শিশুতোষ গল্প

শিশুতোষ গল্প।।বন্ধু আমার।। মুহাম্মদ মিজানুর রহমান

ছোটবেলা থেকেই মা আমাকে খুব আদর করতেন। আমিও সবমসয় মাকে নানা বাহানায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমার কাছে রাখতে চাইতাম। যাতে একটু বেশি আদর পাই। মা বলতেন- বাবা, সারাদিন যদি এভাবে তোর কাছে বসে থাকি তাহলে আমার ঘরদোর কে গোছাবে? কে তোকে ভালো-মন্দ রেঁধে খাওয়াবে? আমি বলতাম- মাগো, আমি ভালো-মন্দ খেতে চাই না। আমি যে তোকেই চাই মা।

বোকা ছেলে কোথাকার, এভাবে কেউ সারাদিন মাকে পাশে রাখতে চায়? তারচেয়ে বরং চল্ মায়ের কাজ কর। মাকেও দেখা হবে। ঘর-সংসারও ঠিক থাকবে।‘ মা বলতেন।

ওহ! তাইতো, মা যে ঠিক বলেছে। মা ঘরের কাজে লেগে পড়ে। আর আমি যখন যেটুকু পারি মায়ের কাজে হাত লাগাই। আমি বুঝতে পারি, আসলে মা চান না আমি কষ্ট করি। আবার আমার অকর্মণ্য হওয়াটাও মায়ের পছন্দ নয়। তার ইচ্ছে, প্রয়োজনে আমি যেন নিজের কাজগুলো নিজেই করে নিতে পারি।
আমিও ভাবলাম, মা ঠিক কথাই বলছে। তাঁর ভাবনা আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে। বাবা সারাদিন পরিশ্রম করে বাড়িতে ফিরে যদি দেখে ঘরের কাজগুলো অগোছালো, তাহলে বাবা রাগ করবেন। খুব পরিপাটি একজন মানুষ আমার বাবা। নিজের যা আছে তা নিয়েই খুশি থাকতে চান। আমার বাবা একজন দিনমজুর। অত্যাধিক খাটুনিতে যখন তার পেটে টান পড়ে, তখন মন আর মাথার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কী বলতে কী যে বলে ফেলেন…।

আজ রুশুরও বড্ড খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে ওকে কিছু দেওয়া হয়নি। তাই খাঁচার মধ্যে ডানা ঝাঁপটে জানান দিচ্ছে আমি যেন ওকে কিছু খেতে দেই। আমার রুটিন তালিকায় ওর নামটিই সবার আগে। ঘুম থেকে উঠেই ওকে একনজর দেখে নিই। সারারাত ওর ঘুম কেমন হয়েছে? ওকে দেখলেই আমি তা বুঝতে পারি। পুরনো জল ফেলে ওর পাত্রে কিছুটা নতুন জল দেই। যাতে ও তেষ্টা মিটিয়ে পান করতে পারে। ওর জন্য আমার ভারি মায়া। আমার জন্য অনেকে আছে। ওর জন্য আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কেউ বলে, পাখি পোষার শখটা বিশ্রী। এতে পাখির স্বাধীনতা খর্ব হয়। লেখাপড়ায়ও বিঘ্ন ঘটে। প্রথমোক্ত কথাটা আমি না মানলেও দ্বিতীয় কথাটায় আমি ব্যথিত হই বটে! কিন্তু আমি ওকে ভুলতে পারি না। তাই ওকে ছেড়ে দেওয়ার কথাটা আমি কোনোমতেই ভাবতে পারি না।

বাবা কাজ থেকে ফিরে এসে আজ একটু বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। বাবার একটা দারুণ অভ্যেস আছে, যখনই শরীরটা ভালোলাগে না তখনই আমাকে কাছে ডেকে নেন। কাছে বসিয়ে শিক্ষামূলক দু’চারটা কথা বলেন। বাবার কথাগুলো আমার চমৎকার লাগে। তিনি সাধারণ কথাটাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে এমনভাবে বলেন, যা অসাধারণ হয়ে যায়। তাঁর ছোট ছোট বাক্যে বলা কথা শোনার আমি দারুণ ভক্ত। মাঝেমধ্যে আবার আলোচনার বিষয়টিকে বোধগম্য করার জন্য দু-একটা গল্পও তুলে ধরেন। যা তাঁর কথার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দেয়।

বাবার সেই চিরচেনা রূপটা আজকে কেন জানি অচেনা মনে হল। চেহারায় গাম্ভীর্য। মনটা ভারাক্রান্ত। আমি বললাম- বাবা, কী হয়েছে? দেখ্ রাখা, আমার কিচ্ছু হয়নি। তুই তো জানিস, আমি একজন রুগ্ন মানুষ। দেহে কত যে রোগ বাসা বেঁধেছে, সেকথা হয়তো নিজেও জানি না। আর জেনেওবা কী হবে? তাতে মনের কষ্টটা আরো বাড়বে। দু-চার দিন যাওবা বাঁচবো সে সুখটুকু জীবন থেকে হারিয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করে নিজেকে নিয়তির হাতে ছেড়ে দিই। তাতে জীবনে সুখ নাইবা মিলুক কষ্ট তো পেতে হবে না।

রাখা, তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। আর প্রত্যেক বাবা মা-ই চান তার সন্তানটিকে মানুষের মতো মানুষ করতে। তুমি শিশু হলেও তোমার বুদ্ধিমত্তা আর মনুষ্যত্ব জ্ঞানে আমি সততার যে ছাপ দেখেছি, আশা করি এই অমূল্য সম্পদ তোমাকে তোমার সঠিক জায়গা চিনিয়ে দেবে। জেনে রাখবে, আগ্রহ আর প্রচেষ্টাহীন মানুষ কখনো উন্নতি করতে পারে না। আর অর্থ কষ্ট মানুষকে কখনো ঠেকিয়েও রাখতে পারে না। কথাগুলো তোমাকে এজন্য বলছি- জীবনের বাস্তবতায় পড়ে পড়ে আমি যেভাবে মার খেয়েছি, আমার সন্তান হয়ে তুমিও সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ো না। আজ এই কথাগুলো বলা ছাড়া তোমাকে দেওয়ার মতো আমার আর কিছুই নেই। একজন সন্তানের কাছে এর মূল্যও কম নয়। যদি সে এগুলো উপলব্ধি করতে পারে।

আমি বাবার খুব কাছে গিয়ে বসলাম। বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই বাবা ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি আর বাবাকে জাগালাম না। শুধু মাকে বললাম- দেখো, বাবা কীসব বলছে! মা আমার দিকে মলিন মুখ করে তাকালেন। আমার মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। তাহলে মা-ও নিশ্চয়ই জানে বাবার সমস্যার কথা। তাহলে মা আমাকে সে কথা খুলে বলছে না কেন?

আমি বিনয়ের সাথে মাকে বললাম- বলো না মা, বাবার কী হয়েছে? বাবা ওরকম করছে কেন? মা কিছু না বলে আঁচল দিয়ে মুখটি ঢেকে চলে গেলেন। শুধু এইটুকু বললেন, খোদার কাছে তোর বাবার জন্য দোয়া কর্। উনি যেন তাকে সারিয়ে দেন। আমি বললাম- মাগো, আমি তো ছোট্ট মানুষ- উনি কি আমার কথা শুনবেন? কেন শুনবেন না, এইটুকু বলে মা কাঁদতে কাঁদতে বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। চেয়ে দেখি, মা, রুশুর কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ালেও মা যেন আমার উপস্থিতি টের পেলো না। আমি বুঝতে পারলাম- মা, একেবারেই অন্যমনস্ক। যে মানুষটিকে এতদিন সুস্থ দেখে আসছি, সে হঠাৎ করে এতো অসুস্থ! তার মানে, এতদিন আমাকে তার অসুস্থতার কথা ইচ্ছে করেই জানানো হয়নি।
আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাবার কিছু হলে আমাদের কী হবে। মা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? আমিই-বা কী করব? ধরে নিলাম, সে নাহয় একরকম চলে যাবে। কিন্তু আমার প্রিয় বাবাকে যে আর দেখতে পাবো না। তার মুখের সেই মিষ্টি ডাক! মায়াবী আদর কোথায় পাবো? না না, আমি বাবাকে হারাতে পারবো না। আমি দৌঁড়ে গিয়ে বাবাকে ঝাঁপটে ধরলাম। বাবা, তুমি আমায় ছেড়ে কোথাও যাবে না। আর যদি যেতেও হয় আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।

বেশ কিছুদিন ঠিকঠাকভাবে রুশুর দেখাশুনা হচ্ছে না। খুব অস্থির হয়ে উঠেছে ও। বড়ই কু-ডাক ডাকছে। আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম, আমার বন্ধু হয়ে কোথায় আমাকে সাহায্য করবে- তা না, যত অশুভ চিন্তা। ফের যদি আর এসব করেছিস, তোকে আর বন্ধু বলে ভাববোই না। যা তাহলে আমায় ছেড়ে! আমি তোকে মুক্ত করে দেবো।

অনেকদিন ধরে বাবা বিছানায় পড়ে আছেন। কোনো কাজ করতে পারেন না। আয়-রোজগার সবই এখন বন্ধ। সংসারে বাবাই ছিলেন আয়ের একমাত্র উৎস। জমানো অর্থ আর সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই আমাদের। বাবাকে যে একটু ভালো-মন্দ খেতে দেবো, তা-ও পারছি না। দিন যতই যাচ্ছে বাবার শরীরের আর উন্নতি হচ্ছে না। ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। শরীরের দিকে তাকালে মনে হয়, কেউ যেন হাড্ডি থেকে মাংসকে আলাদা করে নিয়েছে। আমি মাকে বললাম- আজ আর চুপ থেকো না, এবারতো বলো বাবার কী হয়েছে? দেখ্ বাবা, মরণ পথযাত্রী জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া এই মানুষটি সম্পর্কে তোকে আর কী বলবো। যে কথা বলতে আমার জিভ শুকিয়ে আসে। দম বন্ধ হয়ে যায়। সেই মানুষটি যখন আমার চোখের সামনে মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, তখন সেই কথা আমি তোকে কী করে বলি?

আমি বাবার বুকের ওপর নিজের বুকটি রেখে আলতো করে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। বুকটা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। এই বাবাকে আমি আর জড়িয়ে ধরতে পারবো না। তাঁকে আদর করতে পারবো না। এই কথা আমি যেন কিছুতেই ভাবতে পারছি না। হঠাৎ করে আমার রুশুর কথা মনে পড়লো। এখন আর ওর ঠিকমতো যত্ন নিচ্ছি না। বেচারি কী রকম আছে, তা-ও বলতে পারি না। নগণ্য হলেও ওর একটা জীবন আছে। আছে মানুষের মতো দুঃখ-বেদনা। ও আমার কাছে নগণ্য না; ও আমার বন্ধু। রুশু খাঁচার মধ্যে মন খারাপ করে বসে আছে। খবার দিলেও রুশু মুখে নিচ্ছে না। আমি পইপই করে রুশুকে বললাম, নে রুশু, খাবারটা খা। আজ বড্ড অভিমানী ও। তাই কিছুই মুখে দিলো না।

হঠাৎ মায়ের চিৎকার শুনে আমি ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি মা শিয়রে দাঁড়িয়ে বাবার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম- মা, কী হয়েছে? অমন করে চিৎকার করলে যে! রাখা, তোর বাবা আর নেই রে! আমি যে কী করব, ভেবে পাচ্ছি না! নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর বাবার কাছে গিয়ে তাঁর শীতল হাতটি ধরে বললাম, এভাবে তুমি ফাঁকি দিলে বাবা? বাবার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। বুকের ব্যথা আর সইতে না-পেরে মাকে ধরে অবোধ বালকের ন্যায় কী যে কাঁদতে শুরু করলাম! লোকজন এসে জড়ো হল।

বাবার মৃত্যুর পর এখানে আর আমাদের থাকা চলে না। কিন্তু বাবাকে ছেড়ে যেতে কিছুতেই মন চাইছে না। তবুও মনকে শক্ত করলাম। নিজেকে বড় হতে হবে। বাবাকে একবিন্দু শান্তি দিতে পারিনি। মাকে আমি কোনোভাইে বঞ্চিত করতে চাই না। আজ আমাদের কাছে কিছু নেই। মা-ও শূন্য। আমিও শূন্য। কিন্তু বাবার উপদেশ দুটোকে আমি আমার জীবনের কর্তব্য বলে মনে করে নিয়েছি। পরম যত্নে আগলে রেখেছি তার কথাকে। জীবন যন্ত্রণার এই কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মাকে আমার সুখ-দুঃখের সাথী করে নানার আশ্রয়েই ফিরে যেতে হবে- যদিও জন্মের পরে নানার মুখটি কখনো দেখিনি। জানি না, সেই আশ্রয় কতটা সুখকর হতে পারে। তবুও বুকে স্বপ্ন বেঁধেছি।
বাবাই যখন আমাদের রক্তের বন্ধনকে মুক্ত করে দিয়েছে, তখন আমি আর রুশুকে বেঁধে রাখতে চাই না। আমি ওকে খাঁচার বাইরে এনে ছেড়ে দিয়ে বললাম, রুশু, তুই আজ থেকে মুক্ত। তোর স্বাধীনতায় আমি আর কখনো বাধা দেবো না। রুশু আমার দিকে তাকিয়ে আছে- ওর চোখ ছলছল। আমি নিজের মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মাকে নিয়ে রওনা হলাম। কারণ, আমি আর রুশুর দিকে তাকাতে পারবো না। তাহলে আমি ওর ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে ওকে ছেড়ে যেতে পারবো না।

মা আর আমি দুজনে গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে হেঁটে চললাম। রুশুর কথা বড্ড মনে পড়ছে। ও শুধু পাখি নয়, ও আমার বন্ধু। ওর কথা ভেবে আমার অন্তরটা ভারি হয়ে আসছে। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে এসেছি। হঠাৎ করে মাথার উপর তাকিয়ে দেখি একটা পাখি উড়ছে। বারবার আমার দিকে আসার চেষ্টা করছে। এই দৃশ্য দেখে রুশুর কথা আরো বেশি মনে পড়ছে। এবার সে মায়ের মাথায় এসে বসলো। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি, এ আমার রুশু।

আমি চাই না। রুশু আর আমাদের দুঃখের দিনের সাথী হোক। ওকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি। আর কোনো কষ্ট দিতে চাই না। ওকে বারবার তাড়িয়ে দেওয়ায় বিষণ্ণ মনে রুশু একটা গাছের ডালে গিয়ে বসল। আমি সামনে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। রুশু আমার পেছনে পড়েছে। ওকে ছেড়ে যেতে আমারও মন চাইছে না। তাই পেছনে তাকালাম। দেখি, একজন শিকারি ওর দিকে বন্দুক তাক করেছে। আমি সবকিছু ছেড়ে শিকারির দিকে দৌড় দিলাম। আর সজোরে চিৎকার দিয়ে বললাম- ওকে মেরো না শিকারি! ও কোনো বুনো ঘুঘু নয়, ও আমার বন্ধু রুশু।

২ thoughts on “শিশুতোষ গল্প।।বন্ধু আমার।। মুহাম্মদ মিজানুর রহমান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *