলাতেই। হয়ত ভুল করেই তিনি লিফটে নিজের ফ্ল্যাট পার হয়ে আরো ওপরে চলে এসেছিলেন।
    নাহার নিজেও জানেন, তার এ সাজসজ্জা সবই ভুল। তবু সেই ভুল হাওয়ার পরশ চাইছেন তিনি! তার বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে এই প্রথম কারো জন্য অপেক্ষা। এ অপেক্ষার আলোতেই এই বাড়ি এখন তার কাছে গুমোট, স্যাঁসস্যাঁতে মনে হয় না। এখন আর সামিউল বা পিউ, কাউকেই বলেন না-জানালায় দাঁড়ালিই ঝাঁপায়ে আসে আরেকটা বাড়ির দেয়াল। দিনির ব্যালাও বিদ্যুৎ না থাকলি চোখে দেহা যায় না। দম বন্ধ অয়ে আসে এহানে। আমারে ঢাকা শহরে রাখতি অলি আলো-বাতাসের বাসা নেও। না অলি যশোরের মানুষ আমি যশোরেই গিয়ে থাহি। মাঝে মাঝে আইসে বেড়াবো, সেই বালো বাড়ির গরু-ছাগলগুনো বেইচে ভুলই অলো।
    মায়ের কথা হয়ত মনে ধরেই ছিলো সামিউলের। হয়তো তারা দুজনে মিলে বাসার খোঁজও করেছে। না হলে হঠাৎ করে বললো কীভাবে- তোমার জন্য বাসা দেখে এলাম মা। কলাবাগান মাঠের কাছে। আমরা আগামী মাসেই চলে যাবো। ও বাড়িটা এতটুকুই। কিন্তু একেবারে নতুন। আমারই হবো ওটার প্রথম বাসিন্দা।
    নাহার থতমত খান। কী বলবেন ভেবে পান না। আমতা করেন-আমি কইছি, তাই বাসা পাল্টাতি অবে? তোমাগের দুইজনের যেহানে সুবিধা সিহানেই তোমরা থাকপা।’
    -আপনার ইচ্ছে পূরণই আমাদের আনন্দ মা। আজই আমরা এ্যাডভান্স দিয়ে এলাম। নাহারের কথা সরে না বউমার কথায়। কিন্তু একটা কিছু বলা দরকার! তাই যা বললেন-দ্যাখো এ্যাডভান্স ফেরত আনা যায় নাকি! কিন্তু তার কথা ওদের কান পর্যন্ত পৌঁছে না।
    আর মাত্র কদিন বাকি এ বাড়ি ছেড়ে যেতে। সব বাঁধাছাঁদার তোড়জোড় চলছে। সামিউলের বারবার ঘর বার করা বেড়ে গেছে। শিথিল হাতে আরো আগে থেকে নাহারই সব গুছিয়ে প্যাকেট করছেন। পিউও ইচ্ছে হলে তার মতো করে হাত লাগায়। অনিচ্ছের সব শাশুড়ির ওপর গড়ায়।
    বাড়িটি ছেড়ে যাওয়ার ঠিক আগে দোকান থেকে কিছু একটা আনতে হবে। সন্ধ্যার পরে শাশুড়িকে নিয়ে বের হয় পিউ। ক’দিন ধরে এরকম হয়ে যাচ্ছে। বাটন চাপ দিতে দশতলা থেকে কয়েক সেকেন্ডে নেমে আসে লিফ্ট আটতলায়। ওরা নামতে নামতে বোঝে, পাঁচতলায় কেউ উঠবে। খোলামাত্র ঢিলেঢালা হাফ হাতা গেঞ্জি আর ট্রাউজার পরা, সরু চশমা চোখে একজন উঠে দাঁড়াতেই নাহার চমকে বলে উঠলেন-আপনি একদুপুরে আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিলেন, মনে আছে…!’
    ভদ্রলোক ভ্রুতে এমনভাবে ভাঁজ তুললেন, যার মানে দাঁড়ায়-তিনি কি আপনি ছিলেন, যাকে আমি দেখেছিলাম? যাকে দেখেছিলাম সেতো অতি আটপৌরে, বিধ্বস্ত এক গ্রাম্য মহিলা। যে আমাকে দেখে চমকে উঠে আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো…!’
    তারপর পিউয়ের দিকে তিনি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে বললেন? সত্যি আমার গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসা উচিৎ ছিলো আপনাদেও কাছে। কিন্তু যিনি বাসায় ছিলেন, তিনি যেভাবে চমকে উঠেছিলেন, আমি তো সেই অবধি ভয়েই আছি। কোথাও ধরা পড়ে নাজেহাল হই। কারণ তিনি ঠিক কীভাবে এর ব্যাখ্যা করবেন আপনাদের কাছে…।’
    ভদ্রলোকও ঘটনাটি ভোলেননি ভেবে নাহার চমকিত হতে গিয়ে দমিত হয়ে গেলেন। কারণ নাহার এখানে আলোচনার লক্ষ্য নয়। সম্মানজনক উপলক্ষ্যও ভাবছেন না উনি তাকে।
    নাহারের করা প্রশ্নের উত্তর কৈফিয়তের স্বরে ব্যক্ত করলেন পিউয়ের কাছে। আর পিউও লোকটির কথায় বহুদিনের চেনা মানুষের মতো অকপট হেসে বলতে লাগলো- এমন হতেই পারে। আমাদের হয় না? মানুষের মন এবং চোখ কি আর সারাক্ষণ একসঙ্গে জাগরুক থাকতে পারে?’ এটুকু কথা শেষ হওয়ার আগেই পথ বেঁকে যাওয়ার কথা। তাই কথা শেষ হতেই যার যার পথে ঢিমে তাল কেটে পদচারণা দ্রুত হলো।
    বিয়ের আগে থেকে দেখা প্রায় দুই বছরের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম শাশুড়ির মুখে একটি সম্পূর্ণ বাক্যের শুদ্ধ উচ্চারণ ‘আপনিই তো একদুপুরে আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিলেন…।’ প্রসঙ্গক্রমে শাশুড়ির জীবনের সব অধ্যায় থেকেই তাঁর নিজের মুখে যতটুকু শুনেছে, তাতে একটা নিটোল গল্পের নায়িকায় পরিণত হয়ে আছেন তিনি বউয়ের মনে। যদিও সামিউলের কোনো উৎসাহ সে কখনো লক্ষ্য করেনি মায়ের কোনো বিষয় নিয়ে কিছু বলতে বা শুনতে। তবু কোনো সংঘাত জয়ের অবসাদ বা আনন্দের রেশ নয়, যেন একটি শীতার্ত নদীর একা বয়ে চলার চিহ্ন কপাল জুড়ে প্রকট হয়ে আছে শাশুড়ির। তাই সামিউলের শীতল মনোভাবকে সে কখনো সমর্থন করতে পারে না।
    নতুন বাড়িতে শাশুড়িকে সবতাতে ক্ষুণ্ন থাকতে দেখে, এবং সেদিনের লিফটের ঘটনার রেশ ধরে পিউ খুব ঘনিষ্ঠস্বরে এক সময় বললো-মা আপনি বাবার কাছে ফিরে যেতে পারেন না? অথবা তাকে এখানে আনতে…।’
    বহু বছর পর এই প্রথম নাহার আবার গুলিয়ে ওঠেন। কারণ এখনো তিনি মাত্র ত্রিশ হাজার টাকার কাবিননামায় ঝুলে আছেন। যা ছিন্ন করতেও প্রসঙ্গের অবতারণা করতে হতো বলে ছিন্ন করা হয়নি। আর সে জন্য আজো ধুলো জমে সুতোর শক্ত হয়ে থাকার মতো কোনো অনুভূতিই মগজে শিরায় কাজ করছে না। তিনি অবচেতনেই বিড়বিড় করে বললেন- আশ্রয়হারা নাহলে কেউ কারোর কাছে যাতি চায় না বউমা! সবাই কেবল সবার নিজির স্বপ্নের কাছেই যাতি চায়। সেরকম স্বপ্ন কখনি আমারে হাতছানি দেয় নাই। শুধু একটাই ভয় আমার। আমি যেন তোমাগে কোনো অ-সুখের কারণ না অই। এইটুকুরতে রেহাই পাওয়া ছাড়া, কারো কাছেই আর আমার কিছু চাওয়ার নাই!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *