শিশুতোষ গল্প

শিশুতোষ গল্প।। হাতুড়ে – মাথা ও বাঘা হাঙ্গরের গল্প।। সুমাইয়া বরকতউল্লাহ্

সে দেখতে অনেকটা ইংরেজি ‘T’ অক্ষরের মত। তার দুই চোখের মাঝখানে এই এত্তো ফারাক। এক চোখ যদি তাকায় পূর্বে তো অন্য চোখ দেখে পশ্চিম। মাছটার এই অদ্ভুত আকৃতির জন্য সবাই তাকে ডাকে ‘Hammerhead Shark’, মানে যে হাঙ্গরের মাথা হাতুড়ির মত!

তো এমন চেহারা নিয়ে সে আছে ভীষণ দুঃখে। কেউ মিশতে চায় না তার সাথে। কেউ ভালো করে দুটো কথাও বলে না। অন্য হাঙ্গরের কাছে গেলে তাকে হাসাহাসির পাত্র হতে হয়। কী যে কষ্ট তার!

অন্যদিকে ‘Tiger Shark’ – কে সবাই খুব সমীহ করে চলে। তার সব কথা শুনে চলে। সে নামে যেমন টাইগার, তার হম্বিতম্বিও বাঘের মত। গায়ে বাঘের মতো কালো ডোরাকাটা দাগ। চেহারাও দশাসই। আর সে যেখানেই যায়, জলের প্রাণীগুলোকে ভয় দেখাতে একদম ভুল করে না। সবাই তার যন্ত্রণায় আর ভয়ে একদম তটস্থ হয়ে আছে।

তাই হাতুড়ে – মাথা হাঙ্গরের খুব ইচ্ছে সেই বাঘা হাঙ্গরের বন্ধু হওয়া। তাহলে বাকি সবাই তাকেও সম্মান করে চলবে, আর হাসাহাসি করবে না। এজন্য বাঘা হাঙ্গর যা যা খেতে পছন্দ করে, হাতুড়ে – মাথা সব জোগাড় করে রাখে। যখনই তাদের দেখা হয়, হাসিমুখে বাঘা হাঙ্গরের কাছে সে খাবার নিয়ে এগিয়ে যায়।

একদিন বাঘা হাঙ্গর হাতুড়ে – মাথার দেয়া খাবার খুব আয়েশ করে খেতে খেতে বলল,

‘কী ব্যাপার, ইদানিং এত খাবার নিয়ে আসিস আমার জন্য! কারণ কী?’

হাতুড়ে – মাথা খুব কাঁচুমাচু করে বলল,

‘আমি আসলে তোমার বন্ধু হতে চাই।’

এই কথা শুনে বাঘা তো হেসেই বাঁচে না!

‘বন্ধু! তাও আবার আমার! তোর সাহস তো কম না। নিজেকে দেখ আর আমাকে দেখ, তারপর বন্ধু হওয়ার কথা বলতে আসিস। হা হা হা… ‘

এরকম কথা শুনে হাতুড়ে – মাথার ভীষণ মন খারাপ হল। তার চেহারা দেখেই বাঘা সব বিচার করে নিলো! সে যে পানিতে ডুবুরি নামলে তাদের কোনো ক্ষতি করে না, তার এই ভালোমানুষিটা বাঘা দেখলো না!

সেই থেকে হাতুড়ে – মাথা কারো সাথে মিশতে যেতো না। একা একা ঘুরে বেড়াতো আর মনে মনে নিজেকে খুব বকতো, ‘ বেশ হয়েছে, খুব তো গেছিলাম অন্যের চোখে সম্মানিত হওয়ার লোভে। এমনই হয়, স্বার্থের চিন্তা নিয়ে বন্ধু পাতাতে গেলে।’ এদিকে গ্রীষ্মকালও চলে আসছে। হাতুড়ে – মাথা হাঙ্গর তাই মেরুর দিকে যাওয়ার জন্য ব্যাগ গোছাতে লাগল।

একদিন বঙ্গোপসাগরের অর্ধেক প্রাণী ভয় পেয়ে গেল এক চিৎকারে। সবাই ছুটে গিয়ে দেখে বাঘা হাঙ্গর অনেকটুকু শেওলা দিয়ে গা ঢেকে রেখেছে আর থেকে থেকে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে। ভীষণ অবাক সবাই। এর হলোটা কী!

বাঘা হাঙ্গরের কান্না শুনে হাতুড়ে – মাথার খুব মায়া হল। তাই আগের সব রাগ ভুলে সে বাঘার কাছে গেল। তার গায়ে লেজ দিয়ে আদর করতে করতে বলল,

‘তোমার কীসের এতো দুঃখ, আমায় বলো। সব শুনব।’

হাতুড়ে – মাথার এমন আদুরে ডাক শুনে বাঘা আর থাকতে পারলে না। ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে গা থেকে শেওলার ঝোঁপ সরিয়ে ফেলল।

  • এ কী অবস্থা তোমার!

আসলেই অবাক করার মতো ব্যাপার। বাঘার গায়ের সব ডোরাকাটা দাগ যেন ভোজবাজির মতো উড়ে গেছে! তাকে এখন মোটেও ভয়ংকর লাগছে না, সাধারণ একটা হাঙ্গরের মতোই লাগছে দেখতে।

একটু পরেই সবাই হো হো করে হেসে উঠল। এতদিন বহুত জ্বালিয়েছে সে। তাই এখন সবাই মনের ক্ষোভ মিটানোর জন্য যা খুশি বলে অপমান করতে লাগল। কিন্তু পুরোটা সময় হাতুড়ে – মাথা একদম চুপ করে থাকল।

বকবক করা শেষে সবাই যখন যার যার কাজে চলে গেল, হাতুড়ে – মাথা বলল,

‘আমায় নিয়ে যখন সবাই খুব হাসাহাসি করে, ঠিক এতোটাই মন খারাপ হয় আমার। কষ্টটা বুঝতে পারলে তো এবার? যাকগে, এখন বল, তোমার এই অবস্থা কী করে হল?’

বাঘা হাঙ্গর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল,

‘এটাই আমাদের নিয়ম। আমরা যখন বড় হয়ে যাই, গায়ের ডোরাকাটা দাগগুলো আর থাকে না। কিন্তু… কিন্তু তাই বলে সবাই এমন ব্যবহার করবে আমার সাথে? আমার চেহারাটাই কি সব!’

হাতুড়ে – মাথা হাসতে হাসতে বলল,

‘তুমি তো এতদিন ভয় দেখিয়ে সবার রাজা হতে চেয়েছিলে। কিন্তু এখন তো তোমাকে দেখতে একটুও ভয়ংকর লাগছে না। তাই কেউ আর তোমায় ভয়ও পাচ্ছে না। আর তুমি যদি সবাইকে ভালোবেসে আপন করে নিতে, তাহলে তুমি দেখতে যেমনই হও না কেন, কেউ তোমায় ছেড়ে চলে যেতো না। বুঝলে?’

বাঘা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘ঠিক বলেছ। তুমি খুব ভালো। এসো, আমরা বন্ধু হয়ে যাই। ‘

হাতুড়ে – মাথা দারুণ খুশি হয়ে গেলো বাঘার প্রস্তাব শুনে। যাক, এতদিনে একটা বন্ধু পেলো সে। আসলে ভালো মন নিয়ে কারো পাশে দাঁড়ালে সে বন্ধু হবেই। খুশিতে তাই হাতুড়ে – মাথা হাঙ্গর তার পূর্ব পশ্চিমের চোখ দুলিয়ে বললো, ‘ তথাস্ত! ‘

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *