প্রিন্স আশরাফ এর ছোট গল্প মেরুদণ্ডী

অর্থোপেডিক ডাক্তার তাকে নানানভাবে বাঁকিয়ে চুরিয়ে হেলিয়েদুলিয়ে পরীক্ষা করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি করেন? মানে আপনার পেশা কি?’ আসাদ বুঝতে পারল না, তার মেরুদন্ডের এই ব্যথার সাথে পেশার কি সম্পর্ক! ডাক্তারসাহেব কি পেশা জেনে তারপর পেশা অনুযায়ী আয়ের ধরণ বুঝে দামী অদামী ওষুধের বন্দোবস্ত করেন! ডাক্তারের বিপরীত দিকের নীলরঙা প্লাস্টিকের চেয়ারে কুজো হয়ে বসে ডাক্তারের চোখে চোখ না রেখে মাথা নিচু করে মিনমিনে গলায় বলল, ‘ক্লার্ক। কেরানি।’
‘অ। বুঝেছি। আপনাকে কি অফিসে বেশিরভাগ সময়ে নিচু হয়ে কাজ করতে হয়? আই মিন বেশিরভাগ সময় ঝুকে বসেন?’
‘জ্বি স্যার। আগে ফাইলপত্রে ঘাড় গুজে কাজ করতাম। এখন কম্পিউটারের সামনে ঝুকে কাজ করি।’
ডাক্তার আবার ভাল করে আসাদের দিকে তাকালেন। ঠিক, লোকটার চেহারা কেরানির জন্যই উপযুক্ত। অত্যন্ত দুর্বল, শুকনো, হাড় জিরজিরে, কুঁজো ভগ্নস্বাস্থ্যের মেরুদন্ডহীন একজন মানুষ। ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস কোৎ করে গিলে ফেলে বললেন, ‘যা সন্দেহ করছি সেরকম কিছু হলে আপনাকে বেশ কিছুদিন ভোগাবে। বিছানায় পড়ে থাকতেও হতে পারে।’
‘কি সন্দেহ করছেন স্যার!’ আসাদের গলায় কেরানির চির আকুতি ঝরে পড়ল। ‘খুব খারাপ কিছু কি?’
‘আগের কাগজপত্র দেখে ঠিক বুঝতে পারছি না। পুরানো যে এক্সরেটা এনেছেন ওটাও স্পষ্ট না। আপনার মেরুদন্ডের অবস্থা খুব একটা ভাল না। আমরা এটাকে মেকানিক্যাল কন্ডিশন বলি। অর্থাৎ দীর্ঘদিন ঝুকে কাজ করতে করতে আপনার মেরুদন্ডের মেকানিক্স নড়বড়ে হয়ে গেছে। সম্ভব হলে আপনি মেরুদন্ডের একটা এমআরআই করে ফেলেন।’ ডাক্তার বুঝলেন রোগীর জন্য এমআরআই বেশি হয়ে যাচ্ছে, তারপরও এই ছাড়া উপায় নেই।
আসাদ কাচুমাচু হয়ে হাত কচলে মেরুদন্ডটাকে আরো বাকা করে অসহায় কন্ঠে বলল, ‘শুনেছি এমআরআইতে অনেক খরচ। ডিজিটাল এক্সরে করালে হবে না স্যার!’ ও এর আগে আরেকজন অর্থোপেডিক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। তিনিও এমআরআই সাজেস্ট করেছিলেন। অতো টাকার ধাক্কা সামলাতে আরেকজন ডাক্তারের দিয়ে যাচাই করে নিচ্ছে সে।
‘ডাক্তার কি আপনি না আমি?’ ডাক্তার একটু উঞ্চ হয়ে উঠলেন, সিরিয়ালে এখনও অনেক রোগী, এই কুজো কেরানির সাথে বকবকে ফায়দা নেই। তবে নির্দিষ্ট ডায়াগনষ্টিক থেকে এমআরআই করাতে পারলে পার্সেন্টেজে হাজার দুয়েক টাকা চলে আসবে। ‘ডিজিটাল এক্সরেতে কাজ হলে তো তাই করতে পরামর্শ দিতাম। আপনি কেরানি মানুষ অযথা খরচ করিয়ে লাভ কি! শুনুন, যা সন্দেহ করছি তা এমআরআই ছাড়া ক্লিয়ার হওয়া যাবে না। আমি একটা ডায়াগনস্টিকের ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। ওখান থেকে এমআরআই করান। সাত হাজার টাকার এমআরআই টুয়েন্টি পার্সেন্ট লেসে সাড়ে পাঁচে হয়ে যাবে। এর কমে আর কোথাও করাতে পারবেন না।’
ডাক্তারের ফিস দিয়ে ডায়াগনস্টিক কার্ডটা হাতে নিয়ে ওটা দেখতে দেখতে ফ্যাকাশে মুখে এমনভাবে আসাদ বের হতে লাগল যেন ডাক্তার মুর্ত্যু পরোয়ানা ধরিয়ে দিয়েছে। সাড়ে পাঁচহাজার টাকা চাট্টিখানি কথা নয়। তার ক্লাস ফোরে পড়া ছেলেটা সাইকেল সাইকেল করে মাথার পোকা খেয়ে ফেলছে, পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটা সাইকেল কিনে দেয়া সম্ভব হয়নি। এই জন্মদিন না আগামী জন্মদিন করে করে আবিদ এখন এগারোয় পড়েছে। মগ্ন হয়ে চেম্বার থেকে বের হতে গিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকা পরের সিরিয়ালের রোগীর কাছে কনুইয়ের ধাক্কা খেল। সেই সাথে রোগীর মুখ দিয়ে ঝাঁঝালো মন্তব্যও বের হলো, ‘শালার অন্ধ, হাড়ের ডাক্তারের কাছে কি করতে আসছে? যাবে চোখের ডাক্তারের কাছে!’ অন্য কেউ হলে সাথে সাথে লোকটার এই কথার প্রতিবাদ করে হয়তো বলে উঠতো, ‘কি বলতে চান আপনি? আপনিও তো একটু দেখেশুনে যেতে পারতেন।’ কিন্তু সে অন্য কেউ নয়, সে আসাদ, একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ছা-পোষা কেরানি। ও কিছুই বলল না, শুধু মুখটা কাচুমাচু করে অপরাধীর ভঙ্গিতে ‘সরি’ বলল, কিন্তু সেই ‘সরি’ শব্দটাও ওর মুখ দিয়ে প্রস্ফুটিত হলো না। শুধু জন্তুর মত জান্তব একটা ঘোৎ শব্দ বের হলো। এরকম গুতোগাতা খেয়ে নিশ্বব্দে সরি বলার অভ্যেস আসাদের আছে। গুতো লেগে চোখের সামনে সর্ষের ফুলও অনেকবার দেখেছে। অনেকবার রামধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে পড়তে গিয়ে সামলে নিয়ে উঠে দাড়িয়েছে। সর্বক্ষণ মাথা নিচু করে কাজ করার কারণে বাইরের উচু দুনিয়াটা সমন্ধে ওর নিজস্ব একটা ভয় সবসময়েই কাজ করে। মনে হয় যেন ও মাথা উঁচু করলেই কেউ ওর ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়বে, ধাক্কা দেবে, গুতো মারবে, আর কিছু না হলেও চোখ গরম করে তাকাবে। এমনকি অফিস অথবা বাসার চেনা পরিচিত গন্ডি ছাড়া অন্য কোথাও গেলেই ওর মনের মধ্যে নানা ধরণের আশাংখা কাজ করে। দুএকজন লোককে দেখলেই ওর মনে হয় সবাই ওকে নিয়েই আলাপ আলোচনা করছে, ওর দুর্বল শরীর, কুজো মেরুদন্ড আর নত মাথাই সবার মাথা ব্যথার কারণ। তাই ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়েই ও বাড়িতে চলে আসার জন্য পা বাড়াল।
হাতে টাকা নেই, এমআরআই করা হবে না। ও বাড়িতে ফেরার জন্য বাসস্টান্ডে এলো। এই রাত নটাতেও বাসস্টান্ডে এত ভীড় যে ও দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখতে লাগল। দুএকটা গেটের মুখে ঝুলতে থাকা পরিপূর্ণ লোকাল বাসের গেটের কাছে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ষন্ডামার্কা যাত্রীদের ধাক্কা এবং কনুইয়ের গুতো খেয়ে ছিটকে গিয়ে পড়ে। শেষমেষ আরেকটু বেশি রাত হলে যাত্রী ফাকা হয়ে গেলেই বাসে চড়ার সিদ্ধান্ত নিল আসাদ। একটা লোকাল বাসের ভেতরে নিজেকে কোনমতে গলিয়ে দিতে পারলেও রড ধরে দাড়িয়ে সামনের সিটের দিকে নজর রাখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। সেখানেও ওর গুটিয়ে নেয়া স্বভাবের কারণে ওর নজর রাখা প্রাপ্য সিটে অন্য একজন যাত্রী টুপ করে পাছা গলিয়ে বসে পড়লেও ও কিছু বলতে পারে। শুধুমাত্র কোৎ করে ঢোক গিলে নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়ে দাড়িয়ে থাকে।
দুই রুমের স্বস্তার ফ্লাটে ফিরতেই স্বাস্থ্যবতী চলনসই সুন্দরী বউয়ের খেকানি শুনতে হয়, ‘এত রাত পর্যন্ত কোন মাগীর গর্তে বসেছিলে? তোমার অফিস তো সেই পাচটায় শেষ হয় আর এই রাত দশটা করে বাসায় ফিরলে?’
আসাদ কুজো শরীরে লেপ্টে থাকা জাামা খুলতে খুলতে মিনমিনে গলায় বলল, ‘একটু কাজে গিয়েছিলাম।’
‘করো তো কেরানিগিরি, তার আবার কি রাজকার্য?’ বউয়ের ঝাঁঝ তখনও কমেনি।
আসাদ মাথাটা নিচু করে সুড়–ৎ করে বাসার একমাত্র বাথরুমে ঢুকে পড়েই সজোরে ট্যাপের পানি ছেড়ে দিল। ট্যাপের পানির ঝরঝরে আওয়াজে যদি বউয়ের ঝাঁঝালো আওয়াজ কিছুটা কম শোনা যায়। ঠান্ডা পানিতে হাত দিয়েই মনে পড়ল ডাক্তারসাহেব বলেছিলেন, ‘পরবর্তী চিকিৎসা ব্যবস্থা না দেয়া পর্যন্ত গরম পানি ব্যবহার করবেন। মোটেই ঠান্ডা লাগাবেন না। ঠান্ডাতে আপনার অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে।’ আসাদ বউকে এক হাড়ি পানি গরম করে দেয়ার কথা বলতে পারেনি, যেমন বলতে পারেনি তার মেরুদন্ডের অসহ্য ব্যথার অসুখের কথাও। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়ের মত ছেলেও হয়েছে মায়ের চেয়ে এক কাঠি বাড়া। বাথরুম থেকে বের হতেই আবিদ ব্যঙ্গাত্বক স্বরে বলল, ‘আজকেও নিয়ে আসোনি, তাই না বাবা? আসলে তুমি আনতে ভুলে যাও না, ইচ্ছে করেই আনো না। আমার বন্ধুদের বাবারা যা করতে পারে তার কিছুই করার তোমার মুরোদ নেই।’ মুরোদ নেই শব্দটা আবিদ শিখেছে ওর মার কাছ থেকে।
আসাদ মুখ বুজে খাবার টেবিলে বসে পড়ল। ছেলেকে একটা ধমক লাগাতেও সাহস করল না। ধমক দিলেই ওর মা ওপাশ থেকে সপ্তম সুরে সুরে ক্যানক্যান শুরু করবে। কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে! ওর চেয়ে মুখ বুজে থাকাই ভাল। বোবার শত্রæ নেই!

ডাক্তার এমআরআইয়ের প্লেটগুলো বারবার উল্টেপাল্টে ভিউবক্সের আলোর সামনে লাগিয়ে দেখতে লাগলেন। ডাক্তারের কুচকানো ভুরু দেখে আসাদের আশংকা শংকায় রুপ নিলে। শুধু ওর সেই অনাহুত কুণ্ঠার কারণে ও কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস করল না। জিজ্ঞেস করলেই ডাক্তারসাহেব যদি ধমক দিয়ে বসে! ও আরো কুজো হয়ে চেয়ারের মধ্যে ঢুকে গেল।
ডাক্তার হাতের ছোট্ট হ্যামারটা টেবিলের উপর ঠুক ঠুক করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘যা সন্দেহ করছিলাম তাই। এমআরআইতে স্পষ্ট ধরা পড়েছে।’ তারপর আসাদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি কি সারাজীবনই এরকম কুঁজো হয়ে মানে ঝুকে কাটিয়েছেন নাকি? ব্যাপারটা তো জন্মগত নয়। আপনার মেরুদন্ডে মারাত্বক ফ্যাটাল দেখা দিয়েছে। মেরুদন্ডের কার্ভ বেঁকে একেবারে অন্য পজিশনে চলে গেছে।’
আসাদ অসহায়ের মত চোখে করুণার দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখে ডাক্তারের একটু করুণা হলো। সামান্য একজন কেরানি কি আর মেরুদন্ডের অপারেশনের মত দুই তিন লাখ টাকার ধাক্কা সামলাতে পারবে। তারপর তো শুধু অপারেশন করিয়ে দিলেই হবে না। অপারেশনের পরে ফিজিওথেরাপিও করাতে হবে বছরখানিক। সব মিলিয়ে অনেক টাকার ধাক্কা। তবে একটা উপায় আছে। রোগীর বয়স কম হওয়াতে ওটাতে কাজ হলেও হতে পারে, না হলে অপারেশনের লাইনেই যেতে হবে। ডাক্তার মনের চিন্তাগুলো মুখে প্রকাশ করলেন, ‘আপনার যে সমস্যা তাতে অপারেশনই লাগসই ব্যবস্থা। কিন্তু তা তিন চার লাখ টাকার ধাক্কা।’
ডাক্তার একটু বিরতি দিলেন।
অন্য রোগী হলে এক্ষেত্রে বলতো, ‘স্যার, অন্য কোন উপায় নেই?’ কিন্তু আসাদ তা বলল না, গরুর মত চোখ বড় বড় করে নিবোর্ধের মত ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘তবে একটা অপশন আছে। ওই পথেই চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। খরচও খুব একটা বেশি হবে না। কিছুদিন ওইটা দিয়ে ট্রাই করে দেখব। যদি দেখি উন্নতি হচ্ছে তাহলে আপনাকে আর সার্জারির দিকে যেতে হবে না। মেরুদন্ডীর অপারেশন সহজ ব্যাপার নয়।’
‘কি উপায় স্যার?’ আসাদ কফ জড়ানো ঘড়ঘড়ে গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘আপনাকে একটা ব্রেস পরতে হবে। মিল্কওয়াকি ব্রেস। জিনিসটা খানিকটা ওই লাইফ জ্যাকেটের মত। ঘাড় এবং গলার কাছ থেকে পিঠ এবং বুক জুড়ে বর্মের মত আটকানো থাকবে। শার্টের ভেতরেই পরতে পারবেন। তাতে আপনার মেরুদন্ডটা সবসময় সোজা থাকবে। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে। গা গতর ব্যথা হতে পারে। আপনার আকারও একটু বেড়ে যাবে। আপনি ¯øীম হওয়ায় সুবিধেই হয়েছে। ওর উপরে শার্ট পরলে আপনাকে বেশ স্বাস্থ্যবানই লাগবে। ভারী বোঝার মত মনে হলেও পরতে পরতে অভ্যাস হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম ব্যথায় শিরদাড়া টনটন করবে। কিন্তু ওই টনটনানিতেই কাজ হবে। দীর্ঘদিনের বেঁকে যাওয়া শিরদাড়া সোজা হতে গেলে একটু তো কষ্ট হবেই। তবে কয়েকটাদিন সয়ে গেল শিরদাড়া খাড়া করার অনুভুতি চলে আসবে আপনার মধ্যে। আর চব্বিশ ঘন্টা পরে থাকতে হবে না। গোসলের সময় আর সঙ্গমের সময় খুলে রাখবেন। পরেও সঙ্গম করতে পারেন, যদি আপনার স্ত্রী আপনার শরীরের ওই খোলটাকে বরদাস্ত করে। হা, হা, হা।’ কিন্তু আসাদের ভাবলেশহীন মুখ দেখে ডাক্তারসাহেব রসিকতাটা গিলে ফেলে বললেন, ‘এটাই আপনার আপাতত বন্দোবস্ত।’
আসাদ কিছুই বুঝতে পারছিল না, শুধু একটু বুঝতে পারছিল ওকে প্রাচীনকালের যোদ্ধাদের মত একটা বর্মজাতীয় কিছু পরে থাকতে হবে, হয়তো ওইটা পরেই বাকি জীবন কাটাতে হবে। সে আমতা আমতা করে বলল, ‘ওটা কোথাও পাব স্যার। আপনি যদি একটু ব্যবস্থা করতেন…’
‘আপনি আমার রোগী যখন ব্যবস্থা তো আমাকেই করতে হবে। আর ওটা তো কোন লেদার জ্যাকেটটা না যে গুলিস্তানের বঙ্গবাজার থেকে কিনবেন। ব্রেসটা আপনার মাপমতো অর্ডার দিয়ে মেরুদন্ডের সাথে ফিট করে তৈরি করিয়ে নিতে হবে। চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। আপনি শ্যামলীর ওই ব্রেস সেন্টারে গিয়ে মাপ দিয়ে বানিয়ে নেবেন। খরচও বেশি পড়বে না। আমি ফোন করে বলে দেব।’ এই ব্রেস সেন্টারের সাথেও ডাক্তারের চুক্তি আছে। ওখান থেকেও একটা পার্সেন্টেজ পাওয়া যাবে।

ব্রেস সেন্টার থেকে দর্জির মত ফিতে দিয়ে নিজের গলা, ঘাড়, বুক পিঠের মাপ দিয়ে ব্রেস বানাতে দেয়ার সময় আসাদের মনে হলো, মহিলাদের ব্রেস পরাতে গেলে কি করে! ওদের স্তনের জন্য কি বুকের ওখানে দুটো বড় বড় ফুটো রাখতে হয়!
ব্রেসের কারিগরও ব্রেস বানিয়ে ওখানেই আসাদকে পরিয়ে ফিট করিয়ে দিল। কিভাবে পরতে হয়, কোন পাশ সামনে, কোন পাশ পিছনে, ভেলক্রোর সাথে স্ট্রাপগুলো কিভাবে লাগাতে হয় সব দেখিয়ে দিল। পরানো শেষ হলে আসাদ বলল, ‘ওটা খুলে দেন।’
‘কেন? পরে থাকবেন না?’ কারিগর জিজ্ঞেস করল।
‘পরব। কিন্তু বাড়ি নিয়ে গিয়ে। ওটা প্যাকেট করে দেন। আর একটা বিল করে দেন অফিসে জমা দিতে হবে।’

বাসার দরজা খুলতেই ওর হাতে বাহারি বড়োসড়ো প্যাকেট দেখে আবিদ চেচিয়ে উঠল, ‘ওয়াহ! আম্মু, দেখ আজকে বাবা কি নিয়ে এসেছে। এতে কি আছে বাবা?’
পলিও রান্নাঘর ছেড়ে কৌতুহলের সাথে বেরিয়ে এসেছে। আবিদের এত দিনের ঘ্যানঘ্যানানির ফল পেতে যাচ্ছে মনে করে। মুখে ইচ্ছেকৃত হাসি ফুটিয়ে পলি বলল, ‘দাও, প্যাকেটটা আমার হাতে দাও।’
আসাদ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘থাক। ওটা আমার জিনিস।’
সাথে সাথেই মা ছেলে দুজনেরই মুখ কালো হয়ে গেল। মা ঝাঝালো কন্ঠে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, ‘তোমার জিনিস তাই বলে আমাদের দেখানো যাবে না? আমরা কি খেয়ে ফেলব নাকি?’
আবিদও রাগত স্বরে বলল, ‘বাবার জিনিস বাবাই দেখুক গে যাক, আমার কি?’
আসাদ বাহারি প্যাকেট থেকে ব্রেসটা বের করতে করতে বলল, ‘আমার শরীরের জন্য।’
আবিদ গোটা জিনিসটা উল্টো করে ধরে বলল, ‘মা, মা, বাবা মনে হয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেনাবাহিনীতে ঢুকেছে। আমাদের অনেক মজা হবে।’
মাও ব্যাপারটা কি বুঝতে পারছিল না, গ্রীক যোদ্ধাদের মধ্যে বর্মের মত পোশাক ওর স্বামীকে পরতে হবে না সে সেটাই ভাবছিল। একটু ব্যঙ্গাত্বক স্বরে বলল, ‘তোমাদের অফিস থেকে কি এখন কেরানিদের যুদ্ধে যেতে হয় নাকি?’
স্ত্রীর মন্তব্যে আসাদ একটু হাসল। তারপর গায়ের জামা খুলতে খুলতে বলল, ‘ওটা আমার মেরুদন্ডের জন্য। মেরুদন্ডের হাড়ের ম্যালফ্যাংশান হচ্ছে বলে ডাক্তার সাহেব দিয়েছেন। এখান থেকে আমাকে ওটা পরে থাকতে হবে।’ বলতে বলতে আসাদ ওর সব প্রেসক্রিপশন, কাগজপত্র, এমআরআই ফাইল দেখাল। স্ত্রীকে আগেই ব্যথার কথাটা জানতো, কাজেই বোঝাতে বেশি বেগ পেতে হলো না। ‘একটু ধরে আমাকে পরিয়ে দাও তো।’ স্ত্রীকে সামনে পিছনে দেখিয়ে দিতে দিতে বলল।
‘তুমি না এখন গোসল করো!’ স্ত্রী ব্রেসটা পরাতে পরাতে বলল। ‘ওটা কি গোসলের সময়ও পরে থাকতে হবে নাকি?’
‘না, ডাক্তার বলেছে গোসল আর ডট ডট ডট করার সময় বাদে বাকি সময় পরে থাকতে হবে।’ আসাদ ডটডটডট বলে একটু লজ্জিত হাসি দিল। স্ত্রী ডট ডটের অর্থ বোঝে। সন্তান সামনে থাকলে সঙ্গমের কথা ওভাবে ইশারায়ই বলতে হয়।
ততক্ষণে ব্রেসটা পরা হয়ে গিয়েছিল। স্ত্রীকে ওকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, ‘ডাক্তার ঠিকই বলেছে। এই জিনিস পরা অবস্থায় আমি তোমাকে আমার বুকের উপর উঠতে দেব না। তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে, অন্য মানুষের মত। ওটা পরলে তোমাকে অন্য মানুষ লাগে।’
আসাদ কিছু বলল না, ওর স্ত্রী যে অন্য পুরুষে অভ্যস্ত সে কথা বলতে ও কুন্ঠাবোধ করল।
আবিদ ওর কিছু নেই দেখে হতাশ হয়ে ওর রুমে চলে গেছে।

ঝুকে থাকতে থাকতে অভ্যস্ত শিরদাড়া হঠাৎ করে খাড়া হয়ে গিয়ে ব্যথায় টনটন করতে লাগল। ওটা পরে থাকতে গিয়ে এত ব্যথা হতে লাগল যে, আসাদের মনে হলো ওর চেয়ে আগের কুজো মেরুদন্ডের ব্যথায় সহনীয় ছিল। কিন্তু ডাক্তার তো অমনটাই জানিয়েছে। আরো ক্ষতি হয়ে গেলে তখন হয়তো ওকে বিছানা শোয়া হয়েই থাকতে হবে।
ব্রেস পরে অফিসে যাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারে না আসাদ। ওর কলিগরা হঠাৎ করে ওর এরকম শিরদাড়া খাড়া করে চলায় সন্দেহ করবে, শুধু তাই নয় জামার নিচে বর্মের কারণে শরীরটা বেঢপ ফুলে থাকায়ও ওকে দেখাচ্ছে বেশ কিম্ভুত। এই নিয়ে ওরা হাসাহাসি করতে পারে। আসাদ এমআরআইয়ের ফাইল আর ডাক্তারের চিকিৎসাপত্র নিয়ে অফিসে গেল। কেরানির ডেস্কে ঝুকে বসে কিছুক্ষণ কাজ করল। বিদেশী ডেলিগেটদের আসার ব্যাপারটা চেক করল। ‘বস’ অফিসে এলে ওর ডাক পড়ল। বস আরো কিছু কাজ ধরিয়ে দিল। কিন্তু ও একবারও ওর নিজের কাগজপত্রগুলো দেখাতে পারল না। অসুস্থতার কারণে ছুটি চাওয়ার মত হঠকারী কাজ কিভাবে করবে, ভেবে পেল না, যদিও গত পাচ ছয় বছরের মধ্যে ও একদিনও ছুটি নিয়ে স্ত্রীপুত্রকে নিয়ে কোথায় বেড়াতেও যায়নি। অফিসের বাকি সব অফিসাররা কক্সবাজার, সেন্টমার্টিনের স্বপরিবারের মাস্তি করার ছবি ফেসবুকে দিয়ে নিজেরা যে কতটা স্যোসাল তা স্যোশাল মিডিয়ায় জানান দেয়।
শেষমেষ অফিসিয়াল কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ওর কাচুমাচু ভঙ্গি দেখে বস বলল, ‘কি আসাদ, কিছু বলবেন?’
এই সুযোগ, আসাদ তাড়াতাড়ি ওর হাতের চিকিৎসাপত্র বসের দিকে বাড়িয়ে দিল। বস ওগুলো দেখে কিছু বুঝতে না পেরে বলল, ‘এগুলো কি?’
‘আমার মেরুদন্ড, স্যার।’ আসাদ কি বলবে বুঝতে পারছিল না, ‘কদিনের ছুটি চাই স্যার, অসুস্থ।’
বস গম্ভীর মুখে চিকিৎসাপত্রগুলো নাড়াচড়া করে বলল, ‘আপনি অফিসের চাপটা তো বুঝতেই পারছেন। বিদেশী এই প্রজেক্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ওটা হাতছাড়া হয়ে গেলে আপনাদের সময়মত বেতনও দিতে পারব না। এই প্রজেক্ট না হওয়া পর্যন্ত ছুটি দিতে পারছি না। আপনি ছুটিটা আরো কয়েকটাদিন পরে নিয়ে চিকিৎসা করান। এতদিন যখন চলেছে আরো কয়েকটা দিন চলবে।’
আসাদ তাড়াতাড়ি বলল, ‘ঠিক আছে স্যার, ঠিক আছে।’
ও কাগজপত্র নিয়ে ওর ডেস্কে চলে এলো। স্যারকে দেখাবে বলে ব্রেসটাও ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিল। ছুটি যখন হচ্ছে না তখন ডাক্তারের পরামর্শমত ব্রেসটা পরে থাকাই ভাল। ও ব্যাগটা হাতে করে কমন বাথরুমে এলো। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ব্রেসটা পরে ফেলল, তার উপরে শার্টটা চাপাল। বাথরুম থেকে বের হতেই অফিসের চাপাবাজ আইটির ছোকড়াটা ওর পিঠ চাপড়ে, ‘আসাদ ভাই, বাথরুমে এতক্ষণ কি করেন?’ বলতে গিয়ে ব্যথায় ‘আউ’ করে উঠল।
‘আপনি জামার মধ্যে কি পরেছেন? লোহা নাকি?’
মেরুদন্ড সোজা হওয়ায় আসাদের ভাল লাগছিল, কেমন যেন ব্যক্তিত্বও ফিরে এসেছে, ও একটু রসিকতা করে বলল, ‘আপনাদের অযাচিত পিঠ চাপড়ানোর হাত থেকে বাঁচতে লোহার বর্ম পরেছি। প্রাচীনকালে যোদ্ধারা বর্ম পরতো বর্শার খোচা থেকে বাচতে, এখনকার কেরানিরা বর্ম পরে আপনাদের মত মুর্খচাপাবাজ চাটুকারদের পিঠ চাপড়ানোর খোচা থেকে বাচতে।’ কথাগুলো ওর মুখ দিয়ে বের হচ্ছে ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। এমনকি ওর কলিগও আসাদের মুখে দীর্ঘ চাকরি জীবনে প্রথমবারের মত অমন কথা শুনে এত হতভম্ব হয়েছে যে কিছু না বলেই তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
অফিস ছুটির পরে ফলের দোকান থেকে কিছু ফলমুল কিনল। ডাক্তার খেতে বলেছে। ছেলের জন্য একটা রোবট খেলনা কিনল। আজকেও বাসে অনেক ভিড়। ঠেলাগুতো দিয়ে কোনমতে উঠতে পারল, বুঝতে পারল বুকে পিঠে বর্ম থাকায় ঠেলাগুতো দেয়া সহজ হয়েছে। বাসে উঠে সিটে বসতেও বেগ পেতে হলো না। সামনের একজন বসার আগেই ও সিট দখল করতে করতে বলল, ‘অফিস ছুটির পরে বাসে সিট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’ নিজের প্রগলভতায় অবাক হয়ে গেল। বাসের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়া-কমার সাথে বাস ভাড়া নিয়ে দুইজন লোক দাড়িয়ে দাড়িয়ে আওয়ামীলীগ-বিএনপি নিয়ে জোরে জোরে কথা বলছিল দেখে, যে আসাদ সাত চড়েও রা কাড়ে না সে গলা উচিয়ে বলল, ‘ভাই আপনারা থামেন তো, সারাদিন অফিসে কাজের চাপে থাকতে হয়। তারপর বাসে উঠে যদি রাজনীতিক আলাপ শুরু করেন, তাহলে হয় কি করে! একটু শান্তিতে যেতে দেন।’
আসাদের কথায় কাজ হবে ও ধারণা করেনি। কিন্তু আওয়ামীলীগ-বিএনপি চুপ মেরে গেল। শুধু তাই নয়, আসাদের কথার সমর্থনে বসে থাকা কয়েকজন যাত্রীও বলল, ‘ঠিক বলেছেন ভাই, নিজেদের সমস্যার শেষ নেই, আবার প্যানপ্যানানি।’
বাসায় কলিংবেল কয়েকবার অস্থিরভাবেই চাপল। দরজা খুলতেই হুংকার ছাড়ল, ‘দরজা খুলতে এত দেরী হয় কেন? আমি সারাদিন অফিস করে খেটে মরি, আর তোমরা সব পড়ে পড়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও?’
ভেবেছিল স্ত্রী দরজা খূলেছে, দেখল দরজা খুলে আবির দাড়িয়ে আছে। বাবার হাতে প্যাকেট দেখেও আবিরের হেলদোল হলো না। একটু বিরক্ত স্বরে বলল, ‘কি ওতে? তোমার বর্ম?’
আসাদ রোবটের প্যাকেটটা ডাইনিং টেবিলের উপর এক প্রকার ছুড়ে দিয়েই বলল, ‘না। তোমার রোবট। ওটা নিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।’ তারপর আঙুল উচিয়ে ভারিক্কী গলায় বলল, ‘যদি দেখি পড়াশুনা বাদ দিয়ে রাত দিন রোবটের পিছনে লেগে আছ তো রোবট এই পাচ তলা থেকে নিচে ছুড়ে ফেলে দেব।’
আসাদ ফলমুলের প্যাকেটটা বউয়ের হাতে দিতে দিতে বলল, ‘আমার জন্য এক হাড়ি পানি গরম করো। এক্ষুণি। চুলোর উপর অন্য কিছু থাকলে সরায়েই করো। ডাক্তার বলেছে এখন থেকে সবসময় গরম পানি দিয়েই গোসল করতে হবে।’
আসাদের এরকম আচরণে স্ত্রী একটু নরোম স্বরেই বলল, ‘তুমি কাপড়জামা ছাড়, তোমার ওই ব্রেস না কি বলে ওটা খুলে ফেল। আমি গরমপানি বসিয়ে দিচ্ছি।’
আসাদ ঝাঝালো স্বরে বলল, ‘ওইটা আমি কখন পরব কখন খুলব তা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি তোমার কাজ করো।’
গোসলের সময় খুলে রাখলেও স্ত্রী সঙ্গমের সময় খুলল না ওটা। অর্ধ উলঙ্গ স্ত্রী ভেবেছিল হয়তো ও শেষ মুহুর্তে খুলে ফেলবে, তাও খূলছে না দেখে বিরক্ত স্বরে বলল, ‘তোমার শরীর থেকে ওইটা খুলে ফেল। নাঙ্গা শরীর শুধু ওইটা দেখতে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। তোমাকে অন্য মানুষের মত লাগছে।’
আসাদ ব্রেসের স্ট্রাপগুলো আরো টাইট করে শরীরের সাথে বেধে স্ত্রীর বুকের উপর উঠতে উঠতে বলল, ‘ওটা পরাই থাক। আমি এখন অন্য মানুষ। অন্য মানুষের সাথেই সহবাস করো। তুমি যখন অন্য মানুষের সাথে সহবাস করো তখন তো কিছু হয় না? তোমার পীরিতের কাজিন সুমন যে আমি অফিস থাকাকালে বাড়িতে আসা তা কি আমি জানি না ভেবেছো?’
স্ত্রী আর একটুও টু শব্দ করল না। এমনকি রমণরত রমণীর আউ, উহুও ওর মুখ থেকে একবারও বের হলো না। সুমনের কথা বলায় ও পুরোপুরি হজম হয়ে গেল। ভেবেছিল তার বোকাসোকা কেরানি মাথা নিচু করা স্বামীর নজরে হয়তো ওর ওই আনহেলদি সম্পর্কটা চোখেই পড়বে না।
দীর্ঘদিন চেপে রাখা না বলা কথাগুলো বলতে পেরে আসাদেরও ভাল লাগছিল। শুধু তাই নয়, ওর যৌন উত্তেজনাও বেড়ে গিয়েছিল। এর আগে কখনও এত উত্তেজনা বোধ করেনি। ওর মনে হলো ওর শরীরের ভেতরে সেই ‘আসল পুরুষ’ ভর করেছে। শীতল পড়ে থাকা স্ত্রীর শরীরে প্রবিষ্ট হতে হতে আসাদ দুরন্ত সঙ্গম শুরু করে দিল। প্রথম কিছুক্ষণ সুমনসহ নানান আজেবাজে ভাবনা ভাবতে থাকলেও শরীরের রোমকুপের পরতে পরতে শিহরণ জেগে উঠতে স্ত্রীও শরীরি সাড়া দিতে লাগল। স্বামীর খোলসপরা শরীরটাকে বুকের মধ্যে আকড়ে ধরতে ধরতে গোঙানীর শব্দে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে দিতে ওর মনে হলো, এইরকম সার্ভিস পেলে কোথায় লাগে সুমন! কোথায় কি!

পরের দিন অফিসে এসে আসাদের মনে পড়ল, বসের রুমে ভুলে ওর চিকিৎসাপত্রের একটা কাগজ বসের টেবিলে রয়ে গিয়েছিল। ও দীপ্ত পায়ে সালাম দিয়ে বসের রুমে ঢুকল। বস ওকে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু বলবেন?’
আসাদ কাগজটা ফাইলে ঢোকাতে ঢোকাতে শিরদাড়া খাড়া রেখে ব্যঙ্গের হাসি দিয়ে বলল, ‘কি আর বলব স্যার? এই জগতে ভাল মানুষের ভাত নেই। গত পাচ বছরে আমি অফিস থেকে একটা দিনও ছুটি নেইনি। সময়মত অফিস করেছি। পাওনা ছুটি থেকেও ছুটি নেইনি। আপনার অফিসের অন্যরা যখন ছুটি নিয়ে হিল্লী দিল্লী করে বেড়াচ্ছে তখনও আমি ঘাড় গুজে নটা পাচটা অফিস করে গেছি। আমার মেরুদন্ডের এই অবস্থা কেন হয়েছে জানেন স্যার? এই অফিসের জন্য, আপনাদের জন্য। অথচ সেই মেরুদন্ডের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের পরামর্শমত কয়েকদিন কমপ্লিট বেড রেস্টের জন্য যখন আপনার কাছে দিন পনেরোর ছুটি চাইলাম, তখন আপনি না করে দিলেন। অথচ আপনার চাটুকার চামচা তোষামোদকারীরা যখনই ছুটি চায় তখনই চামচামিতে বিগলিত হয়ে সুড়সুড় করে ওদের ছুটি দিয়ে দেন স্যার। আফসোস, এত বড় অফিসের প্রধান হয়ে আপনি চামচা আর কাজের লোকের পার্থক্য বুঝতে পারেন না স্যার। আপনাকে আর কি বলব?’
আসাদ স্যারকে একটা কথাও বলতে না দিয়ে শিরদাড়া খাড়া করে গটগট করে বসের রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
অফিস ছুটির আগে বসের কাছ থেকে ডাক পড়ল। আসাদ বসের রুমে গিয়ে দেখে বস জরুরীভাবে কারোর সাথে ফোনে ইংরেজী আলাপ করছে। আসাদকে দেখে বস ফোনে থাকা অবস্থায় পিএকে ইশারা করল।
পিএ আসাদকে ডেকে বলল, ‘এই নিন। স্যার দিয়েছেন। আপনাকে চলে যেতে ইশারা করেছেন।’
আসাদ হাতে নিয়ে দেখল অফিসের লোগো সম্বলিত মুখ আটকানো একটা খাম। তার উপরে বসের সিলছাপ্পর দেয়া। আসাদের আর বুঝতে বাকি রইল না। বসের সামনে সত্য কথা বলার অপরাধে এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাকে আজ থেকে অব্যহতি দিয়েছে। আগামীকাল থেকে ওকে আবার অন্য জায়গায় চাকরি খুজতে হবে।
অন্য সময় মানে শিরদাড়া সোজা হওয়ার আগে এরকম খবরে আসাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তো। এই শহরে একটা চাকরি পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ও হয়তো একেবারে ¤্রয়িমান হয়ে বসের পা চেপে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিত।
কিন্তু তার বদলে আসাদের মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল।
অফিসের প্রায় সবাই অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। ওর ডেস্কে এসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যেতে হবে। চেয়ারের পায়ার কাছে ময়লার বাস্কেটে দলামচা করে ছুড়ে ফেলে দিল খামটা।
ডেস্কটা পরেই গুছিয়ে রাখবে ভেবে উঠে দাড়াল আসাদ। চোখ গিয়ে পড়ল বাস্কেটে দলামচা করা খামটার দিকে। মুখে অদ্ভুত হাসি ঝুলিয়ে রেখে নিচু হয়ে খামটা হাতে তুলে নিল। দেখি, স্যার চাকরিচ্যুতির কারণ কি দেখিয়েছে? সত্য কথা বলার অপরাধে ইউ ফায়ারড! হা! হা! হা!
খামের মুখটা ছিড়ে লেটারটা বের করতেই হতভম্ব হয়ে গেল আসাদ। তার পনের দিনের ছুটি মঞ্জুর হয়েছে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *