জাকির তালুকদারের ছোটগল্প ‘হিন্দু-মুসলমান’
’
ছোট্ট শহরকে দু’ফাঁক করে বয়ে যাওয়া নারদ নদীর লিয়াকত ব্রিজের নিচে হ্যাপি, আতা এবং অবিনাশকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে মেরে ফেলার পরে লাশ তিনটিকে নারদেরই পাঁকে পুঁতে ফেলে চলে যাওয়ার আগে সেই কবরের ওপর ছর ছর শব্দে পেচ্ছাপ করে পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন জমসেদ। ঘটনা একাত্তরের মার্চ মাসের ত্রিশ তারিখের। সম্পূর্ণ হত্যাকাণ্ড, ক্যাপ্টেনের পেচ্ছাপ করাসহ, ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে বসে দেখে পোস্ট অফিসের মোসলেম পিয়ন। সারা শরীরে ভীতিজনিত কম্পণ এবং গলার কাছে উঠে আসা হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি নিয়ে পাকবাহিনী চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ বসে থাকে মোসলেম সেই ঝোপের ভেতরেই। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরে যখন তার মনে হয় যে পাকবাহিনীর আর এই পথে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই, একমাত্র তখনই সে ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারে। এখন তার একমাত্র চিন্তা, বাড়িতে ফিরে পরিজনদের মুখ দেখা। কিন্তু বাড়ির দিকে ত্রস্ত পা বাড়াতে গিয়েও সে কী মনে করে থমকে দাঁড়ায়। একে তো এই ছোট্ট শহরের প্রায় সকল প্রাপ্তবয়ষ্ক একে অপরকে চেনে, তদুপরি মোসলেম নিজে পিয়ন হওয়ার সুবাদে নামে নামে চিঠি পৌঁছে দেবার কারণে সবার সঙ্গেই তার নিদেনপক্ষে বাক্যালাপের সম্পর্ক তো অবশ্যই রয়েছে।
আজ হঠাৎই সবগুলি সম্পর্ক তার কাছে বড় নিকটের বলে মনে হতে থাকে। সে বাড়ি যাওয়া কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত রেখে পায়ে পায়ে নেমে আসে সদ্য তৈরি হওয়া গণকবরটির কাছে। পাঞ্জাবি শুয়োরটার পেচ্ছাপের দুর্গন্ধ তখনো পাওয়া যাচ্ছে একটু একটু। মোসলেম বড় দেখে একটা কচুর পাতা ছিঁড়ে আনে। তাতে করে নদীর পানি বারকয়েক এনে ঢেলে দেয় কবরটার ওপর। দুর্গন্ধ পুরোটা যায় না। কিন্তু আর কিছু করার মতো অবস্থায় এখন মোসলেম নেই। যদি সুযোগ পায়, তবে একসময় সে লোবান এনে জ্বালিয়ে দেবে এই কবরে। পীরের কবরে মানত করার মতো করে নিজেকে বলে সে। আপাতত দোয়া পড়ে, ‘ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেউন!’ তারপরে মনে আসে যে মৃতদের মধ্যে একজন তো হিন্দুও আছে। মোসলেম ছোটবেলায় আর সব মুসলমান ছেলেদের মতো মক্তবে পড়ার সময় শিখেছিল যে বিধর্মী কারো মৃত্যুর খবর শুনলে বলতে হয়, ‘ফি নারে জাহান্নামা খালেদিনা ফিহা’। তার তাহলে সেই দোয়াটাও পাঠ করা উচিত। কিন্তু এই ওলোট-পালোট সময়ে তার মাথার মধ্যেও কিছুটা ওলোট-পালোট ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে। হিন্দু-মুসলমানের অনেক শোনা তারতম্যের হিসাব এখন আর তার মাথায় বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট আছে বলে আর মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এই দোয়াটির মধ্যে বিধর্মীদের সম্পর্কে খারাপ কিছু বোধহয় বলা হয়েছে। বস্তুত এই মূহুর্তে তার কাছে মৃত অবিনাশকে মোটেই বিধর্মী বলে মনে হচ্ছে না।
আতঙ্ক এখন অনেকটা কমে এসেছে। ভয়ের তীব্রতায় শরীরের ভেতরের কল-কব্জাগুলি এতক্ষণ থমকে গিয়েছিল। এখন ধীরে ধীরে নিজের অনুভূতি ফিরে পাচ্ছে সেগুলি। যেমন, এই এতক্ষণ পরে বুক ফেটে কান্না উঠে আসতে চাইছে তার। সে কাঁদছেও। কিন্তু চিৎকার করে কেঁদে শত্রু-মিত্র কারো দৃষ্টিই যে এখন আকর্ষণ করা চলবে না, সেটুকু হুঁশ তার ইতোমধ্যে ফিরে এসেছে। সে তাই নিঃশব্দে কাঁদে। গণকবর থেকে মাত্র হাতদশেক দূরে দাঁড়িয়ে থেকেও সে নিজেকে রক্ষা করার কথাটিও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে পারে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, আর নয়। বউ-বাচ্চা নিয়ে আজই তাকে শহর ছাড়তে হবে। সম্ভব হলে এক্ষুনি। সরকারের চাকরি করে সে। চাকরির কথা ভুলে যেতে হবে এই মুহূর্তে। জীবন বাঁচলে তবে না চাকরি। সে বাড়ির দিকে পা বাড়াতে গিয়েও আর একবারের জন্য ফিরে আসে। একটা জিগার ডাল ভেঙে নিয়ে ফের নারদের পাঁকে নামে। যেখানে পুঁতে রাখা হয়েছে তিনটি মৃতদেহ, তার পাশে পুঁতে দেয় জিগার ডালটি। একটা চিহ্ন অন্তত থাকুক।
২.
বুড়ির এক হাতে সোমত্ত নাতনির হাত। আরেক হাতে ছাগলের দড়ি। মানুষের স্রোতে মিশে তারা চলেছে ইন্ডিয়ায়। জীবন বাঁচাতে ছুটে চলেছে মানুষের ঢল। ঢলের পর ঢল। বুড়ির চলার গতি ধীর। পায়ে বাত, কোমরে বাত। সঙ্গে বেশি হাঁটতে অনিচ্ছুক ছাগল। ঘাস-পাতা দেখলেই মুখ বাড়ায় সেদিকে। তাই তারা বারবার পিছিয়ে পড়ে। সঙ্গের মানবঢল তাদের পেছনে রেখে চলে যায়। তাদের ধরে ফেলে পেছনের ঢল। একসময় সেটিও তাদের পেছনে ফেলে অগ্রবর্তী হয়ে পড়ে। তখন আরেক দল এসে তাদের সঙ্গ নেয়।
পঁচাত্তর পেরিয়ে যাওয়া বুড়ি প্রাণপণে হাঁটে। জীবনের প্রায় পুরো পথ পেরিয়ে এসেও জীবন বাঁচাতে হাঁটে। তার ঘোলাটে চোখ সামনের দিকে তাকিয়ে ইন্ডিয়া খুঁজে পায় না। বরং তার চোখের সামনে শুধু আগুয়ান মানুষের পিঠ। মাঝে মাঝে দূরের মাঠের তাপ-তরঙ্গ নাচে তার চোখে। একটু পর পর বুড়ির চোখে লাল-নীল-হলুদ রঙের নাচুনি, আর মাথা ঘুরে ওঠা। বুড়ি তবু হাঁটে। সোমত্ত নাতনির হাত চেপে ধরে হাঁটে। অনিচ্ছুক ছাগলের দড়ি ধরে টানতে টানতে হাঁটে।
মানুষের দল হাঁটছে না, যেন ছুটে চলেছে। সবার মুখে সাঁটা আতঙ্কের মুখোশ। ভীতি ছাড়া আর কোনো অনুভূতির সঙ্গে যেন তাদের পরিচয় ছিল না কোনোকালে। তারা পেছনে দেখে এসেছে মৃত্যুর ভয়াবহতা, দেখে এসেছে পৈশাচিকতার চরমতম রূপ।
আর সেই সদ্য আতঙ্কের স্মৃতি তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে তাদের। নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে বাঁচানোর বাইরে আর কিছু ভাবতে পারছে না তারা এখন। তারা হাঁটছে তো হাঁটছেই। দিনের আলোয় যতক্ষণ পথ দেখা যাচ্ছে, ততক্ষণ হেঁটে চলেছে তারা। পথের পাশে ছড়ানো ছিটানো গ্রাম পড়ছে মাঝে মাঝে। কোনো গ্রামকেই তারা তাদের সবুজ বিশ্রামের হাতছানি ভাবতে পারছে না। কিছুক্ষণের জন্য থামছে হয়তো কোনো কুয়োর পাশে। শুকনো খাবার খেয়ে মুখে পানি ঢেলে নিচ্ছে দু’ঢোক। তারপরেই হাঁটা শুরু করছে। পথপাশের সেই গ্রামগুলিতে ফেলে-ছড়িয়ে যারা রয়ে গেছে এখনো, তাদের মনে বাড়তি ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে এই ইন্ডিয়ামুখী কাফেলাগুলি। ওরে পালা পালা! মেলেটারি এলেই কিন্তু সর্বনাশ! তখন সেই গ্রাম ছেড়েও অধিবাসীদের কেউ কেউ বেরিয়ে আসছে। পোটলা-পুটলি নিয়ে ছুটছে বর্ডারের দিকে।
বুড়ির দুশ্চিন্তা নিজের পৌণে একশো বছরের পুরনো জীবনকে নিয়ে, লকলকে তরুণী নাতনিকে নিয়ে, সংসারের সম্পত্তি বলতে থাকা একমাত্র ছাগলকে নিয়ে। বুড়ি তাই পরিবার এবং সম্পত্তিকে টেনে হিঁচড়ে যতটা পারে জোরে পথ পেরুতে চায়। কিন্তু বাংলাভূমিতে নিরবচ্ছিন্ন পথ বলতে তো কিছু নেই। একটু পর পর আর কিছু না থাকুক, খালের কমতি নেই। আর খাল পড়ল তো শুরু হলো ছাগলের চরম অসহযোগিতা। কিছুতেই ছাগল নামতে চায় না পানিতে। আর বুড়ি তখন ফেটে পড়ে ক্রোধে– ‘এখন পানিত নামিস না ক্যারে হারামজাদি? তখন ভোটের সময় তো তুই-ও কইছিলি নৌকা মার্কাত ভোট দ্যাও, মজিবরের মার্কাত ভোট দ্যাও!’
ছাগল বুড়ির গালাগালিতে কান দেয় না। সে পানির সমান্তরালে ছুটতে থাকে খালপাড় ধরে। একবার ডানদিকে, একবার বামদিকে। বুড়ি এখন নাতনিকে সামলায় না ছাগল সামলায়! দৃশ্য দেখে এই দুঃসময়ের মধ্যেও হই হই করে হেসে ওঠে পলায়নপর মানুষের দঙ্গল। মানুষের সম্মিলিত হাসির হল্লায় ছাগল আরো ভড়কে যায়। ছাগলের টানে বুড়ির হাতের দড়ি হাতছাড়া হয় হয়। একসময় ছুটেও যায়। ছাগল এবার ছুট লাগায় উল্টোমুখে। যেন বাড়ি ফিরে যেতে চায়। বুড়ির মুখে শাপশাপান্ত, ‘হারামজাদি বকরি! বাড়িত যাওয়ার খায়েশ। তখন তো তুইও কইছিলি নৌকা মার্কাত ভোট দিতে।’
দলের মানুষ মজা দেখে বটে, কিন্তু তাদের জন্য অপেক্ষা করে না। আসলে এই দল তো সৃষ্টি হয়েছে পালানোর পথে। পলায়নপর মানুষ বেশিক্ষণ দলবদ্ধ থাকতে পারে না।
৩.
সাত বছরের মেয়ে, চার বছরের ছেলে, আর যুবতী বউকে নিয়ে পথে নামে মোসলেম পিয়ন। বউ কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না বাড়ি ছাড়তে। হোক না মোটে দু’টো টিনের চালার মেটে ঘর, তবু তো নিজের সংসার। তকতকে নিকানো উঠোন-মেঝে-বারান্দা। উঠোনে ছেলে-মেয়ে দু’টি ছুটোছুটি খেলে। লাউ- কুমড়া-সিমের উঁচু করে বাঁধানো মাচানের ছায়ায় দানা খুঁটে খায় ঘরের পোষা মোরগ-মুরগি। গলাছেলা চীনা জাতের মুরগিটা তো মাসে পাঁচ-ছয়দিন মাত্র পালির বিরাম দিয়ে সারাবছরই ডিম পেড়ে চলে। বাগডাশ-শিয়াল-চিল-প্রতিবেশীদের লোভী চোখ থেকে কত কষ্ট করেই না ওগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে সে। ফেলে রেখে চলে গেলে কে দেখাশোনা করবে ওদের! তার এই সকরুণ অনুযোগ স্বামীর কানের ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। রাখো তোমার মুরগি! এখন জান বাঁচান হচ্ছে আসল কাম।
সঙ্গে কি কি নেয়া যাবে? শুধু নগদ টাকা, সামান্য যা আছে সোনা-দানা, আর কাপড়-চোপড়। ব্যাস! তাহলে তিন মাস ধরে স্বপ্নের ফোঁড় তুলে তুলে বোনা নকশিকাঁথা তিনটি? কুলা থেকে মুষ্টি সরিয়ে মাজারে শিন্নি চড়ানোর নিয়তে জমানো আধমণটাক চাল? ছেলে-মেয়েদের জন্য বারুহাসের মেলা থেকে কিনে আনা শোলা আর মাটির খেলনাগুলো? মেয়ের নাক ফোঁড়ানোর সময় নানির দেওয়া জামবাটি। পুরনো কাপড়ের বিনিময়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনা ছেলের দুধ খাওয়ার চীনামাটির মগ? পেতলের সেই বগি থালা, যাতে ভাত-তরকারি বেড়ে স্বামীর সামনে তুলে ধরার সময় নিজেকে সত্যিকারের আদর্শ স্ত্রী মনে হয়?
‘ওইসব লিয়্যা বোঝা বাড়ান যাবি না!’ স্ত্রীকে বোঝায় মোসলেম– ‘মেলেটারি পাখির মতোন মানুষ মারতিছে। আমি নিজের চোখে তিন জনাক মারতে দেখিছি। যুবতী মিয়্যামানুষ দেকলেই তুল্যা লিয়্যা যাচ্ছে। এখন আমার নিজের জীবন, ছাওয়াল-মিয়্যার জীবন, তোমার ইজ্জত বাঁচাতে হলে পালান লাগবি। আল্লা যদি ফের সুদিন দেয়, তখন আবার নতুন ভাবে সব শুরু করা যাবি।’
‘আমরা কই যাব?’ এই প্রশ্নে থমকে যেতে হয় তাকে। ইন্ডিয়া! একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় এখন সেটাই। কিন্তু সেখানে তারা কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে?
ঝটপট সিদ্ধান্ত নেয় মোসলেম– ‘প্রথমে বড় বুবুর বাড়িতে। বর্ডারের কাছে বাড়ি। সুযোগমতো চলে যাওয়া যাবে সেখান থেকে।’
খানিকটা পথ বাসে।
তারপর রিকশায়।
তারপর আবার বাস।
তারপর নদীপথে নৌকায় অনেকখানি পথ।
তারপর আর কোনো বাহন নেই। গরুর গাড়ি পর্যন্ত পাওয়া যায় না।
তখন থেকে শুধু হাঁটা।
বড় বুবুর বাড়ি এখন অনেক দূরের পথ বলে মনে হচ্ছে।
বিয়ের পরে সপরিবারে অন্তত বারতিনেক গেছে সে। তিনঘণ্টার বাসযাত্রা। তারপরে ঐ ঘণ্টাতিনেকই হাল-বওয়া নৌকা। গঞ্জে নেমে বড়জোর আধা ক্রোশ হাঁটা। কিন্তু এখন কোনো বাস বা মোটর তার গন্তব্যে যেতে পারছে না। নৌকা নিয়ে মাঝিরা কোনো সদরের গঞ্জে যেতে ভয় পায়। তাই তাদের পথের মধ্যেই নামিয়ে দেওয়া হয়।
অবস্থা দেখে মুষড়ে পড়ে মোসলেম।
বউ মিনমিন করে শেষ চেষ্টা করে, ‘ফিরত গেলে হয় না!’
‘পাগল!’
ছোট ছেলেটাকে কোলে তুলে নেয় মোসলেম। বাক্সটা তুলে নেয় আরেক হাতে। মেয়ে আর বউকে পাশে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে।
কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায়, তারা একা নয়। শত শত। হাজার হাজারও বোধহয় বলা যায়।
কিন্তু বুবুর বাড়ি যেন ক্রমশ-ই আরো দূরে সরে যাচ্ছে। তারা হাঁটছে তো হাঁটছেই! সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই সময়ে এসে পৌঁছায় নন্দকুঁজা নদীর ধারে। কোনো নৌকা নেই।
এখন উপায়!
কেউ কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। তাকায় পরস্পরের দিকে। একজন বুদ্ধি দেয়, পাশের গ্রামে গিয়ে নৌকার মাঝিকে খুঁজলে কেমন হয়? বুদ্ধিটা মনে ধরে মোসলেমের। তিনজন যায় গ্রামের দিকে। নৌকা এবং মাঝির খোঁজে। বাকিরা নদীপাড়ের ঘাসে বসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। যতখানি বিশ্রাম নিয়ে নেয়া যায়। কেউ কেউ শুয়েও পড়ে। মোসলেমও তাদের দলে। মাথার নিচে টিনের বাক্সটা বালিশ হিসাবে ব্যবহার করে। শক্ত এবং উঁচু। কিন্তু তাতেও তার শরীরে বেশ আরাম বোধ হয়। উল্লম্ব থেকে আনুভূমিক হতে পারাটাই শরীরকে যথেষ্ট আয়েশ এনে দিতে সক্ষম হয়। ছোট ছেলেটা এসে তার কোল ঘেঁসে শুয়ে পড়ে। বালিশ হিসাবে ছেলের মাথার নিচে নিজের বাহু বিছিয়ে দেয় সে। রাতে এই নদী পার হওয়ার কোনো আশা বোধহয় নেই।
কিন্তু প্রায় অলৌকিকভাবেই সাহায্য পাওয়া যায়। যে তিনজন নৌকা ও মাঝির খোঁজে গ্রামে গিয়েছিল তারা ফিরে আসে সুখবর এবং সঙ্গে আরো তিনজন যুবককে সঙ্গে নিয়ে। তাদের দেখে উঠে দাঁড়ায় বিশ্রামরত মানুষেরা। এরাই কি নৌকার মাঝি? না। কথায় কথায় পরিচয় পাওয়া যায়। তারা আশ-পাশের গ্রামেরই সন্তান। শহরে লেখাপড়া করে। তারা এখন শহর থেকে চলে এসেছে। সঙ্গীদের নিয়ে পরিকল্পনা করছে কীভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।
মোসলেমের চোখে, পলায়নপর মানুষগুলোর চোখে, মুহূর্তে দেবদূতে পরিণত হয় তিন যুবক। আর তাদের নিজেদেরকে মনে হয় কাপুরুষের দল। তিন যুবক হেসে সান্ত্বনা দেয়– প্রয়োজনে পিছু হটতে হয়। পিছু হটা মানেই পালানো নয়। প্রথমে তো নিজেকে রক্ষা করতে হবে। পরিজনদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। তারপরে দেখা যাবে, যার যাওয়ার সে ঠিকই যুদ্ধে চলে গেছে।
তিন যুবক আরো জানায় যে, পাকবাহিনী খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই রাতের মধ্যেই পানি পার হয়ে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এই গ্রামের প্রায় সমস্ত লোকই পানি পার হয়ে চলে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। মাঝির খোঁজে লোক পাঠানো হয়েছে একটু দূরের গ্রামে। তারা এসে পড়বে শিগগিরই।
বলতে বলতেই দেখা যায়, আরো আট-নয়জন লোক চলে এসেছে। পাঁচজন মাঝি। অন্যেরা এই যুবকদের সঙ্গী। তারাও যুবক। তারা নৌকায় উঠতে সাহায্য করে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘরছাড়া মানুষগুলোকে। নৌকা ছাড়বে। এমন সময় এক হাতে নাতনির হাত, আরেক হাতে ছাগলের দড়ি ধরে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে হাজির হয় বুড়ি। তাদেরও জায়গা হয় মোসলেমদের নৌকায়। নৌকা ভাসানোর মুহূর্তে দেবদূতের মতো যুবকদের কাছে বিদায় নেয় আরোহীরা। দোয়া করে তাদের জন্য। সাবধানে থাকতে বলে। যুবকরা হাসিমুখে দোয়া গ্রহণ করে। জানায়, তারা নিশ্চয়ই সাবধানে থাকবে।
নদী পার হতে হতেই আঁধার জেঁকে বসে। এই অন্ধকারে তারা কোথায় যাবে!
নদীর লম্বা এবং উঁচু পাড় বেয়ে ওপরে উঠলেই করিম শাহের মাজার। বিরাট চত্বর। মোসলেমদের দলটিকে বাধ্য হয়ে খুব কুণ্ঠার সঙ্গে আশ্রয় চাইতে হয় সেই মাজারেই। কিন্তু এমন সাদর অভ্যর্থনা পাওয়া যায় যে কুণ্ঠিত ভাবটি মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায় তাদের মন থেকে।
এমনিতে মাজারে মেয়েদের রাত কাটানো বারণ কিন্তু এখন সব নিয়ম শিথিল করে দেন খাদেম সাহেব। শুধুমাত্র পীরের কবর-ঘর বাদ দিয়ে যে যেখানে ইচ্ছা আশ্রয় নিতে পারে বলে জানিয়ে দেন তিনি। সেই সঙ্গে অন্য খাদেমদের সঙ্গে নিয়ে খাবারেরও বন্দোবস্ত করতে শুরু করেন।
সারাদিনের অবিরাম হাঁটা এবং উৎকণ্ঠা প্রতিটি মানুষকে নির্জীব করে ফেলেছে। তবুও কেউ কেউ খাদেমদের সঙ্গে হাত লাগায় রান্নার কাজে।
লাল মোটা চালের ধোঁয়াওঠা ভাতের সাথে মসুরের ডাল আর আলুর তরকারি। খাদেম সাহেব কুণ্ঠার সাথে নিজেদের অক্ষমতা স্বীকার করেন। দেশ-দুনিয়ার পরিস্থিতি ভালো না। কারো মনেই শান্তি নাই। তাই মেহমানদারির যথার্থ আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। অতিথিরা এই ত্রুটি মার্জনা করবেন।
যেচে আশ্রয় নেয়া মানুষও মহান অতিথির মর্যাদা পেয়ে যায় মাজারের খাদেমদের কাছে। এমনটি সম্ভব শুধু এই বাংলাতেই। আশ্রিত অতিথিদের কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। তারা সবাই তৃপ্তির অধিক ভালোলাগা নিয়ে খাবার খায়।
টিনের বাক্স থেকে বড় কাঁথাটা বের করে মোসলেমের বউ। পিঠের নিচে বিছানা হিসাবে পাতার জন্য চট বিছিয়ে দিয়েছেন খাদেমরা। কিন্তু এত লোককে বালিশ কোত্থেকে দেবেন তারা। তাছাড়া মাজারে যারা আসে, এবং রাত কাটায়, তারা বালিশজাতীয় বিলাসিতার ধার তেমন একটা ধারে না। কিন্তু বালিশ ছাড়া তো গৃহীদের ঘুম প্রায় অসম্ভব। কাঁথা ভাঁজ দিয়ে নিজেদের জন্য বালিশ তৈরি করে মোসলেম। শুয়ে পড়ে সপরিবারে।
ছাগলের দড়িটা একটা খুঁটার সাথে বেঁধে তার সামনে কিছু ঘাস-পাতা কুড়িয়ে এনে রাখে নাতনি। কেননা ছাগলজাতি রাতে ঘুমের ঘোরেও খাবার খোঁজে। না পেলেই ভ্যা ভ্যা করে জ্বালাবে সারা রাত।
চটের ওপর সারি সারি শুয়ে থাকা মানুষগুলোর ওপর দিয়ে নন্দকুজা থেকে আসা বাতাস মাঝে মাঝে আছড়ে পড়ে। মাঝে মাঝে সেই বাতাস মাজারভিটের পাকুর গাছের পাতার গায়ে পড়ে পিছলে যেতে যেতে দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ তোলে। রোজ রাতের অভ্যাসবশত নাতনি নানিবুড়ির বুকের মধ্যে নাক ডুবিয়ে দেয়। এখন তার কেচ্ছা শোনার সময়। রোজকার অভ্যেসমতো দিনযাপনের ছকে বাঁধা বুড়ি নিজের অজান্তেই নিজের শিশুকাল থেকে মুখস্ত হয়ে থাকা কাসাসোল আম্বিয়ার পাতা উল্টে বসে– মুছা নবীর হাত আছিল এক আ’সা। কুদরতি লাঠি। আল্লাহর কাছ থাক্যা সেই আ’সা আন্যা দিছিল জিবরাইল ফেরেস্তা। নাকি আজরাইল ফেরেস্তা? না না জিবরাইল ফেরেস্তাই হবি। আজরাইল ফেরেস্তার কাম তো খালি মানুষের জান কবজ করা। সব নবীর কাছে আল্লা তো জিবরাইলরেই পাঠাচ্ছিল। যেমন হিন্দুরে নারদ। মুসলমানের সেই রকম জিবরাইল। তো মুছা নবী বার বার বিপদে পড়ে। ফেরাউনের হাতে, হামানের হাতে। সেই জন্যে আল্লাহ পাঠায় দিল সেই আ’সা। কেরামতি লাঠি। লাঠি মাটিত ফেললেই আজদাহা সাপ। সেই আজদাহা গিল্যা খায় যত জাদু-টোনা, বান-মুন্তর, তুক-তাক, মন্দ মানুষের ধড়-কল্লা। কিন্তু যে-ই মুছা নবী আজদাহার গায়ে হাত ছোঁয়ায়, অমনি আজদাহা আবার সেই আ’সা। যে কে সে-ই।
তো মুছা নবীর উপর, তার গুষ্টির মানুষের উপর ফেরাউনের খুব অত্যাচার। ফেরাউন তো রাজা। তার সিপাই-শান্ত্রি. সেনাপতি-মন্ত্রী, তীর-ধনুক, লাঠি-তলোয়ার অগুন্তি। খুব অত্যাচার মুছা নবীর উপর।
নাতনি প্রশ্নের মতো মন্তব্য করে– যেই রকম অত্যাচার করতিছে পাঞ্জাবি রাজা আমারে উপর!
তার চায়েও বেশি। বুড়ি খেই ধরে– সেই অত্যাচারের কুনো সীমা-সরহদ্দ নাই। তখন বাঁচার একটাই উপায়। ফেরাউনের দ্যাশ ছাড়্যা দল-বল লিয়্যা পলায় যাওয়া।
“প্রত্যাদেশ আসে– ‘হে মুছা! তুমি তোমার স্বজাতি বনি ইসরাইলের বারোটি গোত্রকে সঙ্গে লইয়া ফেরাউনের রাজ্য মিশর ছাড়িয়া হিজরত করো। নৃশংস ফেরাউনের ক্রোধের নাগালের বাহিরে লইয়া যাও তাহাদের। আমি তোমাদের প্রতিপালক, প্রতিজ্ঞাপূর্বক বলিতেছি যে, বনি ইসরাইলের জন্য মিশর অপেক্ষা অনেক উন্নতমানের জমিন আমি তোমাদের জন্য বরাদ্দ করিব।’
ইশ্বরের এমত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও দেশত্যাগের প্রশ্নে বনি ইসরাইলগণ ইতস্তত করে। তাদের দ্বিধা কাটে না। তারা অশ্রুসজল কণ্ঠে বলে– হে ইশ্বরের নবী মুছা ! যত অত্যাচারই হউক, এই ভূমি আমাদের নিজস্ব ভূমি। এই ভূমিতে আমাদিগের পিতা-পিতামহ এবং তদূর্ধ্ব পুরুষগণ জন্মিয়াছিলেন, এবং এই ভূমিতেই মৃত্যুবরণ করিয়াছিলেন। এই দেশ হইতে চিরতরে প্রস্থান করিলে আমরা হইব বাস্তুত্যাগী, উদ্বাস্তু। যাহার দেশ নাই, তাহার কোনো পরিচয় নাই। যাহার নিজস্ব জমিনের ভূ-ভাগ নাই, তাহার কোনো নাড়ির টান নাই। আপনি কি আমাদিগকে চির উদ্বাস্তু হইতে বলিতেছেন?
মুছা বলিলেন– আমার ইশ্বর বনি ইসরাইলদের জন্য মিশর অপেক্ষা উন্নততর সুফলা, সুজলা, চিরস্থায়ী নিরাপত্তাসম্বলিত একটি দেশ প্রদানের অঙ্গীকার করিয়াছেন। আর ইশ্বর কখনোই ভঙ্গ করেন না অঙ্গীকার। তাই হে বনি ইসরাইলগণ, আইস, আমরা ইশ্বরের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস স্থাপন করি।
লোকজন তখন বলিল– তথাস্তু! আমরা ইশ্বরের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস স্থাপন করিলাম।
অনন্তর তাহারা মুছা নবীকে অনুসরণ করিল।
এই সংবাদ গুপ্তচর মারফত পৌঁছিল ফেরাউনের নিকট। সেই দূরাচার তৎক্ষণাৎ নিযুত সেনাদল লইয়া বনি ইসরাইলের পশ্চাদ্ধাবন করিল।
নূতন আশায় বুক বাঁধিয়া বনি ইসরাইলের বারোটি গোত্র মুছা নবী এবং তদীয় ভ্রাতা হারুনের নেতৃত্বে চলিয়াছে নূতন দেশের সন্ধানে, সম্মানের দেশের সন্ধানে, অভয়ের দেশের সন্ধানে। সারাদিন পথ চলিয়া তাহারা আসিয়া দাঁড়াইল সমূদ্র-সমতূল্য নীলনদের পাড়ে। এখন এই নীলনদ পাড়ি দিবার জন্য প্রয়োজন বিশালায়তন জাহাজের। কিন্তু পোতাশ্রয়ে বড় জাহাজ তো দূরের কথা, ছোট কোনো জলযান পর্যন্ত নাই। হঠাৎ পেছনে শোরগোল। সচকিত হইয়া সভয়ে পিছনে ফিরিয়া আর্তনাদ শুরু হইল– হায় হায়, কী কুক্ষণেই না মুছার কথা মানিয়া লইয়াছিলাম! তাহার ফলস্বরূপ এখন ধনে-প্রাণে-পরিজনে মরিতে হইবে। পিছনে যে আসিয়া পড়িয়াছে ফেরাউন এবং রক্তলোলুপ সেনাদল।
হযরত মুছাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ইশ্বরকে ডাকিয়া বলিলেন– হায় ইশ্বর, সম্মুখে অকুল তরঙ্গবিক্ষুদ্ধ সমুদ্রোপম নীলনদ, পশ্চাতে ভীষণ শত্রু, এখন আমাদিগের প্রাণ রক্ষার কী উপায়!
ইশ্বর তৎক্ষণাৎ মুছা নবীর নিকট প্রেরণ করিলেন তাঁহার দেবদূত জিবরাইলকে। জিবরাইল বলিল– হে মুছা কোনো চিন্তা করিয়ো না। নিশ্চয় ইশ্বর তোমাদিগকে রক্ষা করিবেন। তুমি তোমার হস্তস্থিত আ’সা দ্বারা নীলনদের পানিতে আঘাত করো।
মুছা নবী হস্তস্থিত আ’সা দ্বারা আঘাত করিলেন নীল নদের পানিতে।
ইশ্বরের কী অপার মহিমা! সঙ্গে সঙ্গে নীলনদের বুক বিদীর্ণ হইল বারোটি খণ্ডে। নীলনদের বুকের উপর দিয়া তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হইয়া গেল বারোটি রাজপথ। নিজের পানিকে স্তম্ভে স্তম্ভে বিভক্ত করিয়া নীলনদ যেন বনি ইসরাইলিদের জন্য প্রস্তুত করিয়া দিল মুক্তির রাজপথ।
বনি ইসরাইলের এক একটি গোত্র এক একটি পথ দিয়া নির্বিঘ্নে পার হইয়া গেল নীলনদ। এদিকে ফেরাউন ততক্ষণে সসৈন্যে পৌঁছিয়াছে নীলনদের তীরে। সেই দূরাচার ইশ্বরের কুদরতের প্রতি ভ্রুক্ষেপমাত্র করিল না। তদুপরি তাহার মন্ত্রী হামান তাহাকে এই বলিয়া আরো উসকাইয়া দিল যে ফেরাউনের ভয়েই নীলনদের বুক দ্বাদশ খণ্ডে খণ্ডিত হইয়া পড়িয়াছে। ইহা শুনিয়া ফেরাউন ঘোড়া হাঁকাইয়া নামিয়া পড়িল নীলনদের বুকে। সঙ্গে তাহার সৈন্যরাও। সেই মূহুর্তেই নীলনদের পানি পূর্বের মতো হইয়া গেল। নিশ্চিহ্ন হইয়া গেল বারোটি পথ। আর নীলনদের অগাধ জলে সলিলসমাধি লাভ করিল ফেরাউন, মন্ত্রী হামান এবং তাহার দুর্ধর্ষ সৈন্যদল।”
৪.
কিন্তু এখানে রাত পোয়ানোর আগেই হাজির ফেরাউনের বাহিনী। প্রায় কালিরঙা অন্ধকারের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিল মাজার-ভিটেতে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলো। একটামাত্র বাতি জ্বলছিল পীর সাহেবের কবরগাহে। কেরোসিন শেষ হওয়াতে সেটি-ও নিভে গেছে মাঝরাতের শেয়াল ডাকার আগেই। কাজেই কেউ ঘুম ভাঙলে দেখার মধ্যে দেখতে পেয়েছে কেবল অন্ধকারই। হঠাৎ-ই দাউ দাউ আলোর জেল্লা। সেই হঠাৎ আলো ঘুম ভাঙিয়ে দেয় মোসলেমের, এবং আরো দুই-চারজনের। তারা সচকিত হয়ে এপাশ-ওপাশ তাকায়। কই, এখানে তো কোনো আলোর উৎস চোখে পড়ছে না! তখন চোখ যায় নদীর ঐ পারে। দাউ দাউ করে জ্বলছে যেন অতিকায় এক মশাল। চোখ রগড়ে তাকালে বোঝা যায়, মশাল নয়। এক সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে আসলে। তৎক্ষণাৎ বোঝা যায়, ওপারে পৌঁছে গেছে পাকবাহিনী। পুড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম।
এত কাছে ঘাতক বাহিনীর উপস্থিতি অনেককেই বিমূঢ় করে দেয়। কিন্তু মোসলেম ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। চিৎকার করে বলে– পালাও পালাও! ঐ পারে পাক বাহিনী আস্যা পড়িছে!
কিন্তু কাঁচাঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠা পথক্লান্ত দুশ্চিন্তাকাতর মেয়ে-মদ্দ নিজেদের দ্রুত গুছিয়ে নেবার বদলে আরো আউলা-ঝাউলা হয়ে পড়ে। তাদের তৈরি হবার তাড়া দিয়ে মোসলেম নদীর দিকে হেঁটে যায়। বড় আমগাছের গুড়ির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে তাকিয়ে থাকে নদীর ঐপারের দিকে। সেই একই দৃশ্য। যেমনটি সে দেখেছিল নারদ নদীর ধারে, গ্রাম থেকে ধরে আনা মানুষগুলোকে সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে মেরে চলেছে পাকিস্তানি মিলিটারি। তবে কয়েকজনকে না মেরে রেখে দিয়েছে এক পাশে। ওদের মারছে না কেন?
একটু পরেই উত্তর খুঁজে পায় মোসলেম। আর তখন তার বুকের রক্ত আবার হিম হয়ে আসে।
লোকগুলোকে নিয়ে নৌকায় উঠছে পাকবাহিনী। মোসলেম শুনেছে, পশ্চিম পাকিস্তানে খাল-নদী নাই তেমন একটা। ওদেশের লোকেরা সাঁতার জানে না তেমন। নৌকা চালানো তো দূরের কথা। নৌকা চালানোর জন্যই ওরা বাঁচিয়ে রেখেছে জনাকয়েক গ্রামবাসীকে।
এই পাড়ের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে নৌকাগুলো। যেন ঘোড়ায় চেপে দলবলসহ ছুটে আসা ফেরাউন। মোসলেম বুঝে নেয়, তাদের মৃত্যু এখন আর অল্প কিছু সময়ের ব্যাপার। যে নদীকে তার কাছে কাল রাতে নীলনদের মতো বিশাল মনে হচ্ছিল, এখন মনে হচ্ছে সেই নদী আসলে তেমন বড় নয়। তাছাড়া তাদের দলের মধ্যে তো মুছা নবী নাই। নাই তার হাতের তেলেসমাতি ক্ষমতার আ’সা। ফেরাউনের দল তর তর করে চলে আসছে আজরাইলের কাঁধে চড়ে এই পাড়ের দিকে। ঐ তো, প্রথম নৌকা প্রায় পৌঁছে গেছে মাঝনদীতে! চোখ বোঁজে মোসলেম। অনিবার্য পরিণতিকে মেনে নেবার জন্য নিজেকে যেন প্রস্তুত করতে চায়। তাদের দলে মুছা নবী নেই, তার হাতের অলৌকিক আ’সা নেই, তাদের আর বাঁচার আশা নেই।
এলোপাতাড়ি গুলির শব্দ আসে।
ওরা তাহলে পৌঁছে গেছে। চোখ না খুলেই ভাবে মোসলেম।
আবার গুলির শব্দ। অচেনা ভাষায় চিৎকার। কিন্তু গুলির শব্দ কেমন যেন এলোমেলো মনে হচ্ছে।
চোখ খোলে মোসলেম। সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় অলৌকিক কিছু একটা ঘটে গেছে। নৌকাগুলো মাঝনদীতে চড়কির মতো পাক খাচ্ছে। তার মানে, পাকবাহিনীকে কায়দামতো মাঝনদীতে এনে নৌকা থেকে ঝাঁপ দিয়ে পানিতে পড়েছে বাঙালি মাঝির দল। পানির দিকে তাক করে গুলি ছুঁড়ছে পাকবাহিনীর লোকেরা। কিন্তু নৌকা নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে দুলছে বলে ভারসাম্য থাকছে না কারো। টাল খেয়ে একজন-দুইজন করে পানিতে পড়ে যাচ্ছে সাঁতার না জানা কসাইগুলো। টুপ টুপ করে তলিয়ে যাচ্ছে নন্দকুজার চোরাস্রোতের টানে।
মোসলেমের মনে তখন আবার মৃত্যু দেখা বা মৃত্যুর খবর শোনার পরে দোওয়া পড়ার বিষয়টা চলে আসে। ছোটবেলার অভ্যাস। মুসলমানের মৃত্যু দেখলে বা মৃত্যুর খবর শুনলে দোওয়া পড়তে হয়– ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন’(নিশ্চয়ই আল্লাতায়ালার জন্য। এবং তার দিকেই সবাইকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে)। আর বিধর্মীর মৃত্যু দেখলে বা মৃত্যুর খবর শুনলে পড়তে হয়– ‘ফি নারে জাহান্নামা খালেদিনা ফিহা (জাহান্নামের আগুনে যাও। এবং সেখানে প্রবেশ করো)।’
মোসলেম শুনেছে পাঞ্জাবিরা নাকি মুসলমান। তবু তাদের মৃত্যু দেখতে দেখতে সজোরে উচ্চারণ করে সে, ‘ফি নারে জাহান্নামা খালেদিনা ফিহা’।