ছোটগল্প জীবনের কথা-এম এম মিঠু
অনেক চড়াই উতরাই পাড় হয়ে একদিন লিবিয়ায় এসে পৌছালাম জীবিকার তাগিদে । কাজ কার্ম বেশ ভালোই চলছিল , বেতন বেশ ভালোই ছিল । দিনে দশ ঘন্টা ডিউটি খাওয়া দাওয়া কোম্পানির । মাস শেষেই বেতন দিয়ে দিতেন কোম্পানি । যদিও লিবিয়ায় অবস্থিত কোম্পানি কিন্তু মালিকানা ছিল জাপানিদের ।
এভাবে বেশ ভালই চলছিল মাত্র ৮ মাসেই খরচের টাকা প্রায় অনেকটা তুলে ফেলেছিলাম । এরই মধ্যে শোনা যাচ্ছিল কি যেন আরব বসন্ত । আমরা ভাই শ্রমিক মানুষ এসবে কান দিতাম না । তারপরেও কেউ কেউ বলতো গাদ্দাফি বোধহয় আর থাকতে পারবে না ক্ষমতায় । কেউ বলতো আরে না গাদ্দাফি এতো সহজে ক্ষমতা ছাড়বেন না । এভাবে যখন দিন পচিশ, হঠাৎ কোম্পানির বড় মদির (ম্যানেজার) এসে বললো তোমাদের ডিউটি নেই এভাবেই ব্রাকে (ক্যাম্পে) থাকো পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে তোমাদের কে কাজে নেওয়া হবে ।
আমরা সবাই তখন ক্যাম্পেই সুয়ে বসে সময় কাটাই, এর মধেই একদিন বিকট বিকট শব্দে কেঁপে উটছিল বেনগাজির আমাদের পাঁচতলা ভবণ । আমরা তো ভয়ে শেষ এই বুঝি শেষ হয়ে যাচ্ছে জীবন । এর মধ্যেই শোনলাম কোম্পানির বড় মদির (ইনচার্য) সহ সবাই তাদের দেশে পাড়ি জমিয়েছে । মনটা আরো ভেঙ্গে গেল, মৃত্যু বোধহয় দৌরগড়ে পৌছে গেছে ।
এর মধ্যেই ইন্ডিয়ান যারা ছিল তারাও চলে যাচ্ছে তাদের দেশের বিমান এসেছে নিতে তাদের । পকিস্থানিরা চলে যাচ্ছে তাদেরকে তাদের এম্বাসি (দূতাবাস) সরিয়ে নিচ্ছে পাশের দেশ তিউনিসিয়ায় । রয়ে গেলাম শুধু আমরা কয়েক জন বাংলাদেশী । এভাবে দুদিন যেতেই আমরা বাংলাদেশীরা মিলে একমত হলাম আমরা চলে যাবো মিশোর কিনবা তিউনিসিয়ায় । দিন হলেই বোমা পড়ে উপর হতে, রাতে একটু কম, তাই রাতেই বের হবো চিন্তা সবার, সাথে শুধু পানি আর কিছু নগদ টাকা । মোবাইলে নেটওয়ার্ক কাজ করছে না সেই যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই । এমনি এক রাতে আমরা ত্রিশজন বাংলাদেশী রওয়ানা হলাম ঠিকানা অনিশ্চিত । পথে কিছুদূর যেতে দেখলাম সাদা কাপর টানানো একটা বড় লড়ি দাঁড়ানো কোথায় যাবে কি করবে তা না জেনেই দৌড়ে গিয়ে উঠলাম সে লড়িতে । সারা রাত শেষে সকালে জানতে পারলাম লড়িটি ছিল একটি সাহায্য সংস্থার ।
আমরা কিন্তু তিউনিসিয়ার বডারের কাছে, কিন্তু আমরা ঢুকতে পারছি না, কারন আমাদের পাসপোর্ট নেই কাছে। তারপরেও কেউ কেউ হাল না ছেড়ে চেষ্টা অব্যহত রাখলাম, এদিকে অনেক ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লাম সবাই, সাথে নিয়ে আসা পানি টুকু শেষ হয়ে গেছে । ভাবলাম তিউনিসিয়া যখন ঢুকতে পারছি না তবে মিশোর বডারে গিয়ে দেখি কি হাল, কয়েক জন একমত হলেন বাকিরা রয়ে গেলেন বললেন এখানেই থাকি একটা ব্যবস্থা হবেই, আর মরে গেলে গেলাম, পরে শুনতে পেয়েছি তাদেরকে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের লোক গিয়ে তিউনিসিয়া অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে সাহয্য করেছে ।
আর আমরা মিশোর বডারে গিয়েও আশ্রয় পেলাম না, কারন হিসেবে একটাই সমস্যা আমাদের পাসপোর্ট নেই আমাদের সাথে । এখন আর কি করার; ভাবছি সবাই মিলে । কেউ কেউ কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলাম, মৃত্যুটাও বোধহয় দেশের মাটিতে নেই । এখানেই বোধহয় মরে যাবো কেউ দেখার থাকবে না । মৃত্যু সময় আপন জনের পানিও পাবো না মুখে । এদিকে অনেক ক্ষুধার্ত হয়ে পরা আমরা, টাকা থাকলেও খাবারঘর পাওয়া অনেক কষ্টের, যাও পাওয়া যায় অনেক দূরে দূরে তাও বন্ধ অথবা খাবার নেই ।
এভাবে বেশ কয়েক দিন । রাত হলে যে কোন নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেই আর দিনে ছুট চলি নিরাপদ একটু আশ্রয়ের খোঁজে ।
একদিন শোনলাম মিশোরের বর্ডারে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের লোক এসেছে বাংলাদেশীেদের সাহায্য করতে, পর্যায়ক্রমে দেশে ফিরিয়ে নিবে তাদের । সবাই মিলে আবার সেখানে গেলাম, গিয়ে কোন লাভ হলো না । যে এসেছিল সে বেশকিছু লিবিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীকে শরনার্থী হিসেবে মিশোরে ইন করে চলে গেছে তিউনিসিয়া লিবিয়া বর্ডারে । তারমানে আমরা সেখানে গিয়ে কোন লাভ হলো না । এভাবে অনেক দিন ঘুরাঘুরির পরে, একদিন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম হয় বাঁচবো না হয় মরে যাবো, টার্গেট মিশোর অথবা লেবানন ঢুকা, সেখান থেকে যে কোন ভাবে দেশে যাওয়া ।
হেঁটে হেঁটি চলছি ঠিকানা অনিশ্চিত, এর মধ্যে আবার আমাদের দলের তিনজন রয়ে গেল, তারা আমাদের সাথে যেতে চাইলো না, তারা রয়ে গেল মিশোর বর্ডারে । পরে শুনেছি তারাও নাকি দেশে ফিরেছে ঠিক ঠাক মতো, তবে কয়েক দিন প্রতিক্ষা করতে হয়েছে । বাকি আমরা যে তিনজন রইলাম,আমরা,তো চলছি দেশে ফেরার অপেক্ষায় কিন্তু সিদ্ধান্ত হীনতা ও ধৈর্য আমাদের হারমানিয়েছে বারবার । এভাবে কেটে গেল প্রায় একমাস । পকেটের টাকা যা ছিল শেষ । এবার বাধ্য হয়েই না খেয়ে অথবা কাউকে দেখলে চাইতে হয় খাবার । এভাবে গেল কয়েক দিন । কিভাবে দিন যায় কিভাবে রাত যায় বুঝতে পারছিলাম না, তবে একেক টা দিন অনেক বড় মনে হত । আর রাত যেতে চাইতো না বললেই চলে । নাওয়া নেই খাওয়া নেই ঠিক মতো, চোখে হতাশা আর পেটে ক্ষুধা নিয়ে, কখনো রাস্তার পাশে, কখনো কোন সাহায্য সংস্থার তাবুতে যায় রাত ।
এমনি এক রাতে আমরা তিন জন একটি রাস্তার পাশে বসেছিলাম । হঠাৎ শোনতে পেলাম কেউ একজন বলছে হেল্প মি প্লীজ । পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি মেয়ে কন্ঠে কেউ একজন সাহায্য চাচ্ছে । তবে তার পুরো শরীর যেন কাপছে ভয়ে । এমন মনে হচ্ছে যে সে পৃথিবীর সবচেয়ে ভীতু মানুষ । কাছে গেলাম আমরা তিন জন তার, দেখে মনে হলো সে নেপালি মেয়ে । কিন্তু তার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সে ইন্দোনেশীয়ান । বেশ ভাল ইংরেজি বলতে পারে আরবি তেমন জানে না । কিছু আরবি কিছু ইংরেজি দিয়ে আমাদের সাথে কথা বলছিল । কথা বলছিল ঠিকই তবে মনে হচ্ছিল সে অসুস্থ । আমরা তাকে আমাদের সাথে থাকা পানি দিলাম সে পান করলো ।
এবার আমরা তাকে বললাম এতরাতে তুমি কোথায় যাবে, চারদিক গুলাগুলি হয়, বোম ব্লাষ্ট হয় এর মধ্যে কোথায় যাবে ! তারপর আবার বিদ্রহী বাহিনী তো কোন মেয়ে দেখলেই তুলে নিয়ে যায়, তার থেকে এখানেই থাকো । সে মাথা ঝুলিয়ে হ্যাঁ বললো । এবার আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার এই হাল কেন? সে কিছু আরবি কিছু ইংরেজিতে উত্তর দিচ্ছিল । সে ভাল ইংরেজি জানে তবে আমারা তেমন ইংরেজি জানিনা বিধায় সে ইংরেজি আরবি মিলিয়ে আমাের বুঝাতে চেষ্টা করতে লাগলো । সে জানালো সে একজন ডাক্তার স্বামীও একজন ডাক্তার, তারা দুজনেই লিবিয়া একটি হাঁসপাতালে কর্মরত ছিলেন । লিবিয়ায় যুদ্ধ শুরু হবার পরেই তাকে ধরে নিয়ে যায় বিদ্রহীরা তাকে হাঁসপাতালে যাওয়ার পথে । ধরে নিয়ে চোখ বেধে রাখা হতো একটা দালানে অন্ডারগ্রাউন্ডে, সেখানে আহত বিদ্রহী যুদ্ধাদের চিকিৎসা করতে হতো তাকে । রেপ হয়েছেন অনেকবার । ওখানে যারা আসতো সবাই চাইতো তার শরীরকে একটু টাচ করতে ।
তারপর একরাতে তাকে ওখান থেকে অন্য জায়গায় হস্তান্তর করার জন্য একটি গাড়ীতে উঠানো হলে সে জানতে পারে যে তাকে অন্যখানে নেওয়া হচ্ছে আরো বিদ্রহী যুদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতে । রাস্তায় কিছুদূর যেতেই গাদ্দাফী বাহিনীর বাধার সামনে পরেন তারা, শুরু হয় গোলাগুলি এক পর্যায় সে গাড়ী হতে নেমে পালাতে সক্ষম হলেও বাসায় ফিরে গিয়ে দেখতে পায় তার স্বামী সন্তান কেউ নেই বাসায় । তালামারা পুরো ঘরটিতে । পাশে একটি দোকান ছিল এক মিশোরীর সে বলেছে তার স্বামী সন্তান দেশে চলে গেছে ।
এতক্ষণে সে তার নাম জানালো আমাদের তার নাম মরিয়ম । বয়স ৩২ একটা মাত্র মেয়ে, বয়স তিন বছর । এভাবে কথা বলতে বলতে বলতে রাত পার হয়ে গেল । সকাল হতেই মরিয়ম তার হাতে থাকা ঘড়িতে দিক নির্দেশন দেখলেন । দেখলেন কোন দিকে পশ্চিম কোন দিক দক্ষিণ । মরিয়ম আমাদের বললেন তোমরা আমাকে সাহায্য করো আমি তোমাদের সাহয্য করবো । চলো আমরা কোন এক শরনার্থী শিবিরে যাই ওখান হতে একটা কিছু হবে । আমার সাথে থাকা স্বদেশী দুজন রাজি হলো না । তারা প্রস্তুতি নিলেন ইতালি যাবে সাগর পথে । আমি বললাম ঠিক আছে তাহলে চলো আগে আমরা তোমাদের কে সে ব্যবস্থা করি । এর মধ্যেই মরিয়ম বললেন শোনো আগে আমরা দেশে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করি দেখি তারা কোন সাহায্য করতে পারে কি না । এভাবেই কথা বলি আর হাঁটি । মানুষের সাথে দেখা হয় । কাউকে পথের কথা জিজ্ঞেস করলে তারা কেউ সঠিক টা দেখায় কেউ দেখায় ভুল টা ।
এভাবে পেয়ে গেলাম এক সময় লিবিয়া উপকূলীয় এলাকার সন্ধান । এবার মরিয়ম কে জিজ্ঞেস করলাম মরিয়ম তুমি এবার কি করবে? সে বললো দেখুন আমি দেশে যাবো আমাকে সাহায্য করো তোমরা । লিবিয়া উপকূলীয় এলাকায় এক দালালের সাথে কথা হলো সে বললো ইতালি পৌছে দিবে তাকে বাংলা টাকার তিন লাখ টাকা দিতে হবে । তার লোক আছে বাংলাদেশে টাকা টা তাকে দিলেই হবে । এই প্রথম অনেকদিন পরে ফোন করার সুযোগ পেলাম । বাড়ী ফোন করতেই বাড়ীর লোকজন প্রথমে দেশে ফিরতে বলছিলেন, পরে যখন বুঝতে পারলেন আমাদের কাছে টাকা নেই পাসপোর্ট নেই দেশে আসতে অনেক ঝামেলা তখন দেশ থেকে অভয় দিলেন সাগর পথে ইতালি যেতে । দেশ হতে টাকা দিবে দালাল কে । এবার মরিয়ম এক হয়ে যাবে, সে এক মিনিট ফোন করতে চাইলো, দালাল বেটা না করলেন প্রথম বার, পরে কি মনে করে যেনো দিলন ।
মরিয়ম ফোন করতেই দেখছি তার চোখ থেকে অঝরে পানি ঝরছে , আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলা । তিন মিনিট কথা বলে ফোনের লাইনটা কেটে দিলো ওপার হতে । কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই মরিয়ম বলে বসলেন আমাকে নিবে তোমাদের সাথে? আমি বলে বসলাম এসে পরো । কোথা হতে টাকা আসবে কে দিবে ইতালি পৌছানোর দালালের খরচ ভাবলাম না ।
রাতে ছারলো আমরা তিনজন মরিয়ম সহ আরো কিছু মিশোরী ছিল নৌকায় । চলতে চলতে সাগরে দিক হারিয়ে চলে গেলাম কোথায় যেনো অচেনা এক দিগন্তে মনে হচ্ছিলো । কিন্তু দালাল সঠিক ভাবেই ইতালি পৌছে দিচ্ছিলো হঠাতই ইতালীয় কোর্সগার্ড আমাদের দেখে ফেলে আমাদের সবাইকে গ্রেপতার করা হলো করে কোর্টে উঠানো হলো আমাদের । সেখানে আমাদের পক্ষে সরকারী আইনজীবী ছিল, ছিল মানবধিকার আইনজীবী সবাইকে জিজ্ঞেস করছিল কেন তোমরা ইতালিতে এসেছো, কেউ বলছিল কাজ করতে, কেউ বলতেছিল লিবিয়া যুদ্ধ কাজ নেই তাই । মরিয়ম কে যখন জিজ্ঞেস করা হলো কেন তুমি এখানে এসেছো? সে একটাই উত্তর ভালোবাসার টানে, কোর্ট যখন জানতে চাইলেন কি ভালোবাসা ? মরিয়ম আমাকে দেখিয়ে বললেন এই আমার স্বামী সে বাংলাদেশী আমি ইন্দোনেশিয়ান । লিবিয়ায় আমাদের পরিচয় ওখানেই প্রেম হয়, পরে আমরা বিয়ে করি, লিবিয়ায় যুদ্ধ লাগার পর আমাদের দেশে ফিরে যেতে বলা হলে বাংলাদেশে আমাকে যেতে দিচ্ছে না, আর আমার স্বা
লিবিয়ায় আমাদের পরিচয় ওখানেই প্রেম হয়, পরে আমরা বিয়ে করি, লিবিয়ায় যুদ্ধ লাগার পর আমাদের দেশে ফিরে যেতে বলা হলে বাংলাদেশে আমাকে যেতে দিচ্ছে না, আর আমার স্বামীকে আমাদের দেশ গ্রহন করছে না কারন আমাদের পাসপোর্ট এক এক জনেন ভিন্ন । তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে সব দেশে পাসপোর্ট জন্য স্বামী স্ত্রীকে আলাদা থাকতে হয় সে দেশে আর যাবো না । তাই আমরা পাসপোর্ট সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে নৌকা যোগে আপনাদের দেশে এসেছি, আমরা স্থায়ী ভাবে আপনাদের দেশে থাকতে চাই ।
কোর্ট কিছুসময় পর রায় দিলো, সবাইকে শরনার্থী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হোক, মরিয়ম ও আমাকে ছাড়া । আমাদের দুজন কে স্থায়ী ভাবে কাজ করার অনুমতি দিলেন । মরিয়ম এখন ডাক্তারী করে আমিও ব্যবসা করি। তবে আজো জানা হয়নি মরিয়মকে তার আগের স্বামী কি বলেছিল ।