ছোটগল্পনির্বাচিত

ছোটগল্প।। এখানে নয় অন্য কোনোখানে।। জাকির তালুকদার

আজও অন্যদিনের মতো সকাল সাতটায় বেরিয়ে গিয়ে রোজকার মতোই সন্ধ্যা বাঁকরে যাওয়ার অনেক পরে বাসে ঝুলতে ঝুলতে মহল্লার স্টপেজে নেমে কাঁচাবাজারে পেঁয়াজ, টমেটো, শসা, কাঁচামরিচ, মানকচু কিনে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন তিনি। তারপর থেকেই অন্যরকম ব্যস্ততা তার। এই শতাব্দীতে এই রকম ফ্ল্যাটবাসী পরিবারে কেউ কাউকে তেমন একটা খেয়াল করে না। ছেলে সদ্য ভার্সিটি শেষ করেছে। ভালো সাবজেক্টে পড়েছে, এবং ভালো রেজাল্ট। চাকরি হয়ে যাবে। এখনই অফার আসছে। ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে-টুরে বেড়াচ্ছে ছেলে। বাসায় ফিরতে একটু রাত হলে কেউ বিরক্ত হয় না। মেয়ে তার নিজের ঘরে। ল্যাপটপ, মোবাইল, হেডফোন নিয়ে মহাব্যস্ত। মা তাকে বিকালের নাস্তা দিয়ে গেলেও সেগুলো টেবিলের এককোণাতেই ঠান্ডা মেরে যাচ্ছে। খাওয়ার ব্যাপারে বেদম আপত্তি মেয়ের। ডিশ টিভির কল্যাণে শ-দেড়েক চ্যানেলের নায়িকাদের স্লিম ফিগার দেখে দেখে এই দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণী-যুবতীদের খাবার দেখলেই বমি আসে। যেভাবেই হোক, নিজেদের ঐ রকম স্লিম রাখার সাধনায় দিনের বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। তার তো অন্যদিকে তাকানোর কোনো সুযোগই নেই। আর তাদের মা তো ছেলে এবং মেয়েকে নিয়ে, সেইসাথে নিজের কিছু সমাজকল্যাণ কর্মসূচি নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকে যে স্বামীকে সকালে নাস্তা আর রাতে ভাত বেড়ে দেওয়া, সন্ধ্যায় চা দেওয়া আর বাড়তি খরচের টাকার জন্য মাঝে মাঝে হেস্তনেস্ত করা ছাড়া স্বামী কী করছে না করছে তা দেখার সময় সুযোগ ও সময় কোনোটাই নেই। ইচ্ছাও নাই বোধহয়। আর আজ তো সন্ধ্যায় তাদের সৌখিন এনজিও-র মিটিং রয়েছে। তাই বাড়িতে মেয়ে এবং গ্রাম থেকে নিয়ে আসা কাজের মেয়েটা ছাড়া আর কেউ নাই। ফলে আলমগীর হোসেনের সুযোগ ঘটে যায় নিজের মতো করে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার। কাজের মেয়েটাকে একবার শুধু চায়ের কথা বলেই নিজের কাজে মগ্ন হয়ে যেতে পেরেছেন তিনি।

কাগজপত্র প্রায় গোছানো হয়েই গেছে। একটা মাস ধরে একটু একটু করে গোছাচ্ছেন তিনি। একটু একটু করে, খুব লুকিয়ে লুকিয়ে, কারো মনে সন্দেহের সৃষ্টি না করে। ছেলে, মেয়ে, তাদের মা─ কেউ জানে না, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিজের সমস্ত সঞ্চয়ের টাকা ভাগ ভাগ করে করে জমা দিয়ে দিয়েছেন তিনি। ব্যাংকের একটা ডিপিএস, আর জীবন বীমার পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হয়ে এসেছে প্রায়। সেগুলোর বাকি কয়েক মাসের টাকা অগ্রিম জমা দিয়ে স্ত্রীকে নমিনি করে কাগজপত্র তৈরি করে দিয়েছেন। বাড়ির পানির বিল, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ। গতমাসে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। বাবা এবং মাকে নিয়মিত খেতে হয় ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস আর বাতের ওষুধ। তাদের ছয়মাসের পুরো ওষুধ কিনে দিয়ে এসেছেন। অন্য ভাইদের জানিয়ে দিয়েছেন পারিবারিক জায়গা-জমি-সম্পত্তি তারা যেমন ইচ্ছা, ভাগ-ব্যবহার করতে পারে। স্ত্রীকে নিয়ে তার চিন্তা নেই। ছেলে-মেয়ে মাকে চালিয়ে নেবে। কাজের মেয়েটাকে গ্রামে ফেরত পাঠানোর কাজটি বাকি আছে। সে ব্যবস্থাও অবশ্য করা হয়েছে। তার বাপকে খবর দিয়েছেন তিনি। আজ রাতেই এসে পৌঁছাবে সে। বছরে দুইবার মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে যায় সে। আজও আসছে সেই রকম নিয়ে যেতে। তার হাতে এবার কিছু বেশি টাকা দিয়ে দেবেন। আর তো মেয়েটার ফিরে আসা হবে না এই বাসায়। কেবলমাত্র কাজের মেয়েটার জন্যেই বুকের ভেতর একটু কষ্টের অনুভূতি এলো। মেয়েটা কেন যেন খেয়াল রাখে তার। বাড়িতে ফিরলেই কাছে এসে ঘুর ঘুর করে। মুখ দেখলেই বুঝতে পারে মন তার খারাপ কি না। মাথা ধরেছে কিনা। মাথার ব্যথাটা তার খুব নিয়মিত সমস্যা। মাঝে মাঝে বেধড়ক বেড়ে যায়। সে সময় বিছানায় লম্বা হয়ে একটু আহ-উহ করলেই কপালের ওপর ঠান্ডা মমতামাখা কিশোরী-হাতের স্পর্শ পাওয়া যায়। কপাল টিপে দিচ্ছে রিনা প্রবল মমতায়। এই দৃশ্যে গা করে না কেউ। বউয়ের তখন বাইরে বেরুনোর সময়। একবার জানতে চায় তিনি প্যারাসিটামল খাবেন কি না। তারপরেই বেরিয়ে যায়।

আজ বাড়ি ফিরতে গিয়ে মনে হলো কতদিন বাড়ির কারো দিকে ভালো করে তাকাননি তিনি। অন্য কেউ-ও তার দিকে তাকায় না বটে, কিন্তু তিনি তো একই কাজ করতে পারেন না। গোছানোর কাজ করতে করতেই একবার মেয়ের ঘরের দিকে এগুলেন। তার ঘরের দরজায় এসে বাইরে থেকে ডাকতে যাবেন নাম ধরে, এই সময় কানে এলো ফোনে কারো সাথে চেঁচিয়ে ঝগড়া করছে কন্যা। যে দুয়েকটা শব্দ কানে এলো, তাতে তিনিই যেন ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মেয়ে ফোনের ওপারের শ্রোতাকে গালি দিচ্ছে স্ট্রিট গার্ল কুত্তি মাগি বলে। এই ভাষায় কথা বলছে তার মেয়ে! কোনো এক ফারহানের সাথে মেয়ের কাইজ্জা বাধানোর চেষ্টা করছে ফোনের ওপারের পেত্নি একটা বুক-পাছাহীন মেয়ে, যার সাথে অ্যানাল ফাকিং ছাড়া অন্য কিছু করতে পারবে না ফারহান বা কোনো মরদ, সেই মাগির এমন সাহস কী করে হয় তার বয়ফ্রেন্ডরে ভাগাইতে আসার! মেয়ে আরো হুমকি দেয় এই বলে যে আমার মায়ের কানেকশন জানোস? রাজা-উজির, আর্মি-আমলারা আমার মায়ের অ্যাডমায়ারার। আমার মারে কইলে তোরে তো তোরে, তোর বাপ-ভাইরে পর্যন্ত রাস্তায় নাক-ছেঁছুড় দেওন লাগব।

মেয়ে তার মায়ের সোশ্যাল পাওয়ার নিয়ে দারুণ গর্বিত! বাপের কথা বলে না। আসলে বাপের যে কোনো স্ট্যাটাস-ক্ষমতা নাই, সে তো ছেলে-মেয়েরাই সবার আগে বুঝতে পারে। আলমগীর হোসেন আলগোছে সরে এলেন মেয়ের দরজা থেকে।

তখনই দরজার বেল বেজে উঠল অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে। এই সময় কারো তো আসার কথা না!
রিনা দরজা খোলার আগে একবার জিজ্ঞেস করে– কে?
খোল!

অস্থিরতা এবং ধমকের মিশেল। ছেলে ফিরেছে। অসময়ে। মুখ থমথমে। আলমগীর হোসেন জিজ্ঞেস না করে পারেন না– কী হয়েছে পাভেল?

বাপকে দেখে বিরক্তির সাথে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি অটোমেটিক যোগ হয়ে যায় চেহারায়। কোনো উত্তর না দিয়েই নিজের ঘরের দিকে এগোয় ছেলে। আলমগীর হোসেনের সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে ওঠে রাগে। এভাবে তাচ্ছিল্য দেখাবে ছেলে! প্রশ্ন করলে উত্তরটা পর্যন্ত দেবে না! দুই পা এগিয়ে তিনি পথ আটকান ছেলে। খুব ঠান্ডা গলায় প্রশ্নটা করেন আবার– কী হয়েছে?

ছেলে তীব্র বিরক্তি নিয়ে বাপের মুখের দিকে তাকায়। তারপরেই পরিবর্তিত হয়ে যায় তার মুখের চেহারা। বিরক্তির বদলে বিহ্বলতা, একটু ভীতিও। এমন কিছু একটা আছে বাপের ভাবলেশহীন মুখে যা বহুবছর দেখেনি পাভেল কিংবা বাড়ির কেউ। তার মুখে কথা জোগায় না।

একই ভঙ্গিতে আলমগীর হোসেন জিজ্ঞেস করেন– কী হয়েছে?
বাংলা লিঙ্কের চাকরিটা আমার হলো না।
তাতে কী হয়েছে? একটা চাকরি হয়নি, আরেকটা হবে।

আর হবে! ছেলে এবার একটু একটু করে নিজেকে ফিরে পাচ্ছে– কানেকশন ছাড়া করপোরেটে বড় চাকরি হয় না বাবা। আমি কানেকশন কোথায় পাব?

ঠিকই তো। আলমগীর হোসেন হেসে ওঠেন শব্দ করে– তোর বাপকে কে চেনে? চিঠি পেতে হলেও ঠিকানাতে কেয়ার অফ দিতে হয় তোর মায়ের নাম। এমন অনামা বাপ দিয়ে চলবে না রে। তার চাইতে বদলে ফ্যাল!

মানে? ছেলে বুঝতে পারেনি বাপের কথার পুরো তাৎপর্য।
তিনিও পুরোটা বোঝান না। শুধু আবার বলেন– বদলে ফ্যাল!

এবার ছেলের মুখ লাল হয়ে যায়। বুঝতে পেরেছে সে। নির্বিকারভাবে আলমগীর হোসেন বলেন– জীবনে উপরে উঠতে গেলে মানুষের কত কিছু করতে হয়! এ আর এমন কী? তবে অসুবিধা হবে না।

বলতে বলতে নিজের ঘরে চলে এলেন তিনি।

ঢাকার ভানুর কৌতুক কেউ কি এখনও শোনে? তাহলে সেই গল্পটা মনে পড়ার কথা। ট্রেনের মধ্যেকার ঘটনা। কথা হচ্ছে বিভিন্ন যাত্রীর সাথে ভানুর। একজন জিগ্যেস করল ভানুর গ্রামের নাম। ভানু বললেন। শুনে সবাই তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, এটা কোনো নাম হলো? বদলে ফেলুন। ভালো কোনো নাম রাখুন গ্রামের। ভানু তখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন বাপের নাম। শুনে বললেন, পুরনো কালের নাম, জঘন্য শোনায়। বদলে ফেলুন বাপের নাম।

আলমগীর হোসেন মনে মনে বলেন– পাভেল, খোকা আমার, আমার বাবার নাম ছিল সেফাত মিয়া। লেখাপড়া না জানা মাটি-আঁচড়ানো কৃষক। আমার ছোট চাকরিটা পাওয়ার জন্যে বাপের নামের প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু তোকে যে অনেক উপরে উঠতে হবে। করপোরেটের সিঁড়িতে পা দিতে হলে বাপের আইডেন্টিটি থাকতে হবে। বদলে ফ্যাল! বাপের নাম বদলে ফ্যাল!

তারপর তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে নিজেকেই নিজে শুনিয়ে বললেন– সব ঠিক হয়ে যাবে রে বাপ!

বউ ফিরতে ফিরতে তার গোছানো শেষ হয়ে গেছে। সেগুলো জায়গামতো লুকিয়ে রাখার কাজটাও। রেহানা ফিরল এগারোটা পেরিয়ে যাওয়ার পর। প্রথম প্রথম রাত আটটা হলেই আলমগীর হোসেন কথা শোনাতে চাইতেন। ঘরের বউয়ের এমন রাতচরা স্বভাব কোন স্বামীরই বা ভালো লাগে। এখন কিছু বলতে গেলে বউ উল্টো কথা শোনায়। আজ নিজে থেকেই রেহানা জানায়– রাত একটু বেশিই হয়ে গেল। তবে অসুবিধা হয়নি। তাহমিনা গাড়িতে করে নামিয়ে দিয়ে গেল।

তাহমিনার গাড়ি আছে, রোকেয়ার গাড়ি আছে, মেহেরুনের গাড়ি আছে, এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলারের গাড়ি আছে, আরো কত গাড়ি আছে রেহানাকে লিফট দেবার! তাকে নিয়ে আলমগীর হোসেনকে কোনো চিন্তাই করতে হয় না। রেহানাও তাকে হিসাবে আর গোনে না। মাঝে মাঝে সংস্থার চাঁদা, পার্টিড্রেস, বিউটি পার্লারের টাকার জন্যে নেহাত হাত পাততে হয় বলেই না স্বামীর সাথে বাতচিত হয়। নইলে কে কথা বলতে আসে তার সাথে! কয়েক বছর ধরে স্বামীর সবকিছুই তার কাছে খারাপ লাগে। আলমগীর হোসেনের গায়ে নাকি বোঁটকা গন্ধ। বিছানায় শুতে গিয়ে নাক কোঁচকায় রেহানা। মনে মনে আলমগীর হোসেন বলেন– মাসে মাসে তোমার পারফিউমের সাড়ে তিন হাজার টাকা দেওয়ার পরে দিনে একবার মাত্র সাবান ঘষার টাকা থাকে আমার কাছে। কিন্তু বলেন না। বললেই রাতটাকে চেঁচিয়ে মাছের বাজার বানিয়ে দেবে রেহানা। তিনি নির্বিকারে একটা কাঁথা-চাদর নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়েন। তখন আবার রেহানার আরেক রূপ– ‘ঢং করতে হবে না। মেঝেতে শুলে বুকে ঠান্ডা লাগবে। ঠং ঠং করে দিনরাত কাশবে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা গুনতে হবে ডাক্তারের পেছনে, ওষুধের পেছনে। বিছানাতে উঠে শোও বলছি।’ তো সেই কথা শুনে বিছানাতে উঠে আসা। ঘুম গাঢ় হতে না হতেই ধাক্কা। কী হলো? ‘এমন ছাদ ফাটিয়ে নাক ডাকালে পাশের মানুষ ঘুমাতে পারে! সোজা হয়ে শোও। তাহলে তোমার নাকের বাঁশি কম আওয়াজ করবে।’ তখন শবাসনের মতো টান টান শুয়ে থাকতে হয়। এত অপছন্দের স্বামীকেও মাঝে মাঝে শরীরের টানে ঘুম থেকে জাগায় রেহানা। এখনো তার মেনোপজ হয়নি। যে রাতে কামনাকাতর কণ্ঠে স্বামীর সাথে খুনসুটির ভঙ্গিতে কথা বলবে, সে রাতেই আলমগীর হোসেন বুঝে যান যে আজ তাকে যৌনভৃত্যের ভূমিকা নিতে হবে। নিজের ভেতরের অনিচ্ছা মাথা তুলে বিদ্রোহ করতে চায়। নিজেকে সক্রিয় করতে রীতিমতো কষ্ট হয়। তবু করতে হয়। কারণ গরিব-গেঁয়ো-ছোটমন-সেকেলে-আনস্মার্ট-অসামাজিক-অযোগ্য পিতা ইত্যাকার নানা রকম খারাপ বিশেষণ তার গায়ের সঙ্গে স্ত্রী-কর্তৃক এঁটে বসলেও নিজেকে যৌনঅক্ষম ভাবতে দিতে মন সায় দেয় না। তাছাড়া রেহানার যা মনের অবস্থা, তাকে অনিচ্ছুক দেখলে হয়তো বলে বসবে, অন্য কোথাও থেকে নিশ্চয়ই শরীরের চাহিদা মিটিয়ে আসছ। তার চাইতে এটাকে আনস্মার্ট স্বামীকে স্মার্ট স্ত্রী-র দেওয়া প্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করাই ভালো।

আজ রাতে আলমগীর হোসেন স্ত্রীর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন। সযত্ন মেকাপ, প্লাক করা ভুঁরু, গালে বোঝা যায় কী যায় না এমনভাবে রঙ মাখানো, রঙ করা চুল খুব কায়দা করে বিউটি পার্লার থেকে কাটানো, ম্যাচ করা শাড়ি-ব্লাউজ– কিন্তু তাকে একটুও সুন্দর লাগছে না দেখতে। অথচ রেহানার সহজ সৌন্দর্য দেখেই তো বিয়ে করেছিলেন তিনি। কেন কমে গেল সেই আকর্ষণ? নিজেই আবিষ্কার করলেন─ সৌন্দর্য ঠিকই আছে, নেই সেই সহজতা; যেটাকে বাদ দিলে আলমগীর হোসেনের কাছে কোনো সৌন্দর্যই সৌন্দর্য থাকে না।

স্ত্রী-র সাথে কথা বলতে চান না আজ রাতে। তাই পাশ ফিরে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকলেন। বুকের ভেতর ব্যথা গুমড়ে উঠছে মাঝে মাঝে। কাল সকাল থেকে আর কারো সাথে যোগাযোগ থাকবে না তার। অথচ কত কষ্ট কত অপমান সহ্য করে তিলে তিলে এই সংসার তৈরি করেছেন তিনি, ধারণ করে রেখেছেন তিনি! বহুদিন আগে থেকেই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা তাকে আচরণ দিয়ে কথা দিয়ে বুঝিয়ে আসছে যে তিনি তাদের মনের কাছে প্রয়োজনীয় নন। তবু তিনি আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছেন তাদের। অপেক্ষা করেছেন, একদিন ঠিক হয়ে যাবে সব। কিন্তু ঠিক যে হবে না তা এখনকার মতো তখনো জানতেন। তাই তিনি চলে যাচ্ছেন। তার চলে যাওয়াতে মানসিকভাবে এদের কিছুই এসে-যায় না। কিন্তু যখনই টাকায় টান পড়বে! মেয়ের মাসে মোবাইল খরচ, বন্ধুদের নিয়ে পিজাহাট-কেএফসি, ছেলের বন্ধুদের নিয়ে ডাঁটমারার খরচ, বউয়ের সপ্তা-সপ্তার খরচ। তখন? তখন কী হবে? বুঝবে কত ধানে কত চাল! চোখে অন্ধকার না দেখে কোনো উপায় থাকবে না কারো। মনে মনে এক অদ্ভূত আনন্দ পেলেন আলমগীর সাহেব। সেই আনন্দই তাকে ঘুম এনে দিল। অনেক গাঢ় ঘুম।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আলমগীর হোসেন স্বপ্ন দেখলেন। এইরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারার জন্য আলমগীর হোসেনের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে আরেক আলমগীর হোসেন─ এতদিন তো অন্যের জন্যে বাঁচলে হে; এবার থেকে নিজের মতো বাঁচো, নিজের মতো বাঁচো!

০২.

সকালে বেরুতেই রাস্তার মোড়ে তন্ময়ের সাথে দেখা।

এই ছেলেটাকে দেখলেই বুকটা ভরে যায় আলমগীর হোসেনের। আহা সত্যিকারের মানুষ একখান! সত্যিকারের যুবক একখান! গার্মেন্টের শ্রমিকরা ঈদের আগে বেতন পাচ্ছে না, তাদের মিছিলে তন্ময়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি হচ্ছে, সেখানে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে তন্ময়। তেল-গ্যাস রক্ষার জন্য লংমার্চ হচ্ছে, সেই মিছিলে তন্ময়। মহল্লায় রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন হবে, সেই অনুষ্ঠানে গান গাইছে তন্ময়। সরকারি দলের ক্যাডাররা চাঁদা তুলছে, মারধোর করছে মানুষকে, দেখা গেল প্রতিবাদের আওয়াজ প্রথম তুলল তন্ময়। আবার বস্তির ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্কুল চালাচ্ছে তন্ময়। এইসব করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার মাস্তানদের হাতে বেধড়ক পিটুনি খেয়েছে সে। তারপরে হাসপাতাল থেকে এসে আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে একই কাজে। মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে থাকে তন্ময়। নিজে লেখাপড়া শেষ করেছে। ছোট ভাইটা ভার্সিটিতে পড়ে। তন্ময় প্রিন্টিং লাইনের ব্যবসা করে। খুব যে অনেক আয় তা নয়। কিন্তু তাতেই সন্তুষ্ট সে। তন্ময়কে দেখেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আলমগীর হোসেন─ আহা তার ছেলেটা যদি এমন হতো!

একবার শোনা গেল তন্ময়ের ওপর খুব খাপ্পা হয়ে আছে ধলা জাহাঙ্গীর। তার এলাকায় চাঁদাবাজি কমানোর জন্য দায়ী তন্ময়। সে নাকি নিজে আসবে মহল্লায়। এলোও। জিপ-হোন্ডা আর ক্যাডারের বহর নিয়ে। তার ক্যাডাররা তুলে নিয়ে এলো তন্ময়কে। তারপরে ঘণ্টাখানেক কী যে কথা হলো তাদের দুজনের মধ্যে, ধলা জাহাঙ্গীর চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসল গাড়িতে। পরের দিন সে আবার এসেছিল মহল্লায়। এবার কোলে তার ছোট্ট পুত্র। সেই ছেলেকে তন্ময় কোলে নিতে ধলা জাহাঙ্গীর সকল মানুষকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে বলল─ ব্যাটারে তুই তর বাপের মতোন হইছ্ না, হইবি তোর তন্ময় চাচার মতোন!

তন্ময় তাকে সালাম দেয়─ এত সকালে কই যান চাচা!

থমকাতে হয় আলমগীর হোসেনকে। তাই তো! কোথায় যাবেন তিনি? ঠিক করা তো হয়নি। আমতা আমতা করে বলেন─ এই একটু যাই আর কি। তা তুমি এত সকালে কই যাও?

তন্ময় উত্তর দেয়─ শাহবাগে যাব চাচা।
শাহবাগে কী কাজ?

মানববন্ধন আছে। তনু নামের একটি মিয়ে ধর্ষিতা আর খুন হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মধ্যে। বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হবে নানাভাবে। সেই প্রতিবাদেই মানববন্ধন।

রোজই তো শুনি মানববন্ধন হয়। শাহবাগে হয়, প্রেসক্লাবে হয়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে হয়। তা কোনো ফল আসে এই মানববন্ধন করে?

উত্তর দেবার আগে একটু চুপ করে থাকে তন্ময়─ ফল হয়তো তেমন পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা ভুলে গেলে তো মানুষের চলবে না চাচা।

ও আচ্ছা। তোমাদের কাজ তোমরা করে যাও। আমি চলি। একটু দূরে যেতে হবে। কাজ আছে।

খুব একটা তাড়াহুড়া নাই আলমগীর সাহেবের। ছুটির দিন আজ। সিএনজি, বাস, রিকশা─ সবই পাওয়া যায় সহজে। তিনি রিকশা নিয়েছেন। বাসস্ট্যান্ডে যাবেন না রেলস্টেশনে যাবেন, তা নিয়ে কিছুটা দোনোমনো ভাব ছিল। পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রেনই ভালো। দেখতে দেখতে আর ভাবনা-চিন্তা করতে করতে যাওয়া যাবে। রিকশা এখন কমলাপুরের দিকে যাচ্ছে।

তনু মেয়েটির কথা হঠাৎ-ই মনে পড়ে আবার। নিশ্চয়ই পত্রিকায় ছাপা হয়েছে খবরটা। তিনি নিয়মিত পত্রিকা পড়েন। অথচ তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি তনুর খবর। রোজ এত এত খুন-জখম, এত এত ধর্ষণ, এত এত বাড়ি থেকে উচ্ছেদের খবর ছাপা হয় যে, পত্রিকা-পাঠকদের চোখ এখন এসব এড়িয়ে যেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই শহরে দেড়কোটি মানুষ দিনগত পাপক্ষয় করছে। অথচ কয়জন যায় এইসব প্রতিবাদের কাজে! একটু কৌতূহল হয় আলমগীর সাহেবের। রিকশাঅলাকে বলেন শাহবাগ ঘুরে যেতে। দেখে আসি কেমন মানববন্ধন হচ্ছে সেখানে।

শাহবাগে নেমে রীতিমতো মুষড়ে পড়েন আলমগীর হোসেন। জমায়েত বেশি বড় হবে না এটা ধারণা করেছিলেন। কিন্তু সেটা যে এতই কম, তা কল্পনাও করতে পারেননি। অন্তত মেয়েরা তো আসতে পারত! নারী সংগঠনগুলো! হায়রে দেড়কোটি ঢাকাবাসী! বিস্ময়ের সঙ্গে আলমগীর হোসেন খেয়াল করেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, বিভিন্ন বিল্ডিং এর ফাঁকে ফাঁকে বসে গল্প করছে অন্তত পাঁচ শো প্রেম-জুটি। এরা এসে দাঁড়ালেই তো মানববন্ধন বিশাল আকার ধারণ করতে পারে।

তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিকশায় উঠে বসেন। কিন্তু হঠাৎ-ই তার মনে হয়, দেড় কোটি অধিবাসীর মতো তিনিও তো এই দায়িত্বটা এড়িয়ে চলে যাচ্ছেন। নাহ। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। তনুর চেহারা মনে পড়ছে না। কিন্তু নিজের মেয়েটার মুখ তো ঠিকই ভেসে উঠছে মনের চোখে। একজন মেয়ের বাপ হিসাবে এইভাবে এড়িয়ে যাওয়াটা কী ঠিক হচ্ছে! আলমগীর হোসেন নেমেই পড়েন রিকশা থেকে। আপাতত মানববন্ধনে অংশ তো নেয়া যাক। তারপরে দেখা যাবে, কোথায় যাওয়া যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *