মজিদ মাহমুদের উপন্যাস- মেমোরিয়াল ক্লাব: মহাকাব্যিক শিল্পসংবেদ।। মোহাম্মদ আব্দুর রউফ


সাহিত্য-সাধনায় মজিদ মাহমুদ (জ. ১৯৬৬) একটি অনিবার্য নাম। প্রথম উপন্যাস-আখ্যান মেমোরিয়াল ক্লাব (২০২০) একটি মহাকাব্যিক শিল্পবয়ান। উপন্যাসটি চারটি পরিচ্ছেদে সুবিন্যস্ত। মর্জিনা-মলিনা, ইয়াছিন, হাসান-হাজেরা, আকলিমা অথবা আব্দুল খালেকের মতো কতগুলো চরিত্র তিনি নির্বাচন করেন। এবং সেগুলি সমাজ ও জীবনবাস্তবতায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। সিংহভাগ চরিত্রই যাপিত জীবনে নিদারুণ জীবন-বাস্তবতার মুখোমুখি। বিধবা চাচির সঙ্গে ইয়াছিনের জেনার অভিযোগ। সাক্ষীসাবুদ না থাকলেও, চাচি বাদি না হলেও পাড়াপড়শিসহ মসজিদের মুসল্লিরা জোরালো বিচার দাবি করে। অর্ধদেহ জমিনে পুঁতে পাথর নিক্ষেপে শাস্তির বিধান থাকলেও মৌলভি আবদুল কাদের উদ্ভাবন করে নতুন বিধান। চুল কেটে, মাথা ন্যাড়া করে, ঘোল ঢেলে মুখে চুনকালি মেখে, মহিষের পিঠে চড়িয়ে পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করায়। সেদিন সহস্র মানুষের ঢল নেমেছিল। ইয়াছিনের অপমানে চরবিলকাদার মানুষ আনন্দউৎসবে মেতে উঠেছিল। এই দুঃখে মানবহৃদয় সিক্ত না হলেও জল ঝরেছিল অবুঝ প্রাণি মহিষের চোখে। জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তির খোঁজে ইয়াছিন ঘটনার তিনদিন পরে তেঁতুলগাছে ঝুলে জীবনাবসান ঘটায়। সাতাসের সন্তান এর সমাজ বাস্তবতা সর্বত্র স্বীকৃত। অথচ বিয়ের সাতমাস পরে সন্তান প্রসব করায় প্রতিবেশিরা হাজেরাকে অসতী আখ্যায়িত করে। এমনকি শ্বশুরকুলের লোকজনও বিশ্বাস করেনি, নবজাতক তাদেরই ছেলের ঔরসজাত সন্তান। তেরচৌদ্দ বছরের আকলিমা সালোয়ার-কামিজ পরতে না পরতেই গর্ভবতী হয়। গর্ভে মানবশিশুর আগমন প্রসঙ্গে আকলিমা কিছুই জানে না। নির্মম নির্যাতনের মুখে ঘর থেকে বের করে দেয় শিশুমাতাকে। শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করতে করতে হারিয়ে যায় শিশুমাতা আকলিমা। মাতৃহীন মলিনার মাথায় খানিকটা গণগণ্ডগোল। সংসারের রীতিনীতি সবই অজানা। মা অথবা মুরব্বিগোছের মেয়ে মানুষ না থাকায়, পিতা দূরে থাকায় কেউ তাকে দরকারি বিষয়াদি শিখিয়ে দেয়নি। নিজের মধ্যেও ন্যায়অন্যায় বোধবুদ্ধি তৈরি হয়নি। ধারেকাছের মানুষজন সুযোগটা কাজে লাগায়। পাকবাহিনি মাতৃহীন এই এতিমকন্যা আধপাগলা মলিনাকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যায়। কুড়িদিন পর ছাড়া পায় মলিনা। ফিরে এলে পোয়াতির খবর রাষ্ট্র হয়। জারজ সন্তান ধারণ করায় গ্রামবাসী মালিথা বাড়ির বৈঠকখানায় বিচারসভায় বসে। মলিনা কারো নাম বলেনি, কোনো সাক্ষীও নেই। গর্ভের সন্তানই আজ জন্মদাতা মাতার বিরুদ্ধে। লুকমান ও লুকমানের মেয়ে মলিনা মাটির উপর অনেকটা গা ঘেষাঘেষি করে অধোমুখে বসে। দর্শকসারি থেকে নানাবিধ সব ভয়ঙ্কর শাস্তির প্রস্তাব আসতে থাকে। গর্ভবতী নারীকে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে শরিয়তে নিষেধাজ্ঞা আছে বলে ইমাম জানায়। গর্ভের সন্তান তো পাপ করেনি। সন্তান খালাস হওয়া পর্যন্ত, মাতৃদুগ্ধ পান করা পর্যন্ত শাস্তি মুলতবি রাখার বিধান রয়েছে। শরাশরিয়তের বিধান যা-ই থাক, গ্রামবাসী নগদনগদ শাস্তির পক্ষে। বাপবেটিকে তওবা পড়ানো, মাথার চুল কর্তন করা, পিষ্ঠদেশে আঘাত অথবা একঘরে করার মত নানাবিধ প্রস্তাব এলেও আখেরে গ্রামবাসী শিশুসন্তানসহ মলিনাকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আঘাত সইতে না পেরে মলিনার বয়োবৃদ্ধ নানি আগেই বসতবাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যায়। দিনকয়েক পরে হতভাগ্য পিতা লুকমানও মেয়ে মলিনার হাত ধরে জন্মভূমি মামৃত্তিকার মোহমায়া বিসর্জন দিয়ে গভীর রজনীতে বসতভিটে ছেড়ে পালিয়ে যায়। মর্জিনা হতভাগ্য যুবতী নারী। অনেকের মতে, বর্ধিষ্ণু পরিবারের রূপবতী কন্যা মর্জিনাকে একা পেয়ে আব্দুল কাদের তার সঙ্গে শুতে বাধ্য করেছিল। এতেই মর্জিনা হামেলা হয়। অপবাদ থেকে বাঁচার জন্য আব্দুল কাদের মজিনার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। অগ্নিদগ্ধ হয়ে দিনকয়েক যমদূতের সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে মর্জিনা মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে। ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্থ না হলে অথবা শ্বাসনালি পুড়ে না গেলে হয়তোবা মেয়েটি বেঁচে যেতো। হয়তোবা অভিভাবকও মৃত্যুই চেয়েছিলেন। কেননা, এই মেয়ে বেঁচে থাকলে শেষ পর্যন্ত কুঁচকানো বিকৃত চামড়া নিয়ে বেঁচে থাকবে। তাকে বিয়েসাদি করার মত কোনো পাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। আব্দুল খালেক আরেক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি। রাজাকার আবু তালেব পাক মিলিটারিদের আনন্দ দিতে গিয়ে আব্দুল খালেককে এলাকার উচু খেজুর গাছে তুলে দেয়। পাক জোয়ানেরা হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। সেই সঙ্গে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ আব্দুল খালেকের পিঠের দিকে রাইফেলের একটি গুলি চালিয়ে দিয়ে তারা সেদিনের মৃগয়া উদযাপন করেছিলÑএই হলো মেমোরিয়াল ক্লাব উপন্যাস-আখ্যানের কাহিনি অথবা উপকাহিনি। কাহিনিকাঠামোর অন্তরালে লিপিবদ্ধ হয়েছে জনজীবনের অন্তহীন সব দুঃখগাথা।

২.
ইয়াছিন, আকলিমা, মলিনা-মর্জিনা অথবা হাজেরা-আব্দুল খালেকেরা স্বস্ব পরিণতির জন্য নিজেরা কেউই দায়ি নয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও বাদী অথবা সাক্ষীসাবুদের তোয়াক্বা না করেই এদেরকে নির্মম বিচারের মুখোমুখি করা হয়, ঠেলে দেয়া হয় মৃত্যুমুখে। কারো গায়ে অগ্নিসংযোগ, কাউকে গ্রামছাড়া করা হয়। অপমানÑঅসম্মান থেকে বাঁচতে কেউ বেথেলহামের পথে হারিয়ে যায়, কেউবা তেঁতুলগাছে ঝুলে জীবনযৌবন বিসর্জন দেয়। এসব নিপীড়িত-নিষ্পেষিত অসহায় মানুষেরা উপন্যাস-আখ্যানে উপকাহিনিতে এসেছে। তবে মূল কাহিনিকাঠোমোর আদিঅন্ত জুড়ে রয়েছে নায়ক হাসান। এই হাসানকে কেন্দ্র করেই গ্রন্থটির গল্পকথা সুপ্রসারিত-সুসম্প্রসারিত। বিলকিস বেগম ওরফে বিলুর সঙ্গে কিছুটা প্রেমপ্রেম ভাব দৃশ্যমান হলেও এটি প্রেমপ্রধান উপন্যাস নয়। এটি মূলত চেতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাস অথবা মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাস-আখ্যান। লাঞ্ছিতÑঅপমাণিত জনমানবের নিদারূণ ট্টাজিক পরিণতি হাসানকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলে। হাসানের মনোজগতে বিক্ষুদ্ধ সাগরের ঢেউ একেএকে আছরে পরে। ঢেউয়ের আঘাতে নিজেও সাগরতীরের ন্যায় ক্ষয়ে যেতে থাকে। ভ্রাতৃহত্যাকারী অশোকের অহিংসার বাণী, পিতার ঔরস থেকে হারিয়ে যাওয়া কোটিকোটি শুক্রানু সহোদরের কথা, নিয়ন্ত্রণের কথা বলে পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো; যুগযুগ ধরে, কালকাল ধরে নিপীড়িত-নিষ্পেষিত নিম্নবিত্তের হাহাকার, গ্রাম থেকে শহরে আসা না-খাওয়া কালো মানুষের দল, আইল্যান্ডে শায়িত জীর্ণশীর্ণ নারীর ইহকাল-পরকালের পারাপার প্রসঙ্গ, ফুটপাথের আলোহীন পথশিশু, কৈশোর যৌবনে পৌঁছার আগেই পচাডিমের মতো এদের দুর্গন্ধযুক্ত হওয়া, পথবালিকার পূর্বপুরুষের দাসব্যবসার শিকারে পরিণত হওয়া, টোবাকো কোম্পানির নিকোটিন সরবরাহ, অসংখ্য মানুষের ফুসফুস ধ্বংস হওয়াÑজগৎ ও জীবন সম্পর্কিত ইত্যাকার নানাবিধ বিষয়ভাবনায় হাসানের শরীরমন অবশ হয়ে আসে। চাইলেই হাসান এসব ভাবনা এড়িয়ে যেতে পারে না। ক্রমান্বয়ে নানা মাত্রিক সব বোধভাবনার মুখোমুখি হাসান। হাসানের অন্তর্জীবন ও জগতের চেতনাপরিসর আরেফ আলী অথবা মুহাম্মদ মুস্তফার চেয়েও প্রসারিত। এসব মানুষের নিদারূণ ঘটনাবলি হাসানকে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত করে। মানবমুক্তির কূলকিনারা খুঁজে পায় না হাসান। নিজের মুক্তিও নিজের হাতে নেই। মাঝেমধ্যে নিজেকে টিকটিকি মনে হয়। এমনকি আরো নিমস্তরের। একটি টিকটিকির নিজেকে সুরক্ষার যত সুকৌশল আছে হাসানের তাও নেই। বাস্তবিকই গভীর জীবনসংকটের মুখোমুখি হাসান। রাতে অফিস থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তনকালে পথিমধ্যে পথবালিকার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়। মানবিক ভাবনায় হাসান পথবালিকাকে কিছুটা আর্থিক সহায়তা করতে গিয়ে নিশিপুলিশের হাতে সন্দেহভাজনরূপে গ্রেফতার হয়। রাতে ডিবি অফিসে ভয়ানক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হাসান। সাংবাদিক হিসেবে হাসান মনেমনে মুক্তির প্রত্যাশা করলেও আখেরে জেলজরিমানা ভোগ করতে হয়। একমাস দশদিন পরে হাসানের হাজত বাসের সমাপ্তি ঘটল। বিনা বিচারে যে কোনো নাগরিককে আটক রাখার ক্ষমতা মহান সংবিধান পুলিশকে দিয়েছে।’ জেলমুক্ত হয়ে হাসান অফিসে এলে সবাই সন্দেহ করে এমনকি ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিলুও। বিমর্ষ হয়ে স্বগৃহে ফিরলে হাসান আরো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। স্ত্রী ফারিয়া ওরফে রিয়ার সন্দেহতীরে হাসান ক্ষতবিক্ষত। রিয়া কোনোমতেই হাসানকে গ্রহণ করতে চায় না। তুমি আমায় ছুঁবে না। কিচ্ছুতেই ছুঁবে না। রাস্তার মেয়ে মানুষের কাছে যাও। তোমার হাতে নোংরা লেগে আছে, তুমি একটা খারাপ লোক।’ এমনকি শেষতক ডিভোর্স লেটার ফাইল করে। নিদারুণ জীবনবাস্তবতা হাসান-মস্তিকে গভীর ক্ষত তৈরি করে। তীব্র জীবনযন্ত্রণায় বিকারগ্রস্ত হলে হাসানকে অবশেষে মানসিক অ্যাসাইলামে ভর্তি করা হয়। এই হলো ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ উপন্যাস-আখ্যানের সময় ও সমাজ বাস্তবতা। মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাচেতনার প্রসার খানিকটা বিলু ওরফে বিলকিসের মধ্যেও সমভাবেই সুদৃশ্যমান। বিলু ভাবে, আকলিমা এখন কোথায়? আকলিমার সেই শিশু বেঁচে আছে কিনা? নাকি বেথেলহেমের পথে পথে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে; নাকি হামাসের রকেটের বিস্ফোরক হয়ে পিতার অনুসন্ধানে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে যাচ্ছে; নাকি বুকের সাথে বোমা বেঁধে নিয়ে আদম বোমা বিস্ফোরিত হয়ে যাচ্ছে। কয়েক শতাব্দী ব্যাপি ফিলিস্তিনি সংকট ও সমস্যা আকলিমার চেতনায় হাজির দেখতে পাই। ফিলিস্তিনি জনমানুষের জন্মান্তরের অসহায়ত্ব আকলিমাকেও খানিকটা অসহায় করে তোলে।

৩.
হাসানের চিন্তাপ্রবাহে রাজনীতিও কম জায়গা জুড়ে নেই। এদেশ থেকে সেদেশ, একাল থেকে সেকালের রাজরাজাদের আচরণ হাসানের চেতনাপ্রবাহে সমতালেই প্রবাহিত। সাদা চামড়ার রাজরাজারা তো বণিকবেশেই এসেছিল। প্রায় দুশ বছর দেশ শাসন করেছিল। সহায়সম্পদ লুটেপুটে সাগর পাড়ি দিয়েছিল। দেশ শাসন এখনো কি লাভজনক ব্যবসা নয়? হাসান ভাবে স্বদেশি শাসককুল অর্থকড়ি লুণ্ঠন করলেও দেশেই রেখে দেবে, বিনিয়োগ করবে। শোনা যায়, এখনো নাকি টাকা বিদেশে বেড়াতে যায়, সেফহোম বানায়। রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি। রাজার বিরুদ্ধে অপরাধ আর ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অপরাধের শামিল। নায়কের এসব নানাবিধ চিন্তাস্রোতের সঙ্গেসঙ্গে কাহিনির বুননবিন্যাসে মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংযুক্ত করে দিচ্ছেন সুগভীর চিন্তাদর্শন। কেউ তো আর বেশ্যা হয়ে জন্মায় না, সমাজ বেশ্যাা বানায়’, প্রত্যেক বাড়ির মধ্যেই তো আলাদা আলাদা মিলনের ঘর থাকে, মানুষের মিলনের দরকার না থাকলে, আলাদা ঘরের ধারণার বিলুপ্তি ঘটতো’, সকল প্রাণের মধ্যেই মৃত্যুর বীজ লুকিয়ে থাকে’ ইত্যাদি।

৪.
হাসান অথবা বিলু ওরফে বিলকিসের চেতনাপ্রবাহ মূলত লেখকের নিজস্ব চেতনাপ্রবাহ। এই মানবীয় চিন্তাচেতনা লেখকের অন্তর্জগতে সম্ভবত দীর্ঘদিন নদীর স্রোতধারার ন্যায় প্রবহমান ছিল। সেটি প্রকাশের জন্যই উপন্যাস-আখ্যানের ন্যায় শিল্পাঙ্গনে আগমনটা জরুরি ছিল, জরুরি ছিল এমন একটি প্লটের। মূলত নিজস্ব চেতনাই মজিদ মাহমুদ নায়ক চরিত্রের অন্তর্জগতে শৈল্পিক পথপদ্ধতিতে প্রতিস্থাপন করে দিয়েছেন। তবে মজিদ মাহমুদ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর (১৯২২-১৯৭১) ন্যায় কোনো একটি একক বিন্দুতে স্থির থাকছেন না। বরং ক্রমান্বয়ে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছেন। চরবিলকাদা থেকে ফকিরাপুল অথবা মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা থেকে বেইজিং, রবীন্দ্রনজরুল থেকে পূর্বকালের প্রাচীন জীবন ও জনপদের সঙ্গে মিলিয়ে সমাজ সভ্যতার সংঘাতে মানবিক বিপর্যয়ের এক দালিলিক বয়ান আলোচ্য উপন্যাস-আখ্যানে উপস্থাপিত। পুরাণপ্রসঙ্গে লেখকের সুদৃষ্টি সমভাবেই হাজির দেখতে পাই। রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার গান্ধর্বমতে বিয়ে, সাফামারওয়া পর্বতে মা হাজেরার দৌড়ানো, নবী লুৎসহ তাঁর কন্যাপ্রসঙ্গ ইত্যাকার ইসলামি মিথের সঙ্গে মিলিয়ে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য পুরাণপ্রসঙ্গের সংশ্লেষে গ্রন্থকাহিনি ক্রমান্বয়ে শিল্পপরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি-অর্থনীতি, বিশ্বপরিবেশ-পরিস্থিতি, জনস্বাস্থ্য, স্বকাল-পূর্বকাল, স্বদেশ-বিদেশের নানা জন ও জনপদ, দিক ও দিগন্তের কোল ঘেষে কালান্তরের সঙ্গে সংযুক্তির শিল্পপ্রয়াস সুদৃশ্যমান। গীতাউপনিষদ, বেদবাইবেল, রামায়ণ-মহাভারত, হোমার, রবীন্দ্রনজরুল থেকে জীবনানন্দ দাশ পর্যন্ত বিপুল ব্যাপ্তি নিয়ে এ এক মহাকাব্যিক অভিযাত্রা। সে যাত্রায় সহযাত্রীরূপে পাঠকেরাও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে বলে মনে করি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১), শহিদুল্লাহ কায়সার (১৯২৭-১৯৭১) অথবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের (১৯৪৩-১৯৯৭) উপন্যাস আখ্যানের সঙ্গে একই পংক্তিতে বসবার উপযুক্ত এই শিল্পকর্মটি। নিঃসন্দেহে সময়ই সুবিচারক। আপাতত গ্রন্থ ও গ্রন্থাকারের জন্য অফুরন্ত শুভাশিস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *