পুষ্পকথা উপন্যাসে আছে জেগে ওঠার লড়াই, পরিশ্রমী মানুষের গল্প।। জুবায়ের দুখু
অবুঝ বালকের মতো মেঘেরা কাঁদছে শীতকালীন ঋতুতে। কোথাও কোনো বৃক্ষে ভেজা নীড়ে বসে ডাকছে পাখিরা। এমন বৃষ্টিবেলায় হৈ-হুল্লোড় করছে উঠোনের কাদামাটি। হলুদ আভায় ফুটে আছে আমাদের দুয়ারে গ্যান্দাফুলগুলো। শিশুরা হাসছে, খেলছে, বাইরে ছুটে যেতে চাইছে, তবে পারছে না। আম্মা দাওয়ায় বসে রান্ধে রাতের সালুন। টিপটপ বৃষ্টি, আহা! বৃষ্টি। কতদিন পর যেন বেড়াতে এসেছে আমাদের সবুজগঞ্জে। সকাল থেকেই রবিধারার আগমন নেই। চারিদিকে কোলাহল নেই মানুষের। গান আর গান বৃষ্টির গান। গ্রামে, যে যার ঘরে বসে– গান গাইছে, খেজুরের পাটোয়ারী দিয়ে চিড়ামুড়ি খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, কেউ বউয়ের সঙ্গে গল্প করছে, আর আমার মতো কেউ কেউ বই পড়ুয়ারা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বই পড়ছে একচিত্তে। কয়েকদিনে আমি বেশ কয়টি বই পড়েছি। তারমধ্যে অন্যতম মোজ্জামেক হক নিয়োগী স্যারের পুষ্পকথা উপন্যাসটি। অনেক স্নেহ আর ভালোবেসে বইটি আমাকে পাঠিয়েছে শ্রদ্ধেয় ফখরুল হাসান ভাই। দুঃখ, কষ্ট, অবহেলা, উপেক্ষা, আশা, বঞ্চনা, স্বপ্ন, হতাশা, ভালোবাসা, নিয়ে গঠিত মানুষের জীবন সংসার। মানুষ আমের মুকুলের মতো। ঝড় এলেই ঝরে পড়ে মাটির বিছানায়। পুষ্পকথা উপন্যাসটিও তরতরে নব আমফুলের মতোই জীবন নিয়ে শুরু। দুটি ফুল কাদের এবং পুষ্প। পুষ্পকথার আগের খণ্ড মূলত ফাঁদ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় দুটি চরিত্র ছিল পুষ্প এবং কাদের। যদিও ফাঁদ উপন্যাসটি আমার পড়া হয়নি এখনো। তবে পাঠের মনোবাসনা রাখি ভরপুর। প্রথম খণ্ড না পড়লেও আংশিক ধারণা পাই দ্বিতীয় খণ্ডে এসে মূল চরিত্র দুটি পুষ্প এবং কাদেরের অতীত স্মৃতিচারণে। অতীতে মানে ফাঁদ খণ্ডে কাদের ছিল সামান্য একজন গেইট দারোয়ান। আর পুষ্প ছিল পতিতাবৃত্তি একজন নারী। গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের অবলা সহজসরল সুন্দরী এক কিশোরী কন্যা ছিল পুষ্প। পেটের ক্ষুধা নিবারণের লাগি ঢাকার শহরে চাকরির আশায় আসে পুষ্প। এসে নিজের ভগ্নীপতি নওয়াব আলীর পাতানো রণকৌশলে শিকার হয়ে একসময় নামতে হয় বেশ্যালয়ে, আবাসিক পুরুষদের মনোরঞ্জনের ব্যবসায়। পুষ্পকথা উপন্যাস ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৪ সাল একটি দীর্ঘ সময় বহন করে এসেছে। যে সময়ে ঢাকার দৃশ্যপট অনেকটা পাল্টাতে শুরু করেছে। বড় বড় দালানকোঠা উঠতে শুরু হয়েছে শহরের আশপাশের নিচু এলাকাগুলোতেও। উত্তাল রাজনীতির মাঠ, সমাজের পরিবর্তন, মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, মানবতা, প্রেম মোহাব্বত, নানাবিধ আটপৌরে লেখা পুষ্পকথায়। ঢাকার অদূরে বিলুনিয়া গ্রামে রমিজা খাতুন আড়ালে একাকী কাদেরের জন্য চোখের জল ফেলে। কাদেরের পিতা সাবুদ আলী যখন জানলো তার ছেলে তাকে না জানিয়েই ঢাকায় বিবাহ করেছে। অনেকটা সেই ক্ষোভে কাদেরকে ত্যাজ্যপুত্র করার সিদ্ধান্ত নেয়। অসহায় রমিজা খাতুন স্বামীর কথার উপর কিছু বলতে পারে না। তাই সন্তানের জন্য একাকী কাঁদে, কখনো মায়ের সঙ্গে সামিল হয় কাদেরের বড় বোন মিনা। যে কি-না বাপের বাড়ি থেকে যৌতুকের বাকি ২০ হাজার টাকা না নিতে পারায় স্বামীর হাতে নির্যাতীত এক নারী। সুখের পরে দুঃখ আবার, দুঃখের পরে সুখ, মানুষের জীবন আসলে এমন। পুষ্পকথা উপন্যাসেও এমন। এই পাতায় দুঃখ হতাশায় ভরপুর, তো অপর পাতায় সুখ শান্তিতে ভরপুর। নানান খুনসুটির মধ্যে বাঁধা থাকে একটি সংসার। কলেজবন্ধু গৌতমের অছিলায় শাহ জোবায়েরের আইসল্যান্ড কার সেন্টারে চাকরি নেয়ার পর থেকেই কাদেরের সংসার উন্নতি। আগের ভূতের গলির বাসা ছেড়ে গ্রামীণ পরিবেশ মেরাদিয়ায় টিনসেটের নতুন বাসা নেয়। পাখির কুঞ্জন, জলের ডোবা, শীত ও বর্ষার ভরপূর্ণ আবহাওয়া মেরাদিয়ায়। ডঃ রাফিয়ার পরামর্শে পুষ্পর অতীত স্মৃতি ভুলিয়ে রাখার জন্য মূলত গ্রামীণ পরিবেশ মেরাদিয়ায় আসা। কাদের চাকরির প্রমোশন হয়। এক সুবেহ-সাদিকের ভোরে হতাশা থেকে বেড়িয়ে আসা সংগ্রামী দম্পতি কাদের এবং পুষ্পর কোল জুড়ে যমজ দুটো ফুল ফুটে ওঠে আলোক ও রশ্মি। আলোক রশ্মি জন্মানোর কয়েকবছর পর পরই সাবুদ আলীর পা ভেঙে যায়। ঢাকার এক হাসপাতালে ভর্তি করে রিনার স্বামী ময়েজউদ্দীনের কাছে খবর শুনে কাদের নিজে এসে। সাবুদ আলী দীর্ঘ চিকিৎসার পর পঙ্গুত্ব জীবন নিয়ে বিলুনিয়া ফিরে আসে। পুষ্প এবং কাদের ও আলোক রশ্মি তাদের সঙ্গে গ্রামে যায়। কাদের এবং পুষ্পর নানান টানাপোড়েনের জীবনে যখন নিজেকে জড়িয়েনিয়েছি। কাদের চরিত্রে দাঁড় করিয়েছি আমাকেই। তখনই এলো পুষ্পকথা উপন্যাসে সবচেয়ে বড় ঝড় প্রাণঘাতী আঘাত। শূন্য দশকের শুরু থেকে দেশের অবস্থা অস্থিকর পরিবেশ, রাজনীতির উত্থান-পতনের আবর্তে মোড়ানো চারিপাশ যা, একটি উপন্যাসে পাঠকের পাঠকে আরও আগ্রহী করে তোলে। মানুষের লালসা হিংস্রের মতন। অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত মোজাম্মেল হক নিয়োগী স্যারের ২৮৮ পৃষ্ঠার পুষ্পকথা উপন্যাসে হিংস্রতার পাশাপাশি আছে মানবতা, বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, জেগে ওঠার লড়াই, স্বপ্ন, আকাঙ্খা, কঠোর পরিশ্রমী মানুষের গল্প। মূল্য: ৫৪০ / অনুপ্রাণন প্রকাশন / প্রচ্ছদ শিল্পী প্রিয় মামুন হোসাইন / নভেম্বর ২০২১ প্রথম প্রকাশ।
জুবায়ের দুখু
সাঁথিয়া সরকারি কলেজ দ্বাদশ শ্রেণীর