ছোটগল্প //তরমুজের জাহাজ// মোস্তফা অভি
ছোটগল্প
আমরা সরু গলির মুখে সড়কের ফাঁকা পথের দিকে মাথাটা বাড়িয়ে সুযোগের অপেক্ষা করছি। তখন সন্ধ্যাটা ঘোর হয়ে এসেছে। এমনিতেই পথে-ঘাটে লোকজন নেই। মাঝেমধ্যে দু’ একটা প্রাইভেট গাড়ি ঝিমুনির গতিতে চলে যায়। রাস্তার নিয়ন আলো কেমন যেন পানসে। তখন মোড়ের কাছে কয়েকজন মানুষের বাকবিতণ্ডার আওয়াজ শোনা গেল। লাঠি উঁচিয়ে পথচারীকে শাসাচ্ছে দুজন কনেস্টবল। আমরা কোন দিকের পথ ধরে এগিয়ে যাব সেটা নিয়ে ভাবছি। সরকার সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে তৈরি পোশাক শিল্প, কল-কারখানা এবং সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান। স্থবির হয়ে পড়েছে মানুষের জনজীবন। লোকজন কিছুদিন আগে পরিবার পরিজন নিয়ে শহর ছেড়ে চলে গেছে গ্রামে। পথে ছিল হাজার হাজার পায়ে হাঁটা মানুষের দীর্ঘ লাইন। আবার তারা ফিরেও এসেছে কর্মের প্রয়োজনে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ টিভি চ্যানেলগুলোতে জানিয়ে দিয়েছে, করোনা নামক অদৃশ্য ভাইরাসটি কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় সহসাই খুলছেনা কারখানা, অফিস-আদালত। পুরো দেশজুড়ে অঘোষিত লকডাউন। আমার বউ তারিমা লম্বা ঘোমটা টেনে সড়কের পিচের ওপর প্রথম পা রাখল। ওর সাহসটা এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কেননা, গত তিন চারদিন অভাবটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে ওকে সাহসী করেছে। বহুদিনের চেনা মানুষের কাছে সামান্য কয়েকটা টাকা ধার না পেয়ে খুব অভিমান হয়েছে ওর। অথচ গত রবিবার কত ঝক্কি পেরিয়ে ঢাকায় আসতে হয়েছে কাজে যোগদান করতে। হঠাৎ করে শনিবার সন্ধ্যায় প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়েছিল। বাড়ি থেকে নদী খুব একটা দূরে নয়, সমুদ্র থেকে উঠে আসা ত্রিমুখি নদীর সংযোগস্থলের মাইলখানেক দূরেই আমাদের গ্রাম। শো শো বাতাসের সাথে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ আমাদের ঢাকায় ফেরার অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু আমার তিন বছরের ছেলেটা প্রকৃতিগত স্বভাবসুলভে টের পেয়ে গেল, সেদিন রাতেই আমরা কাজে যোগদানের উদ্দেশে রওয়ানা হব। ছেলেটা অপেক্ষা করতে থাকে আমাদের চলে আসাটা আটকানোর জন্য। কত বাহানা ওর- দাদীর সঙ্গে একদম বনিবনা হয়না, রাত হলে নাকি বিছানায় চেপে ধরে ওর দাদু মারে। এটা আমাদের আটকানোর ওর একটা শিশুসুলভ কৌশল। ছেলেটা ওর মায়ের কোলে ঘুমে ঢুল ঢুল করে। গলাটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মায়ের বুকের ওপর ঘুমিয়ে যায়। সেই ঘুমের ছেলেটাকে ওর দাদীর কোলে দিয়ে আমরা ঝড় পরবর্তী বৃষ্টিস্নাত হাওয়ার ভেতর রাস্তায় নেমে পড়লাম। বাইরের পথঘাট ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাব্লিক বাস যেহেতু বন্ধ তাই তিনগুণ ভাড়া চুক্তিতে মাইক্রোবাসে রওয়ানা হলাম। দৌলতদিয়া ফেরীঘাট পর্যন্ত পথজুড়ে তারিমা ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদল। আমাদের পথ যেন আর ফুরায় না। ফেরিতে পদ্মার জলের ওপর তারিমার শোকার্ত জল যখন গড়িয়ে পড়ে, তখন চোখ মুছে ও ক্ষ্যান্ত হয়। যাত্রীরা মোবাইল স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে আমাদের সান্ত্বনার বানী শোনাল- আরো কয়েকদিনের জন্য কাজের জায়গাগুলো আপাতত বন্ধ। ছেলেকে রেখে আসার শোক পদ্মার জলে ধুয়ে নতুন চিন্তায় ডুবে গেলাম। তিনগুন ভাড়া গুনে শহরে এসে কি ফল হল আমাদের! মানিকগঞ্জ পার হতে হতে রোদ চড়া হয়ে উঠল। পুলিশ রাস্তায় বেড়িকেট দিয়ে বাস থামিয়ে দিল। আমরা হাইওয়ের ডানপাশ ধরে পুবমুখী হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে আমাদের চিন্তার শিরাগুলি কেঁচোর মত ফুলে ওঠে। আমরা আশায় থাকি, এই প্রবঞ্চনার পরও কর্তৃপক্ষ যদি গতমাসের বেতনটা দেয়! অথচ, আজ নয়দিন কেটে গেলেও কারাখানা থেকে আমাদের কেউ ডাকেনি। হাতে টাকাপয়সা নেই, কি খেয়ে বাঁচি দুজন! আর এজন্যই আমাদের অনির্দিষ্ট গন্তব্যের পথে যাত্রা। আমরা জানিনা, ভাগ্য আমাদের জন্য কি নিয়ে অপেক্ষা করছে! সড়কের উল্টোদিকে দুটো ক্ষুধার্ত কুকুর প্রায় পরিত্যাক্ত ডাস্টবিনের পাশে ঘুরছে। আরেকটা সরু গলি থেকে টর্চ হাতে রাস্তায় বের হল পাহারাদার। আমরা সাধারণ পথচারির মতোই হাঁটতে থাকলাম। পাহারাদার একবার টর্চ মেরে তারিমাকে একঝলক দেখে নিল তারপর কি যেন মনে করে চুপ। বিনে বাঁধায় তার চোখের সামনে দিয়ে চলে আসতে পেরে আমরা নিজেদের হালকা বোধ করলাম। দশ নাম্বার গোল চত্তর ওভার ব্রিজের নিচে আমরা প্রথমবার জেরার মুখে পড়লাম।
-কী নাম? পুলিশের পোষাকধারী অফিসার জিগ্যেস করল।
- রোবেল
-রুবেল?
-হুম, রোবেল।
আমার চোখ, মুখ, শরীর দিয়ে অস্থির আগুন বেরোচ্ছে। অফিসার কথার মাঝখানে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল-অসুস্থ নাকি আপনে? আমি নিজেকে ঠিক রেখে স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলাম- ঠিকাছে সব । সামান্য একটা কাশি কিংবা সাধারণ হাঁচিও এখন ভয়ের কারণ। যে কেউ মনে করবে এই বুঝি করোনা ভাইরাসের রোগী। গলার ভেতরের খুসখুস করা ছোট্ট কাশিটাকে কোনো রকম চেপে রাখলাম। আমার মনে পড়ল পাশের বাসার সোবেত আলীর কথা। লোকটার নাম, সোবেত আলী ওস্তাগার। খুব ভালো মানুষ। বাড়ি পটুয়াখালী জেলার রাঙাবালির চরে। ওর এক নীকটাত্মীয় একটা বুড়িয়ে যাওয়া স্টিল বোটের খোন্দলে তরমুজ ভরে বিক্রি করতে নিয়ে এসেছে ফতুল্লার ঘাটে। লগডাউনের এই সময়ে তরমুজের জাহাজ ছাড়া দক্ষিণে যাওয়ার আর কোনো ভালো উপায় নেই। আমার ভাবনা আর পরিকল্পনা চলতে থাকে। - এই রাতে বাইর হইছেন ক্যান? পুলিশের অফিসার জানতে চাইল।
বউ এমনভাবে অভিনয় করল যেন এখানকার আশেপাশেই কোথাও আমাদের বাসা। সামনের কোনো ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে যাচ্ছি।অন্ধকার ঠেলে আরেকজন লোক আসতে দেখে অফিসার আমাদের বাম হাতের ইশারায় চলে যেতে বলল। তারিমার হাত ধরে রাস্তার ডানপাশ ধরে হাঁটতে লাগলাম আর তখন প্রতিদিন টিভির পর্দায় দেখা মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার কথা মনে পড়ল। ভদ্রমহিলা প্রতিদিন করোনায় মৃত আর আক্রান্তের তালিকা খুব মার্জিতভাবে এনাউন্স করে। কিন্তু তাকে এখন আর পর্দায় দেখা যায় না। তার ক্যামেরার অন্তরালে যাওয়ায় আমার মনের ভেতর একটা সন্দেহের দানা বাঁধে। আমরা ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম। সামনের পয়েন্টে পুলিশের জটলাটা একটু বড় দেখে আর এগোতে সাহস হয় না। যতই সামনে যেতে চাই পা দুটো অসাড় হয়ে আসে। তারিমা পেছন থেকে আমার জামাটা দলা পাকিয়ে খামচে ধরল। আমরা একটা উঁচু বিল্ডিংয়ের বামপাশে পরিত্যাক্ত একটুখানি জায়গা দেখে কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে থাকার কথা ভাবলাম। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আরো তিন চারজন মেয়েমানুষ।আর ওদের হাবভাব দেখে যে কেউ মেয়েগুলোকে চিনে নিতে পারে। শরীরে বাসি সুঘ্রাণ, পরনে টাইট ফিটিং জামা। মাস্ক দিয়ে ঢেকে রাখা নাকমুখ। ওরা তারিমাকে দেখে ওদের মতোই বাজারি মেয়ে মনে করল। আর আমাকে মনে করল তারিমার রসিক খদ্দের। লক ডাউনের কারণে পঙ্গপালের মতো যৌনপিপাঁসুরা এখন আর পরিত্যক্ত জায়গাটিতে আসেনা। ওদের আয় রোজগার বন্ধ। ওরা আমাদের কোচর আর পকেট হাতিয়ে খুচরো টাকাগুলো ছিনতাই করল।বউয়ের সামনে আমার হাত ধরে টানাটানি করল। রুচিহীন পোষাক পরা কম বয়সী মেয়েটি ওর বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলল,- কিছু করতি চাইলে কইরে নে মগা, আমরা বিনি কামে পয়সা নিই না। বউয়ের সামনে লজ্জায় মাথা কাটা যায় আমার! তারিমা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস করতে লাগল।মেয়েটির কবল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পেছনের দিকে হাঁটার চেষ্টা করলাম। একটি মেয়ে তেড়ে এসে আমাকে বলল- হালা নয়নশুর আইছে কোত্থিকা! আমি পেছনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ফাঁকা পথের দিকে তাকিয়ে বললাম- পুলিশ! আর তখন হিজরার মত মরদা মেয়েটি তাচ্ছিল্য করে বলল-খেত্তর! পুলিশের জটলার কাছে আরেকটি গাড়ী এসে থামল। কয়েকজন পুলিশ সেই গাড়িটায় উঠে গেলে জায়গাটা একটু হালকা হয়। আমরা আড়াল থেকে বেরিয়ে বামের পথ ধরে দূরের ইলেক্ট্রিক খাম্বার ওপর একটা হলুদ বাতি নিশানা করে হাঁটতে থাকি। একটা তস্যগলির চৌহদ্দি পেরিয়ে সরল পথে হলুদ বাতিটার নাগাল পেয়ে যাই। পুরনো দেয়ালের ফুটো দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি দুই লেনের রাস্তার ওপার ল্যাম্পপোস্টের কটকটে আলোর নিচে পিছমোড়ে হাত বাঁধা তিনজন যুবক। পুলিশ একটু পরপর ওদের পাছায় বাটাম দিচ্ছে আর জেরা করছে চুরির ব্যাপারে। কোন কোন তালাবদ্ধ ঘর খালি করেছে ওরা, সেসব। ওদের মধ্যে একজন সমস্ত শরীর ঝাঁকিয়ে হাঁচি দিয়ে উঠল। পুলিশগুলো সড়কের মাঝখানে পিচের ওপর ধুপধাপ বুটের শব্দ করে দৌঁড়াতে লাগল হাচির বিষ্ফোরণে নির্গত অদৃশ্য জীবাণুর ভয়ে। আমরা সুযোগ বুঝে সড়কটা আড়াআড়ি পাড়ি দিয়ে ওপারের একটা চিপা গলির ভেতর দিয়ে হাওয়া হয়ে যেতে লাগলাম। সুযোগসন্ধানী নিশাচর লোকদের পথে বের হওয়ার মত গাঢ় হয়েছে রাত। আকাশের বারোআনা উজ্জ্বল চাঁদ নিঃসঙ্কচে আয়েশ করে তাকাচ্ছে চরাচরের দিকে। রাস্তায় পথচারী নেই, নিশিজাগা সেইসব মাতালগুলো গা ঢাকা দিয়েছে ঘোপের ভেতর। পথিকের আশায় ওত পেতে থাকা ছিনাতাইকারীর দল কোথায় লুঁকিয়েছে কে জানে! আমরা চুপচাপ হাঁটছি। চিপা গলিটা শেষ হয়ে বহুমুখি এক মোড়ের কাছে চুপ করে দাঁড়ালাম। জায়গাটা অবশ্য আমার চেনা। কোনদিকে যেতে হবে সেটাও জানি। কিন্তু সামনের মোড়ে কর্তব্যরত এক কনেস্টবল রাস্তার মুখে আমাদের নড়েচড়ে ওঠা ছায়া দেখে ফেলল। লম্বা লম্বা পা ফেলে দুজন পুলিশ তেড়ে এসে আমাদের ধরে নিয়ে গেল অফিসারের কাছে। আমাদের মুখোমুখি দাঁড়াল একজন বয়স্ক দুইতারা বিশিষ্ট অফিসার। বেশ ঝাঁঝালো আর কঠোর কণ্ঠস্বর তার। আমাদের ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখল রাস্তার পিচের ওপর। তারপর জেরা করতে শুরু করল- কেন এত রাতে বের হয়েছি রাস্তায়! আমাদের মধ্য কি-ইবা এমন সম্পর্ক, ইত্যাদি। রাত প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তাদের জেরার মুখে পরাস্থ হতে হয় আমাদের। একসময় সত্যি কথাটাই বলতে হল বেকায়দার পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য। সামনে আমাদের বড় দুষ্কাল। আজ তিন চারদিন ঘরে খাবার নেই। সরকারি চাল ডাল টিভির পর্দায় দেখা যায় কিন্তু পাওয়াটা লাইনঘাটের ব্যাপার। তিন বছরের ছেলেটা দাদীর কাছে আমাদের নিয়ে বিচিত্রসব প্রশ্ন করে।ওর দাদী ছেলেটার সেইসব প্রশ্ন নিয়ে হায়বাত করে আর মনযোগে কান পাতলে শোনা যায় বাচ্চাটার অবুঝ আব্দারগুলো। বাদামতলী, ওয়াইজঘাট কিংবা সোয়ারীঘাট যদি লঞ্চ টঞ্চ জোটে সেই আশায় বের হয়েছি ঘর থেকে। খাকি পোশাকপরা সহকারী পুলিশ পাছার ওপর শপাং শপাং দুঘা মেরে বলল, সরকারের বদনাম চোদাস চোদনার পো? কোথায় সরকারের বদনাম করলাম সেটা বুঝে উঠতে পারছিনা। অফিসার লোকটা মুখের মাস্ক খুলে তার হাতের লাঠির আগা দিয়ে আমার পিঠের ওপর খোঁচা দিয়ে বলল- মরার যখোনে শক হইচে,যাহ! আমরা সুবেদার ঘাট জামে মসজিদের পাশ দিয়ে হোটেল আল রাজ্জাকের কাছে একটা পুরনো দালানের গ্যাস রাইজারের কাছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। তারপর একটু গা ঢাকা দেওয়ার জন্য ঘুরপথে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। ফুলবাড়িয়ার মোচড় ঘুরে ওভার ব্রিজের নিচ দিয়ে পুরান ঢাকার কতগুলি গোলমেলেভরা ঘিঞ্জি। পুরনো বাড়িগুলির ধুলোপড়া জানালার পাশ কাটিয়ে যেতে লাগলাম দুজন। নির্ঝঞ্ঝাট রাত্রিকালীন হাওয়া ধুলোভরা গলির ওপর দিয়ে আছাড় খেতে খেতে গড়িয়ে চলছে দূরের চওড়া সড়কটার দিকে। পেটের দায়ে তাড়িত দুএকটা কুকুর ছাড়া আর কোনো প্রাণির স্পন্দন নেই। কোনো গলির মুখে শুকনো বাঁশের বেষ্টনি, কোথাও গলির মুখে লাল নিশান। আমরা অচেনা পথ হাতড়ে তাতীবাজার মোড়ের নিশানা পেয়ে গেলাম।ফোনে তরমুজের জাহাজের অবস্থানটা জেনে হাতের বাম দিকে ফতুল্লার উদ্দেশে হাঁটতে থাকি। গেন্ডারিয়ার ডান দিকের শূন্য পয়েন্ট পাড় হয়ে আজগর আলী লেনের কাছে এসে দাঁড়াতেই পূর্বাকাশ ভোরের ক্ষীণ আভায় উদ্ভাসিত। তাজা দমকা হাওয়ায় মানবশূন্য পথটা সতেজ হয়ে উঠল। কয়েকটা পাখির কিচিরমিচির যেন নতুন দিনের আগমনী কাসিদা পাঠ। কয়েকটা দাড় কাকের কা কা ধ্বনি আর যে কোনো সময়ের থেকে সুরেলা মনে হয়। গলি, ঘুপচিগলি আর উপগলি পাড় হয়ে হরিচরণ রায় রোডের কাছাকাছি এসে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। পাশে ময়লার স্তুপের কাছে কয়েকটি কুকুরের ক্ষুদিত গর্জন। দূরের আকাশে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা শেষ তারাটিও মিটমিট করে নিভে যেতে লাগল। সেখানে দুহাত ছড়িয়ে মাটিতে উবু হয়ে পড়ে থাকা লোকটির পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে ভয়ে কুঁকড়ে যাই। লোকটা পুরুষ, পেছন দিক দিয়ে লুঙ্গিটা উল্টে কোমড়ের কাছাকাছি উঠে গেছে। মনে হল লোকটার ফঁসফুঁস একদম খেয়ে ফেলেছে হরামজাদা ক্ষুদ্রদস্যুর দল। আর ভাইরাসের সাঁতারকাটা জল লোকটার নাকের ফুটো গড়িয়ে বের হয়ে আসছে বাইরের দিকে।নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়েই দেখলাম লোকটার লোহার মত অসাড় দেহটা। আমরা ভয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে শ্মশানঘাট নদীর পাড়ে পৌঁছলাম। পাইলিং করা বুড়িগঙ্গার নির্জন পাড়। বহু বছরের পুরনো একটা জটাধারী গাছের নিচে নোঙর করা প্রতিক্ষিত সেই তরমুজের জাহাজ। জাহাজটার নিতম্বের ওপর অর্ন্তদহণ ইঞ্জিন। নিশ্চল লাশের মত বুক চিতিয়ে থাকা বুড়িগঙ্গার জলের ওপর শুয়ে আছে জাহাজটি। আমাদের মত আরো কয়েকটি পরিবার সেখানে মিলিত হয়েছে দক্ষিণে যাবার জন্য। কেউ চাঁদপুর, কেউ লক্ষ্মীপুর আবার কেউ মেহেন্দীগঞ্জ চরে। বুড়িগঙ্গার জল ধীর গতিতে ছুটছে ধলেশ্বরীর দিকে। জাহাজটা জলের ওরপ দিয়ে মৃদু তালে নাচতে নাচতে এগিয়ে চলছে সুদূর দক্ষিণে।জাহাজের বুকের ওপর তরমুজের কুলুপকাটা গর্তের মত একটা খোঁদল। আমরা অতি সত্ত্বর সেই খোঁদলের ভেতর লুঁকিয়ে নিজেদের ফেললাম।সেখানে আমাদের মত আরো দুটি পরিবার। ডরার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কতগুলি ছোটবড় তরমুজ। পটুয়াখালীর রাঙাবালি চর থেকে তরমুজ নিয়ে এসেছিল জাহাজটি। ভিড়েছিল ফতুল্লার ঘাটে।তরমুজ বেচাবিক্রির পর কয়েকটা চেয়েচিন্তে কয়েকটা চুরি করে রেখে দিয়েছে জাহাজের লোকেরা।খোঁদলের এক কোনে গুটিসুটি মেরে বসে আছে এক থুত্থুরে বুড়ি। কোঁচকানো চেহারা তার। তার পাশে বসা সদ্য গোঁফ গজিয়ে ওঠা তার নাতি। পাশেই ছেলেটির মধ্য বয়সী মা।মাথার ওপরের কুলুপকাটা দরজাটা দিয়ে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটির মা । জাহাজের ইঞ্জিনের দিকটা স্টিলের সেড দিয়ে আড়াল করা। রোদে বেঁকে যাওয়া তক্তার ওপর ভ্যাগাচ্যাগা চাটাইয়ের ওপর একটা অবিন্যস্ত পুরু কাঁথা। জায়গাটা বিশৃংখলার একশেষ। নোংরা তৈজসপত্র, ফেটে যাওয়া কয়েকটা তরমুজের খোল, লালা শুকানো কয়েকটা ডিমের খোসা আর সিগারেটের খালি প্যাকেট ছড়িয়ে আছে কাঁথাটার চারপাশে। রোদের আচ ক্রমশ নামতে থাকে খোঁদলের ভেতর। আমরা একটা করে তরমুজ ফাটিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরলাম। তরমুজের লাল মাংস থেকে স্বচ্ছ জলের ধারা আঙুলের ফাঁক বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোংরা কাঁথার ওপর। সদ্য গোঁফ গজানো ছেলেটির মা অর্থাৎ মধ্যবয়সী মহিলাটি দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে।মহিলা দু’একপা হাঁটার চেষ্টা করে স্রোতের দুলুনিতে আবার ধপাস করে বসে পড়ল চাটাইয়ের ওপর। কেমন ক্লান্ত ভাব তার- লাজুক। মুখটা ফোলা ফোলা, দৃষ্টিতে ঔজ্জ্বল্য নেই। মহিলা নোংরা কাঁথাটার ওপর শাড়িটা ছড়িয়ে বসে পড়ল। মাথাটা নুইয়ে খিঁচ দিয়ে বাঁকা করল মুখটা। ফাটানো তরমুজের স্বচ্ছ জলের মতোই আরেকটা অস্বচ্ছ রক্তিম ধারা গড়িয়ে পড়ল কাঁথার ওপর। চুপষে যাওয়া রেখাটা দেখতে তরমুজের মাংসের মতোই লাল।মহিলার সদ্য গোঁফ গজানো ছেলেটির পিঠের অংশের জামা ঘামে ভিজে ওঠল। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যাগ থেকে লুঙ্গিটা বের করে সেটা ধরিয়ে দিল মায়ের হাতে। তারপর কাঁথাটা তুলে একপাশে আড়াল করে ধরল মাকে। কাজটা পুরোপুরি সম্পন্ন করতে তারিমা মহিলাটিকে সাহায্য করল। অবস্থার পরিপ্রেক্ষেতিতে আমরা পুরুষেরা খোন্দল থেকে বের হয়ে একটা করে তরমুজ নিয়ে জাহাজের খোলা বুকের ওপর দাঁড়ালাম। জাহাজটা মোক্তারপুর ব্রীজ ছেড়ে সোজা দক্ষিণ দিকে অনবরত হামাগুড়ি দিতে লাগল। আমাদের চোখে ভেসে ওঠল সবুজ গাছপালার দেহরেখা। একটা আধা শহরের পাশ দিয়ে একটা নদী ঢুকে গেছে ভেতরের দিকে। মাথার উপর জ্বলে ওঠা পাগলা সূর্যটা ক্রমশ বিদ্রোহী হয়ে উঠছে।তখন খোন্দল থেকে শোনা গেল সেই মহিলার কণ্ঠস্বর। আমি খোন্দলে উঁকি দিয়ে তারিমার অবস্থা দেখার চেষ্টা করলাম।চারপাশের আবর্জনা সাফ ছুতোর করে চাটাইটার শ্রীবৃদ্ধি করেছে ভেতরের মহিলারা। নেংরা কাঁথাটা একপাশে গুটিয়ে মহিলা সম্ভবত পেটের ব্যাথায় শুয়ে পড়েছে চাটাইয়ের ওপর।তাঁতানো সূর্যের তাপে মহিলাদের শরীর ঘেমে গোসল করার মত অবস্থা। থুত্থুরে বৃদ্ধার খুক করে একটা ছোট্ট কাশিতে যেন ঝনাৎ করে নড়ে উঠল তরমুজের জাহাজ।আমাদের প্রত্যেকের মুখের দিকে রুগ্নাবস্থায় তাকিয়ে থাকে ফাটানো তরমুজের লাল মাংস। আমাদের তরমুজ আর খাওয়া হল না। সদ্য গোঁফ গজানো ছেলেটি খোন্দলের দিক থেকে মুখ তুলে তাকাল ডান দিকের আকাশের দিকে। একটা চিল অর্ধেক নদী আর অর্ধেক গ্রাম মিলিয়ে অনবরত তা দিচ্ছে মাথার উপর। তরমুজের লাল মাংস আমাদের হাতে অপেক্ষা করে।গতকালকের ব্রিফিংয়ে মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা যে মৃত্যুর তালিকাটা দিয়েছিল হঠাৎ সেটা মনে পড়ল বুড়ির কাশির শব্দে।কয়েক মুহূর্ত কেউই কথা বলল না আর।রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের নিচে তরমুজের জাহাজের ওপর শুধু ভেসে রইল মধ্যাহ্ন উত্তাপের স্তব্ধতা।
আস্তে আস্তে জালে জড়ালো, স্বপ্নের মতোন। শেষটা ভীষণ সুন্দর আর অর্থবহ।
চমৎকার হৃদয় ছোঁয়া ছোটগল্প,পড়ে অনেক ভালো লাগলো
মুগ্ধ হলাম গল্পটা পড়ে।
অসাধারণ একটা ছোট গল্প।পড়ে অনেক তৃপ্তি পেলাম।