ছোটগল্প।। অ্যাবরশান।। প্রত্যূষা সরকার
“এত প্রশ্ন কোরো না মা, বিষয়টা তুমিও জানো আমিও জানি। সেরকম হলে ডাক্তার দেখাও!”
রেগেমেগে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল তিস্তা। অপরূপা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। আর কোনও শব্দ এলো না মুখে।
“দরজাটা বন্ধ করে দিও…”
অপরূপা শুনলো না তিস্তার আওয়াজ। আস্তে আস্তে রান্নাঘরের দিকে এগোলো। দু-কাপ ক্যাপুচিনো সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস নিয়ে এলো ড্রয়িংরুমে।
“কী গো, খেলে না যে? একটু কিছু মুখে দাও। ঠাণ্ডা হয়ে গেলো তো। আসলে তিস্তাটাকে নিয়ে আর পারি না। বোঝোই তো কেমন অবুঝের মতো করে। কী বলছো এসব? না না, পাগল নাকি, ওকে আমি কিচ্ছু বলিনি! তুমি টেনশন নিও না।”
ছোটো থেকেই রান্নাবান্নায় বেশ আগ্রহী অপরূপা। ষোলোতে বিয়ে হয়। তার ঠিক তিন বছরের মধ্যে বিধবা। তিস্তা তখন মোটে হামাগুড়ি দিতে শিখেছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে একদিন মাঝরাতে পালিয়ে আসে অপরূপা, কোলে তিস্তা। বাপের বাড়িতে এসে অনটনের সংসারে আবার পড়াশোনা শুরু করে। সন্ধে হলে তার সঙ্গী ছিল সেলাই মেশিন আর ছোট্ট তিস্তা। গ্র্যাজুয়েশনের পর একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়ানোর সুযোগ পায়। তিস্তা বড় হয়। মায়ের মৃত্যুর পর অপরূপা আর তিস্তা মেদিনীপুর থেকে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসে। তিস্তা এখন কলেজ ছাত্রী, সবে ফার্স্ট ইয়ার। ছটফটে ও প্রাণোচ্ছল। ঘরের ভেতর একেবারেই মন নেই। আর এই মেয়েকে চোখ থেকে দূরে যেতে দেবে না বলে ওর অনার্স টিউশনটাও বাড়িতে হয়।
“জানো, সেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিল। আমি ছাদে গেছিলাম তিস্তার জামাকাপড় তুলতে। আমার তখন মাত্র দুটো শাড়ি। স্নানের সময় একটা জলধোয়া করে দিয়ে আর একটা পরতাম। সেদিন শরীরটা খুব খারাপ লাগছিলো। থার্ড ডে। সাদা শাড়িটা লাল হয়ে গেলো। আমি যন্ত্রণায় ছটফট করছি। এদিকে রান্নাঘর আর তিস্তাকে সামলে আমি আর পেরে উঠছিলাম না। ওর ঠাকুমার কাছে একটা শাড়ি চেয়েছিলাম। চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে ঘর থেকে বের করে দিলো। ছাদে যেতেই ওর ছোটোকাকা, আমার দেওর একটা লাল টুকটুকে শাড়ি আমার কাছে আনে। আমি ভিজছিলাম, ক্রমশ ভিজে যাচ্ছিলাম। সারা আকাশ জুড়ে মেঘ। একদম চিৎকার করবে না, একদম না। ও আমার মুখ চেপে ধরল। তারপর ওই অবস্থায় আমাকে… আমি সেদিন থেকে আর কাঁদিনি। ব্যথা লাগেনি। এখনও লাগে না। নাও, খাও। খেতে বলছি তো।”
প্রচণ্ড রেগে গিয়ে সোফা থেকে উঠে পড়ে অপরূপা।
তিস্তা বাড়ি ফেরে। এই প্রথম বাড়ি ফিরতে রাত দশটা বাজালেও অপরূপা ওকে একবারও বকে না।
“আয় খেতে আয়। আজকের চিকেন স্ট্রুটা তোর জন্যে, শুধু তোর জন্যে।”
“আমি খেয়ে এসছি।”
“কিন্তু আমি তো…”
“থাক মা, আর কেই বা আসে আমাদের বাড়িতে!”
দু-মাস ধরে পরিতোষবাবু পড়াতে আসছে না। তার বাবার ক্যানসার ধরা পড়েছে। বাড়ির সবাই খুব চিন্তায় আছে। পরিতোষ গ্রামের বাড়ি গেছে পরিস্থিতি সামলাতে। এখানে একটা দু-কামরার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে পরিতোষ মিত্র। তিস্তার কলেজের পার্ট টাইম লেকচারার, বছরতিনেক হল। সপ্তাহে তিনদিন কলেজে আর দিনে দুবেলা এক ঘর টিউশন পড়িয়ে সে দিব্যি আছে। শুধু তিস্তাকেই আলাদা পড়াতে হয়। এ জন্য অবশ্য রেমুনারেশনও কম নয়। সাথে অপরূপার এক্সপেরিন্টাল রান্না তো আছেই।
“তুমি মিথ্যে বলছো, জানি। তাও আমি কিচ্ছু বলবো না। আই জাস্ট কান্ট ইম্যাজিন, হোয়াট ইউ হ্যাভ ডান টু মি। নট ওনলি মি, দিস ইস ফর আস।”
তিস্তা শব্দ শুনে ঘর থেকে বেরোয়। অপরূপার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে অন্ধকার, আওয়াজটা হঠাৎ থেমে যায়। মনের ভুল ভেবে আবার নিজের ঘরে ফিরে যায় তিস্তা। ঘড়িতে তখন রাত দুটো সাতচল্লিশ।
“মা, তুমি কাল রাতে ফোনে ছিলে?”
“কই না তো। কেন?”
“ও না, এমনি মনে হল।”
“আজ কখন ফিরবি?”
“দেরি হবে, ছুটির পর নোট নিতে যাব, রিমির বাড়ি। বলছি, স্যার কবে ফিরবে জানো?”
“না, আমাকে বলে যায়নি। কোথায় গেছে জানিস কিছু?”
“হ্যাঁ, বাড়িতে, তোমার সামনেই তো কথা হল। ভুলে গেলে নাকি?”
“একবার মেসেজ করিস তুই।”
কথাটা শুনে তিস্তা মুচকি হাসলো। মায়ের সামনে তো আর বলতে পারছে না, পরিতোষ ওর বয়ফ্রেণ্ড। কলেজে তো এই নিয়ে হইচই লেগেই আছে। ইদানিং সব বন্ধুদের আছে বলে ওরও একজন লাগবে এমনটা নয়। ক্লাস শুরুর থেকেই একটা অদ্ভুত ভালো লাগার সম্পর্ক তৈরি হয় দুজনের। বয়সে তিস্তার থেকে দশ বছরের বড়ো হলেও তাদের প্রেম আজকালকার ব্রেক-আপ প্যাচ-আপ জেনারেশনকে একেবারে হার মানায়।
রোজ মাঝরাতে কথা হতো দু-জনের। সপ্তাহে দু-দিন থেকে পরপর ছ-দিন তিস্তাকে পড়াতে আসতো পরিতোষ। খুব বেশি সময় কাছ ছাড়া হতো না। তিস্তার কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হলে অনেক আগে এসে ওর বাড়িতে বসে থাকতো। এই দু-মাস তিস্তা খুব ডিপ্রেসড। ফোন করলে খুব কম ফোন তোলে পরিতোষ। কথা হলেও ওই দু-তিনটে শব্দ কিছুক্ষণের জন্যে। মাঝে মাঝে এমনও হয় দু-দিন যোগাযোগ করা গেলো না কোনও মতেই। তিস্তা আরও একা হতে থাকে।
অপরূপা সেদিন ভোরবেলা চার বার বমি করেছে। তিস্তা বুঝতে পারছে না কী করবে। এদিকে পরিতোষও নেই। সে থাকলে না হয় কোনও ব্যবস্থা করতে পারতো। এই এক বছরে পরিতোষ ওদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে। তিস্তা জানে ওর মায়েরও ওর স্যারকে খুব পছন্দ হবে জামাই হিসেবে। দেখতে শুনতে একেবারে নিপাট ভদ্রলোক।
“তুমি এসেছো? এবার কী হবে বলো? দাঁড়াও টেনো না এভাবে। লাগছে। তিস্তা আছে বাড়িতে। কী করছো? ছাড়ো! অ্যাই শোনো স্পষ্ট ভাবে বলছি, আমি দায়িত্ব নিতে পারবো না। একের পর এক আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে তোমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে এমনটা হয় না।”
তিস্তা দুধ আনতে যায় রান্নাঘরে। অপরূপার ঘরে ফিরে আসতেই দেখে সে উঠে বসেছে।
“মা, মা, প্লিজ লিসেন। এই অবস্থায় এরকম করতে নেই। নাও, নাও, একটু খেয়ে নাও।”
মাকে উত্তেজিত দেখে একটু ভয় পায় তিস্তা। ডঃ অনিন্দিতা এখন চেম্বারে আছেন, তবে অপরূপাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। অগত্যা পুরোনো প্রেসক্রিপশনের নম্বরে ফোন করে তিস্তা। “হ্যালো, ম্যাডাম আছেন? খুব দরকার…” অ্যাসিসটেন্ট ফোন দেন তাঁর হাতে।
“হ্যাঁ বলছি”।
“আমি তিস্তা সেন কথা বলছি, ম্যাডাম। অপরূপা সেনের মেয়ে।”
“হ্যাঁ বলো, কেমন আছো? মা ভালো আছেন?” অপরূপাকে এক নামে চেনেন তিনি। কয়েক বছর আগে ডঃ অনিন্দিতার মেয়ের ক্লাস টিচার ছিল অপরূপা।
“আপনি কি খুব ব্যস্ত?”
“হ্যাঁ, পেশেন্ট দেখছি।”
“মার শরীরটা খুব খারাপ। একটু আসতে পারলে ভালো হতো।”
“এখন? কী সমস্যা বলো?”
“না মানে কয়েকদিন ধরেই বলছিলো, আজ বমি করেছে সকালে। বোধ হয় মেনস্ট্রাল পজ।”
ঠিক সাতদিনের মাথায় পরিতোষ ফেরে।
“চেহারার এ কী হাল করেছো সোনাই?”
তিস্তা চোখ নামিয়ে নেয়।
“আজ হঠাৎ?”
প্রশ্ন করে তিস্তা।
“পড়াতে এলাম, আর আমার এই সোনাইটাকে দেখতেও এলাম।”
“তোমার বাবা কেমন আছে?”
“ভা, ভালো, বেশ ভালো। একটু ট্রমায় ছিলেন আর কী… অপরূপা ম্যাডামকে দেখছি না, কোথায়? স্কুল থেকে ফেরেননি?”
“আঃ আর পারছিনা, আর একটু বাবু, আর একটু… উঃ! লাগছে। … একটু নামিয়ে। উফ! তুমি না… যেদিন প্রথম পেছন থেকে এসে ধরেছিলে সেদিনই পাগল করেছো! আমি শেষ, শেষ! আজ আর না… একটু জড়িয়ে ধরো! পেটে যে আছে তার লাগবে, চাপ দিও না”।
ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলো তিস্তা। ভেতরে অপরূপা একা। এটা তার একার অসুখ।
“বললে না তো, মা কোথায়?”
পরিতোষ ঘরের ভেতর থেকে গোঙানির শব্দ পায়… “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”
তিস্তা কোনও উত্তর দেয় না। চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে থাকে। পরিতোষের ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে আসে।
“এ ঘরে চলো, মায়ের আজ থার্ড ডে। পারবে না দিতে।”