ছোটগল্প।। পতাকার ছায়া।। মোহিত কামাল
বাড়ির ছাদে উড়ছে লাল-সবুজ পতাকা। আর পড়ন্ত বিকেলে বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে সংগীতা দেখছে সেই উড়ন্ত পতাকা, ছায়া-পতাকাও। ছায়াটা পড়েছে পাশের বাড়ির দেয়ালে।
আসল পতাকা আর ছায়া-পতাকার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
ছায়ার আড়ালে আসল থাকে, জানে ও। আরও জানে খোলা চোখে পার্থক্য থাকে। তবে আসল চোখে নকল নেই, ভেজাল নেই। ছায়াটাও জানান দিচ্ছে একই বিজয়ের কথা।
সেই ছায়াই নিবিড় করে দেখতে লাগল সংগীতা।
দেখে ফেলল ছায়ার ভেতরের সত্যটাও―মনও তার পতাকার মতো নড়ছে, উড়ছে এখন।
একাত্তরের বিজয় দেখে নি ও। শুনেছে বিজয়ের কথা। এখন দু হাজার সাত সনে বসে দেখছে বিজয়, একাত্তরের বিজয়ের আনন্দের মতো বড় বিজয়; ক্রিকেট-বিশ্বে বাংলাদেশের বিজয়।
মাশরাফির জাদু-বলের ঘূর্ণি দেখছে ও ওই উড়াল-পতাকায়।
ওর ইচ্ছা করছে পতাকার ছায়া বুকে নিয়ে মাশরাফির একটা ছবি তুলতে, ছুঁয়ে দিতে আশরাফুলের হাত, তামিম-আফতাবের ব্যাটের মতো ঝলসে উঠতে। হাবিবুল বাশারের মুখের তৃপ্ত হাসি বুকে পুরে ওই উড়ন্ত পতাকার মতো উড়তে ইচ্ছা করছে সংগীতার।
মা ডাকলেন, ‘ওখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছ, সংগীতা?’
‘ছায়া দেখছি?’
‘ছায়া দেখছ!’
‘হ্যাঁ মা, ছায়া দেখছি, পতাকার ছায়া। বিজয়ের ছায়া দেখছি, মা।’
সংগীতার মা রঞ্জিতা চৌধুরী, দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন মেয়ের সঙ্গে। মেয়ের কথা শুনে দ্রুত তিনি নেমে এলেন নিচে। সংগীতা তখনো তাকিয়ে আছে পাশের বাড়ির দেয়ালের দিকে।
‘সংগীতা!’ কাছে এসে মা ডাকলেন আবার।
‘হ্যাঁ মা! কিছু বলবে, বলো।’ সংগীতা সাড়া দেয় মায়ের ডাকের।
‘কী ছায়া দেখছ, মা?’
আঙুল তুলে ছায়া দেখাল সংগীতা, পতাকার ছায়া, উড়ন্ত ছায়া―‘ওই যে দেখো, বিজয় উড়ছে।’
রঞ্জিতা চৌধুরী মেয়ের আঙুলের নিশানা অনুসরণ করে পুবের বাড়ির দিকে তাকালেন। কোনো ছায়া পড়ল না তাঁর চোখে। তিনি দেখলেন এক তরুণ জানালার পাশ থেকে নিবিড় চোখে তাকিয়ে আছে সংগীতার দিকে।
রঞ্জিতা চৌধুরী বললেন, ‘কোথায় ছায়া, মা? জানালার আড়ালে তো দাঁড়িয়ে আছে একছেলে!’
অবাক হয়ে আবার তাকাল সংগীতা।
‘হ্যাঁ। এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে ছায়া-দেয়ালের পাশের জানালায়। ছেলেটি নির্বিকার তাকিয়ে আছে ওর দিকে।’
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মাকে সংগীতা বলতে চাইল, ‘মা দেখো…।’
সংগীতার কথা থামিয়ে দিয়ে মা ওর হাত ধরে বললেন, এসো, ‘বাসায় এসো। এসব ছায়া দেখার দরকার নেই।’
‘মা, আমি তো ওই দেয়ালে পতাকার ছায়া দেখছিলাম! বিজয়ের উল্লাস দেখছিলাম।’
‘না, দরকার নেই দেখার। বাসায় এসো।’
‘মা, এটা তো বিজয়ের পতাকা। জয় ছিনিয়ে আনার পতাকা।’
‘জয় আনার দরকার নেই, এসো বাসায় এসো।’
‘মা, ভালো করে দেয়ালটা দেখো, জানালা দেখছ কেন?’
‘না, তুমি এসো, আমি আর কিছু দেখতে চাই না।’
‘মা, তুমি কি জানো না, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পরাশক্তি ভারতকে হারিয়ে দিয়েছে আমাদের টাইগাররা? এটা কি বিজয় দিবসের চেয়ে কম বড় বিজয়?’
জানি। কিন্তু তুমি এসো। বাসায় এসো। মা বেপরোয়া, একরোখা।
‘কী হয়েছে মা, আমাকে বার বার বাসায় ডাকছ কেন?’
‘কিছু হয় নি। তবু তোমাকে বাসায় ডাকছি। এসো।’
সংগীতা মন খারাপ করে মায়ের পেছন পেছন এগিয়ে গেল। সিঁড়ির গোড়ায় এসে হোঁচট খেল ও। একটা টিকটিকি টিক টিক শব্দ করছে। সংগীতার মনে হচ্ছে ‘টিক টিক’ শব্দ ঘোষণা করছে ‘ঠিক ঠিক’। বাংলাদেশ ঠিক ঠিক অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেবে সুপার এইটের প্রথম খেলায়।
ঠিক ঠিক শব্দ বুকে নিয়ে দোতলায় উঠে এল সংগীতা।
মায়ের বার বার ডাকে মন খারাপ হয়েছিল। টিকটিকির ঠিক ঠিক অন্তর্ধনী শুনে মন ভালো হয়ে গেল আবার। মায়ের ওপর জেদ চেপেছিল, জেদও কমে গেল। তৃপ্ত মন নিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকাল এবার।
‘বলো মা, কী হয়েছে? এমন করলে কেন?’
‘কিছুই করিনি। কিছু হয় নি। এ বয়সে হ্যাবলার মতো ছেলেদের দিকে তাকানো ঠিক না, এটা বোঝাতে চেয়েছি।’
‘ছিঃ মা, ওই ছেলেকে তো দেখি নি, আমি দেখছিলাম উড়ন্ত পতাকা, পতাকার ছায়া। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় তো দেখি নি, কিন্তু এখন সেটাই দেখছিলাম। ক্রিকেট দুনিয়ায় আমাদের জয়গাথার মধ্য থেকে।’
‘এ কথা বলেছ একবার। আর বলতে হবে না।’
‘বলতে হবে না মানে! সত্যটা জানতে হবে না? সত্য জানা জরুরি নয়? সত্য না জানলে আমার ওপর অবিচার করা হবে না?’
‘সত্য জানা জরুরি, ঠিক আছে। বাস্তবতা হচ্ছে প্রয়োজনে এড়াতে হয় সত্যটাকে। তুমি এড়াতে পারো নি। পতাকার ছায়ার পাশে দাঁড়িয়ে একছেলে তোমাকে দেখছে। সে তো ছায়া দেখতে দাঁড়ায় নি জানালার পাশে। সে হয়তো ভেবেছে তুমি তাকেই দেখছ। নিজের অজান্তে কি তুমি ছেলেটিকে প্ররোচিত করে ফেললে না?’
সংগীতা এবার সত্যি সত্যিই অবাক হলো। মায়ের কথার অর্থ বুঝতে পারল। বাস্তবতা বুঝতে পারল। তারপরও নিজের অজান্তে ব্যালকনিতে এসে ও তাকাল পাশের বাসার সেই দেয়ালের দিকে। এখান থেকেও পতাকার ছায়া দেখা যায়। এখান থেকেও জানালার ওপাশে আবার এসে দাঁড়ানো ছেলেটির মুখও দেখা যায়।
সংগীতার মনে হলো―ও কেবল একটি ছেলে না। মনে হলো, ওই ছেলেটি একটি ছায়া, তামিমের ছায়া, মাশরাফির চোখ ধারণ করে তামিম তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এ তামিম-দল মুক্তিবাহিনীর উদ্যাপিত প্রথম বিজয় দিবসের উড্ডীন পতাকার মতো পতাকা ছিনিয়ে আনবে খেলার মাঠেও।
সংগীতার ইচ্ছে করছে হাত নেড়ে ছেলেটার তাকিয়ে থাকার নিশানাটা পতাকার দিকে ঘুরিয়ে দিতে। হাত তুলতে গিয়েও তুলল না। থেমে গেল। পতাকার দিকে তাকিয়ে মনে মনে আওড়াল, মাশরাফি, আমি চাই প্রথম ওভারে অস্ট্রেলিয়ার একটি উইকেট। সারা দেশের মানুষ যেন চিৎকার করতে পারে, বোল্ড! বোল্ড! দেশের কোটি কোটি মানুষের তর্জনি যেন ওপরে উঠে যেতে পারে, অস্ট্রেলিয়ার প্লেয়ারদের যেন মুখ মলিন করে সাজঘরে ফিরে যেতে হয়।
ওই তরুণ এবার জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়াল। ওর মুখ চেপে ধরল গ্রিলের ওপর। সংগীতার মনে হলো, উইকেটের ফাঁক দিয়ে হাসছে মাশরাফি, হাসছে তামিম, হাসছে হাবিবুল বাশার, হাসছে বাংলাদেশ, হাসছে দেশ স্বধীন করা মুক্তিযোদ্ধারাও।
ওই হাসির রেশ ছড়িয়ে পড়ল মনের গহনেও।
এ সময় আবার ডাক শুনতে পেল সংগীতা, মা আবার ডাকছেন-‘ঘরে এসো সংগীতা।’
‘আসছি মা।’
‘না, এখনই এসো।’
সংগীতা মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। দেখল মা দরজা পেরিয়ে ব্যালকনিতে এসেছেন। জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।
সঙ্গে সঙ্গে উধাও হয়ে গেল ওই বাড়ির জানালার মুখটা।
রঞ্জিতা চৌধুরী এবার তাকালেন মেয়ের মুখের দিকে।
সংগীতার মুখের অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন নেই। মুখে ফুটে আছে প্রত্যয়ের ছায়া। জয়ের ছায়া। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সুপার এইটে খেলছে। এটাই তার কাছে বিশ্বকাপ জয়; দেশের স্বাধীনসত্তার জন্য উজ্জল উপহার। জয়ের নেশায় উন্মত্ত সংগীতার আচরণেও ফুটে আছে দাপুটে ভঙ্গি।
গম্ভীর মুখে ব্যালকনি থেকে সরে এলেন রঞ্জিতা চৌধুরী। মেয়ের মন বোঝা ভার। মেয়েকে নিয়ে শঙ্কাহীন নন তিনি। কোথায় কোন ফাঁদে পড়ে, এ নিয়ে সব সময় চিন্তিত থাকেন।
মাকে অনুসরণ করে ঘরে ঢোকে সংগীতা।
মায়ের আচরণে মোটেই ক্ষুব্ধ নয় ও। পাত্তাই দিচ্ছে না মায়ের পিছু ধাওয়া, বিধিনিষেধ। ও আছে আপন জগতে। ক্রিকেট জগতে। ক্রিকেট ‘প্লেয়িং নেশন’ হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় ‘দি গ্রেট’ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে। ভারতের মতো পরাশক্তির বিদায় হয়েছে, পাকিস্তান লজ্জা ঢাকতে ব্যস্ত। বাংলার এগারোটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন শুনেছে বিশ্ববাসী। বঙ্গবন্ধুর তর্জনি-শাসানো গর্জনের মতোই মনে হচ্ছে এই গর্জনকে। রোমাঞ্চকর উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে উঠছে সংগীতা। মনে মনে ও আওড়াতে লাগল, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীন বাংলাদেশকে উপরে ওঠানোর সংগ্রাম। বিশ্বআসরে জয় ছিনিয়ে আনার সংগ্রাম।’
দুই
সামনে এপ্রিল মাস। সংগীতা জানে পহেলা এপ্রিল হচ্ছে একে অন্যকে বোকা বানানোর দিন। অথচ বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ১৯ বছরের তরুণেরা বিশ্বকে সত্যিকারভাবে বোকা বানিয়ে দিয়েছে। ব্যাটে-বলে ফিল্ডিয়ের যুদ্ধে ধাপে ধাপে এগিয়ে এসেছে তারা।
এপ্রিল হচ্ছে যুদ্ধের মাস। এ মাসে শুরু হয়েছিল আমেরিকান রেভ্যুলেশন ওয়ার, আমেরিকান সিভিল ওয়ার, রুয়ান্ডার যুদ্ধ, বসনিয়ার যুদ্ধ। এখন চলছে ক্রিকেট বিশ্বযুদ্ধ। আর সুপার এইটের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় চাপা পড়ে গেছে মানবযুদ্ধ। দেশে জঙ্গিদের ফাঁসি হয়েছে। মদদদাতাদের ধরার পথ খোঁজা হচ্ছে। জঙ্গিবাদের পতন হবে নিশ্চয়। মাথা উঁচিয়ে বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়ার সুযোগ এসেছে, আমরাও পারি। এমন ভাবনার আলোয় জেগে উঠে ও দেখল মাশরাফির প্রত্যয়দৃপ্ত দেহের ভাষা, শুনল জয়ধ্বনি। আশরাফুলের কচি মুখ ফুল হয়ে ফুটছে, কে ঠেকাবে ওদের?
এখন বৈশাখের ভাষা বোঝে না সংগীতা। অথচ এক সময় বৈশাখ নিয়ে উন্মাদনায় ব্যস্ত থাকত ও। কয়েকদিন আগে বৈশাখী কালেকশনের কয়েকটা পোশাক পছন্দ করে রেখেছিল বিজ্ঞাপন দেখে। মেরুনের ওপর দুর্দান্ত কাজ করা ড্রেসটা এখন আর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে লালের মাঝে সবুজের ডিজাইন ছাড়া অন্যকোনো ড্রেস মানাবে না ওকে। লাল-সবুজের ড্রেস কেনা দরকার। ভাবনাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কাছে গেল ও।
‘মামণি, টাকা দাও। বৈশাখী ড্রেস কিনতে যাব।’
মা সন্দেহের চোখে ঘুরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কোথায় যাবে?’
‘বেশি দূর না, রাইফেলস স্কয়ারে বৈশাখীমেলা হচ্ছে। বৈশাখীমেলায় যাব।’
‘সে তো আমিসহ যাওয়ার কথা।’
‘তুমি তো এখন যেতে পারবে না, নানা কাজে ব্যস্ত। পরে যেয়ো।’
একসঙ্গে যাব আমরা। আমারও তো কেনাকাটা আছে।
সংগীতার মন মানে না। পরে বলে কথা নেই। এখনই যেতে ইচ্ছে করছে। জোর দিয়েই বলল, ‘এখনই যাব, মামণি।’
রঞ্জিতা চৌধুরী কথা বাড়ালেন না। মেয়ের জন্য বাজেট আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। বাজেটের প্যাকেটটা আলমারি খুলে তুলে দিলেন সংগীতার হাতে।
বদলে গেল সংগীতার চেহারা। অন্যরকম আলো ফুটে ওঠল ওর চোখেমুখে। মা অবাক হয়ে দেখেন মেয়েকে। মেয়ের পরিবর্তন বুঝতে অসুবিধে হয় না। তবে কি মেয়ে প্রেমে পড়েছে ? মনে প্রশ্ন জাগে। উত্তর খোঁজার চেষ্টা না-করে নিজর ঘরে ঢুকে গেলেন তিনি।
তিন
বৈশাখীমেলায় ঢুকে অন্যরকম হয়ে গেল সংগীতার মন। রাইফেলস স্কয়ারের উত্তর-পশ্চিম কোণে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। বৈশাখী অনুষ্ঠানমালা চলছে এ প্রাঙ্গণে। ন্যাচারাল বৈশাখীমেলা নয়। কিছুটা কৃত্রিম এ মেলার আয়োজনে আছে ভিন্নমাত্রার লোক-দেখানো আবহ। মেলা ভালো লাগল না ওর। রাইফেলস স্কয়ারের মূল ভবনের ভেতর ঢুকে এসকালেটর বেয়ে চলে এল চতুর্থ তলায়। কে-ক্র্যাফটের সামনে এসে দাঁড়ানো মাত্রই মেরুন রঙের ড্রেসটা দেখতে পেল ও। দারুণ এ ড্রেস কেনার লোভ আটকাতে না-পেরে মূল্য দেখার চেষ্টা করার সময় পাশে এসে দাঁড়াল এক যুবক। সে কালো প্যান্টের ওপর পরেছে লাল-সবুজ রঙের ব্র্যান্ডেড ফতুয়া। ফতুয়াটা দেখে নড়ে ওঠল সংগীতা। মনে পড়ে গেল নিজস্ব মিশনের কথা।
মেরুন রঙের পছন্দনীয় পোশাক মুহূর্তে হয়ে গেল অপছন্দনীয়। শাড়ি কিনতে ইচ্ছা হলো ওর। লাল-সবুজের স্বাধীনতার শাড়ি, বৈশাখী ড্রেসের বদলে স্বাধীনতার শাড়ি।
বিজয়ের শাড়ি কেনার ইচ্ছা জোরালো করে কে-ক্র্যাফট থেকে বেরিয়ে ‘রঙ’-এর শোরুম খুঁজতে লাগল সংগীতা। সেখানে লাল-সবুজের শাড়ি পাওয়া যেতে পারে। একঢিলে তিন পাখি মারা হবে। বৈশাখ পার হবে। স্বাধীনতার স্বাদও পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যাবে উড়ন্ত পতাকার বিজয়ের গৌরব। ক্রিকেট সাফল্যের আনন্দের গৌরব। স্বাধীন দেশের স্বাধীনসত্তার হিমালয় চ‚ড়ায় ওঠার গৌরব।
সংগীতার মন চনমন করে ওঠে। গোপন এক আনন্দধারা বয়ে যায় মনভুবনে। নিজেকে সামলাতে না-পেরে এসকালেটর বেয়ে নেমে আসার জন্য পা বাড়াল ও। এসকেলেটরে প্রথম ধাপে পা রেখে নিচের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখল আরেক জোড়া পা প্রায় একসঙ্গে রেখেছে কেউ।
চোখ উপরে তুলে দেখল লাল-সবুজের ফতুয়া পরা ওই যুবককে।
সংগীতার চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। মুখে অকৃত্রিম হাসির রেখা নিয়ে গভীর চোখে ও তাকিয়ে দেখল যুবকটিকে।
মনে হলো মাশরাফি এইমাত্র বোল্ড আউট করেছে একজনকে।
মনে হলো, আফতাব ছক্কা মেরে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
সংগীতা কথা বলে কম। অথচ এ মুহূর্তে চুপকথার মেয়েটির মুখে আনন্দধ্বনি বের হলো, ‘আপনার ফতুয়াটা খুব সুন্দর!’
‘থ্যাংকস ফর কমপ্লিমেন্টস।’ যুবক ভদ্রভাবে জবাব দিল।
‘কোন হাউজ থেকে থেকে কিনেছেন এটি?’
যুবক হেসে বলল, ‘নিচে পাওয়া যাচ্ছে।’
‘আমি লাল-সবুজের একটা শাড়ি খুঁজছি। শোরুমটা দেখিয়ে দেবেন?’
‘ওহ্ শিওর! চলুন আমার সঙ্গে।’
সংগীতা বলল, ‘চলুন।’
এক অপরিচিত যুবককে অনুসরণ করতে তার বোধের ভেতরে মোটেও বাধা কাজ করল না। জড়তাহীন ছেলেটার পেছনে হাঁটতে লাগল।
একবার মনে হলো কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? এমন অপরিচিত যুবকের সঙ্গে কথা বলা কি ঠিক হলো? তার সঙ্গে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে?
সঙ্গে সঙ্গে ভাবনাটা মাথা থেকে উড়ে গেল।
যে ছেলে লাল-সবুজের পোশাক পরতে পারে তার মনে কালিমা থাকার কথা নয়, তার মন ছেঁড়াখোঁড়া নয়, বীভৎস নয়, নোংরা মনের ছেলে হতেই পারে না সে। তাকে বিশ্বাস করা যায়―নতুন ভাবনার গুণে নিজের অন্তর্জগতে বিরাট এক শক্তি টের পেয়ে গেল ও। দ্রুত পা চালিয়ে ছেলেটার পাশাপাশি এসে মুখ না-ঘুরিয়ে একবার চোরা চোখে দেখল তাকে।
তার চেহারা মোটেই আকর্ষণীয় নয়। তবে ফতুয়াটা তাকে দারুণ মানিয়েছে। ফতুয়ার কারণে যুবককে হ্যান্ডসাম লাগছে।
যুবক বলল, ‘ওই যে রঙের শোরুম। ওখানে শাড়ি পাবেন।’
সংগীতা বলল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ।’
ছেলেটা ঠোঁটে হাসি রেখে বলল, ‘আমি আসি।’
সংগীতা আবার বলল, ‘ধন্যবাদ।’
সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে যুবক ঘুরে দাঁড়াল। হাঁটতে শুরু করল।
তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল সংগীতার। সুযোগ পেল না ও।
মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল সে।
হঠাৎ মনে চিনচিনে ব্যথা জেগে ওঠল। মন খারাপ হয়ে গেল ওর। খারাপ মন নিয়ে শোরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে লাল-সবুজের শাড়ি দেখে আবার মন ভালো হয়ে গেল সংগীতার।
ছেলেটার মধ্যে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের আলো দেখেছে ও। হ্যাঁ, এমনই তো হওয়া উচিত ছেলেদের। যে-ছেলে লাল-সবুজের পোশাক গায়ে দেবে, তাকে তো হ্যাংলার মতো মেয়েদের পেছনে লেগে থাকা মানায় না। স্মার্ট তো হতেই হবে তাকে। বিজয়ের উন্নত শিরই তো চাই তার ব্যক্তিত্বে।
ভাবতে ভাবতে সংগীতার মনও দৃঢ় হতে লাগল।
আবেগে কাবু হওয়া চলবে না। সে এসেছে লাল-সবুজের শাড়ি কিনতে। শাড়ি পরবে। বিজয়ের পতাকার মতো উড়বে ও। মাথা উঁচিয়ে মাশরাফির মতো হেঁটে বেড়াবে। সুশোভন হবে ওই যুবকের মতোই।
ভাবতে ভাবতে লাল-সবুজ শাড়ি কিনে ফেলল ও । সব আছে শো-রুমে। রেডিমেট বøাউজ পেটিকোটও কিনে ড্রেসিংরুমে ঢুকে শাড়ি পরে নিল সংগীতা। নতুন শাড়ি পরে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এল।
রাইফেলস স্কয়ার থেকে বেরিয়ে সামনের লবি পেরিয়ে উদ্যত ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগল বিজয়িনী সংগীতা।
মনে মনে খুঁজল যুবকটিকে।
না, আশপাশে নেই সেই যুবক।
সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ও। বৈশাখী বাতাস বইছে। সে-বাতাসে এলোমেলো উড়ছে পরনের শাড়ি। উড়ছে সংগীতার চুল।
যেন উড়ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট জয়ের পতাকা। উড়ছে দেশের স্বাধীনসত্তা। চারপাশের সবাই দেখছে সংগীতাকে। যেন বিশ্ব দেখছে হাবিবুল বাশারের দলকে।
বিশ্বকাপ থেকে বিজয়ের পতাকা নিয়ে ওরা বেরিয়ে আসছে… ওরা আসছে… দলে দলে।
সংগীতাও এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। সাহসী সংগীতা বাধাহীন। জড়তাহীন। আত্মপ্রত্যয়ী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসূর্য মাথায় তুলে নিয়ে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে… আরও সামনে…।