উপন্যাস।। নিখোঁজ মানুষের গান।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব তিন
- ধারাবাহিক উপন্যাস//নিখোঁজ মানুষের গান// এহসান মাহমুদ// এক
- উপন্যাস।। নিখোঁজ মানুষের গান।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব দুই
- উপন্যাস।। নিখোঁজ মানুষের গান।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব তিন
(৩)
কতোক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে আছি মনে নেই। ‘ইমতিয়াজ, একটু সরে দাড়াও’ শুনে পেছনে তাকাই। রিনি আপা চেয়ারে বসে আছেন। চোখ পড়তেই আমাকে ইশারা করলেন। তার পাশের চেয়ারে বসে পড়ি। বেশ খানিক সময় দাঁড়িয়ে থাকায় পা ধরে এসেছিল। এখন বসার পরে বুঝতে পারছি। কেমন টনটন করছে পা। পিঠের মাঝখান থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত ঝিম ধরে আছে। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে হাটুর ওপর রেখে একটু আরাম করে বসার চেষ্টা করি।
এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি, আশেপাশে তাকিয়ে দেখা গেল হলরুমে আর কোনো জায়গা খালি নেই। প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো সব দখল হয়ে আছে। আমার ডানদিকে তাকিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের বসার জায়গার দিকে চোখ রাখি। প্রতিদিনের মতো কাগজ কলমে নোট নিতে দেখলাম কাউকে। সবাই কেমন বিহ্বল হয়ে পড়েছে।
বাবা হারানো শিশুটি নেমে যাওয়ার পরে এক নারী উঠে দাঁড়ালেন। ছিপছিপে গড়ন। ফর্সা মুখ। চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। তার কোলে ছোট্ট এক শিশু। তিনি সামনে গিয়ে দাঁড়ান। হাতে মাউথপিস তুলে নেন। আস্তে করে বলেন- আমার কোলে যে সন্তান তার বয়স এক বছর পার হয়েছে। আমার সন্তান এখনও তার বাবার মুখ দেখতে পারে নাই। বিয়ের পাঁচ মাস পরে আমার স্বামী নিখোঁজ হয়েছে। আমার কোলের সন্তান তখন পেটে আছিল। স্বামীর এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসায় আমরা সুখে শান্তিতেই ছিলাম। টাকা জমায়া শ্যামলীর আদাবরে দুই কাঠা জমিও কিনছিলেন তিনি। কিন্তু জমি রেজিষ্ট্রি করার তিনদিনের মাথায় তারে আমরা হারায়া ফেলি। একটা সুস্থ জ্বলজ্যান্ত মানুষ দিনিদুপুরে বাসা থেকে বের হয়ে হাওয়া গেল! তারে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। পরে শুনছি, জমি রেজিষ্ট্রি করার পরে এক পার্টি তারে জমিটা বিক্রি করে দিতে বলছিল। তিনি রাজি হন নাই। আর তারপরে লোকটাই নাই হয়ে গেল।
কথা বলতে বলতে চোখ বুজে আসে তার। সাদা গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কোলে থাকা শিশুটি হাত বাড়িয়ে মাউথপিস ধরার চেষ্টা করলো কয়েকবার। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের একজন মাউথপিসটি সরিয়ে নিল। সন্তানকে কোলে জড়িয়ে তিনি নিচে নেমে এলেন। চেয়ারে বসতেই একজন গিয়ে একটি ভিজিটিং কার্ড তার হাতে দিল। আমাদের মতোই কেউ একজন হবে। হয়তো স্পেশাল কোনো রিপোর্টের আইডিয়া পেয়েছে, পরবর্তিতে যোগাযোগ করতে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে রাখলেন।
কোনো ইভেন্ট কভারে গেলে আমরা চেষ্টা করি একটি সাইট স্টোরি তৈরি করতে। অনেক সময় দেখা যায় মূল ঘটনার চেয়ে সাইট স্টোরি বেশি আলোচিত হয়। কিন্তু আজকে আমার কোনো আগ্রহই তৈরি হচ্ছে না। কয়জন কী কী বলে গেলেন নোটও তেমন নেওয়া হয়নি। সাইট স্টোরির দিকে মনোযোগ দেওয়ার কথা এখনও ভাবিনি। একবার মহাখালীর এক বস্তিতে আগুন লেগেছিল। আগুনে বস্তির প্রায় সাড়ে ছয়শো ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ফায়ারসার্ভিস, পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স আর রেডক্রিসেন্টের উদ্ধারকর্মীদের বেশ উদ্ধার তৎপরতা চলছে। আগুনে ঘর হারিয়ে বস্তিাবসী নারীরা আহাজারি করছে। পুরুষেরা পুড়ে যাওয়া ঘরের মধ্য থেকে পোড়া কাঠ-টিন, ঘরের আসবাবপত্র যা সামান্য অক্ষত আছে সেসব উদ্ধারে চেষ্টা করছে। আমি ঘুরে ঘুরে সব দেখছি। আর নোট নিচ্ছি। হঠাৎ দেখি, আট-নয় বছরের এক মেয়ে শিশু হাতে কয়েকটি পোড়া বইয়ের মলাট নিয়ে কান্না করছে। আমি প্রথমে কাছে গিয়ে দেখলাম। পরে দ্রুতই মোবাইলে কয়েকটি ছবি তুলে নিয়েছিলাম। মেয়েটিকে নিয়ে বস্তির বাইরে রাস্তার পাশে একটি খাবারের দোকানে নিয়ে গেলাম। ওর সাথে কথা বলে বিস্তারিত জেনে নিলাম। পরেরদিন আমাদের পত্রিকায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে বস্তি পুড়ে যাওয়ার খবরের পাশে ছাপা হয়েছিল একটির সাইট স্টোরি। কয়েকটি পোড়া বই হাতে নিয়ে কান্নারত মেয়েটির ছবি ছাপা হলো। সেই খবর বেশ আলোচিত হয়েছিল।
ওই ঘটনার পর থেকে বড় কোনো চাঞ্চল্যকর ঘটনা বা ইভেন্ট কভারে গেলে আমি সাইট স্টোরি খোঁজায় বাড়তি সময় দিতাম।
কিন্তু আজকে প্রেসক্লাবের এই অনুষ্ঠানে এসে কোনো সাইট স্টোরির আইডিয়াও আমার মাথায় আসছে না। আজ হলরুমের পরিবেশই আলাদা। কেউ যখন কথা বলে, কেবল তখনই স্পিকারে শব্দটা গমগম করে বেজে ওঠে। বাকি সময়টা হলরুমের ভেতরে রাত্রির নিরবতা নেসে আসে।
একে একে আরও কয়েকজন নারী উঠে এলেন। তারা তাদের স্বামীকে হারাবার কথা বলে গেলেন। তাদের স্বামীরা বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন, তা তারা জানেন না। তারা বিধবা নাকি সধবা, নিশ্চিত করে তা কেউ বলছেন না। অভিধানে তাদের জন্য জুতসই কোনো শব্দ নেই। কারও স্বামী এক বছর, কারও তিন বছর, কারও স্বামী আট বছর আগে গুম হয়েছেন। তারা একদিন না একদিন ফিরে আসবেন, স্বজনেরা আগে এমন সান্ত¡না দিলেও এখন আর কোনো আশার কথা শোনান না।
এরপরে মঞ্চে উঠে এলেন এক মধ্যবয়সি পুরুষ। নিজের পরিচয় জানিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। তিনি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি নিখোঁজ হওয়া লোকদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে তাদের আইনি লড়াইয়ে সহায়তা দিয়ে আসছে। তিনি বেশ কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরলেন। জানালেন ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে গুম হওয়া পাঁচ ব্যক্তির স্ত্রীর সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেছে তাদের গবেষণা দল। স্বামী গুম হয়ে যাওয়ার পর তাদের কেউ কেউ স্বামী-শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে গেছেন। কখনো পরমুখাপেক্ষী ছিলেন না, এখন বেঁচে থাকার জন্য অন্যের সহায়তা নিতে হয় অনেককে। কারও কারও ক্ষেত্রে নতুন জীবন শুরু করতে পরিবারের চাপ আছে। কিন্তু স্বামী যদি কখনো ফিরে আসেন, যদি সন্তানেরা কষ্ট পায়-এ রকম হাজারো যদির চক্করে থমকে গেছে তাদের জীবন।
(চলবে….)