মুক্তিযুদ্ধের ছোটগল্প।। আব্রাহাম এর পতাকা।। রহিমা আক্তার মৌ
ইরিনা ও ইরিশার মায়ের সাথে পরিচয় সেই ৭/৮ বছর আগে থেকে। একই স্কুলে পড়তো ইরিনা, ইরিশা ও অভ্র। মাঝে দুই বছর দেখা না হলেও এরপর আবার প্রায় প্রতিদিন দেখা হতো। ইরিনা ও ইরিশাকে দেখলেই বলতাম।
— জমজ মেয়ের খুব সখ ছিলো আমার। কিন্তু —
ঢাকা শহরের নামকরা স্কুলে পড়ে ইরিনা ও ইরিশা। সেই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ছুটতে হয় পড়ার পেছনে। অভ্র আর ওরা এখন একই স্কুলে পড়ে না। তবে আসা যাওয়ার পথ একই হওয়ায় প্রায় প্রতিদিন দেখা হয়। শুধু স্কুলের পথে নয়। একই আর্ট একাডেমীতে আর্ট শিখতে যায় অভ্র ইরিনা ও ইরিশার। সেখানেও দেখা হয়।
ইরিনা ও ইরিশাকে দেখলেই আমি তাকিয়ে থাকি। স্বপ্নটা তাড়া দেয়, ওরা প্রতিদিন একই ডিজাইনের জামা একই ব্র্যান্ডের ব্যাগ জুতো সহ সব কিছু মিলিয়ে পরে। আর্ট ক্লাসে ওদেরকে দিয়ে আমরা অন্যরুমে বসে গল্প করি। মায়েদের গল্পগুলো যেমন হয়, তেমনিই। কখনো রান্নাঘরের গল্প কখনো শপিং আবার কখনো বাচ্চাদের পড়ার বিষয়।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে ইরিশার আম্মুকে আমাদের এলাকায় বাসা ভাড়া হবে কিনা খুঁজতে দেখি। সেদিন তেমন কোন কথা হয়নি আমাদের। পাশের বাড়ির ৩য় তালায় ছুটা বুয়ার কাজ করে আমাদের ছুটা বুয়া হালিমা। হালিমা এসেই বলে–
— খালা নতুন কাজ খুঁজতে হবে।
— কেনো?
পাশের বাড়ির ৩য় তালা দেখিয়ে দিয়ে বলে ওরা চলে যাবে, নতুন ভাড়াটিয়ে আসবে।
— নতুন যারা আসবে, তাদের কাজ নিতে পারো।
— খোঁজ নিয়েছি, ওরা ছুটা লোক নিবে না।
মাসের এক তারিখ না আসতেই পাশের বাড়ির আগের ভাড়াটিয়া চলে যায়। আমাদের রান্নাঘর আর ওদের বারান্দা একেবারেই পাশাপাশি। আমাদের একটা বেডরুমের জানালা আর ওদের একটা বেডরুমের জানালা সামনাসামনি। ঢাকা শহরের বাড়ি গুলো যেমন হয়। মনে হয় এক বাড়িতে সুঁই পড়লে অন্য বাড়ি থেকে দেখা যায়।
মাসের এক তারিখ রান্নাঘরে যেতেই দেখি পাশের বাড়ির ৩য় তালায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। মধ্যবয়সী একজন মহিলা অনেকটা আমার মায়ের বয়সি, তিনি মালামাল ঠিক করছেন। নতুন ভাড়াটিয়া আসার পর থেকে বেডরুমের জানালাটা খুব একটা খোলা দেখি না। বারান্দায় ও লোকজন আসে খুব কমই। জানি পাশাপাশি আছি বলে পরিচয় ঠিক হবেই একদিন। মাঝে মাঝে ওই ফ্লাট থেকে করুণ কন্ঠে কান্নার আওয়াজ আসে। ছোট বাচ্চার চিৎকার শুনা যায়। কিন্তু বুঝতে পারিনা এমন করে কান্না আর চিৎকার কে করে। আবার গানের সুর ও আসে। তখন বুঝি কেউ গান শিখছে। বারান্দায় প্রায় কিছু কাপড় নাড়া দেখি, কিন্তু কখন যে কে এসে দিয়ে যায় দেখিই না।
সেদিন অভ্রর বন্ধুদের নিমন্ত্রণ ছিলো আমাদের বাসায়। তাই অনেক রান্নার করছি। পাশের বারান্দায় কারো উপস্থিতি দেখেই তাকাই, একি এতো দেখি ইরিনা ও ইরিশার আম্মু। তাহলে কি ওনারাই এই বাসা ভাড়া নিয়েছে। ভাবী বলে ডাক দিতেই উনি এদিকে তাকান।
— আরে আপনি এই ফ্লাটেই থাকেন। জানতাম এই বাড়িতে থাকেন, তবে এই ফ্লাটেই থাকেন জানতাম না।
— আমিও জানতামনা আপনারা এই ফ্লাটে এসেছেন। আচ্ছা সেদিন দেখলাম মধ্যবয়সী একজন।
— ও, উনি আমার মা। বাসা পাল্টানোর সময় মা এসেছিলেন।
সামান্য কিছু কথা হয়, দুজনেই নিজেদের বাসায় আসার নিমন্ত্রণ দিয়ে বিদায় নিই।
এরপর থেকে যখনিই কান্না আর চিৎকার শুনি ভাবনাটা আরো বেড়েই যায়। গানের রেওয়াজ শুনা যায় মাঝে মাঝেই। এখন বুঝতে পারি ইরিনা ও ইরিশা দুবোনেই গান শিখে। ভালোই লাগে গানের রেওয়াজ শুনলে।
ইরিনা ও ইরিশার সাথে যেমন দেখা হতো আগে তেমনিই দেখা হয়। ওর আম্মুর সাথে এখন আরো বেশিই দেখা হয়। একই দোকান থেকে কেনাকাটা করি, বাজার করি। এর মাঝে প্রায় মাস ছয় পার হয়ে যায়। বারান্দায় আসে ইরিনা ও ইরিশার আম্মু।
— কেমন আছেন।
— জ্বী ভালো।
— আচ্ছা আপনাদের বাসা থেকে মাঝে মাঝে,,,
এইটুকু বলতেই উনি বলেন,,,,
— কান্নার আওয়াজ আসে, আর চিৎকার আসে এই তো।
— জ্বী, আসলে কিছু মনে না করলে বলতে পারেন।
— ও আমার ছেলে আব্রাহাম। আমার বড় সন্তান। ও বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশু।
সেদিন কথা আর বাড়েনি আমাদের। দুজনের তাড়া ছিলো নাকি একে অন্যকে এড়িয়ে গেলাম বুঝে উঠতে পারিনি।
প্রায় প্রতিদিন বারান্দায় ছোট ছোট কাঁথা নেড়ে দিতে দেখি। একই ধরনের গেঞ্জি কাপড়ে কয়েকটা হাফ প্যান্ট ঝুলতে দেখি। বুঝতে পারি এগুলো আব্রাহামের ব্যবহৃত। ইরিনের আম্মু যে ভাবে বলল, তাতে আব্রাহামের বয়স ১৫ কি ১৭ হবে। ছোট কাঁথা দেখে বুঝি আব্রাহাম বিছানায় প্রস্রাব করে। কিন্তু মনের মাঝে প্রশ্ন, ওরা কখনো বেডরুমের জানালা খোলে না কেনো?
একদিন ওদের বাসায় যাই। ইরিনা ও ইরিশা বাসায় ছিলো না। আব্রাহামকে দেখি আমাদের রুমের পাশের সেই রুমেই ও থাকে। হয়তো এই জন্যেই জানালা বন্ধ থাকে সব সময়। ইরিনার আম্মুকে জানালা খোলা রাখার কথা বলি। জানি এমন সন্তান যার ঘরে আছে তিনিই অনেক ধৈর্য নিয়েই চলেন। আব্রাহামের সামনে ছোট ছোট অনেক গুলো রং পেন্সিল। ভাবি আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বলেন।
— ইরিনা ও ইরিশা রং করতে বসলেই ওর ও চাই। তাই ওকেও এনে দিয়েছি। সারাদিন টিভি দেখে এগুলো নিয়েই সময় কাটায়।
— আচ্ছা ও চিৎকার করে কখন?
— যখন ইরিনা ও ইরিশাকে নিয়ে বাইরে যাই।
— তার মানে ও যেতে চায়।
— আগে নিয়ে যেতাম, এখন বড় হয়েছে পারিনা।
কথা বলছি আমরা টিভিতে সিনেমা হচ্ছে। সিনেমায় পতাকা নড়ছে দেখেই আব্রাহামের সেই কি উত্তেজনা। ও হাত নেড়ে নেড়ে পতাকা দেখাচ্ছে। আমি খুব অবাক হই। কিছু সময় থেকে আসার সময় জানালাটা খোলা রাখার জন্যে অনুরোধ করি। ইরিনার আম্মু সাথে সাথে খুলে দেয়।
এখন আমাদের রুমের জানালা দিয়েই ওকে দেখা যায়।
সেদিন ছিলো ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখ। হঠাৎ আব্রাহামের চিৎকার শুনি। দৌড়ে জানালার পাশে যায়। দেখি ও হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বাইরে কি দেখছে। আমিও দেখার চেষ্টা করি। সামনে বিজয় দিবস তাই হকার লম্বা বাঁশে করে পতাকা বিক্রি করছে। সেই পতাকা দেখে আব্রাহাম চিৎকার দিচ্ছে। আমি ডাকছি, ও এদিকে তাকায় তবে কান্না থামায় না। আগেরদিন অভ্র মাঝারি সাইজের একটা পতাকা কিনে আনে বাসায়। আমি ভেতরের রুমে এসে পতাকা হাতে জানালার পাশে যাই। ওকে ইশারা দিয়ে বলি রং পেন্সিল দিয়ে এমন পতাকা আঁকতে। প্রথমে না বুঝলেও পরে ঠিক বুঝতে পারে। আব্রাহাম কান্না বন্ধ করে রং পেন্সিল আর খাতা নিয়ে বসে।