ঘোর // পিওনা আফরোজ

কনফারেন্স রুমে সকালের নিয়মিত ব্রিফিং চলছে। বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর শামসুর রহমান ,চেয়ারে বসে আছেন। বিভিন্ন বিভাগের বারো জন ডাক্তার তাঁর তিন পাশে। ব্রিফিং এ নতুন কিছু নেই। সেই বহুল কথিত ‘কোভিড নাইনন্টিন ‘। গত কয়েক মাস ধরে একই টপিকস এ বারবার মিটিং। বিরক্তি ধরে গেছে ডাক্তারদের। তবু সরকারি নিয়ম। না শুনে উপায় নেই। এই ভয়ংকর ভাইরাস থেকে দূরে থাকারও কোন ও উপায় নেই। সামনে ধোঁয়া ওঠা চা এ চুমুক দিতে দিতে স্যারের চর্বিত চর্বন কথাগুলো শুনতেই হচ্ছে অগত্যা। একটি চেয়ারই শুধু খালি। সেটি ডাক্তার শাহেদের। ইয়াং। দেখতে হ্যান্ডসাম। কথা বলে খুব কম। কিন্তু দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে খুবই সচেতন। প্রফেসর রহমান সম্ভবত সেজন্যে একটু বেশিই স্নেহ করেন শাহেদকে। এজন্যে শাহেদকে নিয়ে ডাক্তারদের মনে কিছুটা ঈর্ষা কাজ করে। কিন্তু কাজ পাগল মানুষ প্রফেসর রহমান, এসব গায়ে মাখেন না। সেই শাহেদ আজ একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছে। কোনো সমস্যা হলো না তো? প্রফেসর রহমানের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে। মোবাইলে শাহেদ এর নাম্বার টা ডায়াল করবেন কথা বলার জন্য,ঠিক সেই সময়ে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে পড়ে শাহেদ। কিছুটা বিষন্ন দেখায় তাকে। খালি চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলে,‘স্যরি স্যার। মেয়েটা কিছুতেই ছাড়ছিল না। করোনার কথা শোনার পর থেকে রোজই এমন করে।এনিওয়েস। কী বলছিলেন,বলুন স্যার।’প্রফেসর রহমান বললেন,‘না, নতুন কিছু না। সবই তো জানো। করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দেশে। বাকিটা শুনে নিও কলিগদের কাছ থেকে। আমার আর বলতে ভালো লাগছে না। মনটা খারাপ করে প্রফেসর রহমান মিটিং শেষ করে চলে গেলেন পাশের রুমে।প্রফেসর রহমানের বের হওয়ার পর পরই একে একে সবাই মিটিং রুম থেকে যার যার দায়িত্ব পালনে বেরিয়ে পড়লেন।শাহেদের উঠতে ইচ্ছে করছিলো না। এই একাকীত্বের সুযোগে সকালের ব্যাপারটা মাথায় এসে ভর করে। স্ত্রী শীলা আর একমাত্র মেয়ে ছয় বছরের মানালকে নিয়েই ওর ছোট্ট সংসার। এতদিন কত হাসি আনন্দই না ছিল ওর সংসারে। সারা বিশ্ব জুড়ে করোনার প্রাণঘাতী তান্ডব সবার মুখ থেকে সেই হাসিটুকু কেড়ে নিয়েছে। ধুকে ধুকে চলে যাচ্ছে কত শত শত প্রাণ। অথচ কোন চিকিৎসা নেই। ভ্যাকসিন নেই। ডাক্তারদের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট ইকুইপমেন্টও নেই। এসব খবর শীলাকে বলতে হয়নি। টিভি আর নিউজপেপার থেকেই সব জেনেছে । টিভি দেখলেও খবর টবর তেমন দেখে না সে। পত্রিকা পড়লেও সিনেমা,লাইফ স্টাইল,রান্নাবান্না এসবেই ওর ঝোঁকটা বেশি। করোনার উত্তাপে এখন সেসব ঝোঁকও গেছে। এর উপর আসছে অনেক স্বপ্নের, অতিথি। শীলা আর সাহেদের দ্বিতীয় সন্তান।মানালের একজন সাথী হবে,দুজনে এক সাথে খেলবে,খুনসটি করবে- সেই আনন্দেই কাটছিল ওদের দিন আর রাত। সেই আনন্দ এখন হয়ে পড়েছে উদ্বেগের কালো মেঘ। মনের উপর কোন চাপ যাতে না পড়ে সেজন্যে অনেক খবরই শীলাকে দেয় না শাহেদ। টিভির খবর দেখতেও বারণ করেছে। তারপরেও স্বামীর জন্য উৎকন্ঠা কি আর কমে যায়?দিন দিন হাসিখুশি সুন্দর মুখটা বিষন্নতায় ভারী হয়ে যাচ্ছে । পেশাগত কারণে ,ডাক্তার স্বামীকে এই বিপদে আটকাতে চেয়েও পারে না। শাহেদকে ও ভালো ভাবেই চেনে। মানুষকে সেবা করা আর তাদের মুখের হাসিই শাহেদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। এমনকি এই সংসারের চেয়েও বেশি। প্রতিদিন তাই চোখের জল গোপন করেই বিদায় দিতে হয় শাহেদকে। কিন্তু আজ আর পারেনি। শাহেদকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে শীলা কেঁদেছে। ছোট্ট মেয়ে মানালও পথ আটকে দিয়েছিল। বলেছিলো,‘না বাবা,তুমিআজ অফিসে যাবে না।’ শাহেদ বলল,‘না মা ,তা কী করে হয়? আমি যে ডাক্তার। আমার কি এসবে ভয় পেলে চলবে?’‘চলবে। একশো বার চলবে। তুমি আমার বাবা। করোনা কি বাবাদের ছেড়ে দেয়?’ঠিকই তো। করোনা কাউকেই ছাড়ে না। অসহায়ের মতো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা ছাড়া কোন উপায়ই আজ আর মানুষের নেই।ওইটুকু মেয়ে হয়েও সে ঠিকই বুঝেছে করোনার এই ভয়ংকর থাবার কথা। কিছুতেই মানানো যায় নি মানাল কে। বাবার অফিসের ব্যাগটা লুকিয়ে রেখে আটকানোর শেষ চেষ্টা করেছিল একমাত্র স্নেহের মেয়ে। পরে ওর প্রিয় চকলেটের লোভ দেখিয়ে কোলে নিয়ে আদর করার পর ছাড় পেয়েছিল শাহেদ। কিন্তু কাল? তারপরদিন? কিভাবে সামলাবে সে এইসব ভালোবাসার চাপ? কিভাবে?এরপর দিন পনের কেটে গেছে। করোনা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। আক্রান্তের সংখ্যার পাশাপাশি মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। এ হাসপাতালের দুজন ডাক্তারও ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। শাহেদের দায়িত্ব তাই আরো বেড়ে গেছে। নিজেকে যতটা সম্ভব প্রটেকশনে রেখে রাতদিন সেবা দিয়ে যাচ্ছে সে। রাতে বাসায় ফিরতে কোন কোনদিন অনেক রাতও হয়ে যাচ্ছে ওর। বাসায় ফিরেও থাকতে হচ্ছে একা। এত রুগীর মধ্যে কাজ করে আইসোলেশনে না থেকে তার উপায়ও নেই। শীলা সেটা মেনেই নিয়েছে।কিন্তু বাবার কাছে যেতে না পারার কষ্টটা শুধু চেপে রাখতে পারছে না মানাল। ঘরের দরজায় দাাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাবাকে কত যে হাওয়াই চুমু দিচ্ছে, তার কোন হিসেব নেই। এভাবেই এক সময় অভ্যস্ত হয়ে যায় মানালও। কিন্তু সপ্তাহখানেক পরে বাসায় ফেরার পরিস্থিতিটাও আর থাকে না। ঢাকার আরো কয়েকটি হাসপাতালের সাথে শাহেদদের হাসপাতালটিকেও করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। টেস্ট করানোর ব্যবস্থাও করা হচ্ছে শিগগিরই। নমুনা সংগ্রহ ও টেস্ট করার জন্য শাহেদসহ কয়েকজনকে ট্রেনিং ও দেয়া হয়েছে গত তিনদিনে। তার মানে চ্যালেঞ্জটা আরো বেড়ে গেলে। এ খবরে ডাক্তার নার্স সহ সবার মুখেই নেমে আসে আতঙ্ক ও বিষন্নতার কালো ছায়া।এদিকে শীলার ডেলিভারীর সময় ঘনিয়ে আসছে। এ সময় স্বামী হিসেবে শাহেদের পাশে থাকা খুব দরকার। কিন্তু সেই সুযোগ বা সময় কোথায়? হাসপাতালে টেস্ট করতে আসা মানুষের ভীড় আর করোনা আক্রান্ত রুগী যেভাবে বাড়ছে, তাতে তাদের সামাল দিতে গিয়ে বাড়ি ফেরার সময়টুকুও আর মিলছে না তার।হাসপাতালের ভেতরেই আলাদা থাকার ব্যবস্থা আছে। অনেকে থাকছেনও। শুধু শাহেদকেই হাসপাতালে থাকার কথা বলতে পারছেন না স্যার, সম্ভবত শীলার কথা ভেবে। শাহেদও শীলাকে এখন অনেক কিছুই জানায় না। ওর মনের ওপর চাপ পড়বে সেই ভয়ে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে শীলার দিকটায় এতটা ইম্পর্টেন্স দেয়া আর চলছে না। ডাক্তারের কাছে রুগীই সবকিছুর উপরে। এসব ভেবে মনটাকে শক্ত করে ফেলে শাহেদ। হাসপাতালে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় । শীলা যথেষ্ট ভালো মেয়ে। নিশ্চয়ই তার কর্তব্যের বিষয়টি বুঝবে। ফোনটা হাতে নেয় । অফিসে আসার ঘন্টাখানেক পরে শাহেদের ফোন পেয়ে একটু অবাকই হয় শীলা।‘কী ব্যাপার শাহেদ? কোন সমস্যা? এ সময় তো তুমি ফোন কর না। সব ঠিক আছে তো?’‘হ্যাঁ শীলা,এভরিথিং ওকে। শোন শীলা, হাসপাতালে কাজের চাপ বেড়েছে। বাসায় যাওয়া আসা করা এখন আর possible হচ্ছে না। তাছাড়া সবসময় রুগীদের সেবা দিতে গিয়ে আমি নিজেও যে কোন সময় এ্যাফেক্টেড হয়ে যেতে পারি। তাই তোমাদের সেফ্টির কথা ভেবে আমি এখানেই থাকার ডিসিশেন নিয়েছি। তোমার সাথে কথা তো হবেই। তাছাড়া যখনি দেখতে ইচ্ছে হবে ভিডিও কল করব। সো, ডোন্ট ওয়ারি।কোন কথা নেই।ফোনের ওই প্রান্তে গাঢ় নিস্তব্ধতা। কিছুক্ষণ পর কান্নার ফোঁপানি শব্দ। শাহেদ বোঝানোর চেষ্টা করে।‘এই শীলা,ডাক্তারের বউ হয়ে তোমার এমন কান্না করা কি চলে? আমি তো দূরে কোথাও যাচ্ছি না। পরিস্হিতি তো বুঝতে হবে। পরিস্হিতি ঠিক হয়ে গেলেই তো চলে আসব। জীবনের জটিল কিছু পরিস্হিতিতে কত কিছুই আমাদের মেনে নিতে হয়। উপায় নেই শীলা । প্লিজ শান্ত হও। মানালকে বুঝিয়ে বলো।শীলা,বুঝতে চেষ্টা করো। অনেক চ্যালেঞ্জ এখন আমাদের সামনে…’‘ঠিক আছে,সাবধানে থেকো। ফোন করো।’’Take care dear।’ বলেই শাহেদ ফোনটি কেটে দিল।হাসপাতালে সংকটেরও শেষ নেই। ডাক্তার নার্সদের অভাব তো আছেই, তার উপর দরকারি ইকুয়েপমেন্টও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। এরই মধ্যে জরুরী ভিত্তিতে আসা রুগীদের মধ্যে তিন জন মারাও গেছে। কিছু করার নেই। আইসিইউ তে অল্প কয়েকটি বেড, অল্পসংখ্যক অক্সিজেন-সিলিন্ডারএই নিয়ে কিভাবে সম্ভব, এত রুগীকে জরুরি সেবা প্রদান করা? রুগীদের সামলাতে গিয়ে হাসপাতালের ডাক্তার নার্স স্টাফ সবারই চোখে ঘুম নেই। তারপরেও এ এক কঠিন যুদ্ধ। প্রাণপণ লড়ে যেতে হবে সবাইকে শেষ নিঃশ্বাসটুকু পর্যন্ত। প্রফেসর রহমান নিজেও সব ক্লান্তি ভুলে, বাসায় যাওয়া বাদ দিয়ে সবাইকে সাহস যুগিয়ে চলেছেন, পুরো হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে।আজ আটদিন হলো শাহেদ বাসায় ফেরেনি। একরাশ ক্লান্তি তার শরীরেও ভর করেছে। মাঝেমধ্যে একটু জ্বরও আসছে। সর্দি কাশিও আছে সাথে। এখনও পর্যন্ত তার অসুস্থতার কথা কেউ জানেনা । নিজের জানা ওষুধগুলোই খেয়ে চলছে। তাতে জ্বর কিছুক্ষণের জন্য কমলেও আবারও আসছে। কিন্তু নিজের শারিরীক অসুস্থতাকে পাত্তা না দিয়েই কাজ করে যাচ্ছে দিনরাত। কলিগরা সাবধান করেছে কয়েকবার। শাহেদের একই উত্তর‘ও কিছু না, সিজন্যাল। অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্যও হতে পারে। ঠিক হয়ে যাবে’।এসব বলে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে । কিন্তু প্রফেসর রহমান এর অভিজ্ঞ চোখকে এড়ানো সহজ নয়। রাউন্ডে এসে শাহেদের সাথে কথা বলতে বলতে এক সময় বললেন,‘আমার কিন্তুু সন্দেহ হচ্ছে শাহেদ। তুমি আজই টেস্ট করিয়ে নাও। নো আর্গুমেন্ট। কালই রিপোর্ট চাই। ওকে?’আর কিছু বলার সাহস পায় না শাহেদ। শুধু যে বস তা নয়,প্রয়াত বাবার মতোই শাহেদ তাঁকে সমীহও করে যথেষ্ট।হাসপাতালের নির্জন একটি ঘরে শুয়ে শুয়ে কত কি ভাবে শাহেদ। ন’টা দিন কেটে গেছে তারপরও বিশ্বাসই করতে পারে না যে, সে নিজেই এখন করোনা পজিটিভ। অথচ এটাই সত্যি। খুব জোরালো ভাবে সবাইকে নিষেধ করে দিয়েছে, শীলা যেন কোনভাবেই শাহেদের অসুস্থতার কথাটি জানতে না পারে। শীলার সাথে শাহেদের সব ধরনের কথাই হয়,শুধু পজিটিভ কথাটি ছাড়া। কিন্তু করোনা তো কারো বারণ শোনে না। সে গলা থেকে শ্বাসনালীতে এরই মধ্যে নামতে শুরু করেছে। গলা ব্যথাও বেড়েছে। কিছু উপসর্গভিত্তিক ওষুধ চলছে এখনও। তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না। তবে অবস্থা খুব খারাপের দিকে এখনও যায় নি। মোটামুটি স্টেবল রয়েছে বলা যায়।ওদিকে শীলা এখনও জানে যে, সিজন্যাল কোনো অসুখ টসুখ কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কই, কতদিন হয়ে গেল, ঘরে তো ফিরছে না শাহেদ। জিজ্ঞেস করলেই বলে, কিছু ভেবো না তো শীলা,আমি ঠিক আছি। শারিরীক দুর্বলতার জন্য স্যার কিছুদিন রেস্ট নিতে বলেছেন । ফিজিক্যালী একটু স্ট্রং ফিল করলেই বাসায় চলে আসব। টেনশন করো না ।’কিন্তু মন কি তা মানে? টিভির সামনে বসলেই নিউইয়র্ক, স্পেন, লন্ডন, ইতালীর ভয়াবহ খবর চোখের সামনে ভাসে। শাহেদ কি কিছু লুকোচ্ছে? প্রশ্নটা মনের ভেতরে এলেই বুকটা ধক করে ওঠে শীলার। কিন্তু শীলা এ-ও জানে-কিছু লুকোনোর মতো ছেলে শাহেদ নয়। এ কাজটি কখনও শাহেদ করেনি। নিজেকে কিছুটা তবু এভাবে সান্তনা দেয়। কিন্তু মানাল? ওকে তো আর বোঝানোই যাচ্ছে না। সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছে। ফোনে বাবার সাথে কথা বলিয়ে দিয়েও ওকে থামানো যাচ্ছে না।শীলার এ অবস্থা জেনে বগুড়ার বাড়ি থেকে মা বাবা বোন প্রায়ই খোঁজখবর নিচ্ছে।শুধু ওইটুকুই। আসার মতো অবস্থা কারো নেই। সাভারে শাহেদের এক খালা থাকেন। তিনিই খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। খালা সংসারের অনেক কিছুই সামলান। কিন্তু মন সামলানো? সেটা করবে কে? শাহেদের কলিগ ডাক্তার রূপম ঘন ঘন ফোন করে শীলার খবর নেয় ঠিকই, কিন্তু শাহেদের অসুস্হতা নিয়ে ডিটেইলস কিছুই বলে না। এটা সেটা বলে এড়িয়ে যায়। তাতে মনের চাপটা আর সরে না শীলার। রাতে দু’চোখের পাতা একেবারেই এক করতে পারে না শীলা ।পনেরদিন পরে দ্বিতীয়বার টেস্টেও পজিটিভ ধরা পড়ে শাহেদের। তবে উপসর্গগুলো আগের মতোই আছে। কিছুটা চিন্তিত হয়ে প্রফেসর রহমান ডাক্তার রূপমকে ডেকে নেন চেম্বারে।‘বসো রূপম। শাহেদ না থাকায় তোমার উপর খুব চাপ পড়েছে বুঝতে পারছি। কিন্তু কী করবে বল। আমাদের যে কোন পরিস্থিতির জন্যই তৈরি থাকতে হয়। এনিওয়েস, শাহেদকে কেমন মনে হচ্ছে তোমার?’‘ভালো তো বলতে পারছি না স্যার। তবে উপসর্গগুলো স্টেবল আছে-এটা একটা ভালো দিক।’‘না রূপম। সেকেন্ড টাইমও পজিটিভ। আমি কোন রিস্ক নিতে চাই না। অবস্থা যে কোন সময় আরও খারাপ দিকে যেতে পারে। ওষুধগুলো চলতে থাক। আর তুমি ইমিডিয়েটলি আইসিইউর একটি বেড খালি কর। আমি এই হাসপাতালের করোনাযোদ্ধা একজন ডক্টর নার্সকেও হারাতে চাই না। আমি শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে যেতে চাই,বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান প্রফেসর রহমান। খোলা জানালার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন। স্যারের এমন প্রত্যয়দীপ্ত ভাবান্তর দেখে রূপম আর কিছু বলার সাহস পায় না। নীরবে বেরিয়ে যায় চেম্বার থেকে।চব্বিশটি দিন হয়ে গেল শাহেদের এই নির্জন বাস। অবস্থা যা ছিল, তার থেকে একটু ভালো বোধ হচ্ছে আজ। আরো কয়েকজন রুগীও তার আশেপাশেই আছে। সবারই বাধ্যতামূলক আইসোলেশন। চোখের সামনেই বিরাট হাসপাতাল। রুগীদের চিৎকার, কান্নকাটি সবই কানে আসে তার। একটু আগে করোনায় মারা গেল আরেকজন রুগী। স্বজনদের তার কাছেও যেতে দেয়া হচ্ছে না। সে কি বুকফাটা আর্তনাদ তাদের। সাদা ব্যাগে লাশটিকে ভরে, সাহেদের রুমের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো।দুঃখজনক হলেও সত্যি ,মৃত্যুর পর মানুষটি শুধুই একটি সংখ্যা,শুধুই একটি মাংশের পিন্ড। এতটুকু সন্মান নেই! এ পর্যন্ত করোনায় কতোজন যে চলে গেল পরপারে এই হাসপাতাল থেকেই,তার কোন হিসেব নেই। কথাগুলো ভাবতে ভবতেই শাহেদের মনেও একধরণের মৃত্যুভয় তাকে ঘিরে ধরে? মনটা হঠাৎ ছটফট করতে থাকে শাহেদের। দুপুরের নিস্তব্ধতায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না সে। দুর্ভাবনার পাহাড় নেমে আসে তার মাথায়। সেও তো করোনা পজিটিভ। দ্বিতীয়বারের রিপোর্টেও পজিটিভ। সে কি বাঁচতে পারবে? মনে হয় না। যদি যেতেই হয়,তাহলে? কী হবে ভালোবাসার সঙ্গিনী শীলার? কে দেখবে তাকে?শাহেদ ছাড়া ওকে তো দেখার আর কেউ নেই। কী হবে অবুঝ মেয়ে মানালের? কোথায় পাবে সে তার প্রিয় বাবার আদর,স্নেহ?যে বাবার হাত ধরে সে রোজ স্কুলে যেত,অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর রাতে বাবার গলা জড়িয়ে ঘুমাত। সেই যে অনাগত সন্তানটি? সে তো তার বাবাকে দেখতেই পাবে না।কখনও বুঝবেই না বাবার ভালোবাসা কি? তিলতিল করে গড়ে তোলা ছোট্ট এই ভালোবাসার সংসারটি ঝুরঝুর করে ঝরে যাবে শুকনো পাতার মতো…। ডাক্তার হয়ে সে এভাবে অসহায়ের মতো এটা মেনে নেবে? হেরে যাবে সে? নাহ্ । এ কী করে হয়? এ হতে পারে না। এক ঝটকায় বেড থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় মেঝের উপর। বিড়বিড় করে বলতে থাকে, হ্যাঁ, আমি বাঁচতে চাই। খুব সাধারণ এক মানুষের মতো, খুব সামান্য এক স্বপ্নের মতো এই আলো ভরা পৃথিবীতে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই। এর বেশি তো কিছু না। কিন্তু তার নিঃশ্বাসকে নিষ্ঠুরের মতো চেপে ধরছে কে? কোন সে অদৃশ্য দানব?‘কোথায় কে ? কার সাথে কথা বলছো? তোমার কি নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?’সহকর্মী বন্ধু রূপমের কথায় নিজেকে ফিরে পায় শাহেদ। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। অবাক হয়ে বলে, ‘রূপম! তুমি কখন এলে? আচ্ছা বন্ধু, আমার পালস্ টা ধরে একটু দেখ তো আমি বেঁচে আছি কিনা? আমার তো খুব সন্দেহ হচ্ছে-আমি হয়তো আর নেই।’রূপম ওর পালস ধরে হেসে বলে,‘ধুর! কী যা তা বলছো?, তুমি তো বেঁচেই আছো। এতক্ষণ কী সব বলছিলে পাগলের মতো? শোন,তোমার নিঃশ্বাসে কি কোন সমস্যা হচ্ছে ? গলার ব্যথাটা?’‘স্যরি রূপম,আসলে সেকেন্ড টাইম পজিটিভ হওয়াতে চোখের সামনে সবকিছু এলোমেলো লাগছিলো। মাথাটা ঠিক ছিল না। কী সব বলেছি, কিচ্ছু মনে নেই। স্যরি রূপম। ‘‘তুমি কোনো চিন্তা করো না। অসুস্থতায় এ রকমটা হতেই পারে।এখন যা জানতে চেয়েছি, তাই বল প্লিজ।’শাহেদ ততক্ষণে নিজেকে শান্ত করছে। রূপমের দিকে তাকিয়ে জোরে একটা শ্বাস ফেলে বলে, ‘নিঃশ্বাসে সমস্যা একটু তো আছেই। একটুতেই হাঁফিয়ে উঠছি। গলার ব্যথাটাও কমছে না। মুখে কোনো রুচিও নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো-বাসায় একটু যাওয়া দরকার। কতদিন দেখি না ওদের। শীলা ফোন করলেই কাঁদে।ভিডিও কলে ওদের দেখি, কিন্তু তাতে মন ভরে না। ওকে আর মানাতেই পারছি না। ছোট্ট মামনিটা কেঁদে কেঁদে হয়তো মরেই যাবে। প্লিজ রূপম,আমার যা-ই হোক,ওদেরকে একটুখানি দেখার ব্যবস্থা করে দাও, প্লিজ।’‘করবো বন্ধু। অবশ্যই করবো। তার আগে স্যারের কাজটা একটু করতে দাও। থার্ড টেস্ট করতে বলেছেন স্যার।’‘ওসব করে আর কিছু হবে না রূপম। ফালতু। সব শেষ। ওপারের টিকেট কনফার্ম হয়ে গেছে,বুঝতে পারছো না? টেস্ট করে আর কী করবে বল?’রূপম একটু হকচকিয়ে যায়। কিন্তু স্যারের নির্দেশ। না করে উপায় নেই। গম্ভীর হয়ে যায় রূপম। বন্ধুর কন্ঠটাও হয়ে যায় ডাক্তারের কন্ঠের নির্দেশ।এরপর পাঁচটা দিন কেটে গেছে। শাহেদের অবস্থার আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। গলা ব্যথা,শ্বাসকষ্ট আর বাড়ে নি। উন্নতি বলতে এটুকুই। তবে ছেড়ে যাওয়া জ্বরটা আবার এসেছে । ১০০এর উপরে যায় নি যদিও, তারপরও বিপদমুক্ত ভাবার উপায় নেই। যখন তখন বেড়ে গিয়ে বিপদ বাড়তে পারে। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবার পরেও হঠাৎ জ্বরে দু’জন রুগী মারা গেছে এই হাসপাতালেরই। এদিকে কয়েকজন রুগীর থার্ড টেস্টের রিপোর্ট এসেছে গতকাল বিকেলে। এরমধ্যে শাহেদের রিপোর্টও আছে। একটা বন্ধ খামের উপরে শুধু রুগীদের নাম লেখা আছে। সেটা এখন স্যারের হাতে। কী যে কপালে আছে শাহেদের, ভাবতে ভাবতে বিষন্ন হয়ে ওঠে রূপম।খুব কাছের বন্ধু শাহেদ। ওরা একই সাথে বিসিএস দিয়ে চাকুরীতে জয়েন করেছে। রূপমের তখনি জয়েন করার তেমন ইচ্ছে ছিল না। সে আরো পড়াশোনা করে অনেক বড় ডাক্তার হতে চেয়েছিল। কিন্তু শাহেদ বলেছিলো, সমস্যা নেই বন্ধু,চাকরি করেও এফসিপিএস পরীক্ষা দেয়া যাবে। আমিও দেব। সো,জয়েন করে ফেলো।সেই শাহেদই এখন….ভাবনাটা আর শেষ হয় না রূপমের। প্রফেসর রহমান স্বয়ং এসে দাঁড়িয়েছেন রূপমের পাশে। তার হাতে একটা হলুদ খাম। উঠে দাঁড়ায় রুপম।‘শোন রূপম, আমি চাইছি শাহেদ আজই বাসায় চলে যাক। ওখানে ফ্যামিলির সাথেই আইসোলেশনে থাকুক। ফ্যামিলির জন্য ওর মনে যে চাপটা পড়েছে সেখান থেকে ওকে বের করে আনা দরকার। আমার তো মনে হচ্ছে ফ্যামিলির যত্নে থাকলে ও শিগগিরই সেরে উঠতে পারবে। কাজেও জয়েন করতে পারবে।’‘এ আপনি কী বলছেন স্যার! ওর জ্বরটা তো আবারও ফিরে এসেছে। আরো বাড়তে পারে।শ্বাসকষ্ট,গলাব্যথা….’কথা শেষ করতে দেন না প্রফেসর রহমান।‘আমি জানি,তুমি কী বলতে চাচ্ছো রূপম। এ ধরনের রুগীকে যে এভাবে ছাড়া যায় না সেটাও জানি। তোমার অবজার্ভেশন,উদ্বেগ সব ঠিক আছে। বাট আমি নিজেও তো একজন ডাক্তার, সেন্স অব রেসপন্সিবিলিটি,এক্সপেরিয়েন্স-এসব তো কম হলো না, কী বলো?’রূপম একটু লজ্জিত হয় স্যারের কথায়।‘স্যরি স্যার,আমি আসলে ওইভাবে মীন করে বলিনি। এক্সকিউজ মী স্যার। আপনি যা বলবেন ,তাই হবে।’প্রফেসর রহমান তাঁর ড্রাইভারকে ফোন দিলেন গাড়ি সরাসরি শাহেদের রুমের সামনে রাখতে বললেন।গাড়িতে উঠে শাহেদ যেন হাতের মুঠোয় স্বর্গ পেয়ে যায়। সত্যিই সে বাসায় যাচ্ছে! আবার সে দেখতে পাবে শীলা,মানালকে ! বিশ্বাসই করতে পারছে না সে। খুশিতে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে ওর রূপমকে। কিন্তু সোশ্যাল ডিসট্যান্সের কথা মনে পড়ে যায়। প্রফেসর রহমানও রূপমের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তখনও কথা বলছেন। সো জড়িয়ে ধরা আর হলো না। প্রফেসর রহমান এবার শাহেদের জানালার পাশে আসেন।‘শোন শাহেদ, বি কনফিডেন্ট। ঠিকমতো আইসোলেশেনে থাকবে। ওষুধগুলো আগের মতোই চলবে। তোমার মিসেসকে যা যা বলার রূপমই বলবে। আর রূপম তোমার সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখবে। বেস্ট অফ লাক,মাই বয়। হোপ,ইউ উইল কাম ব্যাক এন্ড জয়েন এগেইন শর্টলি। বাই।’‘ইউ স্টে সেইফ টু।বাই।’ একটা হাত তুলে মৃদু হেসে বিদায় জানায় শাহেদ। গাড়ি চলতে শুরু করে। শাহেদ এবার রূপমের দিকে তাকিয়ে বলে,‘কী ব্যাপার রূপম, কিছু বুঝতে পারছি না। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত! মিরাকলের মতো মনে হচ্ছে সবকিছু।’রুপমের মুখে কোন উচ্ছ্বাস না দেখে শাহেদই আবার বলতে লাগল,‘নাকি এটা ফাঁসির আসামীর আত্মীয়স্বজনদের সাথে শেষ দেখার আয়োজন?’‘ছিঃ শাহেদ, এভাবে বলছো কেন? স্যারকে এভাবে ছোট করা কি ঠিক? স্যার যা ভালো মনে করেছেন,তাই করেছেন।’‘আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে একটা কথা বলবে,প্লিজ। আমি কি নেগেটিভ?’রূপম এ কথার কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। যা সে নিজেও জানে না তা বলবে কী করে? মুখটা গম্ভীর করে বলে,‘তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করবে?’‘হ্যা,বল কেন করবো না। মৃত্যু যার দুয়ারে দাঁড়িয়ে তার আবার বিশ্বাস করাই কি আর না করাই কী?’‘এভাবে বললে কিন্তু কিছুই বলব না।’রূপম অন্যদিকে মুখ ফেরায়। শাহেদ এবার একটু কাছে ঘেঁষে বলে,‘ঠিক আছে বন্ধু ভালো করেই বলছি। বল, রিপোর্টটা কী?‘আমি জানি না। স্যার আমাকে কিছু বলেন নি। ভয়ে আমিও কিছু জিজ্ঞেস করিনি।’ গলাটা ভারী হয়ে আসে রূপমের।আর কোনো কথা হয় না। অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে আসে সাদা ধবধবে গাড়িটার ভেতর। জানালার গ্লাসে চোখ রেখে বিকেলের শান্ত নীল আকাশটা পলকহীনভাবে দেখতে থাকে শাহেদ। ভাবে-এ কেমন অসুখ তার? দুইবার পজিটিভ,থার্ড টাইমেও হয়তো পজিটিভ। তারপরেও তার ঘরে ফেরা কেন? প্রায় সব উপসর্গই তো রয়ে গেছে। জ্বরও এসেছে আবার। যে কোনো সময় বেড়ে যেতে পারে। শুধু শ্বাসকষ্টটাই আগের মতো আছে। তাতেই কি নেগেটিভ রিপোর্ট আসতেও পারে? কীভাবে সম্ভব? নেগেটিভ কিনা তা জিজ্ঞেস করার সাহস শাহেদেরও নেই। আর নেগেটিভ না হলে তো স্যার এভাবে পাঠাতেন না। আবার বললেন-সুস্থ হয়ে শিগগিরই নাকি জয়েন করতে পারব হাসপাতালে। এও কি সম্ভব? অবাক লাগে। এটা কি স্বান্তনা! এত কষ্টেও হাসি পায় শাহেদের। কিন্তু এত অভিজ্ঞ প্রফেসর রহমান, তাঁরই স্নেহধন্য একজন ডাক্তারকে এমন মিথ্যে স্বান্তনা তিনি দিতে পারেন কি? মনে মনে শাহেদ ভাবে না,পারেন না। তাহলে? আকাশের অসীম শুন্যতায় ভেসে চলা মেঘের অপার রহস্যে একজন ঘোর লাগা মানুষের মতো প্রশ্নটির উত্তর খুুঁজতে থাকে শাহেদ। অসম্ভব জেনেও এক টুকরো আশার আলো খুঁজতে থাকে সে আশা নিরাশার দোলাচলের ভেতর। এ আলো আদৌ আছে কি নেই জানা নেই তার। কিন্তু নিঃশ্বাসটুকু এখনও তো আছে। হয়তো আছে তা শীলার জন্য। আছে মানালের জন্য। এটুকুইবা কম কী? সত্যিই তো, কম কী? একটি নিঃশ্বাসের এপারে তরতাজা মানবজীবন, ওপারে নিথর মাংশপিন্ডের সাদা বস্তা!

২ thoughts on “ঘোর // পিওনা আফরোজ

  • অক্টোবর ১৪, ২০২০ at ৬:৪০ অপরাহ্ণ
    Permalink

    সত্যিই ঘোর লেগেছে গল্পটি পড়ে। এমনও হয়! লেখিকা পিওনা আফরোজকে আন্তরিক অভিনন্দ।

    Reply
  • ডিসেম্বর ১০, ২০২০ at ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ
    Permalink

    দারুণ!হ্যা,সত্যিই…দারুণ লেগেছে। লেখিকাকে অভিনন্দন। এগিয়ে যান।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *