ছোটগল্প।। নববর্ষের উপহার।। শফিক নহোর

ডিসেম্বর মাস স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেছে এখন ছুটি । ছেলে মেয়েরা বায়না ধরেছে,
এবার ফয়েজ লেক দেখতে যাবে । চট্টগ্রাম খুব সুন্দর শহর , নানুপুরের মন্দির দেখবে। বড় দিনের অনুষ্ঠান শেষ করে বাবার বাড়িতে তিন চারদিন থেকে নববর্ষের বিশেষ দিনে লিটনকে অবাক করবার মতো প্লান প্রোগ্রাম চলছে রীতার মনে । ফয়েজ লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কোন মানব হৃদয়ে প্রেমের নৈসিক সুন্দর্ষের অবলোকন করতে পারবে ।
স্বচ্ছ পানির ভেতর দিয়ে আকাশের নীল রোদন মায়ায়
বিকেলর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরও একধাপ বাড়িয়ে দেয় পাখির কিচির মিচির শব্দ জলে ভেসে বেড়ানো পানকৌড়ি , এদের আলিঙ্গনে তখন মনে হয় আমি সবকিছু থাকতে লিটনের সংসারে সুখ খুঁজে পেলাম না ।

বায়েজিদ বোস্তামি রোডের বাসা থেকে সকালে সূর্য ওঠার প্রথম প্রহরের কিরণ ঘর আলোকিত করলেও মনের কোণে ঘোর অন্ধকার ভর করত , ঢাকা শহরে থাকতে থাকতে একটা মায়া জন্ম নিয়েছে ,শহরটার উপর ।আর দিনদিন মায়ার ঘাটতি ঘটছে ঘরের মানুষের সঙ্গে । নববর্ষের উপহার মানুষের কাছ থেকে চেয়ে নিতে নিজেকে খুব ছোটলোক মনে হয় । জীবন সম্পর্কে তাঁর অন্তদৃষ্টি নিরপেক্ষ এবং বাস্তব । চোখের আড়ালে মিজানের সঙ্গে
রীতার সম্পর্ক বেশ দারুণ গাঢ় হয়েছে । মিজান ব্যবসায়িক পার্টনার লিটনের ভেতরে- ভেতরে রীতা যত দূর এগিয়ে আসছে তা দুধকলা দিয়ে সাপ পোষার মতো অবস্থা ।

মিজান স্বপ্নেও কখনো ভাবতে পারেনি এমন সুখের সংসারে দাবানল প্রবাহিত হচ্ছে ।
এই অপ্রত্যাশিত অন্ধকার আলো-আঁধারের ডাকে আতঙ্কিত হলেন ।

রীতাকে একদিন একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন :
কী করে এমন ঘটলো আপনার ও লিটনের মধ্যে ।
রীতা তখন পুরনো কিচ্ছা-কাহিনী বলা শুরু করল ।
বিয়ের দিনের রাত থেকে শুরু প্রথম দিকে আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন আসত তাদের আদর আপ্যায়ন করতাম , লিটন তখন নতুন ব্যবসা শুরু করছে সংসারে একটা অভাব লেগে থাকত আত্মীয় স্বজন একের পর এক আসতে থাকত , তবে লিটন ভদ্র ও বিনয়ী ছিল ।
দিনদিন লিটন পরিবর্তন হতে লাগল । রীতা একটা সুখের ঠিকানা খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল । চট্টগ্রামের বেড়ানো শেষে ঢাকায় ফিরে একদিন সন্ধ্যায় মিজানকে রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ করেছে বন্ধু লিটন ; সেই সুযোগকে মোক্ষম সময় ভেবে প্রণয়ের বিষবীণ বাজিয়েছে মায়াবতী রীতা মনেমনে অনেক জলপনা কল্পনা থাকলেও গোপনে চেপে ধরে আছে ।
দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল । শব্দ শুনে চমকে উঠলেন।মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব হতে লাগল । দরজা খুলা উচিত হবে কি ? কিন্তু সাত পাঁচ ভেবে দেখলেন খোলাই উচিত । নববর্ষের রাত্রিতে কোনও পথিক তাঁর দুয়ারে আঘাত করে থাকে , তবে সে যাই হোক-না কেন, দরজা খুলে দেখি কে এসেছে । রীতা একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রথম রুম পেরিয়ে গিয়ে প্রথমে দরজার খিল খুললেন, তার পর হাতে চাবির গোছা নিয়ে দরজার সামনে এগিয়ে গেলেন । দরজা টান দিয়ে খুলতেই দেখতে পেলেন তার হৃদয়ে মন মন্দিরে সাজানো মানুষটির আলোকিত মায়াবী মুখ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । রীতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনি এখন এখানে ?’
তুমি কি বাসায় একা আছ ?’
হ্যাঁ।’
‘তোমার বাসার কাজের-লোক নেই তো ?’
‘না।’
মিজান ভেতরে ঢুকল। মিজানের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু একটা বলতে চায় ।ড্রয়িং রুমে ঢুকে সোফায় বসে আয়েস করে বসে ম্যাগাজিন পড়তে লাগল ,
রীতা শরীর ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ভীষণ কান্না জড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল,
‘আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি ।’
মানুষ পাগল হয় জানতাম , এমন পাগল দেখেনি কখনো । আবেগ ধরে রাখা একটা আর্ট সেই বৃত্তের বাহিরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বোকা মানুষজন । রীতার চোখের জল গড়িয়ে তাঁর হাতের উপরে পড়ল ।বিস্মিত স্বরে বললেন :
‘রীতা, তোমার কী এমন হয়েছে ? প্লিজ ! আমাকে সব খুলে বল।’
‘রীতা ভিজা কণ্ঠে ফোঁপাতে ফোঁপাতে আস্তে করে বলল:
‘ এরকম ভাবে এ সংসারে আমি আর বাঁচতে পারবো না ।’
রীতার বক্তব্য অস্ফুট বুঝতে পারলেন না ।
‘কী রকম করে!’
‘হ্যাঁ , এরকমভাবে আমি আর বাঁচব না। আমি অনেক সয়েছি । আজ সকালে বাসা থেকে বের হবার সময় লিটন আমাকে প্রহার করেছে’
কে’— তোমার স্বামী?’
হ্যাঁ, আমার স্বামী ।’
মিজান বিস্মিত হয়ে গেলেন । কোনদিনও ভাবতে পারিনি যে রীতার স্বামী এমন নির্দয় হতে পারে। রীতার স্বামী একজন ভদ্র, শিক্ষিত মানুষ । বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্ম করে , কবিতা লেখেন , লোকে তাকে চেনে সম্মান করে । সবাই তার খুব প্রশংসা করে । সুশিক্ষিত মার্জিতরুচির লোকের মতো- আচার-ব্যবহারে সে ছিল খুব ভদ্র । স্ত্রীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল । স্ত্রীর ইচ্ছামত চলত সংসার তবুও কিসের একটা অভাব ছিল। স্বামীর সঙ্গে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে প্রায় রাতে দুজনের ঝগড়া হতো তাঁরা আলাদা রুমে থাকত । ছেলেমেয়ে স্কুলের আবাসিক হোস্টেলে থাকে । সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাসায় আসলে সন্তানদের দেখতে হতো বাবা মায়ের ঝগড়া ।

রাত অনেক হয়েছে, লিটন বাসায় আসবে , মোবাইলের ক্ষুদে বার্তায় রীতাকে জানিয়েছে রাতে । আসবার সময় হোটেল থেকে রাতের খাবার নিয়ে আসবে । আজ আমাদের সঙ্গে বিশেষ একজন মানুষ থাকবে খাবার টেবিলে । সেই বিশেষ মানুষটি বিশ্বাস থেকে বিষ হতে চলছে নিজ গৃহিণীর গভীর প্রণয়ের অন্ধকার কক্ষে । সংসারে বিভেদ বাড়তে বাড়তে ব্যবধান বড় হয়ে গেছে ।
রীতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বামীর সংসার করবে না । যদিও স্বামী একথার কানাকড়ি জানেনা । জানলে তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে ।
একটা কথা বলার অনুমতি চাইছি ,
‘আমি স্বামীর সংসার করবো না । এখন থেকে আমাকে তুমি অন্য কোথাও নিয়ে যাও গোপনে ।’
মিজান তার পাশে বসে রীতার হাতদুটো ধরে বললেন: রীতা তুমি অপূরণীয় ক্ষতি করতে যাচ্ছ । তুমি তোমার স্বামীকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাও কেন ?’ তোমার স্বামী একজন ভদ্র ও শিক্ষিত মানুষ ।তাছাড়া একজন মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ না আনতে পারলে তাকে এমন ধোঁকা দেওয়া ঠিক না । সমাজে তোমার স্বামীর নাম আছে , তোমাকে সবাই চেনে জানে ।তোমার সুখের সংসার তা ফেলে অগ্নি দহনে সেচ্ছায় কেন নিজেকে বিসর্জন দিতে চাও ? এটা কি বোকামি নয় ?’

তুমি আমাকে যে পরামর্শ দিলে তার মধ্যে আমার প্রতি তোমার কোন প্রেম নেই , মায়া নেই ,সম্মানবোধ নেই, একজন গবেট কাপুরুষের মতো ।
‘না, এটাই সত্য ও যথার্থ এবং যুক্তিসংগত ।
সে উঠে দাঁড়াল । অগ্নি কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল,
আমার মনের ভেতর থেকে তার জন্য স্থান শেষ হয়েছে , চিরতরে শেষ হয়েছে ।’
সোনায় মোড়ানো সংসারে সামান্য কুকথায় বিক্ষিপ্ত হয়ে কুটিল পরিকল্পনা যে নির্বুদ্ধিতা আর ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের রূপ নেওয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়, এ-কথা অসংখ্য যুক্তি এবং বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেও ফলাফল শূন্য ।রীতার এই দৃঢ় সংকল্পের জন্য তার প্রতি একটা গভীর মমতা বোধ কাজ করেছিল ।সাময়িক সময়ের জন্য কিন্তু ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে ।
বিশেষ দিনে নববর্ষের উপহার হিসাবে তোমার মতো একজন আদর্শবান বন্ধু বিশ্বাসী ব্যবসায়ীকে আমার স্বামীকে উপহার দিতে চেয়েছিলাম । আজি সত্যিই একজন মহান হৃদয়ের বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি ;
প্রিয় মিজান, আমি তোমাকে আলিঙ্গন করতে চাই ।
এই আলো আঁধারের দুনিয়াতে অনেক ভাল মানুষ আছে , ভাল মানুষকে খুঁজে নিতে হয় বিভিন্ন কলাকৌশলে ।আমাকে নিশ্চয়ই ক্ষমা করবে প্রিয় বন্ধু। তোমার সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের প্রনয়ের মিথ্যা লীলাখেলা আমি সত্যিই এই নববর্ষে আমার স্বামীর জন্য একজন সত্যিকার বন্ধু ও সৎ ব্যবসায়ীকে খুঁজছি , আর তুমি আমার সেই বিশেষ নবর্বষের উপহার ।
রীতাকে মিজান জড়িয়ে ধরতেই ঘরে লিটনের আগমন ঘটল !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *