হাবিবা লাবনী’র কবিতা
পরিহারের পূর্ণতা
সকলেই সরে গেছে, তুমিও কম যাওনা!
তাতে কি; টিকে আছি এখনো।
ছাতিম ফুলের সুবাসিত সুবাতাস,
আমর্শে জানায়- সুপ্রভাত।
দোয়েলটা ঘোরলাগা শিষে
জানতে চায় ভালো-মন্দ সব।
দারুন আছি ; সাথে ধন্যবাদ।
হিমসিক্ত ঘাসে পা ডুবালে পরে,
প্রশান্তি বিরাজিত দেহ-মন
আনন্দের অনুনাদে দোলে ওঠে।
রোদের আলোর উষ্ণতায়,
জাগন্ত হয় নীরস চেতন।
মাঝবেলা ভর করে গাঢ় উদাস
জড়ো হয় গোপন বিষাদ;
আচমকা দূর আকাশের হাতছানিতে
মিলে যায় কবিতার চরণ।
অশ্রুত সেই শব্দগুচ্ছ
প্রাণে তুলে নয়া শিহরণ।
বৈকালিন আবহে ‘বউ কথা কও’ পক্ষীটা,
কেমন আদুরে কন্ঠে ডাকতে থাকে;
রোমাঞ্চিত আমি হই পরিপূর্ণ।
নিঃসঙ্গ গোধূলি চূর্ণে ঢেকে যাই যখন,
সন্ধ্যামালতীর বাহারি রঙে
রাঙায়িত শেষবেলায়;
রঙিন আলোয় হই রাঙায়িত।
নির্ঘুম নিশিথের অসহ্যতায়;
তানপুরার স্নিগ্ধ সুরের তালে
স্বপ্নেরা সব দলবেধে
বিরহের আদরে ঘুম পাড়ায়;
কলুষমুক্ত আমি ফিরি শৈশবে।
সবার প্রতি রইল অগাধ কৃতজ্ঞতা।
অবিরত সতেজীকরণের অভিপ্রায়ে
নব-যৌবনে বিকশিত হই।
তবে নির্বাধ কৃতজ্ঞতার যোগ্য শুধুই তুমি;
যদিও আমায় এড়িয়ে চলো।
তোমার এই পরিহারেই তো
শুদ্ধ নিসর্গের আবির্ভাব।
কবিতায় সমর্পণ
এবার আমি ঠিক করেছি
কবিতাকে নোবেল পুরস্কার দিব।
কবিকে নয়, তবে কবিতার প্রেমিক কেও,
কেননা তুমি কবিতা ভালোবাসো আর আমি তোমাকে।
প্রয়োজন হলে নতুন করে
কবিতার ডিনামাইট আবিষ্কার করব।
সে নব্য ডিনামাইট গোটা বিশ্ব লন্ডভন্ড করে
খনির অতল গহবর থেকে বের করে আনবে
পৃথিবীর আদিমতম কবিতা।
রক্ত খুড়ে আনা লাল দিয়ে সে কবিতার প্রতিটি পঙতি
রাঙায়িত করে মনের ফ্রেমে বাধিয়ে
তোমায় উপহার দিব।
অতঃপর পৃথিবীর তাবৎ কবিকে কবিতার ছুড়ি দিয়ে,
খুচিয়ে খুচিয়ে একে একে হত্যা করবো।
আর সকল কবির কবিতা লুন্ঠন করে
তোমার পথে থরে থরে সাজিয়ে রাখবো।
তুমি কবিতা স্পর্শ করতে করতে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে
যখন গনগনে সূর্যের মতো
পড়ন্ত বিকেলের দিগন্তে এলিয়ে পড়বে,
তখন খুব আলতো হাতে,
আমি তোমার কবিতার দোলনায় দোল দিবো।
তুমি দোল খেতে খেতে তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে বিড়বিড় করে
কবিতার পঙতি আওড়াবে।
ঠিক তখনই আমি কবিতার হাওয়া বইয়ে দিয়ে
তোমাকে করবো সুশীতল।
ঘুমন্ত তুমি সজাগ হয়ে কবিতার সমুদ্রে অবগাহন করবে
পৃথিবীর সকল ভালোবাসার কবিতা
তোমাকে ঘিরে ব্যস্ত সময় কাটাবে,
তোমাকে নতুন কবিতার পোষাকে সাজাতে।
অসাধারন সব কবিতার সাজে সজ্জিত তুমি তখন
কবিতার কল্পলোকে কবিতার পাখা মেলে
সাদা মেঘের মতো ভেসে বেড়াবে।
আমি অপেক্ষায় থাকবো যতক্ষন না তুমি
কবিতার স্বর্গরাজ্য থেকে ফিরে আসো।
আমি তোমার জন্য সৃষ্টি থেকে
ধ্বংস অবধি সব কবিতার ছন্দ মেখে
নিস্পলক নেত্রে দাড়িয়েথাকব।
তোমার ছন্দের স্পর্শে আমি
শিহরিত, মুখরিত, উদ্ভাসিত আর প্রকম্পিত।
অতঃপর কবিতার মৃত্যুসুধা পান করে আমি,
নিজেকে বিসর্জন দিব তোমার ভালোবাসার বেদিতে।
কষ্টবিলাস
চুপ থাকা সব কষ্টগুলো কেমন করে মোচড়ে উঠে!
নদীর ধারে বিশাল মাঠের পাড় বাধানো ছাতিম তলায়;
ডিঙ্গি নৌকা বৈঠা বেয়ে ঢেউয়ের তালে সুর তুলে যায়;
জ্ঞানের ভারে নুয়ে পড়া বয়সী সেই তেতুল তলায়;
ওপারের ঐ কাশবনের সেই সাদা সবুজ সজীবতায়;
চার্চ আঙিনার কাটা মেহেন্দীর গুল্ম ছাটা সতেজ ডগায়;
কাজলকোঠা বিলের পাড়ে মেঠো পথের মাদকতায়;
বটতলার ঐ সরু লেকের ছোট ছোট ঢেউয়ের দোলায়;
বোটানিকাল গার্ডেনের ফুলেরা সব বাগান সাজায়;
কেন আমার এমন করে কষ্ট লাগে বলতে পারো?
হাউজ বিল্ডিংয়ের মাস্কটের সেই উচু প্লাজায়;
চন্দ্রিমার সেই লেকের ধারের জোৎস্নারাতের সিড়িগুলো
লালবাগ কেল্লার লাল রঙা সব ইতিহাসের দেয়াল গুলো
রমনা বটের পুরোনো সব ঝুল শিকড়ের মিলনমেলায়;
টিএসসির সড়কদ্বীপে সোপার্জিত স্বাধীনতায়;
কার্জন হলের খোলামাঠে এলোকেশের কৃষ্ণলীলায়;
বুয়েটের নজরুল হলের গেষ্ট রুমের সেই নীরবতায়;
লেডিস হলের বিশাল মাঠে জনারণ্য সন্ধ্যাবেলায়;
আটকে থাকা কষ্টগুলো হঠাৎ করেই ফুপিয়ে ওঠে।
এমন করেই বয়ে বেড়াই নীরব গোপন কষ্টগুলো।
তবুও দিন যাচ্ছে কেটে নিয়ম মেনে কেমন করে,
সূর্য ওঠে সূর্য ডুবে এই নিয়মেই নিত্য চলে।
কষ্টেরা সব ফিকে হয়ে একটা সময় টিকে গেছে।
রাত গভীরে করুন সুরে গুনগুনিয়ে গান শুনিয়ে;
মনে পড়ে সব। মনে পড়ে যায়; কষ্টগুলো উথলে পড়ে
কষ্টবিলাস মনটা আমার কঠিন তালে বাজনা বাজে।
কোভিডের থাবা
এ যাত্রায় যদি বাঁইচ্যা যাই,
কমলা সুন্দরী দিঘীর পাড়ো বইসা জোৎস্না দেখবা আমার লগে!
আয়মান গাঙের ঘোলা পানিত গোসল দিবা আমার লগে!
কাজলকোঠা বিলের ধারে বইসা দখিনা বাতাস খাবা আমার লগে!
পুবের বাঁইদে কাদা মাখাইয়া টেংরা-পুটি ধরবা আমার লগে!
ও রুজুর বাপ! কথা কওনা ক্যা!
তোমার মনে আছে?
আমারে দেখার লাইগা টিনের চালে বড়ই পাড়তে উঠতা।
আমিও ঘরে ঢুইকা খিল দিতাম।
চুরি কইরা তোমার আফসোস দেখতাম, আর মনে মনে হাসতাম।
ইস্!এত কস্ট করলা তাও দেখবার পারলানা।
রুজুর বাপ!আর কতো গোস্যা কইরা থাকবা আমার লগে!
তুমি যদি সেই ছোডকালে সাতার টা না শিখাইতা;
কবেই জলে ডুইবা মইরা যাইতাম।
এই বেলাতেও যখন ডুবতে নিছিলাম!
তুমিই তো বাঁচাইলা আমারে!
নতুন জীবন দিলা।
তুমি না থাকলে কবেই বানের জলে ভাইস্যা যাইতাম!
তাতো দুনিয়ার সক্কলেই জানে।
এই দুইন্যাতে ওপরওয়ালা তোমারে আমার রক্ষাকবচ কইরা পাঠাইছে;
তা কি আর অস্বীকার করার জো আছে!
তার লেইগ্যাই তো আমার বুকটা ধরফর করে তোমার বুকে যাওয়ার লাগি।
তোমার ঐ মাথা ভর্তি চুলে বিলি কাটবার মন চায়।
কিন্তুক কেমনে? তোমারে ছুইবার পারিনা, ধরবার পারিনা।
মনডা খুব পোড়ায় তোমার লাগি।
এতো যে পোড়ায় আগে বুঝবার পারিনাই।
আমি নারী
নিয়ত খোলসে ঢাকা শৈশবে;
অপর গড়নে নাই ভ্রুক্ষেপ।
ক্ষুদ্র চেতনায় ভাবনার খোঁচা,
ভৌত ঢক বলে, আমি নারী!
ভাবে-খেলায়-চলায় শত বারণ;
জাগরনে অপসারণে শুধুই শাসন,
নিবারণ-নিয়ন্ত্রণ বলে, আমি নারী!
রজঃস্রাবের রক্তিমায় ভয়ার্ত;
শৈশবের মুক্তিতে কৈশোরে গমন,,
বয়ঃসন্ধিক্ষণের মানস পরিবর্তন
একটা প্রচ্ছন্ন আশ্রয় খুঁজি
যেখানে মিলবে সঠিক সমর্পণ।
ইচ্ছেগুলো সুর মিলিয়ে বলে, আমি নারী!
চপলতা-চঞ্চলতা আর নাহি সাজন;
সেচ্ছাচারী আমি তবে অতি ভদ্রজন।
নিজকে গুটানোই হলো জীবনের কারন;
স্বাধীনতা আচমকা বলে, আমি নারী!
ললিতে-অশোভনে ধরা দেয় ভুল;
শত যত্নেও মিলেনা গুনের কবুল।
মেধার পাপ চেচিয়ে বলে, আমি নারী!
মাতৃত্বের সাধ মিলে তীব্র আকাঙ্ক্ষায়;
আরও তৃপ্ততা আসে প্রসব যন্ত্রনায়।
বংশের বৃদ্ধির মনোযোগে আচ্ছন্ন;
প্রতিটি ক্ষণ বলে, আমি নারী!
নিজের কোন ঘর নেই,
নেই কোন নিজস্ব ঠাঁই,
দায় যেন কার বেড়াজালে আবদ্ধ?
আলাদা স্বকীয়তা নেই কোন;
পরাধীনতার বেড়াজালে অস্তিত্ব খুজি,
পুরুষসম হওয়ার তেজ কোথায়?
বলবান পথরোধ করে বলে, আমি নারী!
হ্যা আমি নারী, আমি আবার মানুষ কিসের?
নারী তো নারীই, নারী কি মানুষ ছিলো কখনো?