ছোটগল্প।। সাদা রুমাল।। ফাইজুস সালেহীন
বৈচিত্রহীন এক জীবন যাপন করে চলেছেন কামাল মেহেদি। নির্বান্ধব এই জীবনের কথা যখন ভাবেন তখন বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। নিজেকে মনে হয় তিস্তাপাড়ের সর্বস্বহারা মুক্তিযোদ্ধা গণি মিয়ার মত। গণি মিয়ার কিছু নেই, কেউ নেই। জমি-জিরেত সামান্য যা ছিলো গিলে খেয়েছে প্রমত্তা তিস্তা। জোয়ান ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে শহরে গেছে সেই কবে, আর ফিরে আসেনি। গণি মিয়া ছেলের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। আর এই দিকে তিস্তারও এখন নিদানকাল। গরীব গণি মিয়ার জমি খেয়ে ওই রাক্ষুসিরও ভাল হয়নি। পানি নাই, সোত নাই, মর মর অবস্থা। বুকভরা তার এখন ধূ ধূ বালুচর, শুধু হাহাকার। তিস্তা পাড়ের গণি মিয়ার সাথে কামাল মেহেদির দেখা হয় নি কখনও। হয়তো হবেও না কোনও দিন। পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গেরিলা গণি মিয়ার ছবি, কপালে হাত দিয়ে একাকি বসে আছেন তিনি নদী পাড়ে। এই সূত্রে গণিমিয়ার সাথে সামান্য পরিচয় কামাল মেহেদির। আর তাতেই তিস্তাপাড়ের সেই দুঃখিত -তাপিত ভাঙাচুরা মানুষটিকে খুব চেনা, খুব কাছের বলে মনে হয়। মনে হয় তিনি নিজেই এক নাগরিক গণি মিয়া । কামাল মেহেদির বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে এক প্রাচীন দীর্ঘ নিঃশ্বাস। ঠিক সেই সময় দেখা হয়ে যায় অন্য এক কামাল মেহেদির সাথে। সে বলে, হলোটা কী তোমার ! এসব কী ভাবা হচ্ছে ? কামাল মেহেদি থতমত খেয়ে বলে, কী আর ভাববো! নিজের জীবনের কথা ভাবছি।
: জীবনের আবার কী হয়েছে ?
:কী হয় নি বলো?
: আহ! সেটাই তো জানতে চাইছি। বলো! বলো! মন খুলে বলো কী হয়েছে তোমার!
মমতাভরা কণ্ঠে জানতে চায় অন্য কামাল মেহেদি।
:তোমাকে কেন বলবো! কে তুমি?
: বাহ! ভাল বলেছো! আমাকে বলবে না তো কাকে বলবে ! নিশ্চিত জেনো, আমার চাইতে আপন তোমার আর কেউ নেই। আমাকে বলো , দেখো সব দূঃখ মোচন হয়ে যাবে।
: এইসব বুজরকি রাখো! মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে, দেখা তো আর কম হলো না। এত দিন পর কোথাকার কোন কামাল মেহেদি এসেছো আপনগিরি দেখাতে! শোনো! তোমাকে পরিস্কার বলে দেই, আপনজন বলতে আমার কোথাও কেউ নেই। থাকতে নেই। তিস্তা পাড়ের ওই মানুষটার মতই আমি একা। বাদ দাও এসব কথা। ভেলামারি যাবে একবার?
: ভেলামারি!
চমকে উঠলো কামাল মেহেদি। বুকের ভেতর কেমন যেন তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো॥ মুখে বললো, ভেলামারি কেন যাবো?
: কেন যাবে! সামিয়ার কথা মনে পড়ে না!
সামিয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেলেন অন্য কামাল মেহেদি। তখন ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। সঙ্গে শীতল বাতাস। কামাল মেহেদি এসে বসলেন দখিনের বারান্দায়। অনেক দিন পর বৃষ্টি নামলো। আষাঢ় মাসেও ঠা ঠা রোদ গেছে এই ক’দিন। এখন শীতল বৃষ্টি এসে প্রাণ জুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। দখিনের বারান্দা তো নয়, এ যেন প্রাণেরই বারান্দা। সে দিনও খুব বৃষ্টি ছিলো। সে দিন ছিলো বিষুদবার ; স্পষ্ট মনে আছে। বৃষ্টি ছিলো সারা রাত। সেই বৃষ্টির রাতে কমান্ডার মাহতাবের মনে হলো মধুপুর ক্যাম্প আক্রমনের এই সুযোগ। কামাল মেহেদিরও তা-ই মনে হয়ে ছিল। মধুপুর বাজারের উত্তর দিকে প্রাইমারি স্কুলে হানাদার ক্যাম্প। রাত সাড়ে এগারোটায় কোমরে গামছা বেঁধে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পশ্চিম দিক থেকে ক্রলিং করে ভাঙ্গা লোহার পুলের নিচে ওরা পজিশন নেয় নন্দা খালের ঢালে । ফায়ার ওপেন করে কামাল মেহেদি। মাহতাবের এলএমজি গর্জে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে মিলিটারি ক্যাম্প থেকে শুরু হয়ে যায় বুলেট বৃষ্টি। এমনই হওয়ার কথা। গেরিলারা ভাল করেই জানে যে মিলিটারি ক্যাম্পে রসদের কেনো অভাব নেই। ওদের অস্ত্র-গুলিরও কোনো খামতি নেই। এই দিক থেকে একটা গুলি ফুটলে ওরা দশটা কি একশটা বুলেটও বর্ষণ করতে পারে। মেশিনগানও চালিয়ে দিতে পারে। সব জেনে শুনেই মাহতাব ও তার বাহিনী তুমুল বৃষ্টির মধ্যে আক্রমন চালায়। খান সেনারা পাল্টা গুলি করতে শুরু করলে খালের ঢালে গেরিলারা রাইফেল তাক করে ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে ঝিম মেরে অপেক্ষা করে। বৃষ্টির তোড় আরও বেড়ে যায়। ক্যাম্প থেকে গুলি বর্ষণ হচেছ অবিরাম। টর্চ মেরে গেরিলাদের অবস্থান সনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। ক্যাম্প থেকে এত দূরে খালের ঢালে ঝিম মেরে পড়ে থাকা গেরিলাদের দেখে ফেলার কোনোই কায়দা নাই। কমান্ডার মাহতাব কাদাজলে মাখামাখি করে উত্তর দিকে ক্রলিং করতে শুরু করে । সঙ্গীরা কমান্ডারকে অনুসরণ করে। তিন শ গজ কি তার চাইতে কিছু বেশি দূূর গিয়ে পুবদিকে বাঁক নিয়েছে নন্দাখাল । বাঁক পেরিয়ে গেরিলারা সামান্য জিরিয়ে নেয়। এখান থেকে ফের এলএমজির ব্রাশ ফায়ার করে মাহতাব। ক্যাম্প থেকে এবার গুলি বর্ষণ শুরু হয় এই দিকটা লক্ষ্য করে। বুলেট বৃষ্টি হতে থাকে অবিরাম। গেরিলারা কিছুক্ষণ ঝিম মেরে পড়ে থেকে আবারও ক্রলিং করতে শুরু করে। উত্তর দিকে আরও হাজার বারো শ গজ এসে ওরা খানিক জিরিয়ে নিলো। তখনও ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিলো। থেমে থেমে ঝিলিক মেরে আকাশ ডাকছিলো। সেই সঙ্গে মিলিটারি ক্যাম্প থেকে অব্যাহত ছিল বুলেট বর্ষণ । মাহতাব ও কামাল মেহেদির দল এখন যেখানটায সেখানে খালের পাড়ে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে তিনটে প্রাচীন বটবৃক্ষ। তার নিচে শিয়ালমোতি , খুড়েকাঁটা আর বিষকাটালির ঘন জঙ্গল। তারপরেই খালের ঢালের ঠিক ওপরে এলোমেলো দণ্ডায়মান অনেকগুলো ডুমুরের গাছ। বড় বড় পাতার ভারে ডুমুরের কয়েকটি ডাল নুয়ে পড়েছে খালের পানির ওপর। বটের তলায়, ডুমুর ঝোপের ফাঁকফোকরে ওড়াউড়ি করে অনেক জোনাকি পোকা। মিটিমিটি আলো জ্বলে আর নেভে। এইখানে খাল আর জলেডোবা পাট ক্ষেত একাকার হয়ে গেছে। মধ্যরাতে পশ্চিম আকাশে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারে ঘড়ি মেরে ওঠা ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ। ধূসর জোসনায় তিরতির করে বয়ে যাওয়া খালের ঘোলা পানি ঝলমল করে। পানির ওপরে জেগে থাকা পাটের ডগায় বিছানো সবুজ জমিনে ঢেউ খেলে যায় বৃষ্টি ভেজা রাতের বাতাস। কাদামাখা শরীরে উপুড় হয়ে শুয়ে রাইফেলের বাটে মাথা রেখে এই নিসর্গ ছবির মধ্যে ডুবে যায় কামাল মেহেদি। তখন তার মনে পড়ে যায় জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার কথা। কবির মুগ্ধ চোখে কামাল মেহেদি বর্ষণমুখর জোসনা রাতে রূপ দেখে রূপসী বাংলার। রূপের নেশায় আনমনা হয়ে যায় গেরিলা কামাল। ঘাড়ের কাছে হাতের স্পর্শে সম্বিত ফিরে পায় কামাল মেহেদি। মাথা তুলে দেখে কমান্ডার মাহতাব। ফিসফিস করে মাহতাব বলে, রাত পোহাবার বেশি বাকি নাই। আমাদের এখন বেক করতে হবে। আরেকটু সামনে গেলে দুইটা নাইল্যা ক্ষেতের মাঝখানের ফাঁক দিয়া আমরা খাল পাড় হয়ে যাব। হারামির বাচ্চারা সারারাইত ফায়ার করতে থাকুক। বলে মাহতাব মাটিতে পেন্সিল লাইট মেরে সঙ্গীদের আগে বাড়বার ইঙ্গিত দেয়।
কমান্ডারের নির্দেশে গেরিলারা সামনের দিকে ক্রলিং করতে শুরু করে । মিনিট কয়েকের মধ্যেই ওরা এসে যায় সেই জায়গায়, যেখানে দুটো পাট ক্ষেতের মাঝখানে ফাঁকা । খালের এপাড় ওপাড় ঘোলা পানির পথ। সেখানে পাটক্ষেতের ভেতর থেকে গলুই বার করে একটা ডিঙিনৌকা একটু একটু দুলছে । কার নাও কে জানে ! হবে হয় তো ধারে কাছের কোনো জেলে মাঝির নৌকা। বৃষ্টির পানি পড়ে ডিঙি প্রায় অর্ধেক ভরে গেছে; ডুবোডুবো অবস্থা। সবার আগে, খুব সাবধানে মাহতাব পানিতে নেমে নৌকার গুলুই ধরে। নিঃশব্দে পানিতে নামে সিরাজ, মিরাজ, ফজলু , কামাল: ওরা সবাই। কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে ধরে কাত করে ডিঙির পানি ফেলে ওরা চুপচাপ ওঠে বসে। বৈঠা নেই। পাটের গাছ ধরে ওপাড়ের উদ্দেশে ডিঙি সামান্য চালু করতেই সিরাজ বলে, ওস্তাদ ; এইডা কিরম অপারেশন অইল! খালি খালি রাইতভর মেঘে ভিইজ্জা কয়ডা গুলি ফুডায়া ভাইগ্যা যাইতাম! একটা জানোয়ারও পড়ছে বইল্লা তো মনে হয় না।
সিরাজের কথায় কামাল বলে , সিরুর কথা টা কিন্তু ঠিকই। কমান্ডার মাহতাব বলে, রাইতও বেশি নাই। অহন কি করন তাইলে! সিরু বলে, ওস্তাদ পারিমিশন দেও , দুইডা বেল মাইরা আসি। ঠিকমত দুইডা মারতে পারলে ক্যাম্পই উইড়া যাইব। মাহতাব কোনো কথা বলে না। চটের ব্যাগ থেকে দুটো হ্যান্ডগ্রেনেড বের করে একটা সিরুর হাতে দিয়ে আরেকটা নিজের কাছে রেখে ডিঙি থেকে নেমে পড়ে। বলে তোমরা অপেক্ষা করো , দশ মিনিট। সিরু আর মাহতাব জোড়া বটগাছের নিচ দিয়ে উত্তর দিকে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরাম! আগুনের ঝিলিক মেরে বিস্ফোরিত হয় একটা গ্রেনেড। মহূর্তের মধ্যে আরেকটা বিস্ফোরণ। প্রচন্ড শব্দে কেঁপে ওঠে চারদিক। দৌড়ে নৌকার কাছে চলে আসে মাহতাব ও সিরাজ। আর এক মহূর্তও বিলম্ব নয়্, পাটের গাছ ধরে ধরে ডিঙি চালিয়ে ওরা চলে আসে খালের ওপাড়ে।
ওরা হাঁটতে শুরু করে। যেতে হবে বহুদূর। বেতাগইর, ভেলামারি, চরশ্রীরামপুর,কাদিরপুর ছাড়িয়ে গোবিন্দপুরে মাহতাব বাহিনীর ক্যাম্প। গোপাট আর আল-বাতরের পথ । কম করে হলেও পনের মাইল। ওরা ক্লান্ত-শ্রান্ত। কাধে রাইফেল , এলএমজি। ক্ষুধায় পেট চু চু করছে। পথে প্যাক-কাদা । শরীর সবারই অবশ হয়ে আসছে। পা চলে না। ওরা যখন ভেলামারির ঝাউবনে এসে পৌছেছে তখন মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে। কামাল মেহেদি আর এক পা-ও এগুতে পারে না। মাথা চক্কর মারলে ও পথের মাঝখানেই বসে পড়ে। মাহতাব বলে, কি হইলো কামাল বইসা পড়লা যে! কামাল কোনো জবাব দেয় না। সিরাজ ছুটে এসে মাথায় হাত রেখে বলে , খুব খারাপ লাগতাছে কামাল ভাই?
: না। তেমন কিছু না। মাথা টা চক্কর মারছিলো।
বলে কামাল মেহেদি সিরাজের হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। সিরাজ বলে, কামাল ভাই তোমার শরীরটা তো দেখি একটু গরম গরম লাগতাছে। জ্বর না আইয়ে আবার।
এ কথা শুনে কমান্ডার মাহতাব চিন্তায় পড়ে যায়। বলে, এ তো বড় মুশকিলের কথা। ফজলু বলে, মুশকিলের কিছু নাই মাহতাব ভাই। সকাল তো হইয়াই গেলো। সামনেই ঢালি বাড়ি। ইয়াকুব ঢালি আমার বড় মামু।। চিন্তা নাই। মামুর বাড়ি যাইয়া উডি আগে। বাসি-পান্তা যা হোক কিছু নাশতা পানি কইরা কিছুক্ষণ জিরায়া জুড়ায়া আবার রওনা দেওন যাইব।
ফকফকা সকাল হয়ে গেছে। সারা গ্রাম জেগে উঠেছে। ইয়াকুব ঢালি মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে সবে বাড়ি ফিরেছেন। ঠিক তখন ফজলু হাজির সঙ্গিদের নিয়ে। ইয়াকুব ঢালি ওদের দেখে বললেন , একি অবস্থা তোমাদের ! তিনি দেখেই বুঝতে পারেন যে তার ভাগনে গেরিলা সাথীদের নিয়ে এসেছে। তিনি তাড়াতাড়ি করে চৌচালা বাংলা ঘরের কপাট খুলে দিলেন।
কামাল মেহেদির জ্বর আরও বেড়ে গেল। দিনশেষে মাগরেবের পর ওরা চলে যাবে গোবিন্দপুর। ইয়াকুব ঢালি বললেন, ফজলু মিয়া , তোমাদের তো জোর কইরা রাখতে পারবো না! কিন্তু জ্বর নিয়া ওই মিয়া তো যাইতে পারবে না। কামাল মিয়ার যাওনের কাম নাই। জ্বর নামলে যাইব নে।
জ্বর শরীর নিয়ে কামাল মেহেদি রয়ে গেল ভেলামারির ঢালি বাড়িতে। সবাই চলে গেলে ইয়াকুব ঢালি কামাল মেহেদির সিথানে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকলেন, সামিয়া! তোমার মায়েরে এক বাটি গরম দুধ দিতে বলো। একটু পরেই সামিয়া চিনামাটির বাটি ভরে গরম দুধ নিয়ে এলো। সামিয়ার পেছনে পেছনে এলেন ওর মা। ইয়াকুব ঢালি বললেন ,দুধ টা খাওয়াইয়া দেও। আমি যাই। হালিম ডাক্তাররে পাই কিনা দেখি। তোমরা ধারে কাছেই থাকো। ইয়াকুব ঢালি বেরিয়ে যান ডাক্তারের খোঁজে। সায়েমার মা কামালের সিথানে বসে কপালে হাত দিয়ে বলেন, ইয়া আল্লা জ্বরে তো গা পুইরা যাইতাছে। ও সামি, পানির ব্যবস্থা কর। পানি দিতে অইব।জ্বর মাথায় উইঠ্যা গেলে উপায় নাই। আল্লারে আল্লা পোলাডার বাপ মা কেউ নাই কাছে । বাজান একটু উঠেন। উইট্যা গরম দুধ টুক খাইয়া লন। কামাল মেহেদির দুই চোখ পানিতে ভরে যায়। মনে পড়ে যায মায়ের কথা। মনে পড়ে বোনের কথা। কতদিন দেখা হয় না। সেই যে বৈশাখের পূর্ণিমা রাতে কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছে, আর তো ফিরে যাওয়া হয় নি। ছলছল চোখে ও তাকিয়ে থাকে এই অনাত্মীয়া মায়ের দিকে। সামিয়া ছুটে গিয়ে কলস ভরে পানি নিয়ে আসে। মাথার কাছে একটা চেয়ার পেতে বসে কামালের মাথায় পানি ঢালে সামিয়া। মাথার চুলে বিলি কেটে দেন ওর মা। কামাল বলে , খালাম্মা আপনাদের বড় কষ্টে ফেলে দিলাম।
কষ্ট কিয়ের বাজান ! নিজের ছেলের এরম জ্বর আনলে কি করতাম!
আপনার ছেলে কোথায়?
মায়ের বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাস। বললেন ,ছেলে আমার কোথায় আছে কেমন আছে, কিছুই জানি না বাপ। গত বৈশাখে ফরহাদ একদিন আমারে কইলো, মা আমি যুদ্ধে যাইয়াম। সেই দিনই বুকটা ধড়ফড় কইরা উঠল। মাথার কিরা দিয়া কইলাম , না রে বাপ যুদ্ধে যাওয়ার কাম নাই তোমার । কার কথা কে শোনে! তিনদিন পরে সকালে দেখি তার বিছানা খালি । সেই খালি তো খালি । পুত আমার পলাইয়া যুদ্ধে চইলা গেছে। কোথায় গেছে বলতে পারিনা। আইজও কোনো খবর দেয় নাই। বলতে বলতে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে মায়ের চোখ।
কামাল কি বলবে ! কোনো কথা খুঁজে পায়না। মা বলেন, সামি রে পানি মনে আরও দেওন দরকার । তুই আর কয়েক বদনা পানি ঢাইলা দে মা। আমি দেখি পাকের ঘরে যাই। বেডার খাওনের ব্যবস্থা করি গিয়া। সায়েমা পানি ঢালে নিঃশব্দে। ওর নিঃশ্বাস পড়ে কামালের কপালে। ও বলে, আর পানি দেওনের কাম নাই।
আচ্ছা।
বলে সামিয়া গামছা দিয়ে কামালের ভেজা মাথা মুছিয়ে দিতে শুরু করে। কামাল বলে, গামছাটা আমারে দিলে আমি নিজেই মুছতে পারি। সায়েমা কোনো জবাব না দিয়ে কামালের ঘাড় উঁচু করে ধরে মুছিয়ে দেয়। কামালের তপ্ত গাল ছুয়ে যায় সামিয়ার চেক শাড়ির মেলায়েম আচল। ও উঠে বসে। সামিয়া বলে , অহন একটু ভাল লাগতাছে না?
কামাল বলে , আপনাদের কষ্ট দিতাছি।
আর কোনো কথা নাই আপনের!
কৃত্রিম রাগ মাখিয়ে বলে সামিয়া।
সেই যাত্রায় কামাল মেহেদি বিছানায় পড়ে ছিলো পুরো একুশ দিন । আর এই একুশ দিনের মধ্যে ঢালি বাড়ির সাথে ওর কি এক বন্ধন যে রচিত হয়ে গিয়ে ছিল , তা কোনো দিন কাউকে বলতে পারেনি কামাল মেহেদি। সামিয়াকে বলতে চেয়েছে, বলা হয় নি। সামিও মনে হয় বলতে চেয়েছে, কিনতু বলেনি। ভাঁজ করা সেই সাদা রুমালে কি লিখে দিয়েছিল নাকি এঁকে দিয়ে ছিল, তাও জানা হয়নি কামাল মেহেদির। ভেবে ছিল , নিঝুম রাতে, যখন কেউ জেগে থাকবে না, আকাশে শুধু জেগে রবে চাঁদ, তখন হারিকেনের মৃদু আলোয় এই সফেদ রুমালের ভাঁজ খুলে একাকি দেখবে দু চোখ ভরে। আর কথা হবে সামিয়ার সাথে মনে মনে। কিন্তু তার আগেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল দুধসাদা সেই রুমাল।
একুশ দিন পর জ্বর নেমে গেলে ঢালিবাড়িতে আরও তিন দিন ছিল কামাল মেহেদি। তিনদিন পর আরেক বিষুদবার সকালে কামাল মেহেদি ঢালিবাড়ি ছেড়ে যাত্রা করে গোবিন্দপুর। এ বাড়ি থেকে বেরুবার আগে সামিয়া আসে বাংলাঘরে। কামাল বলে , সামি, আর কবে দেখা হবে জানি না। সামিয়া বলে , দেখা কি হবে না কোনো দিন?
: কি করে বলবো বলো।
: দেশ স্বাধীন হবে না!
:স্বাধীনতার জন্যই তো এই লড়াই।
: তবে কেন দেখা হবে না?
কামাল কোনো জবাব খুজেঁ পায় না। ও তাকিয়ে থাকে সামিয়ার দিকে। চোখে চোখ পড়ে যায়। চোখ নামিয়ে নেয় সামিয়া। অকারণেই লাজ রক্তিম হয়ে ওঠে ওর মুখমন্ডল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে ভাঁজ করা একটা রুমাল চৌকির ওপর রেখে সামিয়া পালিয়ে যায়। কেউ এসে পড়বার আগেই কামাল সেটি হাতে তুলে নেয়। তখনই ভাঁজ খুলে দেখার সাহস হলো না ওর। আরও একটা ভাঁজ করে বুক পকেটে তুলে রাখল সামিয়ার দেওয়া রুমাল।
সামিয়ার মা তেলের পিঠা বানিয়ে টিফিন ক্যারিয়ার ভরে দেন । বলেন, গোবিন্দপুর ক্যাম্পে আমার ছেলেদের লইয়া খাইয়ো। ওদের বইলো, ঢালিবাড়ির মায়ে দিছে। কামালের চোখে পানি টলমল করে। সামিয়া দাঁড়িয়ে দেউড়ির পাশে সামিয়া। আঁচল দেখা যায় , মুখ দেখা যায় না । কেন এই আড়াল বুঝে উঠতে পারে না কামাল মেহেদি।
এতগুলো বছর পেছনে ফেলে এসে কেন মনে পড়ে তারে? কেন জানতে ইচ্ছে করে সে কোথায়? অতীতের বক্ষ বিদীর্ণ করে জানতে বড় সাধ হয় কি ছিল সেই ভাঁজ করা সাদা রুমালে !
Excellent thanks and good story
Very good story
অসাধারণ গল্প। দেশ স্বাধীন করার শাণিত প্রতিজ্ঞা…জানবাজি গেরিলা লড়াই…ফেলে আসা গোপন-মোহন টান…অনিবার্য এক দুর্ঘটময় সময়- মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকাল আর তার হৃদয়-চেরা স্মৃতির অনন্য বয়ান ‘সাদা রুমাল’- যার ভেতর মিশে আছে দুই জীবনের সবটুকু আবেগ-আকুলতা…
এই সুন্দর মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।
“সাদা রুমাল ” অত্যন্ত চমৎকার একটি ছোট গল্প।
আমার গল্পটা পড়ে মনে হয়েছে আমি গল্প না সত্যি কোন ঘটনা জেনেছি। মুক্তিযুদ্ধের কথা, ঘটনার বিবরণ অত্যন্ত সাবলিল, সরল ভাবে লেখা হয়েছে, এতে লেখকের মুন্সিয়ানার পরিচয় মেলে।
‘সাদা রুমাল’ শক্তিমান কথাশিল্পী ফাইজুস সালেহীনের অন্যতম এক গল্পের নাম।জীবন কখন কোথায় কীভাবে আটকে যায় অথবা হয়ে যায় ক্ষণকালের জন্যে স্হিতু- আগাম তা বলা যায় না। কামাল মেহেদি স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধে যায়। হঠাৎ আক্রান্ত হয় অসুখে। ঢালীবাড়ি অনাত্মীয়, অথচ তাদের নিবিড় সেবা-যত্নে সুস্হ হয়। অসুস্হকালীন সময়ে ঢালীবাড়ির মেয়ে সামিয়া আর কামাল মেহেদি পরস্পরকে নিমগ্ন চিত্তে অনুভব করে।পরবর্তীকালে এই অনুভব কামাল মেহেদির জীবনে অব্যক্ত ব্যথার শ্বাসাঘাত হয়ে থাকে। ‘সাদা রুমাল’ মুক্তিযুদ্ধের গল্প। এগল্পে যেমন আছে হৃদয় চর্চার প্ল্যাটোনিক সংবাদ, তেমনি আছে যুদ্ধদিনের অনিকেত জীবনের ছবি, আছে যুদ্ধোত্তর দেশে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির যোগফল মিলানোর ব্যর্থ প্রয়াস, যে কারণেই কামাল মেহেদি তিস্তাপাড়ের গনি মিয়ার ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করতে চায়। সব মিলিয়ে ‘সাদা রুমাল’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শৈল্পিক ফটোগ্রাফ।
কথাশিল্পী ফাইজুস সালেহীন অসাধারণ মুন্সীয়ানায় নির্মাণ করেছেন ‘সাদা রুমাল।’ তাঁর ভাষা বিন্যাস, ঘটনা প্রবাহ তৈরীর কৌশল, চরিত্র অংকনের কারিশমা যেমন এই কথাশিল্পীর শিল্পবোধের গভীরতার কথা মনে করিয়ে দেয়, তেমনি মনে করিয়ে দেয় ‘সাদা রুমাল’ আমাদের ছোট গল্পের ভুবনে দ্যুতিঝরা এক সংযোজন।
‘সাদা রুমাল ‘ মুক্তিযুদ্ধের গল্পটি কাব্যশালীন কর্তৃক নির্বাচিত হওয়াই প্রিয় সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব ফাইজুস সালেহীনকে অভিনন্দন। সত্যিই এটি অসাধারণ একটি ছোট্ট গল্প ।গল্পে কামাল মেহেদী’র মত দেশ প্রেমিক মুক্তিযুদ্ধারা সকল মায়া পেছঁনে ফেলে যুদ্ধে আসলে যখন সামিয়ার বাবা-মায়ের মত লোকজন পাশে দাঁড়ায় তখন বিজয় সুনিশ্চিত। তাই মাত্র নয় মাস যুদ্ধ করে বিজয় অর্জিত হয়েছে,যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল৷
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এ গল্পটি স্বাধীনতা উত্তর কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়তির খন্ডচিত্র এবং কামাল মেহেদি ও তাঁর সঙ্গীদের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান তুলে ধরা হয়েছে। অসুস্থ কামাল মেহেদির সামিয়াদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া,তাঁর প্রতি সামিয়া ও তার বাবা-মায়ের ভালবাসাও চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলা হয়েছে। সবশেষে সামিয়ার প্রণয়ে কামাল মেহেদির দুর্বল হওয়া,সামিয়ার দেয়া সাদা রুমালে কামালকে কিছু একটা লিখে দেয়া গল্পটিতে অন্যরকম এক স্পৃহার সঞ্চার ঘটায়। ধন্যবাদ প্রিয় লেখক ❤️❤️❤️
‘সাদা রুমাল ‘ মুক্তিযুদ্ধের গল্পটি কাব্যশালীন কর্তৃক নির্বাচিত হওয়াই প্রিয় সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব ফাইজুস সালেহীনকে অভিনন্দন। সত্যিই এটি অসাধারণ একটি ছোট্ট গল্প ।গল্পে কামাল মেহেদী’র মত দেশ প্রেমিক মুক্তিযুদ্ধারা সকল মায়া পেছঁনে ফেলে যুদ্ধে আসলে যখন সামিয়ার বাবা-মায়ের মত লোকজন পাশে দাঁড়ায় তখন বিজয় সুনিশ্চিত। তাই মাত্র নয় মাস যুদ্ধ করে বিজয় অর্জিত হয়েছে,যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল৷
সাদা রুমাল-মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি অসাধারণ গল্প। লেখক কথাসাহিত্যিক ফাইজুস সালেহীন দারুণ দক্ষতার সাথে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা তুলে এনেছেন। গল্প পাঠে পাঠক বিমোহিত হবেন। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ঘটনাবলী জানতে গল্পটি নিয়ে নাটক বা চলচ্চিত্র হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সাদা রুমাল ইতিহাস প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্থান করে নিতে পারেন। অভিনন্দন গল্প কারকে..
অত্যন্ত সুন্দর বর্ণনা। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে সাবলীল রচনা। ধন্যবাদ।
লেখক অসাধারণ এই গল্পের সূত্রপাত করেন এক নান্দনিক কুহেলিকা সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। রহস্যময়তার আবর্তনের ভেতর দিয়ে শীঘ্রই এবং অবলীলায় পাঠক পৌঁছে যান একাত্তরের যুদ্ধমগ্নদিনের নিবিড় বাস্তবতার ক্যানভাসে। বস্তুত মহান মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত দলিল এই সাদা রুমাল। নিঃসন্দেহে এটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প।
এই গল্পটি পড়বো পড়বো করেও নানান কারণে এতদিন পড়া হয়নি। আজ পড়লাম। মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হলাম! ঢালিবাড়ির আতিথ্য, সামিয়ার দুর্বার আকর্ষণের সবুজ রুমাল আর দেশ মাতৃকা- এই ত্রি-ধারা ভালোবাসার টানাপড়েনে শেষ পর্যন্ত মাতৃভূমির মুক্তিই প্রাধান্য পেয়েছে। একজন খাঁটি প্রেমিক তো এমনই হয়! সবার আগে দেশ!
এই গল্পটি দিয়ে একটি সুন্দর টিভি নাটক হতে পারে।
হতে পারে। কিন্তু করবে কে?
সে যাক গে।
কষ্ট করে পড়া এবং তারপরে ভারি সুন্দর একটা কমপ্লিমেন্ট! খুশি হলাম।
অনেক ধন্যবাদ প্রিয় মাজহার জুয়েল
মুক্তিযুদ্ধের একটি খন্ডচিত্র এই সাদা রুমাল। গল্পকার নিপুণ কৌশলে নন্দাখালের রাতের সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন, যেন চোখে প্রতীয়মান।
গণি মিয়ার এমন চরিত্র বর্তমান। কামাল মেহেদীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আলোকিত হয়েছে পটভূমি।
গল্পটা পড়ে আরো তৃপ্ত হয়েছি এখানে আমার নাম (ফরহাদ) উঠে এসেছে, ভালো লেগেছে। সাদা রুমালের ব্যক্ত ভাষা অপূর্ণতা রয়ে গেল, এটাই সার্থক ছোট গল্প।
আমাদের পাঠকদের জন্যে গল্পটি আমরাও শেয়ার করলাম।
সাদা রুমাল-মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি বাস্তব গল্প, যার মাধ্যমে বিশাল বিস্তৃত পটভূমির স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো একটি বিষয় অত্যন্ত চমৎকার, সুন্দর ও প্রাঞ্জল বর্ননায় তুলে ধরা হয়েছে, এটি যেন সামগ্রিক ভাবে পুরো তৎকালীন প্রত্যন্ত বাংলার গেরিলা যুদ্ধের অণুচিত্র।লেখক কথাসাহিত্যিক ফাইজুস সালেহীন দারুণ দক্ষতার সাথে মুক্তিযুদ্ধের মত একটি বিস্তৃত বিষয়কে ছোট গল্পের প্রাঞ্জলতায় তুলে এনেছেন। গল্প পাঠে পাঠক মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের অবলোকন করতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ঘটনাবলী জানতে গল্পটি নিয়ে বিস্তৃত আলোকপাত হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সাদা রুমাল ইতিহাস সাক্ষ্য নথি হিসেবে স্থান করে নেয়ার মত একটি লেখনী। অভিনন্দন কথাসাহিত্যিককে।
গল্পে মুক্তিযুদ্ধের মাঝে শুভ্র ভালোবাসার চিত্রায়ণ তা পাঠককে আগ্রহী করে তোলে সামির অনুভূতি জানার। যে কথা ‘সাদারুমাল’ এ লেখা ছিল তা অজানা রয়ে গেল হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায়। কিন্তু সামির অস্তিত্ব আজও রয়েছে কামাল মেহেদীর মনের ভেতর।
এই ছোটগল্পে ফাইজুস সালেহীনের মুন্সিয়ানা পারম্ভে ও শেষাবধি নিঃসন্দেহে বলা যায়।
I visited a lot of website but I conceive this one has got something special in it in it