গল্প।। সন্দেহভাজন।। ইকবাল খন্দকার
আজ খুব ধকল গেছে মোতালেবের উপর দিয়ে। মাথার ঘাম গড়িয়ে গড়িয়ে পায়ে পড়ার মতো ধকল।
ক্লান্তিতে শরীর অবশ হয়ে আসছে তার। মোতালেব সেই মোরগডাকা ভোরে বের হয়েছে কাপড় নিয়ে। টইটই করে চষে বেড়িয়েছে তিন তিনটা গ্রাম। অন্যদিনও অবশ্য তাই করে। একদিনে তিন গ্রামের কম ঘোরার ইতিহাস তার নেই। ব্যবসার শুরুর দিকে তো চারটা-পাঁচটাও ঘুরে ফেলত। তবু ক্লান্তি আসত না। মনে হতো, খুব তাড়াতাড়ি রাত হয়ে গেছে। নইলে আরো দুয়েকটা গ্রাম ঘোরা যেত। অথচ তখন জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস। সূর্যই ডুবত সাতটার দিকে। রাত হওয়া তো আরো পরের ব্যাপার।
মোতালেব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। কাপড়ের ব্যবসা তার। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সে লুঙ্গি, শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট আর ছোটদের পোশাক-আশাক বিক্রি করে। বিক্রির ধরন বিবেচনায় তাকে ‘ফেরিওয়ালা’ বলাটা অধিক যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এই যুক্তি মানতে নারাজ মোতালেব। তার কথা হচ্ছে, তাকে ব্যবসায়ী বলতে হবে। ভুল করেও ফেরিওয়ালা বলা যাবে না। কারণ, ফেরিওয়ালা বলা মানে তাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা করা।
ফেরিওয়ালা কি খারাপ কিছু?
লোকজনের এই প্রশ্নের জবাবে মোতালেবের মুখস্থ বক্তব্য─ খারাপ ভালো বুঝি না। ফেরিওয়ালারা বেচে পাঁচ-দশ টেহার আইটেম, আর আমার কোনো আইটেম একশ টেহার নিচে নাই। তাইলে আমারে ব্যবসায়ী ডাকতে সমস্যাডা কী!
মোতালেবের এই বক্তব্য যারা কোনোদিন শোনেনি কিংবা যারা তাকে ক্ষেপিয়ে মজা পেতে চায়, তারা এখনও ফেরিওয়ালাই বলে। সে মুখ বুজে সহ্য করে অথবা সবিনয়ে সেই মুখস্থ বক্তব্যটা শুনিয়ে দেয়। তবে কাস্টমারদের পক্ষ থেকে কেউ বললে খবর আছে। মোতালেব ফিরেও তাকাবে না ওই কাস্টমারের দিকে। তার কথা─ যে আমারে ইজ্জতের সহিত একটা ডাক পর্যন্ত দিতে পারবো না, তার কাছে মাল বেচার কোনো দরকার নাই।
এইরকম কাস্টমার না হইলেও আমার ব্যবসা চলবো। যখন না চলে, তখন দেখা যাইবো। মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্ত মোতালেব আজ রুস্তমের চাস্টলের বেঞ্চে বসেই শরীর ছেড়ে দেয়। চেষ্টা করে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে। কিন্তু পারে না। কারণ, বেঞ্চে আরো দুজন বসে আছে। দুজনই বয়স্ক। চুল-দাড়ি পাকা। গণ্যমান্যও বলা চলে। কম বয়সী ছেলেপুলে হলে মোতালেব তাদের উঠিয়ে দিয়ে শোয়ার জায়গা বানিয়ে নিত। উঠতে না চাইলে ধমক দিয়ে ওঠাত।
তাতেও কাজ না হলে গায়ের জোর প্রয়োগ করত।
কাপ ধোয়ার ফাঁকে মোতালেবের দিকে চোখ পড়লে রুস্তম বলে─ আজকা মাটিকাটার কাজ কইরা আইছো মনে হয়? নাকি ঠেলাগাড়ি ঠেলছো? মুহের দিকে তো মিয়া চাওন যাইতাছে না। এত কাহিল ক্যান?
─তোমারে কতদিন কইলাম ইস্টলের সামনে দুইটা টুল পাতো। কতা তো কানে যায় না। পরনের লুঙ্গি তুলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে মোতালেব।
─দুই টুল পাইতা পাপ বাড়ামু নাকি?
─পাপ! পাপ কিয়ের?
─আরে এইহানে বইয়া খালি একজন আরেকজনের গীবত করে। গীবত পাপ না? আমার জায়গায় বইসা গীবত করলে পাপ কি আমার ভাগে আইবো না?
─তাইলে টুল যেইটা আছে, সেইটাও তুইলা দেও।
─বেশি বুইঝো না।
─বেশি বোঝার কী আছে? টুলও নাই, গীবতও নাই, পাপও নাই।
─আরে মিয়া, টুল একটা আছে, ঠিক আছে।
─না, ঠিক নাই। টুল থাকলে গীবত হইবোই।
─মিয়া, বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করো। যারা আসল কাস্টমার, তারা আসে, বসে, চা খায়, চইলা যায়। যদি খাওয়ার পরে হুদাহুদি বইসা থাইকা গালগল্প করতেও চায়, পারে না। ক্যান পারে না? কারণ, ঘাড়ের উপরে আরো দুই চাইরজন দাঁড়ায়া থাকে। আর ঘাড়ের উপরে লোক দাঁড়ায়া থাকলে কিন্তু বইসা শান্তি পাওয়া যায় না।
─হ, বুঝছি। আর গেজাইয়ো না। এইবার ইস্পেশাল একটা চা দেও। মোতালেব হাই তোলে।
─দিতাছি। তো যেইটা কইতেছিলাম। বওয়ার জায়গা বেশি থাকলে হয় কী…
─ভাইরে, তুমি যা কইতাছিলা, যা বোঝাইতাছিলা, সব আমি বুঝছি। এইবার ক্ষ্যান্ত দেও। চা দিতে কইছি, চা দেও।
─টুলের কতা তো তুমিই তুললা।
─তুলছি, অপরাধ করছি। মনে চাইলে অপরাধের সাজা দেও। তবু চা দেও এক কাপ। রুস্তম আর কথা বাড়ায় না। ‘ইস্পেশাল’ চা বানানোর জন্য যা যা করতে হয়, করে। আর মোতালেব বেঞ্চ লাগোয়া খুঁটিতে হেলান দিয়ে চোখ বোজে। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে তার। কিছুক্ষণ পর রুস্তমের ডাকে সে যখন চোখ খোলে, তখন বেঞ্চ ফাঁকা। মুরব্বি যুগল চলে গেছেন। ফাঁকা বেঞ্চ পেয়ে খুশি হয়ে মোতালেব শুয়ে পড়তে চাইলে রুস্তম বলে─ ইস্পেশালের জায়গায় ডাবল ইস্পেশাল চা বানাইলাম, আর তুমি আছো শোয়ার তালে। চা কি শুইয়া শুইয়া খাইবা? নাকি তোমার চা আমি খামু?
পানসে মুখে সোজা হয়ে বসে মোতালেব। রুস্তম তার হাতে চা ধরিয়ে দিয়ে বলে─ চুমুক দেও। শইলডা চাঙ্গা বানাও। তারপরে ঠিক কইরা বসো। তোমার সাথে জরুরি একটা কথা আছে। আমি ম্যালাক্ষণ ধইরা অপেক্ষা করতাছি তুমি কখন আসবা। আসলা তো আসলা, জম্মের কাহিল হইয়া আসলা। এই অবস্থায় কথা কওয়া যায়? আইচ্ছা, এত কাহিল হওয়ার কী কারণ একটু হুনি! ব্যবসা করতে তো রোজই যাও। এইরকম কাহিল তো অইন্যদিন হও না? অসুখ-বিসুখ নাকি? নাকি মনের দিক দিয়া কোনো পেরেশানির মধ্যে আছো?
─আরে না। এইরকম কিছু না।
─তাইলে?
─বেচা-কিনির চাপে দুপুরে ভাত খাইতে পারি নাই। সকালের নাশতাডাও বেশি যুইতের আছিল না। খাওন ভালো না হইলে শইল ঠিক থাহে?
─নাহ্।
─তা জরুরি কী কথা জানি কইবা? কইতে থাহো। মোতালেব চায়ে চুমুক দেয়।
─চা শেষ করো। তারপরে কই। রুডি নেও। খালিপেডে চা খাওয়া ভালো না।
─আমার পেট খালি, এইডা তোমারে কেডা কইল? দুপুরে ভাত খাইতে না পারলেও এইটা সেইটা কম খাই নাই। কিন্তু ভাতের খিদা কি এইটা সেইটায় দূর অয়?
─জীবনেও না। একটা গান আছে না, চাচি বলো খালা বলো মার মতো না, চিড়া বলো মুড়ি বলো ভাতের মতো না।
─গান খুব ভালো হইছে। এইবার কও কী কইবা। রুস্তম তার পেছনের তাক থেকে লাল ঢাকনার একটা বৈয়াম নামিয়ে দুটো বিস্কুট বের করে। বিস্কুটগুলো আজকে এসেছে। তরতাজা। দারুণ মজার। কামড় দিলে পাকা নারকেলের স্বাদে মুখ ভরে যায়। রুস্তম বিস্কুট দুটো মোতালেবকে নিতে বললে নেয় না। বলে, এখন সে এইসব খেয়ে রুচিটা নষ্ট করতে চায় না। কারণ, বাড়িতে গিয়ে ভাত খাবে। গলা পর্যন্ত ভরে ভাত খাবে। বিস্কুট খেলে হয়তো গলা পর্যন্ত আর ভাত দিয়ে ভরা হবে না।
রুস্তম বলে─ যেইটা জানো না, সেইটা নিয়া ক্যান যে কথা বলো! আরে মিয়া, বিস্কুট খাইলে রুচি নষ্ট হয় না। আমি মনে করি রুচি আরো বাড়ে। খাওয়ার একটা জোশ চইলা আছে। খাইতেই মন চায়, খাইতেই মন চায়। আসলে রুচি নষ্ট হয় চা খাইলে। কিন্তু চা তো ঠিকই খাইতাছো। আর বিস্কুট দুইটা যে দিতাছি, এইটার কিন্তু কোনো পয়সাপাতি দেওয়া লাগবো না। মহব্বত কইরা দিতাছি। ধরো। আরে ধরো তো!
মানুষের মহব্বত মোতালেবের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
তাই সে রুস্তমের মহব্বতের অমর্যাদা করে না।
চায়ের কাপটা বেঞ্চে রেখে বিস্কুট খায় মজা করে।
আর জরুরি কথা শোনার আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে রুস্তমের মুখের দিকে। রুস্তম প্লাস্টিকের জগ থেকে স্টিলের গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলে─ এই এলাকার দোকানদাররা কোন কোম্পানির বিস্কুট রাহে, তুমি তো জানোই। তো ওই কোম্পানির যেই লোকটা আগে বিস্কুট লইয়া আইত, সে নাকি চাকরি ছাইড়া দিছে। আজকা নতুন লোক আসছিল।
তোমার ছোটভাইয়ের বয়েসী।
─এইগুলা আমারে শোনায়া কী লাভ। জরুরি কী কইতে চাইছিলা, সেইটা কও।
─আরে ওই কথাই তো কইতাছি। কান লাগায়া হোনো না।
─এখন কান লাগানির টাইম নাই। ভাল্লাগতাছে না।
─না লাগলেও হোনো। নতুন লোকটার নাম অইল রতন। রতন ভূঁইয়া। খুব আলাপী লোক। অনেকক্ষণ আলাপ করল আমার লগে। আলাপে আলাপে কইল, সে নাকি আগে ঢাহা থাকত। ঢাহার ইসলামপুর আছে না? ওই এলাকায়।
─তুমি কিন্তু কিচ্ছা জুইড়া দিছো।
─কথা কইয়ো না তো! হোনো কী কই। সে একটা কাপড়ের কোম্পানিতে চাকরি করত। জিগাইলাম কী ধরনের কাপড়। সে কইল শাড়ি, লুঙ্গি, বাচ্চাকাচ্চার কাপড় এইসব। আমার তখন তোমার কথা মনে পইড়া গেল। কারণ, এই এলাকায় একমাত্র তুমিই কাপড়ের ব্যবসা করো। আবার তোমার লগে আমার ভালা একটা খাতিরও আছে।
─তারপরে?
─এইবার তাইলে আমার কথার দিকে একটু আগ্রহ হইছে!
─তারপরে কী হইল, সেইটা কও।
রুস্তম পানিভর্তি গ্লাসটা মোতালেবের হাতে দিয়ে বলে─ আমি তারে খুঁটিনাটি নানান কথা জিগাইলাম। শেষ পর্যন্ত যেইটা জানতে পারলাম, ওই কোম্পানি খুব কম দামে মাল সাপ্লাই দেয়। যেমন ধরো যেই শাড়ি তুমি হাজার দিয়া কিন্না আনো, সেইটা তাদের কাছ থেইকা কিনলে কিনতে পারবা সাতশ আটশ দিয়া। চিন্তা করো কত লাভ! তয় তুমি মনে করতে পারো, ঢাকা থেইকা কাপড় আনতে গেলে গুড়ের লাভ পিঁপড়ায়ই খাইয়া ফেলবো। জি না, এই ডর নাই। কারণ, তুমি এখন যেইখান থেইকা কাপড় কিনো, সেইখানেও তাদের সাপ্লাই আসে। তুমি নিতে চাইলে তারা কিছু মাল বাড়ায়া পাঠাইবো।
এবার চোখ চকচক করে ওঠে মোতালেবের।
সে রতনের ফোন নম্বর চায়।
জানায় আজকেই কথা বলবে তার সঙ্গে।
রুস্তম বলে─ অত উতালা অইয়ো না। ধন-দৌলত, টেহা-পইসা এইগুলা হইল কপালের ব্যাপার। কপালে থাকলে আসবোই। তুমি চাইলেও আসবো, না চাইলেও আসবো। আর কপালে না থাকলে দৌড়ায়া ধইরা আনতে পারবা না। আমি মনে করি, এই জিনিসটা তোমার কপালে আছে। না থাকলে ক্যান আৎকা কইরা লোকটার লগে আমার পরিচয় অইবো, ক্যান তার কাপড়ের কোম্পানির লগে পরিচয় থাকবো? সে তো আগে কাপড়ের কোম্পানিতে চাকরি না কইরা জুতার কোম্পানিতেও চাকরি করতে পারত। পারত না?
মোতালেব উপর-নিচে মাথা দোলায়।
তবে তার চোখের চকচকানি কমে না।
কমে না জরুরি ভিত্তিতে রতনের ফোন নম্বর পাওয়ার আগ্রহও। রুস্তম তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে─ সবুরে মেওয়া ফলে জানো না?
বেশি না, একটা দিন সবুর করো। কালকার দিনের পরের দিনই রতন আসতেছে। তার সামনাসামনি বইসা কথা বলবা। আরে এইসব কথা সামনাসামনিই বলতে অয়। মোবাইলে না। পরশুদিন হাতে আর কোনো কাজ রাইখো না কিন্তু। একদিনের লাইগা ব্যবসার কথা ভুইলা যাও। একদিন ব্যবসা না করলে কিচ্ছু অইবো না। কথার সমাপ্তি ঘোষণা করে মোতালেবকে বিদায় দেয় রুস্তম। আর উপদেশ দেয় বাড়ি গিয়ে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। কারণ, শরীরের উপর দিয়ে ঝড়-তুফান যাওয়ার পর যথেষ্ট বিশ্রাম না নিলে অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আর অসুস্থ একবার হয়ে পড়লে মহাবিপদ। আমও যায়, ছালাও যায়। অর্থাৎ রোজগারের পথও বন্ধ হয়ে যায়, ঘরে জমানো টাকার উপরও হাত পড়ে। আর যার ঘরে জমানো টাকা নেই, তার করতে হয় ঋণ।
মোতালেব বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে চায়ের বিল দিতে চাইলে রুস্তম নেয় না। বলেÑ আজকা তোমার লাইগা সব ‘ফিরি’। এখন যদি চা-বিস্কুট আরো খাইতে চাও, সেইগুলাও টেহা নিমু না। তবে রতনের সাথে যদি কথাবার্তার বনিবনা অইয়া যায়, তাইলে কিন্তু আমারে পোষায়া দিতে অইবো। বেশি কিছু লাগবো না, তোমার ভাবীরে একটা শাড়ি দিলেই হইবো। খুব দামির দরকার নাই। মাঝারিমানের একটা হইলেই চলবো।
চালানের সবচেয়ে দামি শাড়িটা রুস্তমের বউকে উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্টল ছাড়ে মোতালেব। তবে দশ গজও এগোতে পারে না। রুস্তম তাকে ডাক দেয়। বলে আরেকটা কথা নাকি আছে। কাপড়- সংক্রান্ত কথা মনে করে বেশ আগ্রহ নিয়েই আবার স্টলে যায় মোতালেব। কিন্তু রুস্তম বলে অন্যকথাÑ একটা বিষয় কইতে ভুইলা গেছিলাম। মনে হয় কথার তলে পইড়া গেছিল। তলা থেকে এখন টাইনা তুলছি। আইচ্ছা, একজনের চেহারার সাথে তো আরেকজনের চেহারার মিল থাকতেই পারে।
পারে না? তুমিই কও!
─পারে। এখন কী হইছে, সেইটা কও।
─মিল থাকতে পারে, এইটা ঠিক আছে। তাই বইলা এত মিল! আমি তো দেইখা তাজ্জব। তখন এইখানে যারা আছিল, তারাও টাশকি খাইছে। আসলে টাশকি খাওয়ার মতোই ব্যাপার।
─কার চেহারার সাথে কার মিল? কেডা কারে দেইখ্যা টাশকি খাইছে? কিছু তো বুঝতাছি না। একটু বোঝায়া কও।
─রতনের কথা কইতাছি। তার চেহারা হুবহু আসাদের মতো।
─কোন আসাদ? লতিফ খোনকারের পোলা?
─ধুরু! নিজের পোলার নাম যে আসাদ, সেইটাও ভুইলা গেছো নাকি? বুঝছি, ভালো কাহিলই হইছো। মাথামুথা পুরা আউলায়া গেছে। যাও, এক্ষন বাড়িত যাও। খাইয়া ঘুম দেও।
─আমার পোলার মতো রতনের চেহারা? মোতালেবের প্রশ্নে বিস্ময়।
─তাইলে আর কইতাছি কী! আরে, ওই সময় যারা এইখানে ছিল, তারা তো এইটা নিয়া ঠাট্টা-মশকরা শুরু কইরা দিছিল। কয় রতন আর আসাদ নাকি বাপ-পুত। হা হা হা।
রুস্তমকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে দেখে আগ-পিছ না ভেবে হেসে ফেলে মোতালেব। কিন্তু স্টল ছেড়ে বাড়ির দিকে কয়েক কদম এগোতেই হাসিটার জন্য অনুশোচনা হতে থাকে তার। রাগ হতে থাকে নিজের উপর। ‘রতন আর আসাদ নাকি বাপ-পুত’─এটা হাসার মতো কোনো কথা? মানুষ হাসতে পারে, সে কেন হাসবে? নিজের পিতৃত্ব যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, নিজের বউয়ের সতীত্ব যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে তার দাঁত বের হলো কোন লজ্জায়? লজ্জা শরম কিছু আছে? নাকি‘ইস্পেশাল’ চায়ের সঙ্গে গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছে? বাড়ি ফিরে মোতালেব আসাদের পাশে বসে রাতের খাবার খায়। এসময় স্ত্রী নাসিমা সারাদিনের বেচা-বিক্রির ব্যাপারে প্রশ্ন করতে চাইলে সে উত্তর দিতে অনীহা প্রকাশ করে। ক্লান্তির অজুহাত দেখায়। আর তাগাদা দেয় শোয়ার ব্যবস্থা করতে। নাসিমা স্বামীর আদেশ পালন করে।
মোতালেব টয়লেট থেকে ঘুরে এসে মশারির ভেতর ঢোকে। তবে শোয় না। পা বিছিয়ে বসে তাকিয়ে থাকে আসাদের দিকে। আসাদ জানালার পাশের টেবিলে বসে পরীক্ষার পড়া পড়ছে। কদিন পরেই তার বার্ষিক পরীক্ষা। ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠবে সে। পড়াশোনার প্রতি তার বেশ মনোযোগ। পরীক্ষার সময় তো অবশ্যই, অন্যান্য সময়ও সে সম্পূর্ণ নিজের আগ্রহে পড়তে বসে। পাড়ার সমবয়সীদের মতো বকে-মেরে পড়ার টেবিলে বসাতে হয় না। তবে পড়াশোনার প্রতি তার যতটা মনোযোগ, পরীক্ষার ফলাফল ততটা ভালো না। এ নিয়ে আফসোস নেই মোতালেবের। ছেলে পড়াশোনায় মনোযোগী, তাতেই সে খুশি।
ছেলের দিকে অল্পক্ষণ তাকিয়ে থেকেই নিজের মধ্যে পরিবর্তনের আভাস পায় মোতালেব। ইতিবাচক পরিবর্তন। তার মনের মেঘ কাটতে শুরু করে দিয়েছে। একটু পরেই হয়তো সূর্য উঠে আলো ছড়াতে থাকবে। প্রখর আলো। মোতালেব শুয়ে পড়ে নিশ্চিন্তে। তবে চোখ বন্ধ করে না। ডানকাত হয়ে বউয়ের হাঁড়ি-পাতিল গোছানো দেখে। দেখে বাসন পরিষ্কার করা। শোনে হাতের চুড়ির চিরপরিচিত শব্দ। যে শব্দ কোনো কোনোদিন তার ঘুম ভাঙানোর কাজেও ব্যবহৃত হয়।
হঠাৎ হেসে ওঠে মোতালেব। নিঃশব্দ হাসি। অদৃশ্য হাসিও বটে। কারণ, সে মুখ ঢেকে ফেলে হাত দিয়ে। মোতালেবের এ হাসির কারণ─
নিজের বোকামি। কতটা বোকা হলে সে সামান্য চেহারার সামঞ্জস্যকে‘ইস্যু’ বানিয়ে মন খারাপ করেছিল? আসলে এটা কি বোকামি? নাকি পাগলামি? তার কি পাগলাগারদে স্থান পাওয়া উচিত? প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে মোতালেবের। সে তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে। একদিন পর।
রুস্তমের দোকানের বেঞ্চে বসে আছে রতন।
তাকে দেখে বিস্ময়কর বস্তু দেখার মতো চমকে ওঠে মোতালেব।
আরে এ তো একদম আসাদ! সিনিয়র আসাদ। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের মতো হতে পারে। অহরহই হয়। তাই বলে ফটোকপি? আরে ফটোকপিতেও তো কিছুটা অসামঞ্জস্য থাকে। যে অসামঞ্জস্যের কারণ মেশিন কিংবা কালি। কিন্তু এখানে তো চুলপরিমাণও অসাঞ্জস্য নেই। এ কীভাবে সম্ভব? মোতালেবের অভিব্যক্তি দেখে সেদিনের সেই অট্টহাসিটা আবার দেয় রুস্তম। তার শরীর দুলতে থাকে দোকানসহ। হাসির বেগ আর শরীরের দুলুনি কমে এলে রুস্তম বলেÑ চেহারার মিলের কারণে আর কেউ কোনো ফায়দা পাক বা না পাক, আমি কিন্তু পাইছি। কী ফায়দা পাইছি জানো? আমার কষ্ট কইরা পরিচয় করায়া দিতে হয় নাই। তুমি দেইখ্যাই চিন্না ফেলছো এইটা রতন ভাই। তবে খালি একজনে চিনলে তো হইবো না, একসাথে কাজ করতে হইলে দুইজনেই দুইজনরে চিনতে হইবো। রতন ভাই, সে হইতাছে মোতালেব। পরিচয় পর্ব শেষে চা-বিস্কুট সমেত শুরু হয় মূল আলোচনা পর্ব। রুস্তমের মধ্যস্থতায় ফলপ্রসূ হয় আলোচনা। রতন কথা দেয়, ঢাকার সেই কোম্পানি থেকে সর্বনিন্ম দামে কাপড় পেতে মোতালেবকে যত প্রকারের সাহায্য করতে হয়, সে করবে। আর এ সাহায্যের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়ে যাবে আগামীকাল থেকেই। রতন উঠে দাঁড়ায়। রুস্তম তাকে আরেক কাপ চা খেয়ে যেতে অনুরোধ করে। সময় স্বল্পতার কারণে রতন অনুরোধ রাখতে পারে না। এই গ্রাম এবং পাশের গ্রাম মিলিয়ে তাকে আরো বারোটা দোকানে বিস্কুট পৌঁছুতে হবে যে!
রতন চলে যাওয়ার পর রুস্তমের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চায় মোতালেব। কিন্তু কামালদের জন্য পারে না। কামাল আর তরিকুল ঠাট্টা শুরু করে রতনের চেহারা নিয়ে। রুস্তম বা মোতালেব জোর দিয়ে তাদের কিছু বলতে পারে না, কারণ তারা এই গ্রামের প্রভাবশালীদের সন্তান। কিছু বলতে গেলে শারীরিক আক্রমণ তো হতেই পারে, আক্রমণ হতে পারে চাস্টলের উপরও। আর তারা আক্রমণ একবার করে বসলে কেউ এগিয়ে আসবে না বাধা দিতে।
রুস্তম মোতালেবকে ইশারা দেয় চলে যাওয়ার জন্য। মোতালেব পা চালালে কামাল বলে─ কই যাইতাছেন ভাই? বাড়িতে? ভাবির কাছে?
ভাবির কাছে গিয়া আর কী করবেন? ভাবি তো যা করার আগেই কইরা ফেলছে।
─আগেই কইরা ফেলছে মানে? কী করছে? রাগে গড়গড় করতে করতে বলে মোতালেব।
─কী করছে বুঝতাছেন না? পোলা আপনের, কিন্তু চেহারা পাইছে আরেকজনের। ঘটনা কোন জায়গায় প্যাঁচ খাইছে, বুঝতে পারছেন? না বুঝলে বোঝায়া দেই?
─বসেন ভাই, বসেন। একটু বোঝায়া-ই দেই।
─নাকি বাড়িতে আসমু? আপনেরে আর ভাবিরে একলগে বসায়া বোঝাইলাম! তরিকুলদের নোংরা ইঙ্গিতে মোতালেব তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতে চাইলেও রুস্তমের জন্য পারে না। সে তাকে ধাক্কিয়ে সরিয়ে দেয় দোকানের সামনে থেকে। মোতালেব সোজা বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে এখন নাসিমা ছাড়া কেউ নেই। আসাদ স্কুলে। সাড়ে চারটার আগে ফিরবে না। রাগে শরীর কামড়াচ্ছে মোতালেবের। তবু সে সংযত। কারণ, আসতে আসতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা করবে, ঠান্ডা মাথায় করবে। রাগ করার যৌক্তিক এবং সুনির্দিষ্ট হেতু না পেলে কোনো রাগ বা উত্তেজনা নয়।
আর পেলে? সেটা পরে দেখা যাবে।
মোতালেব ঘরে ঢুকে নাসিমাকে কাছে ডাকে। এই কথা সেই কথা বলে জিজ্ঞেস করে রতন নামে কাউকে চেনে কিনা। নাসিমা জানতে চায় কোন রতন। মোতালেব খোঁচা মারে– ক্যান, কয় রতনরে চিনো তুমি? দেশের সব রতন তোমার পরিচিত নাকি?
নাসিমা স্বামীর খোঁচায় প্রভাবিত না হয়ে বলে─ দেশের সব রতন পরিচিত না হইলেও ম্যালা রতনরে চিনি। আমাগোর গ্রামেই তিন রতন। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেও রতন আছে। এইদিকে আপনের ছোট চাচার নাম রতন। আমি কোন রতন রাইখা কোন রতনরে চিনমু কন। নাসিমার কথাবার্তায় সন্দেহ করার মতো কিছু না পেয়ে মনের সকল অস্থিরতাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলে মোতালেব। আর প্রতিজ্ঞা করে এমনসব তুচ্ছ কারণে আর কোনোদিন বউকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবে না। মানুষ যা বলে বলুক। শুনবে, ভুলে যাবে। মনে জায়গা দেবে না, ওইসব কথা বাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে আসবে না। বউয়ের সামনে উচ্চারণ তো করবেই না।
এক সপ্তাহ পর।
মোতালেবকে ফোন করে রুস্তম।
বলে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করার জন্য।
দোকানে না। বাড়িতে। কারণ, খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। অন্য কেউ জানলে বা শুনলে সমস্যা। মোতালেব কৌতূহল চেপে রাখতে পারে না। তাই বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকে কী কথা। খারাপ কিছু কি না। রুস্তম বলে না। শুধু তাগাদা দেয় তাড়াতাড়ি আসার জন্য। মোতালেব জরুরি কাজে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু রুস্তমের কথা শোনার পর তার বাড়ির দিকে দৌড় না দিয়ে পারে না।
মোতালেবকে নিয়ে নির্জন ঘরে বসে রুস্তম।
বলে─ পরিস্থিতি খুব খারাপ। তুমি তো আইজ কাইল চা স্টলে আসো না, এই জন্য জানো না এলাকায় কী আলোচনা চলতাছে। আগে তো শুধু কামাইল্যা আর তরিকুইল্যা আছিল। এহন ওই দলে ম্যালা লোক। গুইন্যা শেষ করতে পারবা না। আর একটা বিষয় কিন্তু মানতে হইবো। যা কিছু ঘটে, তার পুরাটা সইত্য না হইলেও কিছু না কিছু অবশ্যই সইত্য। আর এইখানেও যে কিছু সইত্য আছে, তার আলামত আমি পাইছি।
─কী আলামত? মোতালেবের গলা কাঁপে।
─আমি রতনরে জিগাইছিলাম।
─কী জিগাইছিলা?
─জিগাইছিলাম নাসিমা নামে কাউরে চিনে কি না।
─কী কইল? গলার সঙ্গে এবার হাত-পাও কাঁপে মোতালেবের।
─সে কী কইল আর আমি কী কইলাম, সেই বয়ান দিতে গেলে অনেক সময় লাগবো। কী দরকার এত বয়ানের। খালি এইটা শুইনা রাখো, এইখানে একটা গিঁট্টু আছে।
─কী গিঁট্টু?
─খুব জটিল গিঁট্টু।
─এহন কী হইবো? এতদিনের সংসার আমার! মোতালেব কেঁদে ফেলে।
─তোমার সংসার যেইভাবে চলতেছিল, সেইভাবেই চলতে পারত। যদি এলাকার লোকজন রতনরে না দেখত। দেখছে তো দেখছে, আরো দেখব। কারণ, সে তোমারে ব্যবসায়িক সুবিধা দিতাছে। আর তুমি সেই সুবিধা নিতাছো।
─গুল্লি মারি আমি এই সুবিধার। তারে এই এলাকায় আইতে নিষেধ করো। আজকাই নিষেধ করো। আর যাতে না দেহি।
─নিষেধ করলে যদি তার আওয়া বন্ধ হইত, তাইলে তো ভালোই হইত। তারে না দেখলে কেউ আলোচনাও করত না, তোমার সংসারের উপরও শনির দশা পড়ত না। আস্তে আস্তে সবাই তার চেহারা ভুইলা যাইত, সবকিছু আবার আগের মতো হইয়া যাইত।
─দেহো না কোনোভাবে তার আওয়া বন্ধ করা যায় কি না।
─কোনো কায়দা নাই।
─কায়দা একটা বাইর করো। তুমি চেষ্টা করলেই পারবা।
─পারমু না। হোনো, সে যদি এই এলাকায় অকারণে আইতো, ঘুরতে ফিরতে আইতো, তাইলে একটা কথা ছিল। ব্যবস্থা নিতে পারতাম। কিন্তু সে তো অকারণে আসে না। চাকরি করতে আসে। কারো চাকরি খাওয়ার ক্ষমতা কি আমার আছে?
দশদিন পর।
রুস্তমের মোবাইলে একটা ফোন আসে।
অপরিচিত নম্বরের ফোন।
রুস্তম ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে─ ট্রাস্ট বেকারি থেকে বলছি। আমি এই কোম্পানির ম্যানেজার। আমাদের একটা লোক আপনার দোকানে বিস্কুট দিত। রতন নাম। তো রতনকে তিনদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি আপনাদের এলাকার প্রায় সব দোকানদারের সঙ্গেই কথা বলেছি। কেউ ওর খোঁজ দিতে পারেনি। আপনি জানেন কিছু?
রুস্তম ‘না’ বলে লাইন কেটে দেয়।
আর ফোন করে মোতালেবকে। কিন্তু মোতালেবের কণ্ঠ শুনতে পায় না। শুনতে পায় সেই পরিচিত নারীকণ্ঠ─
‘দুঃখিত, এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না’