মুক্তিযুদ্ধের ছোটগল্প।। ডায়েরি ও একটি চিঠি।। সৈয়দ নূরুল আলম

একটি চিঠি রিয়ার জীবনের সবরং পাল্টে দেয়। নয়মাসের যুদ্ধ শেষ। সবাই গ্রামে ফিরে আসে। শুধু রাজা আসে না। সবার ধারণা রাজা আর নেই। যুদ্ধে শহিদ হয়েছে। রিয়া মেনে নিতে পারে না। ওর বিশ^াস রাজা বেঁচে আছে। একদিন ফিরে আসবে। ঠিকই ছয়মাসের মাথায় রাজা আসেনি। ওর চিঠি এসেছে।
চিঠির বিষয়টা অন্য সবার কাছে গোলমাল মনে হয়। রিয়ার কাছে তা মনে হয় না। রাজা যখন যুদ্ধে যায়, তখন রিয়া সাত মাসের অন্তসত্তা। রাজা বলেছিল, মেয়ে হবে। রিয়া বলেছিল, ছেলে হবে। রাজা অনাগত মেয়ের নাম রেখেছিল আনা। রিয়া ছেলের নাম রেখেছিল রাতুল।
‘তোমার রাতুল কেমন আছে? কতো বড় হলো?’ রাজা চিঠিতে জানতে চেয়েছে। এরপর আর কিসের সন্দেহ! রাতুল বা আনার কথা ওর দুজন ছাড়া আর কারও জানার কথা না।
রিয়া চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, রাতুল না। আনা। তোমার কথাই ঠিক হয়েছে।
রিয়ার চোখে খেজুরে রস। আনন্দ অশ্রু টফটফ করে পড়ে।
‘মা. তুমি কাঁদছ কেন?’ দাদি বলল, বাবা বেঁচে আছে। ফিরে আসবে।’
‘হ্যাঁ, মা। তোর বাবা বেঁচে আছে।’
‘আসবে না?’
‘আসার কথা তো চিঠিতে লেখেনি।’
‘তুমি তাড়াতাড়ি আসার কথা লিখে দাও।’
‘কীভাবে লিখব। ঠিকানা তো দেয় নাই।’
‘তা হলে এমনি এমনি চলে আসবে। তুমি আর কেঁদো না। অনেক দিন তো কেঁদেছ।’
রাজার কাছ থেকে গত পাঁচ মাসে দশটি চিঠি এসেছে। চিঠিতে ওর ছোট বোন লায়লার কথা জানতে চেয়েছে। ওদের কালো গাই আবার বিয়নের সময় হয়েছে কিনা জানতে চেয়েছে।
এর পরেও রিয়ার মনে একটু কিন্তু থেকে যায়। মানুষটা আসছে না কেন! তাকে না হোক, আনাকে দেখার ইচ্ছে থাকবে না?
‘আনার মা কোথায় তুমি? তুমি দেকি শুধু চিঠি নিয়ে পড়ে থাক। কাজকাম ছাইড়ে দিছ। কোনো কাজে মন নাই।’
শাশুড়ির একথায় রিয়া একটু ঝাঁকি খায়। বলে, না আম্মা। বলেন কী করতে হবে।
‘বেলা হলো। গাই দোয়াও। দুধ দিয়ে আনারে খাইতে দেও।’
‘আম্মা রাতে বাছুর দড়ি ছুইটে দুধ খেয়ে ফেলছে। এখন দোয়ালে দুধ হবে না। একটু বেলা করে দোয়াই?’
‘মরনের বাছুর! আবার এই কাজ করল।’
‘চিন্তা করেন না। আনারে একটা আ-া ভাইজে খাবার দিচ্ছি।’
‘কাজে মন নাই।’ রিয়া ভাবে,শাশুড়ি ঠিকই বলেছে।
মন থাকবে কিভাবে। ও তো সব ভুলে যাচ্ছিল। একটা চিঠি ওকে ভাবনার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
ভাবতে ভাবতে ওর সময় চলে যায়। সময়মতো নাওয়া হয় না। খাওয়া হয় না। কাজেও ভুল হয়। সেদিন শাশুড়ির জন্য পান-সুপাড়ি কিনতে যেয়ে দোকানদারকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে, বাকী টাকা না নিয়েই বাড়ি চলে এসেছে। এর মধ্যে একদিন চুলোয় ভাত পোড়ে, পোড়াগন্ধ ছোটে, তখন রিয়ার হুঁশ হয়। ইদানীং এধরনের ঘটনা প্রায়ই হয়। কী করবে রিয়া! রাজার কথা মনে হলে, ওর মন আর মন থাকে না। কোথায় উড়ে যায়, তা ও নিজেই বুঝে না। সে দিন একটা চিঠিতে রাজা হাসির কথা লিখেছে। সেটা পড়ে রিয়া খিলখিল করে হাসে। কিছুতেই হাসি থামাতে পারে না। সেটা দেখে শাশুড়ি ময়মননেছা বলেন, বউমা এত হাসো ক্যেন।
‘গোপন কথা’ যা সাধারণত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হয়, সেটা লিখেছে। তা কি শাশুড়িকে বলা যায়?
‘ও কিছু না আম্মা। আপনাকে এক কাপ লেবুচা করে দেই?’
‘লেবু না। আদা দেও। দুদিন ধরে খুস খুস কাশি হচ্ছে।’
‘ঠিক আছে, দিচ্ছি।’
‘তুমি সেদিন ভাই বাড়ি গেলা। কেন, কিছু তো বললে না।’
‘ভাইর কাছে আপনার ছেলের চিঠির কথা বলতে গেছিলাম।’
‘শুনে কী বলন?’
‘চিঠিতে তো ঠিকানা দেয় নাই। ঠিকানা থাকলে তো খুঁজে দেখতে পারতাম, সেই কথা বলল।’
‘আমি ওতো সেই কথা কই। ঠিকানা দেয় না। আসে না। এ কেমন কথা।’
রিয়া যে এটা ভাবেনি, তা নয়। রিয়ার মনে সে খোঁচখোঁচানি ঠিকই আছে। কিন্তু কী করবে বুঝতে পারছে না।
রিয়ার ভাবি। মুনমুন। রিয়ার বয়সী। বন্ধুর মতো।
সব শোনার পর বলে, রাজা ভাই কোথাও বিয়ে করে, সেখানে থেকে গেল নাত?
এ কথা শুনে রিয়া বলে, ও মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন করছে। মুক্তিযোদ্ধারা একাজ করতে পারে?
মুনমুন কথাটা বলে বোকা বনে যায়। ননদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *