ছোটগল্প

ঈদসংখ্যার গল্প।। আমি খুনি কিন্তু অপরাধী নই।। ফরিদুল ইসলাম নির্জন

‘সেদিন এজলাসে দাঁড়িয়ে যখন আমার ফাঁসির কথাটি বিচারকের কাছে শুনতে পেলাম, তখন হৃদয়ের শেষভাগে বত্রিশ ফিট সিডর বয়ে গেল। এজলাসে দাঁড়িয়ে চিৎকারে গলা ফাটিয়ে বললাম মাই লর্ড, আমি রূপাকে খুন করে ভুল করিনি। আমি রূপাকে খুন করে কোন পাপ কাজ করিনি। ওর মত পাপী মেয়েকে ভালবেসে আমার জীবনটা হয়েছিল কচুর পাতার উপর থাকা পানির মত। মাই লর্ড আপনি আমাকে এ শাস্তি দিবেন না। তাহলে আর এই নশ্বর চলতে পারবে না। আসমান ভেঙ্গে জমিন তছনছ হয়ে যাবে। পাহাড় পর্বত সব জমিনের সাথে মিশে এককার হয়ে যাবে। এই নশ্বরকে কেউ ভাল চোখে দেখবে না। সবাই ঘৃৃণার চোখে দেখবে। কেউ বিশ্বাস করবে না নিজেকে, সবাই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। আজ আমার পাশে থাকা সকল মানুষকে আমার দহনের ইতিহাস শুনতে হবে। অন্তরালে লুকিয়ে থাকা মনের গহীনে আগ্নেয়গিরির কথা, ক্ষোভের পাহাড়ের কথা আছে যা আমি বলতে পারিনি। কিন্তু আমার ফাঁসির রায় শোনার পর আমি নিঃশ্চুপ থাকতে পাড়লাম না। আমি স্থির থাকতে পারলাম না। আমার হৃদয়ের জমানো সব কথা বেড়িয়ে আসছে।’
সুমনের আর্র্র্তনাদ মাখানো কথন শোনার পর এজলাসের পাশে বসে থাকা সবাই বিস্মিত চোখে তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। তার নয়নে আষাঢ়ে ঢল শুরু হয়েছে। বিচারক রায় শেষে সভাকার্য ত্যাগ করলেন। তাকে গুটিকয়েক পুলিশ এসে হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে গেলেন।
সুুমনের পরিবারের সবাই স্ট্যাচু হয়ে বসে। চোখের জল যেন শুকিয়ে চৈত্রের মোহনায়। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
দোষটা সুমনের বেশী ছিল না। তবে সে অপরাধী। সে আদালতের রায়ে একজন ফাঁসির আসামী।
তখন সুমনের বয়স এক কুড়ি এক বছর। সে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র । কোনো এক বসন্তের বিষন্ন বিকেলে, সে বসে আছে আনমনে। মনের ভেতর বেদনার গ্লানি মুছে ফেলতে, কোকিলের সুরতান শুনতে একটু ছায়ানিবির পরিবেশে বসে আছে। ঢাবির কলা ভবনে গাছের সারি, শান্ত পরিবেশ আর বসন্তের কোকিলের কলতান একটু মনকে প্রশান্তি রাখার প্রচেষ্টা। মনটা অকারণেই খারাপ হয় কেনো, এমন প্রশ্ন নিজেই নিজেকে করছে। পিছন থেকে দুটো মেয়ে বলছে, এক্সকিউজ মি ভাইয়া?
সুমন একটু বিরক্তিভাব নিয়েই ফিরে তাকায়। মনের গহীনে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ক্ষণিক সময় একা একা পার করার কোনো পথ নেই। তারপরও ভদ্রতা দেখিয়ে বলল, আমাকে বলছেন?
আপনার আশে পাশেতো কেউ নেই। আপনাকেই বলছি। একটু কথা বলতে পারি?
জি¦ বলেন।
আমরা মীরপুর আইডিয়াল গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে অনার্সে পড়ি। জীব বিজ্ঞানের জন্য আমার একটা জবা ফুল দরকার। আমরা হোস্টেলে থাকি। আমাদের তেমন পরিচিত কেউ নেই। শুনেছি ঢাবির হলে এই ফুল পাওয়া যায়। আপনি যদি একটু উপকার করতেন। জানেন কী এই বিষয়ে?
সুমনের বিরক্তিটা আরো বেড়ে দ্বিগুন। নতুন এক উড়ো ঝামেলা মনে করে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা।
কিছু বলছেন না যে। বলতে পারবেন কিছু?
সরি। আমি এলাকাতে নতুন হওয়ায় আপনাদের সহযোগিতা করতে পারলাম না।
ইটস ওকে। ধন্যবাদ।
মেয়ে দুটো হাঁটতে শুরু করে। সুমন ভাবনায় পড়ে যায়। জবা ফুল কোথায় পাওয়া যায় সেটা বললে এমন কি সমস্যা হতো। মেয়ে দুটো ভদ্র ও রুপসী। যে কেউ তাদের প্রতি দরদ দেখাতে আসবে। একটু আলগা পিরিতির জন্য। কোন বদমাইশের খপ্পড়ে পড়লেতো আবার মেয়ে দুটোর ক্ষতি হতে পারে। তার চেয়ে একটু সহযোগিতা করি। এই যে শুনছেন বলে সুমন মেয়ে দুটোর পিছু পিছু যায়। সরি আমি আসলে আপনাদের মিথ্যা বলেছি। আমি ঢাবির স্টুডেন্ট। জবা ফুল পাওয়া যাবে বিজয় একাত্তর হলের আশে পাশে। তবে দিনে তোলা ঝুঁকি। তাই রাতে তুলতে হবে।
মেয়ে দুটো এই জবাবে একটু থমকে যায়। ভাবতে থাকে এর উদ্দেশ্য নিশ্চয় অসৎ।
সুমন বলল, আপনারা কিছু ভাবছেন ? খারাপ কিছু ভাববেন না। আমি রাতে তুলে রেখে দেব। কাল সকালে এসে নিয়ে যাবেন।
এই কথায় যেন মুখে হাসি ফুটল। মনে একটু স্বস্তি পেল। বিশ্বাসের যায়গা ফিরে এল। সমস্বরে দুজন বলল, ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার নামটা?
আমার নাম সুমন। আপনাদের নামতো জানা হল না।
একজন বলল, ‘আমি অধরা। ফুলটি আমার দরকার । আমার বান্ধবী, নাম লিলি। রাতে আপনাকে ফোন দিয়ে ফুলের খোঁজ নেব।’ বলেই কিছু কথপোকথন শেষে তারা বিদায় নেয়।
রাত দশটার দিকে জবা ফুল নিয়ে হলে ফিরছে। হঠাৎ করে ফোন বেজে ওঠে। সুমনের বুঝতে বাকী নয়, তাকে কে ফোন করেছে। এটা নিশ্চয় অধরা। স্বার্থের জন্য ফোন।
যাইহোক ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে, ‘হ্যালো। সুমন বলছেন।’
‘জি¦। আপনি কে ?’
‘ভাইয়া আমি অধরার বান্ধবী সোমা। শুনলাম অধরার জন্য জবা ফুল সংগ্রহ করছেন। আমি অনেক খুঁজে পাইনি। আপনি যদি একটু আমার জন্য চেষ্টা করতেন। প্লিজ একটু দেখবেন।’
‘আচ্ছা দেখছি। অধরার ফুল এখনো সংগ্রহ করে আমার হলের কাছাকাছি এসেছি। তবে চেষ্টা করবো আপনার জন্য।’
‘আপনি চেষ্টা করলে পারবেন। আর দুঃখিত ফোন দেবার জন্য। আমি রাতে আবার ফোন দেব আপনাকে। ফুল পেলেন কীনা তা জানতে। ভাল থাকবেন।’
সুমন বধির হয়ে গেল ক্ষণিক। মেয়েরা এমনি। সুযোগ পেলে একদম শেষ করে দেয়। অধরা আমাকে না জানিয়ে ফেসবুকে আমর নম্বর লিখে স্ট্যাটাস দিয়েছে। স্ট্যাটাসে লিখেছে, কার কার জবা ফুল দরকার এই নম্বরে যোগযোগ করুন।
সোমার জন্য ফুল সংগ্রহ শেষে রুমে প্রবেশ করে। তার রুমমেট ফুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিরে মানুষ প্রিয়জনকে দেয় রজনীগন্ধা, বকুল আর গোলাপ। তুই কিনা জবা ফুল দিতে হাজির। যদিও সুনীল বিশ^ সংসার তছনছ করে এনে দিয়েছিল ১০৮ নীল পদ্ম। তবুও কথা রাখেনি বরুনা।’
‘রকি, তুই আসলে বেশি বলিস। কোনো ঘটনা শোনা নেই, জানা নেই। উল্টা-পাল্টা কথা বলে যাচ্ছিস।’
‘কোনো কিছু না বললে জানবো কেমনে’ বলতেই সুমনের ফোন বেজে ওঠে। ফোনটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে, হ্যালো। আমি অধরা। প্রথমেই সরি সোমাকে নম্বর দেবার জন্য। খুব জোর করাতে দিয়েছি। আমার ফুল পেয়েছেন।
সমস্যা নেই। আপনাদের দুজনের ফুলই পেয়েছি। কাল সকালে এসে নিয়ে যাবেন।
আমার একটু সমস্যা। রুপালী নামে এক বন্ধু কাল পুরান ঢাকা থেকে ফিরবে। আপনার নম্বর দেব। সে নিয়ে নেবে।
আমার কাল ক্লাস আছে। তাকে সকাল দশটার আগে আসতে বলবেন।
ঠিক আছে। ভাল থাকবেন।
পরেরদিন সকালে রুপালী টিএসসিতে এসে ফোন দেয়। সুমন হল থেকে বেরিয়ে তরিঘরি করে তার কাছে পৌঁছায়। দুজনের কথাপোকথন। তারপর সুমন রুপালীকে দেখে একটু তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়। এযেনো শরতের জোছনা বসন্তে এসে হাজির। রুপের ঝলকে উঠেছে চারপাশ।
‘সুমন বলল, সরি আপনাকে বসিয়ে রাখার জন্য। চলেন চা পান করি।’
‘ঠিক আছে। সমস্যা নেই। একটু অপেক্ষা করতেই হয়। না হলেতো আপনাকে মনে রাখা যাবে না।’
‘একটি মন্দ অভ্যাসের জন্য মনে রাখবেন আমায়। অথচো আমি মনে রাখবো সময় সচেতনতার ভালো অভ্যাস হিসেবে।’
‘বাপরে! অধরা বলল, ‘আপনি কথা বলতে পারেন না। অথচো কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলছেন। এটা আসলে আমাকে দেখে? নাকি অন্যকিছু ?’
‘বাসন্তী এলেতো কোকিল কলতান করবেই। চলেন চায়ের দোকানে।’
‘ঠিক আছে থাকেন অন্যদিন আসবো শুধু চা পান করার জন্য। আজকে তাড়া আছে।’
তাদের ভেতর অনেক কথাপোকথন শেষ হয়। তাকে বিদায় দিয়ে সে বসে। আজ সুমনের ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না। বুকের ভেতর একটু ঢেউ খেলা শুরু হয়। অনেক মেয়ের সাথে মিশেছে তারপরও এমন অনুভূতি কখনো হয়নি। এই অনুভূতির মানে কী। শেষ কোথায়। প্রথম দেখাতে কি প্রেমে পড়ে কেউ। আসলে প্রেমতো প্রথম দেখাতেই হয়।
রাতে ঘুমানোর চেষ্টা বিফলে যায়। একটু যদি রুপালীর সাথে কথা বলা যেতো। এক দেখাতে কেউ পাগল হয় জানা নেই। এই শহরে এতো মানুষ তারপরও রুপালী একজনই।
সুমনের ফোন বেজে উঠে স্কিন দেখে চমকে যায়। এটা রুপালীর নম্বর। সে
বিশ্বাস করতে পারছে না। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল আমি রূপালী সকালে আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। এখন ডিস্টার্ব করার জন্য ক্ষমা চাইছি।
‘কিন্তু আমিতো আপনাকে ক্ষমা করবো না।’
‘কি করা। আমাকে বোধহয় নরকে যেতে হবে। নয়তো বনবাসে যেতে হবে।’
পরিচয়টা এভাবেই। অতঃপর নৈমিত্তিক চলতে থাকে তাদের যোগাযোগ; চলতে থাকে মনের অগোচরের কথা। যার ফলাফল চার অক্ষরের মধুর নাম ভালবাসা। তারা একে অপরকে দেখার জন্য ব্যাকুল। অস্থির হয়ে যায় নিজেদের সমর্পনে।
দুজন দুজনকে খুবই আপন করে নেয়। সমস্যা শুধু একটাই দুজন দুই ধর্মের। কিন্তু এতে নিজেদের আপত্তি নেই। সম্পর্কের ভিতটা আরো মজবুত হতে থাকে। দুজন সব সময় পাশে থাকার জন্য বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবারকে জানিয়ে দেয়। না সূচক উত্তর আসে। রুপার পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েকে অন্য যায়গায় বিয়ে দেবে। সুমনের বাবার কড়া কথা কোন ভাবেই অন্য ধর্মের মেয়েকে ঘরের বউ করে তুলবে না।
ভালবাসাতো থামানো যায় না শর্ত দিয়ে। এক পর্যায়ে তারা কঠোর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করবে। আলাদাভাবে সংসার করবে। তাদের বাবা মায়েদের সব কড়া কথা উপেক্ষা করে শুরু করল নতুন জীবন। চলছিল ভালই। নতুন সংসার। ভালবাসার ভরপুর।
কিন্তু তাদের এই ভালবাসার গতিটা থেমে যায় কিছু দিন অতিবাহিত হবার পর। সুমন চাকরি জীবন শুরু করে। কিছুদিন যাবার পর দুজনের ভেতর একটা পরিবর্তন দেখা যায়। সারা দিন অফিসে শেষে রাত আটটায় বাসায় ফিরে স্ত্রীর মুখ আর আগের মত ভাল লাগে না। প্রতিনিয়ত তাদের সংসারে ছোট খাট বিষয় নিয়ে একটু আধটু ঝগড়া হয়। সুমন কিছুই বুঝতে পারে না এমন হচ্ছে কেন। বিয়ের আগের ভালবাসা আর এখনকার ভালবাসা রাত দিন তফাৎ।
ইদানীং যে সমস্যাটা হচ্ছে রুপা টিকটক ভিডিও ছাড়ে নিয়মিত। শরীর প্রদর্শন, অরুচি অঙ্গভঙ্গিতে টিকটক ভিডিও। এই নিয়ে দুজনের তুমুল ঝগড়া হয়। কথা কাটাকাটি হয়। এভাবে কেটে যায় বেশ কিছুদিন।
রুপার পরবির্তনটা বেশি দেখা যায় রাতে। সুমন যখন অফিস থেকে ফেরে, তখন টেবিলে খাবার দিয়ে রুপা শুয়ে পড়ে। যখন সুমন ঘুমিয়ে যায়, তখন রুপা পাশ থেকে ফোনে ফিস ফিস করে কথা বলে। সুমন ঘুমের ঘোরে সব শুনতে পারলেও নীরবে সয়ে যায়।
একদিন অফিসে গিয়ে ভাল না লাগাতে বাসায় ফিরে আসে। রুম লক করা। লক খুলে রুমে প্রবেশ করে। রুমে দৃশ্যপট দেখে যেনো তার হৃদয়ের গহীনে হিরোশিমার কেমিক্যাল ছিটানো পরের মানুষের মত বিদগ্ধ হয়। তার সেই ভালোবাসার মানুষটি শরীরের স্বাদ পেতে অন্য কাঁচা মাংসের স্বাদ নিচ্ছে। নগ্ন অবস্থায় শুয়ে আছে অন্য অচেনা এক মানুষের সাথে। কাঁচা মাংসের স্বাদে ভুলে গেছে তারা দরজার সিটকানি লাগাতে। সুমন জোরে একটা হুংকার দিয়ে মাছ কাটা বটি এনে সরাসরি রূপাকে ভেদ করে কোপ। অচেনা মানুষটি কোন ভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে পালিয়ে যায় কিন্তু রুপা রক্ষা পায়নি। রুপা জোরে একটা চিৎকার দেয়। পাশের বাসার লোকজন ছুটে আসে কিন্তু তার আগেই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে চলে যায় না ফেরার পথে।
যার অপরাধে সুমনের আজ ফাঁসির রায় হল। সে তার মুখ গহ্বর দিয়ে একটি কথা বার বার বলছে, ‘মাই লর্ড আমি ভুল করিনি আমি ওকে খুন করে ঠিক কাজই করেছি। এটা ওর প্রাপ্তি ছিল। আমার কষ্ট গুলো আপনারা না বুঝলে কে বুঝবে। মাই লর্ড, আমি খুনি কিন্তু অপরাধী নই!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *