কবিতা

কাব্যশীলন উৎসব সংখ্যার কবিতা কবি নির্মলেন্দু গুণ

শব্দের স্পিনার

গ্যারী সােবার্স, চন্দ্র-প্রসন্ন—বেদী ও আবদুল কাদিরের মতােন
আমি শব্দকে স্পিন করি। তাদের কাছেই আমি শিখিয়াছি এই
ঘূর্ণিবলের যাদু। আপেলের মত লাল বলটিকে ট্রাউজারে ঘষে
ঘষে, তাহাতে কপালের ঘাম মাখিয়ে আবদুল কাদির যেরকম
নৃত্যের ভঙ্গিতে এসে স্ট্যাম্প লক্ষ করে তার বলটিকে ছোঁড়ে,
আমিও তেমনি প্রতিটি শব্দের কানে মাত্র পাঠ করি, তারপর
‘যাও পাখি’ বলে তারে ভালােবেসে তােমার উদ্দেশে ছুঁড়ে দিই।

তখন শব্দরা বাঁক নিয়ে দ্রুতগতিতে ধাবিত হয় তােমার দিকে।
তােমার পায়ের কাছে পৌঁছতে পারার আনন্দে তারা প্রজাপতি
হয়ে উড়ে বেড়ায়, যেন হঠাৎ আকাশ থেকে রঙের ঝর্না ঝরে।
শব্দেরা স্পিন নিয়ে তােমার পায়ের কাছে পড়ে অফে, লেগে,
মিডলস্টাম্পে লাফিয়ে ওঠে, শকুন্তলার পায়ের কাছে যেরকম
আনন্দে লাফাতে হরিণ-শিশুরা। আমি একটি শব্দও ছুঁড়ি না।
তােমার বডিলাইনে, কেন না, তােমার দেহ আমার লক্ষ্য নয়,
আমার শব্দরা কেবলই পৌঁছুতে চায় তােমার হৃদয়ে প্রিয়তমা।

আমি জানি, একবার যদি মন পাই, তবে দেহ পাবাে শতবার।

আমার কবিতা লেখার সময়

এই শহরের কুকুরগুলাে যখন ঘুমায়, যখন আজিমপুর ও পলাশীর
কোনাে মানুষ আর জেগে নেই বলে মন নিশ্চিত হয়, তখন আমার
কবিতা লেখার সময়। তখনই কবিতা আসে প্রােষিতভর্তৃকার মতাে,
অত্যন্ত গােপনে। তখন আমার ঘরের দরােজা তার কোমল হাতের
চঞ্চল পরশে জাগে, আমি শয্যা ছেড়ে নিঃশব্দ চরণে উঠে যাই, পাছে
আমার পায়ের শব্দে কুকুরের ঘুম ভেঙে যায়। আলােকে জ্বালি না,
পূর্বঅভিজ্ঞতা থেকে জানি, তার বােরখার ভিতর থেকে ঠিকরে-পড়া
রূপের আলােয় দুর হবে সকল আঁধার। কী-বাের্ডের কালাে অক্ষরে
আমার কম্পিউটারের ঘুমন্ত কালাে-পর্দায় যখন তার আলাে পড়বে,
আমি তখন অবস্তু থেকে বিচ্ছুরিত সেই অবিনশ্বর আলাের ভিতরে
বিশ্বরূপের মতাে আমার না—লেখা কবিতাগুলাের রূপ দর্শন করবাে।

একটি প্রেমের সমাপ্তিপর্ব

হারানাের ভয়ে এত দিন গিঁট খুলে দেখে নি সে;
আজ তার ঝুলিটিকে বড় বেশি শূন্য মনে হলাে।
তবে কি শুন্যই ছিল যখন সে বেঁধেছিলাে তারে?
ভেতরে কি ছিল না কিছুই? যে-মুখের বন্দনায়
এত যশ, কবিখ্যাতি, সে কি ছিল শুধুই কল্পনা?
মনের মাধুরী মিশিয়ে বানানাে প্রাণহীন, মায়াহীন
এক মাটির প্রতিমা? শুধু এক কবন্ধ নারীর মুর্তি?
হয়তাে তাই হবে, তা না হলে এ কী ভাবা যায়,
অনন্ত রাত্রিপথে নেমেছিল যে-পথিক, সে-পথিক
এইভাবে হঠাৎ সন্ধ্যায় টানিবে পথের যবনিকা।

আমি তােমার পৃথিবী থেকে গুটিয়ে নিয়েছি ছায়া,
অনন্ত আকাশ-পথ তুলে দিয়েছি তােমার ডানায়।
তুমি যাও, তােমার যেখানে খুশি তুমি চলে যাও,
আমি খুঁজবাে নতুন প্রেম পুরাতন পৃথিবীর পথে।

আকাশ ও মানুষ

কবে থেকে আকাশ দাড়িয়ে আছে একা,
তার বুক থেকে খসে পড়েছে কত তারা।
বেঁচে থাকলে আরাে কত তারাই খসবে,
তা নিয়ে আকাশ কি দুঃখ করতে বসবে?

বসবে না, আমি বলছি, লিখে নাও,
আকাশকে তাে মহান মানি এ—কারণেই।
মনুষ্যবৎ হলে কি মানুষ তাকে মানতাে?

প্রিয়জন চলে গেলে মানুষই ব্যথিত হয়,
আকাশ নির্বিকার, আকাশ কখনও নয়।
তােমরা মানুষ, তাই সহজেই দুঃখ পাও,
হে ঈশ্বর, আমাকে আকাশ করে দাও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *