গ্রন্থ আলোচনা ।। কল সেন্টারের অপরাজিতা সংগ্রামের গল্প।। এম. এ. লতিফ
কল সেন্টারের মানুষগুলোর জীবন কেমন? কেমন তাঁদের যাপন? কোথায় থাকেন তাঁরা? কাজের ধরন কেমন, কখন তাঁরা অফিসে যান? কল সেন্টার নিয়ে এমন অনেক প্রশ্ন আসে আমাদের মনে। সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এসেছে রাহিতুল ইসলামের উপন্যাস ‘কল সেন্টারের অপরাজিতা’। বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন।
বর্তমান বিশ্বে কল সেন্টার সার্ভিসের গুরুত্ব আমরা অনুভব করি প্রতিমুহূর্তে। কিন্তু এই বিশেষ সেবার প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণা নেই বললেই চলে। ফলে আমরা নানা স্ব-কল্পিত ধারণায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকি। কিছু থাকে গুজব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করা মানুষগুলো সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করি। বিশেষত রাতেও কাজ করতে হয় বলে মেয়েদের সম্পর্কে নানা কটূকথা বলেন অনেকে। আসলেই সেসব ঘটে কি না, রাহিতুলের উপন্যাসে চোখ বোলালে আমরা তার একটি চিত্র দেখতে পারি। তবে শুধু কি একটি চিত্র? না, রাহিতুল সেই চিত্রের মধ্যেও তুলে ধরেন একটি গল্প। এমন গল্প, যা পাঠককে একাত্ম করে। তথ্য-নির্ভর না হয়ে গল্প হয়ে ওঠে কাহিনী নির্ভর।
উপন্যাসের মূল চরিত্রের নাম অপরাজিতা। পিতৃহীন সংসারে এক ভাই ও অসুস্থ মাকে নিয়ে তার বসবাস। মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এই মেয়ে একটি কল সেন্টারে কাজ করে। জীবনের সব সাধ–আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে পরিবারের কথা ভেবে শুধু নিজের কাজেই মনোযোগী হয় সে। সমাজের কাছে প্রায় অপরিচিত একটি পেশায় এসে নানান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় একা মেয়েটিকে। জীবন ও যাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্মুখীন হতে হয় নানা বিড়ম্বনার। তবু অপরাজিতা নিজের পেশাটিকে খুব ভালোবাসে। এই পেশায় সে নিবেদিতপ্রাণ। তবে নিজের নামের প্রতি একটি আলাদা ভালোবাসা আছে তার। তাই কোনও কিছু তাকে টলাতে পারে না, পরাজিত করতে পারে না। সব বাধা পায়ে দলে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। মাঝেমধ্যে কিছুটা দ্বিধা হয়তো তার জীবনে আসে, তবে তা ঝেড়ে ফেলার শক্তি সে অর্জন করেছে। ফলে শেষ পর্যন্ত নুয়ে না পড়ে নিজের মেরুদণ্ড শক্ত রাখে অপরাজিতা। মায়ের মৃত্যু বা অভাবের আঘাতও তাকে ভেঙে দিতে পারে না। একমাত্র ভাইটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখায় সামান্যও ঘাটতি থাকে না। এসবের মধ্যেই জীবনের প্রতিটি হোঁচটে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তেও আবার উঠে দাঁড়ায় দ্বিগুণ স্পৃহা নিয়ে।
এমন একটি পরিবেশে অপরাজিতার জীবনে আসে তার বসের বন্ধু মনন। অপরাজিতাকে নানা স্বপ্ন দেখায় সে। হাতছানি দেয় প্রেমের। শুরুতে দূরত্ব রাখলেও আস্তে আস্তে মননের প্রতি একটি টান অনুভব করে সে। ফলে একসময় দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে একটি অব্যাখ্যেয় সম্পর্ক। সে সম্পর্ক বন্ধুত্বের অধিক। যদিও দুজনের মধ্যে সরাসরি প্রেমের কোনো কথা হয় না, কেউ কাউকে কথা দেয় না, কিন্তু প্রেমের জন্য তো কথা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ফলে সেই না দেওয়া কথা একসময় মনন ভাঙে।
অপরাজিতার জীবনে আসে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ঝড়। সে ঝড়ের মোকাবিলা সে করে কীভাবে? সেই গল্প নিয়েই এগিয়ে যায় ‘কল সেন্টারের অপরাজিতা’ উপন্যাসটি। পুরো উপন্যাসে অপরাজিতা চরিত্রটি এতটাই দৃঢ় যে অন্য চরিত্রগুলো তার কাছে ম্লান হয়ে যায়। অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করা একটি মেয়ের পরিণতি কী হতে পারে, তা খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। খুব সহজ ভাষার বর্ণনা উপন্যাসটিকে আরও মনোগ্রাহী করে তুলেছে। কাহিনির উপস্থাপনা ও বুনন সুন্দর।
রাহিতুল তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর উপন্যাস লিখছেন অনেক দিন। আমাদের অজানা ক্ষেত্রগুলোকে তিনি এমনভাবে তুলে ধরেন যে চরিত্র বা ঘটনার সঙ্গে মিশে যেতে কষ্ট হয় না। এমনকি আমাদের প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়–আশয়ও তাঁর উপন্যাসে এমনভাবে উঠে আসে যে সেটা ঠিক শিক্ষকসুলভ না হয়ে লেখকসুলভই হয়। ‘কল সেন্টারের অপরাজিতা’ উপন্যাসেও সম্ভাবনাময় একটি পেশার মানুষদের জীবনসংগ্রাম ও চ্যালেঞ্জ খুব গাঢ়ভাবে উপলব্ধি করতে পারি আমরা। উপলব্ধি করতে পারি এই পেশার এক নারীর ভেতর–বাইরের বাস্তবিক আখ্যান।