কবিতা

নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর এর কাব্যকথা

১.
বনবিড়াল

(উৎসর্গ- প্রয়াত শিক্ষক অধ্যাপক আবুল হাসান)

কোথাও যাবার জায়গা নেই; বন সব হয়েছে উজাড়
কিছু কিছু ঝোপঝাড় ছিল, ছিটেফোঁটাও নেই তার
টিলাটাক্কুর, খাল-বিল, পুকুর, এমন কি নদী— হারিয়ে গেছে সব;
মানবের কাছে প্রকৃতি মেনেছে পরাভব।

যেখানে যা ছিল—ভূমি
নিচু কিংবা উঁচু, আকাশের নীলাম্বর চুমি
সবখানে আজ পর্বতসম ইমারত
গড়ে উঠেছে রেল আর রাজপথ।

ভবন সব দাঁড়িয়ে আছে পর্বতসম, ছুঁয়ে আকাশ
কোথাও এতটুকু নেই মাটি কিংবা সবুজ ঘাস।
আদিম অন্ধকার জমে আছে সুরম্য ভবনের তলে;
আর দেখি, জানালায় অতি সামান্য আলো জ্বলে।

যদি খুঁজে পাই এতটুকু মাটি—
যদি মেলে সামান্য আবাস
কিন্তু জানা নেই, এইসব ভবনে কাদের বসবাস;
বাঁচার আশায় নগরের পথে পথে হাঁটি;

পথ চলতে চলতে টের পাই কার যেন দীর্ঘশ্বাস।
শুনতে পাই, আঁধারের বুকে হিংস্র পশুর হাক
কানে আসে আরও কিছু চেনা পশুর ডাক;
বুঝতে পারি, এ নগরেও জন্তু করে বসবাস।

আমি বনবেড়াল, অকৃত্রিম এক পশু
সামান্য আশ্রয় চাই, দেবেন কেউ?
খেঁকিয়ে ওঠে কেউ করে ঘেউ ঘেউ
দূর হ, যা হতভাগা—
জলদি, দৌড় লাগা,
যদি বাঁচতে চাস, হতভাগা।
বলি, আমাকে একটু দাও ঠায়
প্রাণে বাঁচাই যে দায়।
তোমার জায়গা হবে না, তুমি যাও
বেড়াল হলেও তুমি কর না তো মেউ
স্বাধীনচেতা তুমি, নও কোনো ফেউ
এ নগরে তোমার স্থান নেই, পালাও।
কারা থাকে এ নগরে—তোমরাই বা কারা?
আমরাই তারা, পদলেহন করে বাঁচে যারা।

২.
যা চাই যা হারাই যা থাকা চাই

কথা হচ্ছিল কে কে জীবনে কী কী পেয়েছে আর কী পায় নি
এমন কথাও হচ্ছিল অতি মূল্যবান কী কী হারিয়েছে
বস্তুত পাওয়া না পাওয়া আর হারানোর হিসাব কঠিন কিছু নয়—
বস্তু বা অবস্তুর যোগবিয়োগ মেলানো শিশুদের কাজ।
কার কী কী আছে বা নাই সেই হিসেব থাকে না গোপন
প্রাপ্তির সর্গে বসে আরও কী কী চাই সে হিসেব কষে মহাজন
যতই পাই তবু্ও নাই শব্দটাই অতি মনোকষ্টের কারণ
চাই শব্দটাই সবচাইতে প্রিয় আর বহুল উচ্চারিত শব্দ পৃথিবীজুড়ে
অথচ যাদের কিছু নাই তারাও কিছু একটা নিয়ে বাঁচে
সত্য যে, যখন কিছু থাকে না কারো তখনও কিছু না কিছু থাকে যা মানুষ হারায় না
ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে দেখে মানুষ
অনেক কিছু পেয়েও অমূল্য কিছু হারিয়ে ফেলেছে যা অপূরণীয়
যেমন, মেরুদণ্ড আর শেকড়– যা না থাকলে আর কিছু থাকার দরকার নাই।

৩.
বৃক্ষ খুন হলে পর

বৃক্ষের মৃত্যু হয় না সচরাচর সে খুন হয় মানুষের হাতে
আগে খুন হতো কবিরাজের হাতে মানুষের জীবন বাঁচাতে
বহুযুগ ধরে বৃক্ষকে খুন করে মানুষ প্রাসাদ বা ঘর সাজাতে।
বৃক্ষ খুন হলে নারীর রূপ অপরূপ হয়ে ওঠে সুভাসিত চন্দনচূর্ণ হয়ে
আর কারুকার্যময় দেহাবশেষ মানুষকে সতত প্রলুব্ধ করে।
এমন কি উচ্ছিষ্টাংশ পুড়ে পুড়ে মানুষকে উষ্ণতা দেয়।
বৃক্ষ খুন হলে রক্ত ঝরে না বরং খুন হলে মূল্য পায় মানুষের কাছে।

আর আমার মৃত্যু হলে অথবা আমি খুন হলে মাটিতে পুতে ফেলা হবে দুর্গন্ধ ছড়াবার আগে;
বেঁচে থাকতে আমি কেবল দুর্গন্ধ ছড়িয়েছি চারিদিকে; আর
মৃত্যুর পর পুঁতে ফেলা না হলে পুঁতিগন্ধই ছড়িয়ে যাব যদি—
তবে কেন আমাকে বৃক্ষের জীবন দিলে না হে বিধাতা
না হয় আমি মানুষের হাতে খুন হতাম বৃক্ষ হয়েই।

৪.
খেজুর গাছ

আমি পথের পাশে দাঁড়িয়ে আছি জীবনভর
আমার নেই বাড়ি, হয়নি বাঁধা ঘর—
ছায়া দিতে পারি না বলে লোকে দাঁড়ায় না তলে
পথ চলতে গিয়ে তাকায় না কেউ কমনীয় নই বলে
এমন ঊষর দেহের লোভ কারও হবার কথাও নয়
তবুও যে মনের কথা কইতে আমারও ইচ্ছে হয়!
কেবল শীত এলে আমার কাছে একজন আসে
জড়িয়ে ধরে বুকে বলে সে— ভালোবাসে
আমি তার কথা শুনেও হাসি
বলি, তোমাকেও ভালোবাসি।
আমার রস যারা পান করে আমি চিনি না সেসব রসের মাছিকে
আমি শুধু চিনি আমার ভালোবাসার ধন এক গাছিকে—
সে-ই কেবল আমাকে চেনে—
যে আনে বের করে সুমিষ্ট রস
আমার বুকের ভেতরটা ছেনে।

৫.
উচ্চ পাখি তুচ্ছ পাখি

যারা উঁচুতে উঠে গেছে তাদের নাগাল আর পাব না জানি
মহাশূন্যে উঠে যাক গগনচারীগণ— যারা চূড়ায় উঠতে চায়
তাদের তাড়া আছে, ঊর্ধ্বমুখী, কেবল সম্মুখপানে ধায়
মরিচিকা আমাকেও কখনো কখনো দিয়েছে হাতছানি
মিথ্যে নয়, আমিও কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যেই পৌঁছাতে চাই—
শুধু পথ চলতে চলতে পথের দুপাশে মুগ্ধ তাকাই
যেতে যেতে এই পৃথিবীর যত রূপ শুধু দেখে নিতে চাই
যা চোখে পড়ে পথের দু’পাশে কী আছে কী নাই;
জানি, আমি যে পথ একবার পিছে ফেলে যাব
সে পথ এ জীবনে আর কখনো না ফিরে পাব!
বাজ পাখি সবুজ ছেড়ে নিঃসীম শূন্যতায় শুধু ভাসে
সে আমি নই; আমি তুচ্ছ পাখি, নেচে বেড়াই সবুজ ঘাসে।

৬.
বাজার ও পণ্য

বাজারে কেনা বেচা হচ্ছে হরদম
যার অর্থ আছে কেনে হরেক পণ্য
আর যার পণ্য আছে বেচে নগদে
কেনা বেচার লাভ সবাই বোঝে।
বেচে পণ্য আবার কেনেও সবাই
বেচতে কিনতে কারো ক্লান্তি নাই
কিনতে কিনতে বেচতে বেচতে—
নিজেকেও করে ফেলেছি সদাই।
শরীর বেচা কেনা আগেও হতো
আজকাল যেমন হচ্ছে হরহামেশাই;
আগে মাথা বেচা কেনা হতো কদাচ
গতকাল মাথার মগজ বেচে এলাম।

৭.
সম্পর্ক ও সেতু

একদা নদী ছিল ওটা— যাকে আমরা বলতাম গাঙ
সাঁতরে পেরিয়ে যেতাম ওপারে, তোমার কাছে;
ডুবতে ডুবতে খেয়েছি কত জল
তবুও দেখা হয় নি এর তল
তুমি শুনে হেসে কুটি কুটি হতে
ভরা নদীটার মতোই কল কল;
আমি ভাসতাম তোমার ঢেউয়ের পরে
ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যেতাম তোমার তরে।

এখন আর নদীর বুকে জল নেই শুকনো খাল হয়ে গেছে
স্রোতাবহ যখন ছিল তখন পাটনি নৌকা ছিল
তার পর সাঁকো হলো— সাঁকোর পর সেতু।
বিপ্রতীপ স্রোতধারাই কাছে পৌঁছে দিয়েছিল আমাকে।

জেনেছি অবশেষে পাকা সেতু পার হয়ে নয়—
হৃদয় করতে জয় ভরা নদী সাঁতরে পার হতে হয়।

৮.
পথের শেষ কোথায়?

হাঁটতে শিখে পথের ধারে এসে দেখি শুধু হাঁটছেই না, ছুটছে সবাই
অর্বাচীন আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়েছিল কোথায় যাচ্ছে তারা!
কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় ছিল না
এমন কি তাকাবার ফুরসত নেই কারও
আমিও তখন পথে নেমে তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলাম
কোথায় যাচ্ছে সকলে এ প্রশ্নের উত্তর আমাকে পেতেই হবে
সেই থেকে আমিও ছুটছি আর সকলেরই মতো
জানতে পারি নি আজও যাচ্ছি কোথায়, কেনই বা ছুটছি অবিরাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *