ছোটগল্প।। ডালিয়া।। এহ্সান মাহমুদ
ছোটগল্প। ডালিয়া
ডালিয়ার সাথে দেখা হয়ে গেল দোয়েল চত্বরের কাছে। কার্জন হলের সামনের নার্সারিতে ঝুঁকে কী একটা গাছ দেখতেছিল নেড়েচেড়ে। আমিই প্রথমে ওকে দেখলাম। দাঁড়াবো নাকি হেঁটে চলে আসব এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ও সোজা হয়ে দাঁড়াল। আমাকে দেখেই বলল- কী আশ্চর্য, রাতুল তুমি! কেমন আছো?
কী জবাব দেবো আমি! ভালো আছি বুঝাতে হাসার চেষ্টা করলাম সামান্য। ডালিয়ার দিকে ভালো করে তাকালাম। প্লাস্টিকের প্যাকেটে জড়ানো ছোট্ট একটি গাছের চারা হাত দিয়ে দেখালো-‘কাঠামল্লিকা নিতে এসেছিলাম। বাসার ছাদে লাগাবো’।
ডালিয়া সেই একইরকম রয়ে গেছে। খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি তিন বছরে। শুধু মাথার চুলগুলো ছেটে ফেলেছে, কাঁধ পর্যন্ত। মুহূর্তেই কলা ভবনের মাঠে পিঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকা চুলের আগেকার ডালিয়ার কথা মনে পড়ল। সেই ডালিয়া। যার সাথে আমার বিয়ের কথা হয়েছিল।
কথা ছিল আজিমপুর কাজী অফিসে আমরা বিয়ে করব। সেদিন ছিল শুক্রবার। সকাল এগারোটায় আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা। আমি চানখার পুলের মেস থেকে সারে দশটার মধ্যে আজিমপুর পৌঁছে গেলাম। ডালিয়া কাছেই থাকে। আজিমপুরের মেডিকেল স্টাফ কোয়ার্টারে। পৌনে এগারোটায় ওর আসার কথা। কাজী অফিসের গলির মুখে রিকশা থেকে নেমে মোবাইলে দেখলাম এখনও আধাঘণ্টা বাকি। অন্যদিন সেন্ট্রাল লাইব্রেরি কিংবা চানখার পুল থেকে হেঁটেই আজিমপুর আসি। সেদিন রিকশাতেই এসেছিলাম। আগেরদিন ডালিয়া রিকশা নিয়ে আসতে বলেছিল- ‘সামান্য হাঁটলেই ঘামে তোমার গোসল হয়ে যায়। ঘেমে-ঠেমে কাজীর সামনে বসার দরকার নাই।
আরাম করে রিকশাতে এসো।’ বলতে বলতে ডালিয়া চোখে কী এক দুর্বোধ্য ইশারা করেছিল!
রিকশা থেকে নেমে গলির মুখের চা-সিগারেটের দোকান থেকে একটি সিগারেট আর একটি ম্যাংগো ফ্লেবারের চকলেট নিয়েছিলাম সেদিন।
মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরে আমরা দুজনেই হল ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি উঠেছিলাম চানখার পুলে সতেরো শ টাকা সিট ভাড়ার এক মেসে। ডালিয়া গিয়েছিল খালাতো বোনের বাসায়। তবুও আমাদের রোজ দেখা হতো। আমাদের সকাল শুরু হতো লাইব্রেরির সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে। এরপরে হাকিম চত্বরের সবজি-পরোটা। সেই সাথে চাকরির নতুন কোনো সার্কুলার বেরুলো কিনা খোঁজ নেওয়া। দুপুরে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় টোকেন কেটে ভাত-মাছ-ডাল, সন্ধ্যায় বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ফুলার রোড পলাশী হয়ে আজিমপুর। ডালিয়াকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরতাম লেগুনায় চড়ে। আজিমপুর থেকে চানখার পুল পাঁচ টাকা ভাড়ায়।
সেই শুক্রবারের সকালে রিকশায় চেপে আজিমপুর যেতে যেতে কতো কী যে ভেবেছি! ডালিয়ার সাথে কোনো কোনো শুক্রবারে লালবাগের কেল্লায় কিংবা আহসান মঞ্জিলে যেতাম। এমনি এক শুক্রবারে পুরান ঢাকার টমটম দেখে ডালিয়া বলেছিল- ‘ইশ্! বউ সেজে ঘোড়ার গাড়িতে উঠতে পারতাম’! একদিন গোপনে ডালিয়াকে না জানিয়ে টমটম ভাড়া করতে গিয়েছিলাম সদরঘাটের কাছে, ইসলামপুরে। সারাদিন চার হাজার টাকা। আধাবেলার জন্য দুই হাজার। ইচ্ছে ছিল ডালিয়াকে চমকে দেবো। সারাদিন ঢাকা শহরে টমটম নিয়ে হইহই ঘুরে বেড়াবো। কিন্তু খরচের কথা চিন্তা করে আর আগাতে পারিনি। চার হাজার টাকায় আমার প্রায় পুরো মাস চলে যায়। একটা ভালো চাকরি পেলে তখন হবে- এই ভেবে নিজেকে বুঝালাম।
সিগারেট শেষ করে চকলেট মুখে দিয়েই মোবাইলে সময় দেখলাম। এরইমধ্যে দশটা পঞ্চাশ বেজে গেছে। এখনও ডালিয়ার দেখা নাই।
যথানিয়মে এগারোটা বাজল। তবুও ডালিয়াকে নিয়ে কোনো রিকশা এলো না। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিকশার আসা যাওয়া দেখি। এগারোটা দশের দিকে ডালিয়াকে কল করি। আশ্চর্য! ওর ফোন বন্ধ পাই। দুপুর একটা পর্যন্ত আমি একা একা দাঁড়িয়ে রইলাম।
চানখার পুলের মেসে ফিরলাম হাঁটতে হাঁটতে। রুমে ঢুকতেই ডালিয়ার ফোন ‘রাতুল, শোনো, আমার ব্যাংকের চাকরিটা হয়ে গেছে! আমার ফোনে চার্জ শেষের দিকে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে’। আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে একনাগারে বলে চলে ডালিয়া।
ওর কথা শেষ হলে আমি আস্তে করে বলি ‘তোমার আজিমপুর থাকার কথা ছিল এগারোটার সময়’।
ডালিয়া উল্লসিত গলায় বলে, ‘মনে আছে তো’!
‘তাহলে এলে না যে’!
এবার ডালিয়া সামান্য সময় নিল। তারপরে বলল, ‘ভেবে দেখলাম, এখন বিয়ে করাটা ঠিক হবে না। তোমারও একটা কিছু হোক। সংসার গোছাতে যা খরচ! আর তোমার যে খুব শিগগিরই কিছু হবে এমনটাও তো না’। ওর কণ্ঠের সেই উচ্ছ্বাস ও নির্ভরতা যেন আর পাচ্ছিলাম না। ডালিয়া আরও কিছু বলতে চেয়েছিল কিনা জানি না। তারপরেই আমি ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম।
পরেরদিন থেকে লাইব্রেরিতে যাওয়া বন্ধ করে দিই। মোবাইল বন্ধ করে এক সপ্তাহ রুমেই কাটিয়ে দিলাম। সপ্তাহখানেক পরে এক সন্ধ্যায় টিউশনি বাসায় গেলাম। সেখান থেকে রাতের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরেই সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকা শহর ছাড়তে হবে। কিন্তু কোথায় যাব? যাওয়ার মতো জায়গাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেই রাতে চাকরির পত্রিকার একটি বিজ্ঞপ্তি দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, এই চাকরিটা আমাকে পেতেই হবে। কর্মস্থল কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প, কক্সবাজার। সহকারি প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটরের কাজ। অনার্সে পড়ার সময়ে ইউএনডিপির একটি স্বেচ্ছাসেবি
সংগঠনের হয়ে একবার কাজ করেছিলাম। ঢাকার কাছে আমিনবাজারে বেদে পল্লীর শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে সিভি পাঠিয়ে দিলাম মেইলে। দশ দিনের মাথায় ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পেলাম। ঢাকার বারিধারায় ইন্টারভিউ দেওয়ার পরেরদিনই কাজে যোগ দিয়ে চলে গেলাম কক্সবাজার।
কক্সবাজার গিয়ে আমি আরেক জগতে পড়লাম। নাফ নদী পার হয়ে এপাড় আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে শরনার্থী ক্যাম্প। সারাদিন ক্যাম্পে কেটে যায় রোহিঙ্গাদের এন্ট্রি, বায়োমেট্রিক, রিফিউজি পরিচয়পত্র প্রস্তুত, বিদেশি সাংবাদিকদের দৈনন্দিন তথ্য সরবরাহের কাজে। রাতে কক্সবাজার শহরে অফিসের অস্থায়ী ডরমেটরিতে যখন ফিরি তখন ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে। এভাবে দিন কেটে যায়। এমন একটি কাজই আমি চেয়েছিলাম। যাতে করে নিজের মুখোমুখি হওয়ার অবসর পাওয়া না যায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সবহারা মানুষের জীবনের গল্প শুনতে শুনতে নিজের জীবনে কী ছিল, আর কী-ই-বা হারিয়েছি, সেই হিসেব মেলাবার সুযোগ হারিয়ে আমি যেন বেঁচে গেলাম। এভাবে নতুন কাজের মধ্যে এসে, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারব- নিজের প্রতি এতোটা বিশ্বাস আমার কোনোদিন ছিল না।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আমার চাকরির মেয়াদ ছিল এক বছরের। পরে ছয় মাসের জন্য আবারও মেয়াদ বাড়ানো হয়। পরে আরও ছয় মাস। এনজিওগুলোর চাকরিতে নিয়োগের ধরনই এইরকম। প্রকল্প যতদিন থাকবে চাকরি ততদিন। মাঠ পর্যায়ে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয় তাদের বেশিরভাগই চুক্তিভিত্তিক। রোহিঙ্গা ইস্যু প্রায় স্থায়ী হওয়ায় এখন আর চাকরি নিয়ে তেমন দূর্ভাবনা নেই। এভাবে চাকরিতে দেখতে দেখতে আমার দুই বছর সময় পার হয়ে গেল।
এই সময়ে নাফ নদীর ওই পাড়ে আরাকানে নতুন নতুন গ্রামে আগুন লাগতে থাকে। সুসং পাহাড়ের ঢালে ভির বাড়তে থাকে। নদী পার হয়ে কক্সবাজারে আসা রোহিঙ্গা শরনার্থীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে আমাদের এনজিওর কার্যক্রম।
অধিক সংখ্যক শরনার্থীর সহায়তার জন্য দরকার হয় বিশাল সংখ্যক কর্মীবাহিনি। আবার সেই কর্মীবাহিনির খরচ জোগাতে ব্যয় হয় কাড়ি কাড়ি টাকা। এই অর্থ জোগাতে শুধু শরনার্থী শিবিরে বসে থাকলেই চলে না। দাতাগোষ্ঠিদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয়। ক্যাম্পে কতোজন রোহিঙ্গা আছেন, এদের মধ্যে নারীর সংখ্যা কতো, পুরুষের সংখ্যা কতো, শিশুদের সংখ্যা, বৃদ্ধদের সংখ্যা সব তথ্য দাতাদের জানাতে হয়। কতোজন নারী গর্ভধারণ করেছে সেই তালিকাও করতে হয়। এসব তথ্য দাতা সংস্থা ও দাতা রাষ্ট্রগুলোর কাছে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হয়। সহকারী প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটরের পদ থেকে দুই বছরের মাথায় আমাকে প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর করা হয়। এরপর থেকে আমাকে নিয়মিত ক্যাম্পে না গেলেও চলে। সহকারীদের কাছ থেকে দিনশেষে কাজ বুঝে নেওয়া এবং দাতাদের সাথে মিটিং করা হয়ে উঠল আমার অন্যতম কাজ। এর বাইরে বিভিন্ন সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে যোগদান করাটাও কাজের অংশ হয়ে দাঁড়াল।
এমনই একটি আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি দলের সাথে এবার কক্সবাজার থেকে ঢাকায় এসেছি। আমাদের সংস্থার কান্ট্রি ডিরেক্টর ওরহাম পিটার আমাকে খুবই পছন্দ করেন। ফরাসী এই লোক আমাকে সারাক্ষণ ‘ইয়াং ম্যান ইয়াং ম্যান’ বলে ডাকেন। চাকরিতে জয়েন করার পরে আমি যে গত দুই বছরে ছুটি কাটাইনি এটি পিটার জানতেন। তাই এবার আমাকে ঢাকায় আসার সুযোগটি তিনিই করে দিয়েছেন। সেই সাথে আরও পাঁচদিনের ছুটি। গুলশানের একটি অভিজাত রেস্তোঁরায় একটি সেমিনার এবং ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘মিট দ্য প্রেস’ দুই দিনের অফিসিয়াল কাজ। এই দুইদিন ঢাকায় থাকার জন্য হোটেল রিজার্ভেশন অফিস থেকেই করা ছিল। কিন্তু পিটারের নির্দেশে আমার জন্য আরও পাঁচদিনের হোটেলের খরচ মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথমদিনে গুলশানের সেমিনার শেষে রাতে মেইলে বিস্তারিত রিপোর্ট করার পরেই পিটার আমাকে ফিরতি মেইলে জানিয়েছিল অতিরিক্তি পাঁচদিনের হোটেল খরচ মেটানোর বিষয়ে। আমি আপত্তি জানাতেই ‘হ্যাভ আ নাইস ব্রেক’ এবং ‘গুড নাইট ইয়াং ম্যান’ লিখে আমাকে থামিয়ে দিল।
তিন বছর পরে ঢাকায় এসেছি। অথচ পরিচিত কাউকেই জানাইনি। সত্যি বলতে পরিচিত কারও ফোন নাম্বারও আমার কাছে এখন নেই। আসলে ডালিয়ার সাথে আমার বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পরে ঢাকা থেকে আমি পালাতেই চেয়েছিলাম। আমার চেনা-জানা সবাই জানতো আমি আর ডালিয়া বিয়ে করতেছি। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত যখন আমাদের বিয়েটা হল না, তখন নিজেকে আড়াল করতেই কারও সাথে আর যোগাযোগ করিনি।
তাই প্রথম দিনে অফিসের কাজ শেষ করে হোটেলেই শুয়ে বসে টিভি দেখে সময় কাটিয়ে দিলাম। পরেরদিন সকালে প্রেসক্লাবে ‘মিট দ্য প্রেস’ সামলাতে হবে। আগেই কিছু নোট নেওয়া ছিল। বাকিটা সকালে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলেই চলবে। রাতের খাবারটা হোটেলের ডাইনিংয়ে খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়া নিয়ে যতোটা উৎকন্ঠায় ছিলাম, তেমন কিছু ঘটেনি। তারা মোটামুটি একই ধরনের প্রশ্ন করেছেন প্রত্যেকে। কেউ জানতে চেয়েছেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবসানের জন্য মিয়ানমার কতোটা প্রস্তুত বলে আমরা মনে করি? কেউ কেউ বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে- এতে আমরা দাতাগোষ্ঠির হয়ে যারা কাজ করছি, তারা কী করছি? দু’একজন বলার চেষ্টা করেছেন- আমরাই নাকি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করছি। আবার একজন বললেন, দাতাগোষ্ঠিগুলি মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে যথেষ্ঠ চাপ প্রয়োগ করছে না। তবে প্রায় সকল প্রশ্নের জন্যই আমাদের কাছে নির্দিষ্ট উত্তর প্রস্তুত ছিল। তাই খুব একটা বিরম্বনায় পড়তে হয় নি।
প্রেসক্লাব থেকে বেরিয়ে হাইকোর্ট পেরিয়ে হাঁটা দিলাম। মনে মনে ঠিক করেছি- কার্জন হল, দোয়েল চত্বর, টিএসসি, কলাভবন, শাহবাগ হয়ে হোটেলের রুমে ফিরে যাব। কার্জন হলের কাছে আসতেই ডালিয়ার সাথে দেখা হয়ে গেল।
ডালিয়া খুব সরল গলায় বলল, ‘কই যে হারিয়ে গেলে তুমি! তোমাকে পাওয়াই যায় না।’
কী বলবো আমি ডালিয়াকে। ভাবতে ভাবতে কিছুই বলা হয়ে ওঠে না। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার তাকিয়ে থাকার মধ্যে কী এমন ছিল কে জানে- ডালিয়া হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ‘এই শুনছো, এদিকে আসো’ বলে পাশ ফিরে দাঁড়াল।
এতোক্ষণে আমার নজরে এলো সামান্য দূরেই এক ভদ্রলোক। বেশ হ্যান্ডসাম। লম্বায় হয়তো আমাকে ছাড়িয়ে যাবেন। মাথায় চুল সামান্য কম। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। এই মধ্য দুপুরেও স্যুট টাই পরে আছেন। সামনে ঝুকে মাটির টবে ঝুলানো কী একটা অর্কিড দেখছেন। ডালিয়ার ডাক শুনেই পেছন ফিরে তাকালেন। দু পা এগিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ‘আমরা একসাথে পড়তাম ভার্সিটিতে’- এই কথা বলে ডালিয়া আমাকে দেখাল। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিলেন।
ডালিয়ার মুখে যেন খই ফুটেছে- ‘এই ডিসেম্বেরেই আমাদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হবে। এখানে এসেছি বারোটি কাঠমল্লিকার চারা নিতে। বারো মাস উপলক্ষে বারোটি কাঠমল্লিকা’। বলেই ডালিয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির দিকে তাকাল। ভদ্রলোক বেশ লজ্জা পাচ্ছেন বলে মনে হল। তখনও তার হাত আমার হাতে জড়ানো। আমি সহজে হাতটি সরিয়ে নিলাম। ‘আমার খুব জরুরী একটা কাজ আছে’- বলে ওদেরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে চলে এলাম।
ডালিয়াকে আমি প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। সেই ডালিয়ার সাথে এতোদিন পরে দেখা তার স্বামী সমেত। এই তিন বছরে ডালিয়ার জন্য আমার ভেতরে দুঃখের যে ফোয়ারা চাপা পরে ছিল, আজ তা সচল হল। স্বামীর পাশে ডালিয়ার উপস্থিতি আমাকে আরেকবার মনে করিয়ে দিল আমি ওকে হারিয়েছি। ডালিয়াকে হারিয়ে এতোদিন পরে সব হারানোর অভিজ্ঞতা অনুভব করলাম। এই অভিজ্ঞতাটুকু না হলে, কী এমন ক্ষতি হতো?