ছোটগল্প

ঈদসংখ্যার গল্প।। জলডুমুর।। রেদওয়ান খান

ইদ্রিসের হাঁটার ভঙ্গিতে একটা ঢলক ঢলক ছন্দ আছে।
লোকেরা বলে থাকে, ইদ্রিস কোরানি এট্টা কোল-ভেঙ্গুইরা (নারিকেল কুরানোর আশ্চর্য শিল্পদক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ– ‘কোরানি’ উপাধিপ্রাপ্ত!)। ছোটকালে,জননী-কোলে থাকতেই, তার পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ অনেকখানি বেঁকে গিয়ে,পরবর্তীকালে সেটা স্থায়ী হয়ে গেলে, হাঁটার ভঙ্গিতে এই– ‘কোল-ভেঙ্গুইরা’ তাল-লয়ের বিশেষ ছন্দটি চলে আসে। আরও পরে, সুন্দরী ছলেমাকে বিবাহের পর,ডাকাতিয়া নদীর মতো ভালোবাসায় থই থই মনটি বউটির জন্য দারুণ মায়ায় উথলে উঠলে, ভেজা ভেজা ধোঁয়া-ওড়া রসুইঘরে বসে, অবিরাম শ্রাবণের দিনে, নারিকেল কোরানির মরচে-ধরা রঙ-এর লোহার চিরল চিরল ধারালো দাঁতে, সেই সঙ্গে নিজের এক হাত লম্বা জিহ্বার চোখাগ্রটি নাকের ডগা পর্যন্ত বিলম্বিত করে খুব নারিকেল কুরিয়েছিল সে– ইদ্রিস কোরানি। তখন, স্বামীর ভালোবাসায় অন্তরে স্নিগ্ধতা হেতু নয়া বউ ছলেমা, কী যেন কি– এক প্রকার শিন্নী রাঁধার শখে লাজুক ঘোমটাটি টেনে, গোলপাতার ছাউনি দেয়া রসুই ঘরটিতে খুব শরমিন্দা হয়ে একটুখানি মিটিমিটি হেসেছিল। কারণ, তার সোয়ামীটা জানি কেমন! বেহায়া বে-লাজা বেডা এট্টা, বউয়ের ন্যাওটা! যদি মুরুব্বিরা দেখে ফেলে, কী-রকম এট্টা বিরাট লাজের ঘটনা অইব! বেডা মানুষ কি এইসব বুঝে না কিচ্ছুই! ও মা গো মা– জামাইডা সত্যই বে-লাজা, বে-শরম, নিলাজ আর বেকুপ! বউ-জামাইয়ের এইসব একান্ত বিষয় নিয়ে উঁকি মারার লোকের অভাব নাই। ফলে বৃষ্টির দিনে ইদ্রিসের নারিকেল কোরানোর ছলে বউয়ের আঁচলতলে একটুখানি ঢঙ– মানুষের সহ্য হয় না। মানুষের চোখ নারিকেল কোরানোর লোহার দাঁতের থেকেও ধারালো। তবে দিনকানা কুরকিআঁন্ধা দাদি-শাশুড়ি, হীরামন বেওয়া, তাঁর ঝিঁঙার বিচির মতো ছোট ছোট পান-চুনে ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত বের করে, নাত-বৌ ছলেমার তল পেটে, সায়া-কাপড়ের কুঁচির একটু উপরে, মরে যাওয়া শক্ত, যেন বাদুড়– কালচে নখ-ডগায়, একদা হয়তো সে-নখটিও জীবিত ছিল– একটা খোঁচা দিয়ে বলেছিল, ‘এ্যাতো ঢঙ করো কা গো– নাতবৌ! ও লো– ও সাজুনী বাজুনী বেডি, জোয়ান মরদ এট্টু আট্টু ঘেউ ঘেউ করবোই। তুমি লাই না দিলে ত এই কুত্তা আগানে-বাগানে যাইবো! নতুন বিয়ার পুষ্পগন্ধ তো! এট্টু ঘুর ঘুর করবোই। অলদি-মেন্দি-পুষ্পগন্ধ হুগাইলে আর কি দিবা, কও? অহনই সময়, কুড়িতে যহন বুড়ি অইবা তহন আর কি দিবা– কও ত, ঢঙ্গী মাতারী! মরদ বেডার লগে এমুন সাঁইয়া সাঁইয়া কইরো না, বুঝছো? এক কালে আমাগোও যৈবন আছিল, হুঃ!’

শেষের দিকে হীরামন বেওয়ার কণ্ঠে অতীত হারানো বেদনারা ঝরে– যেন বৃষ্টি।

বুড়ির ঠাট্টা-তামাশায় ভিতরে ভিতরে মুচকি হাসলেও, পেটের চামড়ায় গুঁতা দেয়ায় একটু বিরক্ত ছলেমা। কারণ, সুঁড়সুঁড়ি লাগে না বুঝি! সুঁড়সুঁড়িতে হাসতে হয়, কারণ, নয়া বউদের বিরক্তিপনা প্রকাশ করতে নেই। দাদি শাশুড়ির মতো ঠাট্টার সম্পর্কের লোকেরা সোনামুখি সুঁই দিয়ে খোঁচা দিলেও সেটা নিরবে হজম করাই নয়া-বউয়ের পক্ষে একটা রীতি। ছলেমা মনে মনে কয়– ‘ইস! বুড়ি ঢঙে বাঁচে না! মা গো, এই বেডি অহনও মরে না– কা!’
ইদ্রিসের দাদি হীরামন বেওয়া চিরকালই রসে টইটম্বুর। বুড়ির মেলা বয়স হইছে। বংশ বিস্তারে তাঁর দক্ষতা ছিল সুবিদিত। নয় ছেলে-মেয়ে সহ নাতিনের ঘরের পুন্তি, পুন্তির ঘরের খুন্তি, খুন্তির ঘরের মন্তি, মন্তির ঘরের জন্তুর (!)– ইত্যাদি নানান প্রজন্ম দেখেও, তাঁর জীবনের সাধ মিটে নাই, পৃথিবীতেই র’য়ে গিয়েছেন। পুত্র-কন্যারা অনেকেই এখন ইহজগতে নাই।তাঁর নাতি ইদ্রিসও মা-বাপ খাইছে কোনকালে! সুতরাং দাদির কথায় আসকারা পেয়ে, তখন ইদ্রিস কোরানিও, মনে মনে না-বলে পারে নাই– ‘বউডা আসলেই ঢহের গো! ঠিক নয়াবাড়ির মাজুদা’র লাহান সোন্দর! এক্কেবারে হোঁয়ার (শসা) দানা! এই গেরামে এমন অলদা (হলদে) সোনারঙ আর আছে মাজুদার। মাজুদার লাহান সোন্দর মাইয়্যা তিরুভুবনে নাই!’

জন্ম অভাবে অনটনে আকালের কালে,ফলে ইদ্রিস ছোটকাল থেকেই,খাঁ বাড়ির,খাঁ বাড়িকে কেউ কেউ ‘নয়াবাড়ি’ বলে থাকে– রশীদ হাজীর ঘরে কামলা দেয়। বাঁন্ধা কামলাগিরি– জমিজমা দেখাশোনা আর হাজী সাহেবের গরুটা পালে, গরুর জন্য ঘাস কাটে, তিনকোণা পুকুর থেকে কচুরির ডাউগ্গ্যা আনে, লবণ-কুঁড়া দিয়ে ভাতের ফেন খাওয়ায় সন্ধ্যাকালে। কিন্তু সেই বৃদ্ধা হাঁড্ডিসার গাই-গরুর পোঁন্দে চমড়া নাই, সেহেতু লোকেরা গীত গায়– ‘হাজী সাবের দামড়ী পোঁন্দে নাই চামড়ী!’ কিন্তু যেহেতু মাতৃত্বই জীবন– কিছুদিন আগেই একটা নাড়ীছেঁড়া বিয়ানি দিছে। সেই কঙ্কালিনীর ওলানের নীচে, দুই হাঁটুতে বালতি চেপে ধরে, নিজের জিহ্বাটি মুখের বাইরে উগরে দিয়ে, জিহ্বার মাঝ বরাবর জুতসই একটা কামড় বসায় ইদ্রিস, তারপর মহাপৃথিবীর মতো গোল চোখ বিস্ফারিত করে দুধ দোয় ইদ্রিস। চেষ্টার ত্রুটি নাই,গাইয়ের দুধের বোঁটা ফেটে যায়,চিঁড়িৎ চ্যাঁৎ করে সামান্য সাদা দুধের ছিঁটা বার হয়, কখনও-বা, অজস্র টোল-পড়া পুরনো সিলভারের বালতিটির তলায় ফেনা জমে,ইদ্রিসের ঠোঁটের দুই কোণাও ফেনায় উৎরায়। হাজী সাবের স্ত্রীর ‘গাইভাগ্য’ ভালো না– দুধমুধ কিছুই দেয় না। এ-কারণে, কথায় কথায় জয়তুন বিবিকে সময়-অসময়ে নাঁকি কান্না কাঁদতে দেখে লোকেরা, যারা হাসির খোরাক পেতে আঁন্দায়-ছাঁন্দায় ওঁৎ পেতে থাকে এবং মুখে মুখে শ্লোক-ধুয়া রচনায়ও দক্ষতা দেখায়ঃ ‘কতায় কতায় কাঁন্দে বেশী মাজুদার মায়’– তারা সকলেই নিজ নিজ প্রতিভার সুখানুভূতিতে সুঁড়সুঁড়ি টের পায়। কারণ, জয়তুন বিবি তখনও ইনিয়ে বিনিয়ে বলে যাচ্ছিলেন–

-‘ও ইদ্দিছ, মাকা কবিরাজরে এট্টু খবর দে, কইয়া আয় আমার লগে দেখা কইরা য্যান গাইডারে পানিপড়া দিয়া যায়। গাইডারে মনে অয় আলগা বাতাসে পাইছে। নইলে দুধ দেয় না কা রে, ইদ্দিছ! মাকারে না পাইলে মুন্সীবাড়ির ছেরা মুন্সীরে আমার কতা ক’বি। গাইডারে পানিপড়া দিয়া গোছল করাইতে অইবো।’ এ-কথা বলে জয়তুন বিবির চোখ ভিজে উঠলে ইদ্রিসের বুকেও, তিন ভুবনের মায়া ডুকরে ওঠে। কিন্তু শিমুলসুরের লোকেরা নিষ্ঠুর, কসাই, কঠিন পাথর। মাজুর মারে নিয়া তারা শোলক বানায়– ‘কতায় কতায় কাঁন্দে বেশী মাজুদার মায়! হাজী সাব এই কতা হুনলে, দিবো নি তোগো সাউয়্যা ভাইঙা!’

-‘হ অ অঃ! বল্লে– ওই য্যান কইছিল!– মাকা কবিরাজে ‘হুমা’ (ফুঁ) দিলে ‘আজী’ সাবের মরা গাইয়ের দুধে বান-জোয়ার আইবো,না বাল আইবো! গরুরে খালি কচুরির ডাউগ্গ্যা খাওয়াইলে গরুর ওলানে দুধ অইবো! আচনক, তাজ্জুক কতাবাত্তা– পানিপড়া!’ এসব বলে লোকেরা আসমানের দিকে চোখ বুঁজে বিড়িতে সুকটান দেয়। তাহাদের সুতীক্ষ্ণ স্মরণে আছে– হাজী রশীদ ও তাঁর স্ত্রী জয়তুন বিবি এই গেরামের সবচে’ কিপ্পন লোক, তাঁদের আঙুলের ফাঁক দিয়া কখনও পানি পড়ে না।

রশীদ হাজীর অপরূপা কন্যার নাম মাজুদা। মাজুদার চেয়ে বয়সে এবং সম্পর্কে বড়,তাই ইদ্রিসও, মাজুদাকে নাম ধরে ডাকে– ‘ও মাজু!’ লোকে বলে, পিতলা খাতির করার জন্য মাজুদার মা জয়তুন বিবিকে ‘মা’ বলে ডাকে ইদ্দিছ কোরানি। কিচ্ছু না! চাইল-ডাইল, আটা-আলু, তিল-তিশি, লাল মরিচের ধাঁন্ধা।

কিন্তু শিমুলসুর গাঁয়ের লোকেরা দুনিয়ার বজ্জাত, হিংসুট্ট্যা। তারা মন্তার দোকানে বইস্যা কুট্টুর কুট্টুর কইরা টোবা বিস্কুট কামড়াইতে কামড়াইতে জিহ্বা, গাল, দাঁত ও দাঁতের মাড়ি ব্যথা করে চাবাইতে চাবাইতে, নিকষ কালা কালা রয়না গোটার কষের লাহান আখের গুড়ের চা-য়ে চুমুক দিতে দিতে কয়–
-‘হালার ইদ্দিছ কোরানি এট্টা ভোঁচমা কালা, পাইছে একখান বউ, মাশাল্লা– য্যান হোঁয়ার (শসা) বিচির লাহান সোন্দর!’
-‘ঠিক কতা। বউডা য্যান বানেছা পরী গো! আল্লায় কারে যে কি দেয়, বুঝিটুঝি না কিচ্ছু!’
-‘হালার পুতে এট্টা ভাইগ্যমান। ইস্সি রে! হালার টেংরা কালা কোল-ভেঙ্গুইরার বিলাতি বউডা! এইডা কোনো শইল্ল্যে সয়– ক’!’
-‘এইসব কইয়্যা কি লাভ, ক’? কলিকালে কী অইবো এইডা ত আগেই জানি! আ-পতে পত অইবো, আ-ঘাটে ঘাট!’

এই নিয়ে গবেষণার অন্ত নাই। কারণ,গাঁও আর গবেষণা– এক অর্থে পরস্পর জোড়ভাই– জীবনের সমান্তরাল দুইটি ধারা, পাশাপাশি গলা ধরাধরি করে হাঁটে। নিবিড়-মগ্ন গবেষণার ফাঁকে ফাঁকে কেউ কেউ ইদ্দিস কোরানির বউ ছলেমার বুকের চিঁটচিঁটে তিল্লিপড়া কাপড়ের স্ফীতি ও ধুপ্পুর ধুপ্পুর কম্পন-তুফান দেখতে ভালোবাসে, ঢেঁকির পাহারের মতো সে-কম্পন– একেকটা য্যান টুসটুসে জলডুমুর, তার ঘটিহাতা বেলাউজের দমঠাঁসা-ফাঁসের ভেতর থেকে হাতা-উপচানো কচি লাউডুগী হাতের গোছা দু’টি দেখে লোলুপ হয়ে ওঠে। অথবা,কখন ছলেমা, বড়ঘর আর রসুইঘরের দো-আঁন্ধা চিপায়, কিংবা কাঁঠালতলার আড়ালে– যেখানে কাঁঠালের ডাল ছাপিয়ে এবার সবুজ ‘মুচি’ এসেছিল আর সুপারিপাতায় ঘেরা কীট-কিলবিল মুতনীখানায় যায়– এসব উড়ক্কু খবরে চোখ কান খোলা রাখে। তাদের আগ্রহ, আলোচনা-সূত্রের অভাব হয় না কখনও। তাহাদের পক্ষে এ এক অনন্ত তৃষ্ণা, বৈজ্ঞানিক গবেষণাতুল্য বিষয়।

বৃষ্টি-টানা শ্রাবণে লোকেদের কাজ-কামের রফাদফা। পাটের আঁশও তোলা যাচ্ছে না। পুকুরে, ডাকাতিয়ার খালে জাগ দেয়া পাট পঁচে যাচ্ছে। পাটপঁচা গন্ধে বাতাস ভার হয়ে থাকে কয়েকদিন। মেঘ মেঘ মেঘ। একটানা বৃষ্টি বৃষ্টি, অবিরাম বাদল। খনখনা রোদ ছাড়া এ্যাতো পাট আঁশ ছাড়াইয়া শুকাইবো ক্যামনে– এই চিন্তায় তারা যার যার অবস্থানে গৃহবন্দী, গম ভাজা চাল ভাজা খেতে খেতে, টিনের চালে ঝম ঝম বৃষ্টির বাজনা শুনতে শুনতে, ঝিমানো চোখে শ্যাওলা-পিছল উঠান দিয়ে যেতে যেতে, পাশের ঘরের জানালা দিয়ে এট্টুখানি সকৌতুকে নিজ নিজ ওদানো কল্লা বার করে ঠিকই দেখেছিল– ইদ্দিছ কোরানি কেমন করে তার থুঁতনিটা পোড়া কাষ্ঠবৎ উদাম দুইটা ঠ্যাং-এর আঁটুতে (হাঁটুতে) ঠেক দিয়ে কী ভয়ানক মনোযোগে সোন্দরী বউয়ের জন্য নারিকেল কুরিয়েছিল! গোলপাতার ছাউনি-দেয়া, ইদ্রিসের রসুইঘরে, ঝমঝম বৃষ্টিতে টুমটুম ঝুমঝুম পানি গড়িয়ে পড়ে– সে-ছিল তাহাদের, ইদ্রিস-ছলেমার এক ধ্যানগম্ভীর দ্বৈত-মজমা।

যেহেতু দশ মাসেরও বেশী সময় গর্ভধারণের পর, যন্ত্রণার অবসানে সুখ– প্রথমেই, এক্কেরে পয়লা নম্বরেই সুযাত্রা– কন্যা সন্তান উৎপন্ন করেছিল ইদ্রিসের ‘শসার বিচির মতো সোন্দর’ বউটি– ছলেমা। তাই, ডাকাতিয়া গাঙ্গের ঢলে প্রায় তলিয়ে যাওয়া শিমুলসুর গাঁয়ের উত্তর-পূর্বে, পুরানবাড়ির লোকেরা ইদ্রিসের উদ্দেশ্যে বলেছিল–

-‘হারামজাদা ইদ্দিচ্ছার ভাইগ্যডাই ভালা, পয়লাই এট্টা মাইয়্যা অইছে!’
-‘কাইল্লা বেকুপটা কী ভাইগ্যমান গো! হম্বন্দীর পুতের পোন্দের নাই ছড়, সে করে লক্ষ্মীপূজা! কলির খেইল আর কারে কয়! কী তিলিছমতি কাণ্ডকারখানা!’
-‘আহঃ! আল্লায় যারে দেয় তারে ছপ্পট মাইরা দেয়। হালার আমাগো ভাইগ্যে শবে-বরাতের কোনো বরাত জোটে না! ইদ্দিচ্ছারে ত কুনোদিন দেহি নাই পচ্চিম দিগে ফির‌্যা এট্টা আছাড়ও খাইতে, শবে-বরাতের নমাজ ত দূরের কতা, শুক্কুরবারেও পচ্চিমবাড়ির এজমালি মচ্ছিদে কি সে গ্যাছে কুনোদিন?

-‘না যায় নাই।
-‘কিল্লাই যাইবো? নমাজের নিয়ত ছুরা-ক্বেরাত কিছু জানে নি কিচ্ছু ইদ্দিচ্ছায়! এট্টা মুক্ষু! আকামের কুড়মা! মুইত্যা নেয় না পানি, যাইবো মচ্ছিদে!’
-‘হা হা হা। কী? মুইত্যা পানি লয় না! তাইলে ত অইছে নমাজের কারবার! তাতে কি! তারই ত বরাত-ভাইগ্যে আগুন, তোগো কোনো সমস্যা আছে?’
-‘ওই-ই! এ্যাতো চিল্লাইচ না ত তোরা। এগুলি সবই অল্লাতাল্লার হুকুম, বুঝলি? খালি খালি কাবা কাবা করছ তোরা। বাল ছাল ফাও কতা– যত্তোসব!’

কন্যা কুলছুমা থিরথির ঝরঝরা হয়ে উঠলে, একটু বড় হয়েছে বিধায়, এখন পুটপুট টুন্নুর টুন্নুর কথা কয়, তার নামে,লোকেরা প্রচলিত লৌকিক নিয়মে ইদ্রিসকে যখন ডেকেছে– ‘ও কুলছুমার বাপ’, তখন বুকের তলাটায় এট্টা কলিজা জুড়ানো শান্তি অনুভব না করে পারে নাই ইদ্রিস। লাইয়াপিঁপড়ার কামড় খেয়ে খাঁয়গো বাড়ির বাগান থেকে মোহনভোগ বা সিঁন্দুরী আম চুরি করে খাওয়ার মতোই,সে ডাক–‘ও কুলছুমার বাপ!’– বড়ো আরামপ্রদ মনে হয়েছিল, এ-যেন মেঘলা দিনে শসাখাট্টার মতোই সুমিষ্ট। কিংবা এ-রকম তো হয়েছেই বহুবার–

-‘আঁন্ধাইর‌্যা রাইত দুপুরে থবর থবর কইরা কে-ও,যায়? কই যায়!’
-‘আঁই কুলছুমার বাপ!’ নিজের নাম ‘ইদ্দিস’ বলার চেয়ে ’কুলছুমার বাপ’ বলার ভেতর এক তুলতুলে মায়া-তাবিজের মতো ইদ্রিসকে বিমোহিত করে রাখে, সে ভুলে যায়– তাল গাছে এট্টা ভূত থাকে। তবে ইদ্রিস নিশ্চিত, ‘কুলছুমা একদিন পরী অইবো। পরীর লাহান সোন্দর। জম্বির মা’র কালা-লেদি’র লাহান পাতিলের তলার কালি অইবো না আমাগো মাইয়্যা!’

ইদ্রিসের প্রতিবেশী, জম্বি’র মায়ের ছোট মেয়েটির নাম বিবি মরিয়ম– মরিয়ম ফুল। গায়ের রঙটা ঘুঁটঘুঁটে কালো। শিমুলসুর গাঁয়ের লোকেরা সব কিছুটেই বিকৃতি খুঁজে পেয়ে আনন্দ লাভ করে। ফলে যে-মেয়ের নাম ‘মরিয়ম ফুল’ তারে কয়– ‘কালা লেদি!’ তুলনা রচনা করে ইদ্রিস, ‘আঁর ঝি’য়ে কালা লেদি না, টুকটুইক্কা সোন্দর অইবো আল্লায় বাঁচাইলে।’

-‘ও কুলছুমার বাপ, এ্যাতো রাইতে কি সোনাপুরের হাঁট বইছে নি– হ্যাঁয়? না-কি তালগাছের ভূতে পাইছে তোমারে, হ্যাঁয়!’
-‘নাহঃ ও, কাগা! এ্যাতো ঝড়ি-বিষটি অইলো, গরমডা ত যায় না। এট্টু হাওয়া খাই। গরমে ঘরে থাহন যায় না ও, কাগা। শইল জ্বলাপুড়া করে। শইল ভিজ্জা ছুপছুফা।’

কুলছুমার বাপের যে রাইত দুপুরে ওয়াপদার রাস্তায় খাড়াইয়া শীতল হওয়া খাওয়ার সঙ্গে বিড়ির পোন্দে গরম সুকটান দেয়ার অভ্যাস– একথা সবাই জানে। বিড়ি টানার নিরবচ্ছিন্ন ছন্দে, ইদ্রিসের থুঁতনিতে এক থোকা কালা কালা খোঁচা খোঁচা ছাগলাদাঁড়ি ওঠানামা করে, কয়েকটা দাঁত নাই, দুই গালের কানসা গর্তে ঢুকে গেছে সেই কবেই। হয়তো কোনো এক সইত্যকালে সেই দুই গালেও চকচকে মোলায়েম গোস্ত ছিল। এখন ডুবে গেছে কিংবা জ্বলে-পুড়ে কুঁচকে ঢুকে গেছে কানসার খোঁড়লে।

ইদ্রিস যখন নিশি-রাইতে উদাম গায়ে হাওয়া খায়, তখন, লোকে বলে,তার সোন্দরী বউ ছলেমার ঘরে সিঁধ কাটে গাঙকূল বাড়ির হুক্কা মিয়া। কথাটা ইদ্রিসের কানে যায়। সে, ইদ্রিস– একটা নির্লিপ্ত হাসি দিয়ে কয়, ‘ধুয়ো ধুয়ো! এগুলান কি কতা কন আঁন্নেরা! অসইভ্য কতাবাত্তা!’

লোকেরা আরো বলাবলি করে, ইদ্দিচ্ছাই তার ঘরে হুক্কা মিজিরে ঢুকাইয়া দিয়া বাইরের শিকলডা আটকাইয়া রাইত দুপুরে হাওয়া খাইতে বারায়। ইদ্রিস এ-কারণে, মনে মনে সিদ্ধান্ত না নিয়ে পারে না– একদিন লোকেদের থোঁতা মুখ ভোঁতা করবে ইদ্রিস! এ উদ্দেশ্যে নিজের জিহ্বায় একটা কামড় দিয়েছিল, ‘হারামখোর হগল!’– বলেছিল নিজের সঙ্গেই।
-‘তুই এট্টা মিত্যুকের মিত্যুক রে ইদ্দিছ। এ্যাল্লেই তোর বেগ্গ্যুন দাঁত গ্যাছে এই বয়সেই। মিছা কতা কইলে অল্প বয়সেই দাঁত পইড়্যা যায়।’
ইদ্রিস এসব কথা শোনে, তবে বুঝতে পারে না,সে অক্ষম– কার লগে কী মিছা কথা সে কইছে! কার মাথার তালুতে তার দোষে আসমান ভাইঙ্গা ঠাটা পড়ছে!
সম্পর্কে একই বাড়ির অন্য ঘরের চাচাতো ভাই, ছেদুন, নিজেদের বরই গাছ তলায়, অধুনা মৃত নেংটা-বোবা রমান আলীর মাজারে রঙিল সামিয়ানা টানাতে টানাতে তিরিক্ষি মেজাজ, সে আচরণে তীক্ষ্ণ, কারণ, নেংটা-বোবা রমান আলী– নামের ইতিহাসটা অজানা– আগন্তুক লোকটি কোন দেশ থেকে এসেছিল কেউ জানে নাই; ছেদুনের ঘরের পাশেই নেংটা হয়ে বসেছিল এক লোক– হঠাৎ এক রাতে, সেই থেকে যায় নাই। কখনও কারো সাথে কথাও কয় নাই। ত্যানা পেঁচানো ধুলিমলিন অণ্ডকোষের থলথলে ঝুলি ও লোমাবৃত লিঙ্গ দেখে বিশেষতঃ শিশুরা, বোঝে নাই– লোকটা ইন্দু না-কি মোছলমান। তবু পরম বিশ্বাসী ছেদুন খেদমত করেছিল, ছেদুনের মুখেই লোকেরা নাম শুনেছিল, নেংটা-বোবার নাম– ‘রমান আলী।’ হুট করেই এক নিশিথে মৃত্যুর পর, ছেদুন-ই রমান আলীর কবর বা মাজারের স্ব-ঘোষিত খাদেম, মাগরিবের আজন হলে চার কোণে চারটি মোমবাতি আর মৃতের শিয়রে আগরবাতি জ্বালায়। নিয়মের ব্যত্যয় করে না।

ছেদুন কোনো এক বিচিত্র কারণে ইদ্রিস কোরানির বিড়ি খাওয়াটা একদম সহ্য করে না। সাদা চামড়ার বিলাতি গায়ের রঙ, ছেদুন ওরফে ছেদুইন্যা, বারোমাসি হুক্কুর হুক্কুর কাশির রোগী। গলা থেকে এক দলা কফ গড়ভড়ৎ করে বরই গাছের গোড়ায় ফেললো, বরই গাছটির যৌবন এখন ঢলঢল, ডগায় ডগায় নাকফুলের মতো সুগন্ধী ফুল এসেছিল, এখন ছেদুনের কফের দলার ঘিন্নায় বরই গাছটির শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। ছেদুন ইদ্রিসের উদ্দেশ্যে বলে– ‘ওই হার্মাইদ, তুই ত খুব সাউয়্যার বিড়ি খাছ, বউয়ের খবর-টবর রাখছ কিছু? তোর বউ, সোন্দরী-বাঁন্দরী ছলেমা বিবি ত ভিত্তে ভিত্তে শ্যাষ– জোগা। আহাঃ রে খোদা, ভিত্তে কিচ্ছু নাই তোর বউডার। হুক্কা মিজি তোর বউরে হলতায়,শুলুক মারে– এইডা জানছ নি কিছু তুই! হার্মাইদের ঘরের হার্মাইদ! খাড়াইয়া খাড়াইয়া বিড়ি চোদাও! চোৎমাতের দামড়া এট্টা!’

-‘আইছে ছেদুইন্যায় হেঁডার কতা নিয়া।’ মনে মনে এসব অশ্লীলতা উচ্চারণ করে ড্যাবডেবিয়ে ছেদুনের সাদাটে বিলাইচক্ষুর দিকে তাকিয়ে থাকে ইদ্রিস।

কানাঘুসা চলছিল যে, আইজকাইল ইদ্রিসের বউ ছলেমার লগে গাঙকূলবাড়ির হুক্কা মিয়া রঙঢঙ কইরা কতা কয়। বউ-ঝি’রা ডাকাতিয়া গাঙে বাসন-কোসন ধুতে গেলে, কখনও-বা,সূর্য হেলে-যাওয়া উদাস উদাস সন্ধ্যাকালে, নারীগণ গা-গোসল,দেহ-মাজন করার সময়, ভুঁস করে পাতালপুরীর ডুব থেকে উঠে,যখন তাহাদের জলডুমুর বুকের কাপড় আর বুক তখনও একাকার– দেখেছিল, গাঙকূল বাড়ির হুক্কা, সামান্য দূরেই, কলাগাছের ঝোঁপ-নোয়ানো ছেঁড়া পাতার আড়াল থেকে এইমাত্র সরে গেল– য্যান এট্টা খাটাশ না-হয় বাগডাশ। কখনও-বা, হুক্কা মিয়াকে দেখা যায় ইদ্রিসের দাদার আমলের অতি প্রাচীন চৌচালা ঘরের পিঁড়ায় দাঁড়িয়ে বকমার্কা সিগারেট ফোঁকে– কিংস্টর্ক। সিগারেট-জ্বলা আগুনের মতোই হুক্কার চক্ষুজোড়া সারাক্ষণই জ্বলে,কাছে দূরে স্পষ্ট।

হক্কুার বাড়ি গাঁয়ের এক কোণায়, সুনসান বাতাসে দোলে,লোক সমাগম কম, যেখানে একমাত্র শব্দ,নদী তীরে– হেমাঙ্গ মাঝির খেয়া নায়ের বেঠায় ওঠানামা করে, সেখানে, খেয়াঘাটে, একটি মাত্র মহাবটবৃক্ষ মহাকালের সাক্ষী– হুক্কাদের এ-তল্লাটে রাস্তাঘাট দোকানপাট নাই, বাঁশের চিক্কন সাঁকো পার হয়ে গাঙকূলবাড়ির পুরুষেরা দিনভর জমিনের কাজ শেষ করে এসে এ-দিকটাতেই আড্ডা দেয় বা জুম্মাবারে নামাজ পড়তে আসে পশ্চিমবাড়ির প্রাচীন এজমালি মসজিদে। শেষে ইদ্রিসদের পুরানবাড়ি সংলগ্ন ওয়াপদা মাঠের কোণে তবি’র বাপের মুদি দোকানের সামনের বাঁশ-সুপারি গাছের বেঞ্চে বসে বা মন্তাজ আলী ওরফে মন্তার চায়ের দোকানে অনন্তকাল ধরে গপসপ করে। চাঙ্গা হয়। এভাবেই গাঁয়ের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে এঁদের আত্মীয়তার যোগসূত্রটি টিকে আছে বহুকাল, যেহেতু মুরুব্বিরা একে অপরকে ‘এই-ও, মামু!–’ বলে সম্বোধন করে পরস্পর আত্মায় এক পরম তৃপ্তি অনুভব করে।

নাভির নীচে বিশেষ কায়দায় কুঁচি দিয়ে ধুতির মতো শাদা লুঙ্গি পরে হক্কুা মিয়া,তার লুঙ্গির নিচের অংশ– কাছা, মাটিতে লেচড়ায়। ধুলাবালি, পক্ষীর গু, পোকামাকড় তার লুঙ্গির কাছায় আটকায় বা পায়ের দামী বাটার জুতায় পেঁচায়। তবু তার লুঙ্গির ভঙ্গি পাল্টায় না। ওয়াপদার কাঁচা রাস্তাটাকে যেন সে, হুক্কা,চিনতেই পারছে না এমন ধাক্কা মেরে মেরে হাঁটে– ধুলায় একাকার হয়। তাকে নানান ধাঁন্ধায়, লুঙ্গির গোছা বাঁ-হাতে উঁচিয়ে ধরে ‘সেন’-এর ভঙ্গিতে শিমুলসুর গাঁয়ের পথ দিয়ে হাঁটতে হয়, ফলে হুক্কার কালা কালা ঝুলানো অন্ডকোষ দেখে ফেলার লজ্জায় ক্রীড়ারত নষ্ট খোকারা হি হি করে হাসে– কিন্তু হুক্কাকে তো শিমুলসুর বিদ্যালয় সভা, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ বা চান্দ্রাবাজার-বাগড়াবাজার যেতে হয়। বাঁ-হাতের দুই আঙুলের চিপায় সারাক্ষণ বকমার্কা সিগারেট জ্বলে, মুখের ছিদ্র বড়, ঠোঁট ভারী, সিগারেটের আগুনের তাপে ঠোঁট পুড়তে পুড়তে অঙ্গার– যেন দু’খানি বিকট, বাঁকানো আঙরাকাঠের ঠেঙা। চোখ রক্তজবা। দেখলেই মনে হয়,সে,হক্কুা– কিছুক্ষণ আগেই কোথাও, ডাকাতিয়ার ওপারে চরমেশার চরে– কাউকে খুন করে এসেছে। হক্কুাকে দেখলে বেশির ভাগ লোকই ভয়ে হোক, ঘৃণায় হোক কিংবা ঘোরতর কোনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সন্দেহে– আড়চোখে আড়চোখে চায়।

রাত্রিকালে হক্কুা, শহর থেকে ফেরার পথে, বৃদ্ধ সেরাজ আলীর রিকশা টুংটুং করে নয়াবাড়ির পুকুরের পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় ইদ্রিস কোরানি কান পেতে থাকে। আসলে ইদ্রিস হুক্কার অপেক্ষায় বসেই ছিল, পুকুরপাড়ের জ্বিনবাঁধা তালগাছের তলায়। কারণ, দুপুরেই হুক্কা তাকে আড়ালে ডেকে বলেছিল–

-‘তুই নয়াবাড়ির নমাজের মাচাডায় থাহিস, এট্টু কাম আছে।’

ভৌতিক তালগাছের কাছেই নয়াবাড়ির নমাজের ছোট্ট মাচা। নমাজের সময় বাদ দিলে, লোকেরা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে কিংবা ফকফকা চাঁন্নি রাইতের মায়ায় পড়লে এই মাচায় এসে জড়ো হয়। গামছা কাঁধে ফেলে বসে। গালগল্প করে। বিচার-আচারও করে দু’চারটা।

-‘টাউনতন আইতে আমার এট্টু দেরী অইবো। পাট্টি অফিসে মিটিং আছে। তুই থাহিছ।’

গাঁয়ের রাইত অল্পতেই গভীর, নিঝঝুম, নিরাকার। দূরে,চৌরাস্তার দিক থেকে রিকশার নিচে ঝুলবাতি-জ্বলা হারিকেনের আলো রাত্রিকে সাকার করে তুললে, সেরাজ আলীর রিকশাটা থামিয়ে, তার একমাত্র নিশিযাত্রী হক্কুা মিয়াজি, ইদ্রিসের হাতে একজোড়া কলার আঁতি-বাঁধা বড় বড় ইলিশ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল–

-‘নে রে ইদ্দিছ, বউ-ঝি নিয়া খাইছ। কি খাছ না খাছ তোরা। তোর দাদিও ত আমারে দেখলে ঠাট্টামাট্টা করে রে ইদ্দিছ। বুড়িরও কিছু ভালামন্দ খাইতে মন চায়! বাঁচবোই-বা, আর কয়দিন!’

এ-সময় হক্কুা মিয়ার চোখ দু’টি যেন তার হাতের আঙ্গুলের চিপায় জ্বলা সিগারেটের আগুনের মতোই দৃষ্টিভেদী হিংস্র আগুনের দুই ফুলকি। সে-দৃষ্টিতে ইদ্রিসের সামান্য ভয় হয়। হুক্কা মিয়ার চোক দুইডা বেতাল লাল। কি জানি কী– ছাতানাতা খাই্য়্যা আসে চাঁনপুর শহরের কালীবাড়ি, মেথরপট্টি বড় স্টেশন থেইক্যা,কে কইবো। আঁন্ধারে, রিকশার পা-দানির তলায় টিমটিম হারিকেনের আলোয়, রিকশাচালক সেরাজ আলীও, গায়ে ঘাম-ভেজা ছেঁড়া গেঞ্জি, কোমরে গামছা বাঁধা– ইদ্রিসের হাতে হঠাৎ লটকানো ইলিশের ঝলক দেখে ভেবেছে, পালবাজার গিয়ে একটা ইলিশ কিনবে। তার মনের কথা পরানে ডুব দিয়ে আছে। বলা হয় নাই।

তালগাছটির উপরে তখন গোলগাল পুন্নিমার ঠাণ্ডা চাঁন ঝুলছিল। ফলে,চাঁন্নিতে ইলিশ মাছগুলো রূপার থালার মতো ঝলকে উঠলে, ইদ্রিস চমকে উঠে খুশিতে একগাল হাসে। তারপর লম্বা জিহ্বাটার ডগা সাপের মতো বার করে নাকের আগায় ছুঁয়ে দিয়ে, য্যান কৃতজ্ঞ আহ্লাদিত কুত্তা লেজ নাড়ছে– এ এক আনন্দ প্রকাশের ভাষা। ইদ্রিস একটু কোড়ামুড়ি দিয়ে, তখন ইলিশের আঁশ পুনরায় চমকে উঠে ঝিলিক মারে, সে বলে–

-‘ঘরে আইতেন না, হুক্কা ভাই? এট্টু পান খাইয়্যা যাইতেন!’
-‘আইচ্ছা, যামু। তুই অহন যা। পরে আমু। তোর বউরে গিয়া ক’– কাঁচা সুপারি, হাকিমপুরী জর্দা দিয়া পান বানাইতে। কাম সাইর‌্যা আমি আমু।

এর আগেও, হুক্কা ভাই তার বউকে এট্টা টকটকইয়্যা রঙ্গিলা ছিট-ছাপার মালা শাড়ি দিছিলো। কুলছুমারেও দিছিলো এট্টা পেলাস্টিকের পুতুল, পুতুলের পেডে টিপ দিলে পোঁ-ও-ও-ও করে বাজে। হুক্কা কাঁচা কাম কম করে। তার বউ-বাচ্চাকে উপহার দিয়ে ইদ্রিসকে একটা ধমক দিয়ে বলেছিল–

-‘ওই বেকুবের ঘরের বেকুব, ইদ্দিছ কোরানি, আকামের ঢেঁকি– কেউ জানি না জানে, বুঝলি কিছু?

ধমক খেয়ে ইদ্রিস জিহ্বায় কামড় দিয়ে ঘাড় কাৎ করে সম্মতি-অসম্মতির মাঝামাঝি একটা ভঙ্গি করে কি যেন কী– কাজের উসিলায় ঢলক ঢলক ছন্দে হেঁটে গিয়েছিল।
পুতুল পেয়ে ছোট্ট কুলছুম দুধদাঁত বার করে বলেছিল– ‘বাবা বাবা, এতা আমাল পুতুল!
ছলেমাও,খুশি না হয়ে পারে নাই। শিমুলসুরের রমণীগণ অল্পতেই খুশি হতে ভালোবাসে। একটা কুমকুমের কৌটায় ভরা থাকে তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাওয়া-আকাঙ্খাগুলো। তাদের স্বামীরা সবাই কুমকুম বা হিমকবরী তেল কিনে দিতে পারে না। বর্ষাকালে বেদে নাও ভইরা বাইদ্যানীরা– তাদের কোমরে রূপার চওড়া বিছা, গলায় সাতনরী, খোঁপায় তারার ফুল– নদীতে নাও বেঁধে, হেলে দুলে শিমুলসুরে আসে। তাদের ঝাঁপিতে ভরা থাকে সাত রাজ্যের স্বপ্ন। ছলেমা ও তার অন্যান্য জা বা দাদিরা বেদেনীগণের ঝাঁপি ঘিরে ভিড় করে, লোলুপ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে, কিনতে পারে না। নীরব হাসিই সেখানে একমাত্র সম্বল। কারণ, তখন, তাদের নাকের গহ্বরের মাঝের পর্দা থেকে ঝুলানো পুরনো রূপার নোলক সামান্য নড়ে উঠেছিল।
তখন তালগাছতলার পুন্নিমায়ও, হুক্কার চোখকে জ্বিনের চোখের মতো জ্বলতে দেখে ইদ্রিস। তাড়াতাড়ি ইলিশমাছ দু’টির কাসনা-বাঁধা কলার আঁতির আংটায় ধরে, লেজের দিকটা ওজনের ভারে প্রায় মাটি ছোঁয় ছোঁয়– এ-রকম ঝুলিয়ে নিয়ে প্রায় দৌড়েছিল সে। কারণ, ততক্ষণে মনে পড়েছে– নয়াবাড়ির তালগাছে জ্বিন-ভূত গিজগিজ করে। আর কে না-জানে, জ্বিন-ভূতেরা মাছের গন্ধে পাগল হয়।
ছলেমা সেই পদ্মার ইলিশ পেয়ে– কুলছুমাকে নিয়ে একটু শুয়েছিল, মাইয়্যা দুধ ছেড়েছে অনেক আগেই, তাও দুধের বোঁটায় হাত দিয়ে ঘুমাবে,খাটাশ মাইয়্যা বড়োই জ্বালায় গো– এখন ঘুমে এক্কেবারে নরম তুলা– হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে এসে রসুই ঘরের কুপিটা জ্বালিয়ে এট্টু হাসে। তখন ছলেমার নাকের ক্ষুদ্র রূপার বালীটিও, যেন কুপির আলোয় কথা কয়ে ওঠে–

-‘দিনের কালে আনলে কি অয়, হ্যাঁয়! রাইত দুফুর কইর‌্যা ইলিশ মাছ নিয়া আইছে,মিনসে।’
তারপর ক’খান পেঁটির টুকরা আর ইলিশের ডিম কড়া করে ভাজছিল, ইদ্রিসের ইলশে-সুখি বউটি। ছলেমা এখন আবার পোঁয়াতি। পেট ভার। মনে আশা– এইকালে য্যান এট্টা পোলা অয়। মাছ ভাজতে ভাজতে পুনরায় সে কয়–

-‘রাইত কইরা কই পাইলেন এ্যাতো বড়, ডাঙ্গর ডাঙ্গর ইলিশ!’ লাকড়ির আগুনে ছলেমাকে মনে হয় যেন একটা শামুক-গেলা থলথলে হাঁস। পেট যেন চুলার মুখ ছোঁয় ছোঁয়– এমনভাবে নেমে এসেছে।
আরো কি যেন বলতে গিয়েও বলা হল না ছলেমার, ওই ঘর থেকে তখন, দাদি শাশুড়ি হীরামন বেওয়া চিল্লায়–
-‘আমারে এট্টু ইলিশ মাছের আন্ডা দিও গো, ও নাতবৌ!’
ততক্ষণে ইদ্রিস এক টুকরা ভাজা মাছ নিয়ে ফুঁ দিয়ে খেতে শুরু করে। খাওয়ার চেয়ে ইলিশের গন্ধেই পাগল হওয়ার জোগাড়। ছলেমার কথার উত্তর করে না, বা শোনেই না ইদ্রিস, কারণ, তখন ইলিশের গন্ধ বড়ই আচানক। চুলায় মান্দারের লাকড়ি-জ্বলা আগুনে ইদ্রিসের চোখের মণির ফ্যাকাসে ভাবটা এখন নাই,বরং ইলিশানন্দে জ্বলজ্বল করছে। দিনের বেলা তার দু’চোখের মণিতে স্বচ্ছ আয়নার বদলে কী-রকম একটা মরা চাঁন্দের লাহান কানা কানা আঁন্ধা আঁন্ধা ভাব থাকে। সে-চাহনীতে খুশি হওয়ার মতো কিছু থাকে না,থাকে ডর। শিশুরা ডরায় ইদ্রিসের চোখকে। ছলেমাও, প্রথম প্রথম ডরায় নাই– এমন না। ডরাইছে, ‘মিনসের চোক য্যান মরা মানুষের চোক!’

তবে ছলেমাও জানে,জানে না যে এমন না– কে দেয় এটা সেটা, কোত্থেকে আইয়্যে ইলিশ মাছ। ছলেমার ভাল লাগে ঝোল ঝোল ইলিশ। হলদে-রঙ ঝোল ঝোল ইলিশের গন্ধে মাথা ঘোরে না কার? স্বামীকে আরেক টুকরা পোড়া পোড়া ইলিশের ডিম তুলে দিয়ে নিজেও এট্টু খায়। কুলছুমাডা জাইগ্যা গেলে আবার ট্যাঁ ট্যাঁ শুরু করবো, তাই এট্টু তাড়া আছে তার। রাইতও কম অয় নাই। মুরুব্বিরা কয়, রাইত-বিরাইতে ইলিশ মাছ ঘরে আনাই অন্যায্য কাম। ইলিশ মাছ লগে কইর‌্যা আলগা বাতাস নিয়া আসে। সেই বাতাসডা ভালা না। গরম।

-‘কী গো,কুলছুমার মা! দিলা না আমারে এট্টু ইলিশ মাছের আন্ডা!’ হীরামন বেওয়ার ঘুম নাই। বাঁশের চোঁঙায় ছেঁচা পান জাবর কাটতে কাটতে ইলিশ মাছের পোড়া পোড়া গন্ধে রাত দুপুরে বুড়ীর মন খানিক উতলা।

ইদ্রিসের দাদি হীরামন বেওয়ার আরেক সঙ্গী– চার কুড়ি দশ বয়সের, ছোট্টোখাট্ট কুট্টি বুড়ি– চিঁডার মা, এক চোখে ছানি কাটার দরুণ ময়লা তুলা পেঁচানো, অন্যচোখে ঠিক ঠিক ঠাওর করে বলতে পারেন– এ-বাড়ির কে কোন চিপায়, আঁন্দায়-ছাঁন্দায়,নাড়ার ভুরে, গুয়াগাছতলায়– কি কি করে। পাশের ঘরের চিঁডার মা, সত্যকালের খড়ম পায়ে টকাস টকাস শব্দ তুলে এ-ঘর ও-ঘর, এ-উঠান, ও-উঠান হেঁটে বেড়ান আর বলেন–

-‘ইদ্দিচ্ছার সোন্দর বউডা আগে ভালাই আছিল– ভালারে ভালা না কইলে আল্লা বেজার অন। তয় আইজকাইল হুক্কারে য্যান ঘন ঘন দেকলাম কুলছুমার মা’র লগে, চঁইগাছতলাডায়! মাগরিবের ওক্ত গাঙকূল বাড়ির হুক্কা মিয়া কুলছুমার মা’র চঁইগাছ তলায় কি কামডা করে গো– হ্যাঁয়! ইদ্দিছ বেকুপডা কি কিচ্ছু চোহে দেহে না! চোক্ষের বাইলপাতা কি নাড়ার আগুনে পোড়া দিছে, হ্যায়? হারামজাদা বেকুপের ঘরের বেকুপ এট্টা। হীরামন বুড়ীর নাতি এট্টা আধলিও না, পাজামাও না– এইডা আবার কি জন্তুর গো!’

ইলিশ ভাজার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে হীরামন বেওয়া তাঁর নাতবৌ-এর নামে এইসব কানাঘুসার জপ করছিলেন মনে মনে। তিনি নিজেও হুক্কারে দেখেছেন বেশ ক’বার, ইদ্দিছের বউয়েরও শইল্যের অবস্থা ছিল বেতাল। তয় হুক্কা তাঁকে বহুকাল ধরেই– ‘চাচি চাচি’ করে আহ্লাদ করে।

গাঙকূল বাড়ির হুক্কা মিয়া দ্যাশের রাজার যেই দল, কয়দিন আগেই, হেই রাজদলের মিটিং-এ গলা ফাটাইয়া মাইক ভাইঙ্গা ‘জয় বাঙলা’ কইছে। লোকেরা হাত তালি দিয়া কয়, আমাগো গেরামে কেউ ভোডে খাড়াইলে একমাত্র হুক্কা মিয়াজি ভোড পাইবো। কিন্তু ভোটের সুচিক্কন হিসাব মানুষের অন্তরে স্থিত। মানুষের কৌতুহল দৈর্ঘ্যে জয় বাঙলার চেয়েও ঢের লম্বা, তেজী– কারণ, না অইলে, হেই বেডার লগে– হুক্কার লগে, ইদ্দিছের বউ ছলেমা বিবির সম্পক্ক্যডা কি? আর হাঁইজ্যা রাইতে, চুল ছাইড়া চঁইগাছতলায় (সীম গাছ) কি কামডা মাইয়্যা মাইনষ্যের? এই রকম প্রশ্নের উত্তরে লোকেদের অনুমান কখনও অসত্য হয় না। সত্য অনুসন্ধানে লোকেরা সর্বদাই, নিরন্তর পরিশ্রমী হয়ে থাকে।

চুল ছাইড়া সন্ধ্যা রাইতে মেয়ে মানুষের বাইরে বেরোনো নিষেধ। এ-সময় জ্বিন-পরী দেও-দৈত্য-দানা, শতানেরও, আজানের শব্দ শুনে ভয়ে পেট খারাপের দশা– তারা পাদতে পাদতে দৌড়ায়। সোন্দরী মেয়ে মানুষ একবার এদের সামনে পড়লে রক্ষা নাই। আজ হোক কাল হোক আছর করবেই। তবে ইদ্রিসের বউ ছলেমা ওরফে কুলছুমার মাকে বানেছা পরীরা না ধরলেও, হুক্কা মিয়ার কু-নজরে যে ধরেছে, এতে কোনো সন্দেহ কারো ছিল না, একমাত্র ইদ্রিস কোরানি ছাড়া। কারণ, তার বউটি শসার বিচির লাহান সোন্দর। গাঁয়ের মাইনষ্যের মনডা বড়ো বেশি কয়লা-আঙরা। একেকটা গুয়াগাছতলার কৈ মাছ।

ইদ্রিস কোরানি, তার লম্বা জিহ্বাটা বার করে একটু হেসে বউকে বলেছিল -‘ও কুলছুমার মা, হলদা জরীর চিলিক-মারা লাল শাড়িডা পইরা হাঁইজ্যা কালে ঘরের বার অইয়ো না তুমি, মাইনষ্যে খারাপ কয়। জ্বিন-পরীর ভয়ও কি নাই তোমার? তুমি কি জানো না, এলিয়াছ খাঁ’র মাইয়্যা রহিমারে হাঁইজ্যাকালে কাঁন্ধে কইরা উড়াইয়া নিছিলো বানেছা পরী। এই হেদিনের ঘটনাডা, মনে নাই! ভুইল্যা গেলা!’
রহিমার গল্প শোনে নাই– এমন লোক শিমুলসুরে নাই। বিয়ার পর, রামচন্দ্রপুর থেকে বাপের বাড়িতে ফিরতি আইছিল রহিমা। দিনভর মায়ের সাথে নয়াপুকুরের আঠালো মাটি দিয়ে ঘর লে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *