কবিতা

গুচ্ছ কবিতা- ওমর শামস

সুরা বৃত্তান্ত

১.
শক্তি তার কবিতা মাতাল হয়ে লিখতো, আবার পড়তোও মাতাল হয়ে।
২.
বিনয় অর্ধেক মাতাল, অর্ধেক পাতাল হয়ে লিখতো। সে কি করে পড়তো ?
বুঝি তার কনকেভ আয়নার মধ্যে উলটে গিয়ে নিজেকে নিজেই
নীল আবার গোলাপি, নিরেট আবার বাষ্পে বলতো।
৩.
আল মাহমুদ প্রথম দিকে একটা ভালো দেশী মাল নামিয়েছিলো, বাংলার
গাছ-গাছালি, খনার বচন, এমন কি আলিফ-লাম মিশিয়ে।
পড়তো মফঃস্বলী টানে। পরে ওর সুরা গেঁজে গিয়েছিলো।
৪.
জিনের মধ্যে জিন্দাবাহার লেনের কুলফি ঝাঁকা দিয়ে, শামসুর রাহমান, একটা
কিছু তৈরী করেছিলেন। একদিন ভুলে তার ক’ফোঁটা পাশের আস্তাবলের
ঘোড়ার পেটে পড়লে, সে ডানা পেয়ে বোররাক এক রক্তিম সন্ধ্যায়
আকাশে উড়ে গিয়েছিলো। তাঁর পড়া ওই ঝিমুনো মেজাজের।
৫.
সুধীন্দ্রনাথ গ্লাসে হুইস্কি আকন্ঠ পান করে তবু জিরো মাতাল
তিনি জীয়ন্ত চিত্তবান হয়ে যামিনী রায়ের ১৩টি ছবির নিচে বসে লিখতেন।
পড়তেন স্বচ্ছ ঝক্ঝকে অস্তিত্ববান, তাঁর গ্লাসের স্ফটিক-বরফবৎ।
৬.
বিষ্ণু দে পাত্রে সুরা ভরতেন, কিন্তু চোঙঅলা কলের গান চালিয়ে পিয়ানো
চেলো-ভায়োলিন-বাখ-বেঠোফেন-এ ভেসে দিব্যি পান ভুলে লিখতেন,
সুস্থির, নিষ্কম্প্র, যেন বোতল খোলেনই নি।
তিনি পড়তেন কাটা-কাটা যদিও লিখতেন হিন্দোলায়।
৭.
বুদ্ধদেব বসু কঙ্কাবতীকে বিদায় দেবার পর রামরোজের মধ্যে আমলকীর
রস মিশিয়ে একটা ভালো সুরা নামিয়েছিলেন কখনো জানালায় পর্দা টেনে,
কখনো জানালা খুলে ব্রুকলিন ব্রিজ দেখে-দেখে টেবিলে গ্লাশ, স্তবকে
আবার মাত্রাহীনতায় লিখেছিলেন। পড়তেন দোদুল্যমান তরঙ্গে।
৮.
জীবনানন্দর কি ভিন্টেজ কেনার সাধ্যি ছিলো ? তবু তিনি আকন্দ, ধুন্দুল,
মৃগনাভি, বুনোহংসীর ডিম, কোন বাবিলনের রানীর সাতনরী খশা মুক্তো
মিশিয়ে নিজস্ব চোলাইয়ে কনিয়াক পান ক’রে লিখেছিলেন। ওই
ফর্মুলা আজ পর্যন্ত কেউ পুনরাবিষ্কার করতে পারে নি।
আহা! তাঁর পড়া যদি একবার শুনতে পেতাম।
৯.
মাতাল হও দ্রষ্টা কবি বাণী দিয়ে গিয়েছেন।
কিন্তু একুশ শতকে আমি সুরা পাই কোথায় ? চারিদিকে আইপ্যাড, ড্রোন,
টেরাবাইট, টেররিজম, জেহাদ এসব দিয়ে কি চোলাই করা যায়?
তবু লিখতে হবে।
কে আছিস, দে রে এক গ্লাস আগুন দে।

অস্তিত্ব

এইমাত্র একটা ভূত এসে বলে গ্যালো ভূত বলে কিছু নেই এইমাত্র।
সেদিন মৌলবি বলেছিলো মৌলবি বলে কিছু নেই। নামাজের পরে।
চোর সিঁদ দিয়ে পালাবার আগে বলেছিলো, চোর বলে কিছু নেই। এখনো বলে।
জঙ্গী এসে বলে গ্যালো জঙ্গী বলে কিছু নেই। ২০০২ থেকে।
রাজনীতিবিদ বলেছে রাজনীতি বলে কিছু নেই। কতোকাল মনে নেই।
শুধু আকাশ বললো আকাশ বলে কিছু আছে। ১৪ বিলিয়ন বছর।

আহমদ ছফা

চাকরীতে নেই তার খেদ,
শুধু বাড়ি যাবে একদিন, এই তার দফা।
আর কিছু বান্ডিলের মাঝে “মুসলমানের মন”, “ফাটা বুদ্ধিজীবি”
বুঝেশুনে তার শেষ রফা, করে যাবে আহমদ ছফা।
শাহবাগ, রমনা আর নীলখেত, বিশ্ববিদ্যালয় আদাড়, বাদাড়
অনেক ঘোরার পর একদিন,
ছফা কেনে ট্রেনের টিকিট :
চট্টগ্রাম, অতঃপর বাসে, হেঁটে গাছবাড়ি।
লোলমাখা, উড়ান্ত চুল, ট্রেনের বগিতে এক কয়লাটে ছিন্নমূল দেখে,
ছফা, মুড়ি দ্যায় কিনে।
অন্ধকারে আধোঘুমে, ট্রেনের উল্টোদিকে অবিরাম ছুটন্ত
স্বাধীনতা ধ্বস্ত হ্রেষা খোয়াবের কালসিটে স্ক্রিনে।
অতঃপর গাছবাড়িটির গাছ দ্যাখা যায়
কাঁপানো কলার পাতা, গাঙের শালিখ
তারে চেনেনাকো।
যেখানে নদী রপারে সাঁকো টঙ্গের দোকান
সেইখানে, ডুরেশাড়ি বউ এক বেচে রোজ
অতৃপ্ত পুরুষের গান।
কেউ কেনে, ঘাম আর ধূম্রজালে করে বিনির্মাণ
পৃথিবীর প্রাণ, তার ত্রাণ।
“আছে নাকি, জানিনাই যাহা!”,বলে ছফা।
মহিলা বাড়িয়ে দ্যায়, বোতলের থেকে পুরিয়ায় বিস্রস্ত ঘ্রাণ
রসুন লবঙ্গমাখা অস্থির অতৃপ্ত ছফা’র পরাণ ॥

ভূমৈব
নাল্পে সুখম অস্তি…

আমি কি বিপরীতমুখী কথা বলি ?
বেশ, তাহলে আমি বিপরীত কথা বলি।
কেননা আমি বিশাল
বৃহৎ, ভূমৈব, আমি বহুকে ধারণ করি।

আমি সমস্তর ভিতর থেকে তিতো আর টক
নিষ্কাশন করি, আবার,
মন্দ পবন ভরি, মেঘ ভরি, আলো ভরি,
হাড় ঢুকাই, রক্ত দি কল্পনা, সঙ্গে-সঙ্গে পাথুরে মাটি
দুটোই যেন থাকে।

আমি ভেসে যেতে পারি,
আমি শুয়ে পড়তে পারি,
আমি লাফিয়ে পড়তে পারি,
আমি উড়তেও পারি,
আশলে আমি জাগতে পারি সর্বত্র, অনন্তে।
আমি পিঁপড়ে, আমি শামুক, আমি টুনটুনি,
আমি হরিণ, আমি চিতল, আমি ব্যাঘ্র,
আমি অবলুপ্ত ডোডো, ম্যামথ আমি ট্রাইসেরাটপস্।
আমি কুলুকুলু গুলিশাখালি, কালিগঙ্গা, আত্রাই,
আমি সিন্ধু, আমি দজলা, আমি হোয়াংহো,
ভোল্গা, দানিউব, আমি নীলনদ, মিসিসিপি, আমি আমাজন।

আমি ফোটন, আমি ইলেকট্রন, আমি প্রোটন,
নিউক্লিয়াস, প্লাজমা, ফুস্ফুস, যকৃৎ, প্লীহা,
রিবোনিউক্লিক অ্যাসিড, আমি ডিএনএ
আমি কর্টেক্স, আমি কি না ?
আমি মানুষ।
সাঁওতাল, গারো, মার্মা, চাকমা… সমস্ত নৃ থেকে
বঙ্গাল, বঙ্গাল থেকে সর্ব-ভারতীয়,
সর্ব-এশিয়, ইউরেশিয়, মেদিনীর মানুষ, সৌরচক্রের,
মহাব্রহ্মা-ের…
আমাকে আটকায় কে ?
আমি নির্দিষ্ট, আবার নির্দিষ্ট নই অনির্দিষ্ট
আমি নিউটনী আবার নিউটনী নই
হাইসেনবার্গ, আইনস্টাইন, গ্যোডেল আমাকে
বক্র ও অচিন্তিত অনির্ধারিত স্থানে-কালে নিয়ে যায়,
ঠিক ম্যাজিক গালিচার মতো
নিউট্রিনো আর গ্লুয়নে উড়িয়ে।

এসো, এসো তোমারাও এসো তোমাদের
থেকে একজন এসো, আমি তিনগুণ হবো,
তিনশো, তিন হাজার, তিন অক্ষৌহিণী গুণ হবো।
রহিমা, কৃষ্ণা, অরুণা, কেরামত, শাহাবুদ্দিন,
আশরাফ ইবনে গফ্ফার
এসো সব্বাই এসো, আমার হাত ধরো… হাত ধরো,
আমরা এবার ম্যাজেলান-মেঘ-ছায়াপথে ঝাঁপ দেবো।

জিজ্ঞাসা

শবরী, বলো কাহ্নুপাদ কেন
করুণা-নদী করলো পারাপার
নিলয়, না জানলো কেন হরিণ
কেন বৈরী আঁশে মাসেঁই তার ?

মোহিনী জানো, মোহিনী জানো, কেন
রাতি কৈলুঁ দিবস আর দিবস কৈলুঁ রাতি
পুইড়্যা শ্যাষ হয়নি কেন আজো
হাসন রাজার শোলক মোমবাতি ?

উপালি বলো উপালি বলো, জানো
বুদ্ধ কেন গেল সবাই ভুলে
রেবতী আর সাকিনা জল নেবে
কলসী কেন ভাঙলো নদীর কূলে ?

পদ্মা পাড়ে সিরাজ বলে,লালন
কি গান শিখাইলাম বলো সাঁই ,
এখন দেখি জাহেরির জাউ আছে
বাতেনীর বাস একটুও তার নাই।

একাত্তরে স্বাধীনতা! স্বাধীনতাই!
মানুষ বাঘে কুমিরে দিলো ডাক,
শ্যামা দোয়লে মরলো চখা-চখী –
রক্ত ডালে কা-কা কেবল কাক!

এমন কি-র গযল্

তোরঙ্গ রেখেছি খুলে, নিয়ে যাও দিরহাম, লেবাস ও খতিয়ান, এমন কি মোতিও।
বস্তুই শুধু নেবে তুমি ? মাস আর মৃত্তিকা খুলে? খুলে শ্বাস এমন কি হৃদয়ও ?

দেয়ালের গায়ে কারা এঁকেছে শিকার, নগরীরা ডুবে গেছে, উটের পায়ের দাগ
ভ্রমণ-কাহিনী সেতো পড়বেই; কেতাব পাতায় যদি কাসিদা এমন কি পড়িও।

প্রবন্ধে ফালাসিফা, সংকেতে বিজ্ঞান, বীক্ষণাগারে তারে মহাকাশ দ্যাখা
শুধু কিছু স্পন্দনে, শব্দ ও শব্দহীনতায় , চিত্রকল্পে শায়েরি বাস্, এমনটি বুঝিও।

কিংবদন্তী, ইমেজারি এককালে ছিলো : কচ্ছপের কাঁধে গ্রহ, মাছের পেটেতে বাস,
বোররাকে নীলাকাশ, উচ্ছ্রতি লোহিত সাগরে জলরাশ এমন কি, জানিও।

গরিষ্ঠ পৃথিবীর এখনো নমস্কার করে দূর ওঙ্কার, কেননা তাহার কথা ভেবে,
ভেবে-ভেবে ভোলা যায় পার্থিব ব্যথা, মাটির বিষণ্ণতা ত্রাস এখন কি বুঝিও,

বুঝবে না, ব্রহ্মা- জন্মালো কি করে শূন্য থেকে যতো ভর সান্দ্রতর কিবম্বিধ
তৈরী হল নক্ষত্র, গায়ত্রী, গ্যালাক্সি, হাওয়া-জল-মহাকাশ এমন কি সবিও।

মানুষ কি ভাবে হলো, প্রাণ জন্মালো পরমাণু সমাহার তাও বোঝা গেছে আহা,
রহস্য হবে কি লোপ? ব্যঞ্জনা, কল্পনা, কবিতাও রবে, অংকেও। বাস্, এমনটি বুঝিও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *