ছোটগল্প।। নুসরাত শারমিন।। মঈনুল আহসান সাবের
মঞ্জুরের মনে হলো, এতটা কঠিন করে সে চম্পাকে না বললেও পারত। চম্পা তার সামনেই বসে আছে, মঞ্জুরের মনে হচ্ছে চম্পা তার সামনে বসে নেই, সে
এখন অনেকটাই দূরে। এই মেয়েটা তার কাছ থেকে দূরে থাকবে, এ রকম ভাবতে তার কষ্ট হয়। চম্পার খোঁজ এনেছিল বড় মামা। মঞ্জুরের জন্য মেয়ে খুঁজতে খুঁজতে তখন সবাই হয়রান, এই মেয়ের এটা পছন্দ হয়তো ওটা হয় না, এ রকম চলছে। মঞ্জুর অবশ্য বলছে আশ্চর্য ব্যাপার, তোমরা দেখি নিখুঁত মেয়ে খুঁজছ, নিখুঁত কেউ আছে নাকি! আর এই আমার ভেতরেই কত খুঁত, বাড়ির লোকজন তখন বলছে এমন না তোর বিয়ের সময় দৌঁড়ে পালিয়ে যাচ্ছে একটু সময় নিয়ে দেখাই ভালো, সংসার বলে কথা। এ রকম বলতে বলতে বাড়ির লোকজন হাল ছেড়ে দিল এই মঞ্জুর, তুই নিজে খুঁজে দেখ।
মঞ্জুর বলল আমাকে দিয়ে সেটা হবে না, কীভাবে খুঁজতে হয় আমি জানি না, আর আমার সেটা ভালোও লাগবে না।
তুই একটা আজব। ছাত্র ছিলি এতদিন। এখন প্রায় বছর দেড়েক হলো এত ভালো একটা চাকরি করছিস, একটা প্রেম করতে পারলি না!
পারলাম না তো।
পারলে আমাদের এত দৌড়াদৌড়ি করতে হতো না।
এক কাজ করলেই হয়। বিয়েটাই বাদ দিই। বিয়ে করব না।
দে।
দিলাম, বিয়ে করতেই হবে, এমন লিখিত কিছু কোথাও দিইনি।
তারপর, ‘এবার তা হলে আমি একটু দেখি’ বলে বড় মামা মাঠে নামলেন,
চম্পার খোঁজ পাওয়া গেল, মঞ্জুরের মনে হলো হ্যাঁ, এ রকম একটি মেয়ে পাশে থাকলে…।
বাড়ির সবারও খুব পছন্দ, মঞ্জুরকেও ও বাড়ির সবার। শুধু চম্পা বলল—
আমার একটু সময় দরকার।
সময়?
আমি ওনাকে চিনি না।
তা, এটা এমন কী কথা! আজকাল ছেলেমেয়েরা বিয়ের আগে পরস্পরকে
যতটা সম্ভব জেনেবুঝেই নিচ্ছে। এই দুদিন লাঞ্চ করা, একটু পাশাপাশি হাঁটা,
এই পর্বটি শেষ হলে চম্পা বলল আমার আপত্তি নেই।
এই নিয়ে পরে চম্পাকে খুঁচিয়েছিল মঞ্জুর খুব ভাব নিয়েছিলে।
কী রকম?
ওই যে, মহান এক ডায়ালগ দিয়েছিলে, ‘আমার আপত্তি নেই’।
তো কী বললে খুশি হতে, আমার আপত্তি আছে?
আমি তোমার বলার ধরন নিয়ে বলছি। যেন ধন্য করে দিচ্ছ আমাকে।
ধন্য করে তো দিচ্ছিই।
যেন দয়া করছ।
তাও কিছুটা। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল, আমাকে না পেলে তোমার
চলবেই না।
সেদিন স্বীকার করেনি মঞ্জুর, পরে বলেছিল, তুমি ঠিকই বলেছিলে চম্পা।
তুমি যে কতটা আলো ঝলমল… হুঁ, তুমি বউ না হলে আমার চলতই না।
এখন বেশ খানিকটা ঝগড়ার মতো হয়েছে তাদের। চম্পার একটা ফেসবুক
অ্যাকাউন্ট আছে। ইনবক্সে তাকে একজন রাঙামাটি বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার
প্রস্তাব দিয়েছে। সেটা সে বলেছে মঞ্জুরকে, মঞ্জুর বলেছে, লোকটা তোমাকে এ
রকম প্রস্তাব দিল কীভাবে!
সেটা আমি কী করে বলব!
তুমি বলছ লোকটা বয়স্ক লোক, এরা হয় পারভার্ট, তুমি একে প্রস্তাব দেয়ার
সুযোগ দিলে কেন!
বারে, আমি কোথায় দিলাম!
লোকটা নিশ্চয় তার প্রথম মেসেজেই এই প্রস্তাব দেয়নি?
না, তা দেয়নি।
মানে লোকটার সঙ্গে তোমার মেসেজ চালাচালি হতো।
আচ্ছা, উনি মেসেজ দিলে, রিপ্লাই দেয়ার মতো হলে, রিপ্লাই দেব না?
তোমার বোঝা উচিত ছিল।
আমি কি জ্যোতিষী?
এসব বোঝার জন্য জ্যোতিষী হতে হয় না।
শোনো মঞ্জুর, তোমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে?
আছে। তুমি জানো।
তোমার যারা ফেসবুক ফ্রেন্ড, তাদের সবাইকে তুমি চেনো?
সেটা সম্ভব না
তোমার পক্ষে সম্ভব না হলে আমার পক্ষে সম্ভব?
অচেনা ছেলেদের বন্ধু বানানোর সময় মেয়েদের একটু বেশি সাবধান
থাকতে হয়।
তুমি যখন অচেনা মেয়েদের কনফার্ম করো বা অ্যাড রিকোয়েস্ট পাঠাও…।
আমি অচেনা মেয়েকে অ্যাড রিকোয়েস্ট পাঠাই না।
আচ্ছা, পাঠাও না। কিন্তু যারা তোমার মেয়েবন্ধু আছে, তাদের সবার
সবকিছু তোমার জানা আছে?
সবকিছু কি জানা সম্ভব?
সম্ভব না। কিন্তু কোনো মেয়ের সঙ্গেই তোমার মেসেজ আদান-প্রদান হয়
না, কারো সঙ্গেই কখনো চ্যাট করো না? মিথ্যা বলবে না।
করি।
ওতে দোষ নেই। আমি কারো সঙ্গে কথা বললে দোষ!
কিন্তু আমাকে তো কোনো মেয়ে অশালীন কিছু বলে না।
মেয়েরা বলে? ফেক না হলে? তা ছাড়া তোমাকে কোনো মেয়ে বেড়াতে
যাওয়ার কথা বলবেই বা কেন! তুমি তো আহামরি কিছু না।
চম্পা বলেছিল ইয়ার্কির সুরেই, কিন্তু এরপরই লেগে গেল, লেগে গেল
মানে মঞ্জুর একতরফা বলে গেল। সে, ওই ‘আহামরি’ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল,
বলল, চম্পা প্রশ্রয় দিয়েছে বলেই ওই লোক অমন একটা প্রস্তাব দেয়ার সাহস
পেয়েছে। এই নিয়ে এমন অবস্থা তৈরি হলো, এই সামনেই বসা চম্পা দূরের
হয়ে গেল।
মঞ্জুরের মনে হতে লাগল এত কঠিন করে সে না বললেও পারত। সে এক
সময় বলল স্যরি। তোমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি। কেন করেছি
জানো? তুমি আমার কাছে মূল্যবান। কতটা মূল্যবান, তা তুমি এখন জানো না,
ধীরে ধীরে জানবে।…এখন একটা বুদ্ধি করি আমরা। কী নাম যেন বললে ওই
বুইড়া লম্পটের? ওকে আমি নাচাব।
দুই
বেশ কিছুটা সময় লাগল নামটা ঠিক করতে, নুসরাত শারমিন। আরও বেশকিছু
নাম এসেছিল মাথায়, মঞ্জুর সেগুলো মাথায় রাখল না, সে নুসরাত শারমিন
নামটা ফাইনাল করল ও চম্পাকে জিজ্ঞেস করল, নামটা কেমন হলো বলো তো?
আচ্ছা, তুমি তা হলে সত্যিই সিরিয়াস?
কী বলো, সিরিয়াস না!
এত কিছুর কী দরকার ছিল?
ওই যে মাহবুবুল হাসান, ওকে আমি পাগল করে ছেড়ে দেব।
এত কিছুর দরকার ছিল না মঞ্জুর।
ছিল। আমার বউয়ের সঙ্গে ফাজলামো করতে আসে!
হবু বউ।
ওই একই কথা। নামটা কেমন হয়েছে বলো।
ভালো।
শুধু ভালো, বলো খুবই ভালো। নামটার মধ্যে বেশ লাবণ্য আছে, আবার
কিছু আহ্লাদও আছে। দেখো, কী হয় মাহবুবুল হাসানের!
মঞ্জুর নুসরাত শারমিন নামে ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলল। ছবি
জোগাড় করা অবশ্যই একটা বড় সমস্যা। তবে এ সমস্যাও সে পার হতে পারল।
তিনটা ছবি সে জোগাড় করতে পারল। তিনটির মধ্যে একটি সমুদ্র সৈকতে।
দেখো। মঞ্জুর বলল। এই মেয়েটার চেহারা সত্যিই সুন্দর।
হুম।… পেলে কোথায়? তোমার পরিচিত কেউ?
এখলাস জোগাড় করে দিয়েছে। আমি চিনি না।
মঞ্জুর অ্যাকাউন্ট খুলে অড্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে আরম্ভ করল। দিন চারেক
পর সে বলল, হ্যাঁ, ওই মাহবুবকেও অড্ড করেছি, আগে শ দেড়েককে করে
নিয়েছি যেন ব্যাটা সন্দেহ না করে। তবে দরকার ছিল না। একটা ব্যাপার
দেখেছি, একটা সুন্দরী মেয়ে অড্ড রিকোয়েস্ট পাঠালে, প্রায় কোনো পুরুষই
স্থির থাকে না। সে ফেক, না অন্যা কিছু, কিছুই না ভেবে অড্ড করার জন্য
ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তুমিও তাই করো। করো না?
করি। কিন্তু তাই বলে ওদের ইনবক্সে গোপন মেসেজ পাঠাই না।
বেশ। বুঝলাম তুমি ভালো। ওই লোক কিছু বলেছে?
ওই লোক মানে!…ওহ্ হ্যাঁ, আমাকে ইনবক্সে শুভকামনা জানিয়েছে।
এখন কী করবে? চম্পা জিজ্ঞেস করল। তার মুখে হাসি। এখন আমি মজা
পাচ্ছি।
এখন আমি… না, আমি না, নুসরাত শারমিন ওর জিনা হারাম করে দেবে।
মঞ্জুর নুসরাত শারমিন হয়ে মাহবুবুল হাসানের জিনা হারামের কাজ শুরু
করল।
সে খুঁজে খুঁজে মাহবুবুল হাসানের স্ট্যাটাস গুলো লাইক দিতে আরম্ভ করল,
কখনো কমেন্ট করল, কিছুদিন অপেক্ষা করল, তাও যখন ও পাশ থেকে সাড়া
পেল না, সে মাহবুবুল হাসানের ইনবক্সে মেসেজ পাঠাল- আপনার লেখা গুলো
এত সুন্দর!
সেদিনই উত্তর দিল না মাহবুবুল হাসান, মঞ্জুর দেখল সে সেদিন ফেসবুকেই
নেই সম্ভবত, উত্তর এলো পরদিন- ওহ গড!
মঞ্জুর উত্তর পাঠাল- জি?
কেউ এত সুন্দর হতে পারে, আমার ধারণাই ছিল না।
যদিও বাড়িয়ে বলছেন, তবু থ্যাঙ্ক ইউ,
আঙ্কেল।
আঙ্কেল (দুঃখের ইমো)!
জি?
এই যুগে আঙ্কেল বলে কোনো ব্যাপার আছে! এই যুগে সবাই সবার ফ্রেন্ড।
রাইট। আমি একদম একমত আপনার সাথে।
তা হলে আঙ্কেল বললেন যে!
ভাবলাম আঙ্কেল না বলে ফ্রেন্ড বললে আপনি আবার কী মনে করেন!…
অনেকে তো…।
না না, কেন কিছু মনে করব!… আপনার কি অনেক বন্ধু?
আছে কিছু। যদি ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার না হয় আমি রিমুভ করে দিই।
আমি ইন্টারেস্টিং হবো, দেখেন।
দেখা যাক। কিন্তু আপনি আমাকে আপনি আপনি করে বলছেন কেন! আমি
কত ছোট।
তাও ঠিক। কী করো তুমি?
ভার্সিটিতে। প্রথম সেমিস্টার।…অবশ্য থাকব না।
কোথায় যাবে?
ঠিক করিনি। তবে দেশে পড়ব না। সম্ভবত অস্টেলিয়া যাব।
চলে যাবে!
দেখি।
তুমি চলে গেলে তো ফেসবুকই অন্ধকার হয়ে যাবে।
তা কেন। আমি বিদেশে যাব বলে ফেসবুক ছেড়ে যাব, তা তো না।
তবু…। … আচ্ছা, তুমি কি সময় পেলেই আয়নার সামনে দাঁড়াও?
আয়নার সামনে? কেন!
আমি যদি তোমার মতো সুন্দরী হতাম, তবে তা-ই করতাম।
তাই।…আমার অবশ্য একটু একটু হাসি পাচ্ছে।
আমি কি হাসির কথা বলেছি নাকি!
আমার আসল ছবি গুলো আপনি তো দেখেনইনি। যে তিনটা সবচেয়ে পচা
সে তিনটা দিয়েছি।
কী বলো! তুমি তা হলে তোমার অন্য কয়েকটা ছবি দেখাও। প্লিজ প্লিজ
প্লিজ।
এখন দেখাব না। এখন আমার মন খারাপ।
তোমার মতো সুন্দরীর মন খারাপ হলে চলবে? চারদিক অন্ধকার হয়ে যাবে
না?
ইস, কত কথা যে জানে!
সত্যি কথা।…আচ্ছা, কেন তোমার মন খারাপ আমাকে বলা যাবে?
যাবে।…গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছি। আব্বু এখনো জানে না। কী যে আছে
কপালে!
মাহবুবুল হাসানের সাথে এই যে তার কথা, সেটা মঞ্জুর জানিয়ে দিল
চম্পাকে। হাসিমুখে জানাল, বলল- দেখো।
চম্পা বলল- তুমি কি একটু বেশি সময় দিচ্ছ না?
সময় দেয়ার আর দেখেছ কী! দরকার হলে অফিস থেকে ছুটি নেব।
অতটা অবশ্য করল না মঞ্জুর, ওটা কথার কথা, তবে নুসরাত শারমিন হয়ে
সে মাহবুবুল হাসানের পেছনে যথেষ্ট সময় দিতে লাগল। কখনো ডেক্সটপ
থেকে, কখনো ল্যাপটপ থেকে, কখনো সেল ফোন থেকে। তবে ওই যে একদিন
সে মাহবুবুল হাসানকে বলল, গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছি, কী যে আছে কপালে-
এইটুকু বলে সে তিনদিন গেল না ফেসবুকে। জানান দিল না। চতুর্থ দিনের দিন
সে নিজেই মেসেজ পাঠাল- আপনার কোনো খবর নেই।
সাথে সাথে উত্তর এলো- আমার, আমার খবর নেই!
তো কার! দেখলাম তো।
এই তিনদিনে আমি তোমাকে কত গুলো মেসেজ পাঠিয়েছি দেখো, দেখো
তুমি।
হুঁ, অনেক। থ্যাঙ্ক ইউ…। সিক ছিলাম।
আমি এদিকে চিন্তায়…।
কিসের চিন্তা!
বাহ্! তুমি গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলে, তোমার বাবা কী বলবেন…।
ওহ! আব্বু বললেন, মন খারাপ করবি না। সিক ছিলাম তো, তাই বকা
দেননি।
আসল কথাটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। সিক ছিলে বলছ, কী হয়েছিল
তোমার?
ও কিছু না। একটু সিজনাল…।
উঁহু, আমার মনে হচ্ছে আরও বেশি কিছু, সত্যিই চিন্তা হচ্ছে…।
মঞ্জুর উত্তর দিল না।
কী হলো।
মঞ্জুর চুপ করে থাকল।
কী আশ্চর্য, আমি এদিকে গলা ফাটিয়ে যাচ্ছি…।
ডিস্টার্ব করবেন না।
আমি ডিস্টার্ব করছি!
হুঁ।…আপনার স্টেটাস গুলো পড়ছি। ওহ গড, কী যে ইন্টারেস্টিং…এই যে
এই যে, মানুষের মন নিয়ে লিখেছেন যেটা।…আমার কী মনে হয় জানেন?
কী?
আমার মনে হয় ফেসবুকে আপনি সবচেয়ে…না, বলব না, বললে আপনার
অহংকার বেড়ে যাবে। এমনিতেই আপনি অনেক অহংকারী।
আমি অহংকারী! আমি!… ওয়েল, অন্যের কাছে হতে পারি, তোমার কাছে
না।
আমার কাছে না কেন?
তোমার কাছে এলেই আমার অহংকার কেমন পালিয়ে পালিয়ে যায়। কী যে
ক্ষমতা তোমার!
আচ্ছা!…শুনুন, আমার ধারণা ফেসবুকে আপনি সবচেয়ে ইন্টেলিজেন্ট আর
ইন্টেলেকচুয়াল।
এমন ধারণা তোমার? দেখো…।
ডিস্টার্ব করবেন না।
একটা কথা কি বলতে পারি? একটা আর্জি?
শুনি।
আমাকে তুমি করে বলবে। আমরা বন্ধু না? তুমি তুমি করে না বললে
কেমন শোনায় বলো!
মঞ্জুর চম্পাকে বলল- আমরা এখন তুমি তুমি করে বলছি। তার মুখে মুচকি
হাসি, তার হাসি দেখে বোঝা যাচ্ছে সে একটা বড় হাসি লুকানোর চেষ্টা করছে।
সে বলল, নুসরাত শারমিন মাহবুবুল হাসানকে তুমি তুমি করে বলছে। এটা ছিল
মাহবুবুল হাসানের আবদার। নুসরাত শারমিন অবশ্য একেবারেই রাজি হয়নি,
মাহবুবুল হাসানকে সাধনা করে রাজি করাতে হয়েছে।
মঞ্জুরের বলার ধরন দেখে চম্পা হেসে ফেলল- তুমি পারও বটে। তবে
আমি আবারও বলছি, তুমি কি একটু বেশি সময় দিচ্ছ না?
ঐ যে, আগের কথা আবারও। মঞ্জুর বলল। সময় দেয়ার আর দেখেছে কী!
দরকার হলে ছুটি নেব।
বিয়েটাও পিছিয়ে দেবে?
মঞ্জুর হাসতে আরম্ভ করল।
হেসো না। ছেড়ে দাও না।
কী?
মাহবুবুল হাসানকে। খামাখা সময় নষ্ট না?
আরে না, মজা আছে।
ছাই। একজনকে নাচানোর মধ্যে কী মজা?
না না, কী বলো! শুধু নাচানো হবে কেন!
তা হলে? আবার কী?
একটা ক্যারেক্টার তৈরি হলো না? নুসরাত শারমিন। নেই, কিন্তু আছে।
তুমি ভেবে দেখো…।
বুঝলাম। কিন্তু কী ভাবব?
জানো? মঞ্জুরকে কিছুটা হাসি হাসি দেখাল। যেন সে কথাটা বলতে চাচ্ছে
না, কিন্তু এটা বলার ব্যাপার, তাই একটু দ্বিধা কাজ করছে তার ভেতর- মানে
ভাবো, নুসরাত শারমিন নামে সত্যি সত্যি কেউ থাকতে পারে না?
নুসরাত শারমিন নামটা সুন্দর, কিন্তু আনকমন না। এ নামে অনেকেই থাকতে পারে। না, আমি ঠিক সেটা বলছি না। মঞ্জুর একটুক্ষণ চুপ করে থাকল।
মানে,আমি বলছি, সত্যিই একজন থাকতে পারে।
আচ্ছা, আমিও তা-ই বলছি। সত্যিই একজন থাকতে পারে।
ঐ বয়সীই।
হ্যাঁ, ঐ বয়সীই।
মানে, ধরো, আমি যে রকম বানিয়েছি নুসরাত শারমিনকে ঠিক তেমনই। উচ্ছল, প্রাণবন্ত, খেয়ালি, আর অবশ্যই একটু ছেলেমানুষ। চম্পা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল মঞ্জুরের দিকে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস
করল- আর কিছু?
ধরো সে ফেস বুকিংও করে, এর-ওর সাথে মজা করে, কাউকে নিয়ে একটু একটু খেলে।
সবই বুঝলাম। শুধু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে এটা তোমার জন্য একটা সমস্যা হয়ে উঠেছে।
না না, সমস্যা কী!… সত্যি কথা হলো, আমি তো নুসরাত শারমিন সেজে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে মাহবুবুল হাসানের সাথে কথা বলছি। শুধু খেয়ালই রাখছি যেন অল্পবয়সী, খেয়ালি, ছটফটে মেয়ের মতো করে কথা বলি।
এটা যদি সত্যি কথা হয়, তবে একটু আগে যা বললে, তা কী?
সেসব হচ্ছে প্রাসঙ্গিক কথা। যেমন বাস্তবেও অমন মেয়ে আছে….।
বলেছি তো- থাকবে না! কিন্তু তোমার হয়েছেটা কী?
কিছু না।… কী বলছিলে যেন, বিয়েটা পিছিয়ে দেব কি না?
তোমার কী ইচ্ছা?
চম্পার কাছে কিছুটা বলেছে সে, আবার কিছুটা এড়িয়েও গেছে। তার মনে হয়, সে যেভাবে ভাবছে, সেটা চম্পাকে বোঝানো যাবে না। তবে নিজের কাছে স্বীকার করতে মঞ্জুরের সমস্যা নেই, এটা এখন শুধু মাহবুবুল হাসানকে একটা শিক্ষা দেয়া, শুধু এটুকু নয়; শুরুতে ব্যাপারটা অমনই ছিল। চম্পার সাথে খেলতে এসেছে বুড়ো- আচ্ছা, দাঁড়াও। এখন এটা পুরো ঢাকা পড়ে গেছে এমনও নয়, এখন দেখে নেয়ার ইচ্ছাটা নেই, ব্যাপারটা এমনও না, তবে এখন মজা দেখার ইচ্ছাটাও প্রবল, সেটা শুধু চম্পার কারণে না, সেটা একটা লোকের আচরণ কেমন হয় এসব ক্ষেত্রে, কোন পরিস্থিতিতে সে কী রকম ভাবে আর বলে, এই
একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর, এর সাথে নুসরাত শারমিন তো আছেই। সে নিজেই তৈরি করেছে নুসরাত শারমিনকে। কিন্তু তার মনে হয়,
নুসরাত শারমিন সম্পর্কে সে সবকিছু জানে না, নুসরাত শারমিন কখন কী বলবে,
তাও সে সব সময় ঠিক ঠিক বোঝে না। এটা বেশ লাগে তার— কারণ সে নিজেই নুসরাত শারমিন। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা তা-ই হয়ে দাঁড়িয়েছে বেশ নেশার মতো। কিন্তু চম্পার ব্যাপারটা ছাপিয়ে নেশা জায়গা দখল করেছে… আচ্ছা, ছাপিয়ে না গেলেও নেশা বেশ অনেকটাই জায়গা দখল করেছে, এটা চম্পাকে বুঝতে দেয়া যাবে না। যদি ভুলেও সে বলে ফেলে, কিংবা না বলুক সে, চম্পা বুঝে ফেলে কোনো-না-কোনোভাবে, সে অবাক হবে- তুমি না মাহবুবুল হাসানকে দেখে নেবে বলেছিলে!
আহা, কথা সেটাই।
তা হলে এখন এসব কী দেখছি?
এখন আবার কী দেখছ!
সে তুমিই জানো! মাহবুবুল হাসানের চেয়ে বেশি বলো নুসরাত শারমিনের
কথা।
তুমি বুঝতে পারছ না।
বোঝাও বোঝাও।
এমন হতেই পারে, সে চম্পাকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না। চম্পা বলবে— বলো বলো।
সমস্যা হলো_ ঠিক কী বলবে সে! সে চম্পাকে আগে বলেছে, তা-ই আবার নতুন করে বলবে? হ্যাঁ, নুসরাত শারমিনের মতো মেয়ে থাকতেই পারে আরও একজন বা অনেক। পরম লাবণ্যাময়, আচ্ছা পরম না হোক, বেশ লাবণ্যাময়, তা বয়সটাই ও রকম ও মেয়ের, এ বয়সে পরম সুন্দরী বা লাবণ্যাময়ী না-ই হোক, তাদের মধ্যে আলাদা এক চটক থাকবেই। একইসাথে তেজী, আহ্লাদী ও
খেয়ালি, ক্ষেত্রবিশেষ ছেলেমানুষি থাকতে পারে, এমন একটা মেয়ে। এসব মানিয়ে যায় তাকে, কখনো গাড়ি চালাতে গিয়ে ছোটখাটো অ্যাক্সিডেন্ট করে কপট ভয়েও থাকতে পারে- বাবা তাকে ধমকাবে…। আচ্ছা, থাক না এসব। মঞ্জুর ভেবে দেখল, এত সব গুছিয়ে ভাবার দরকার নেই। ঠিক এ রকমই একজন আছে, এ রকমই, সত্যিই আছে, কোনো না কোনো মাহবুবুল হাসানের সাথে চ্যাট করছে, মেয়েটির একটা নিজস্ব পৃথিবী আছে, সেখানে তার মতো করে থাকে- এই, সব মিলিয়ে এই-ই মূল ব্যাপার।
এটাই সে বলল মাহবুবুল হাসানকে। সে বলল মানে নুসরত শারমিন বলল- জানো, মাঝেমাঝে একটা কথা ভেবে আমার খুব অবাক লাগে।
বলো শুনি, কী তোমার অবাক লাগে। মাহবুবুল হাসান জানতে চাইল।
না, বলব না।
আহা, বলো না।
ন, বলব না। আমার ইচ্ছা।
এমনি আর বলি তুমি বাচ্চা একটা…।
অ্যাই খবরদার, বাচ্চা বলবে না, আমার বয়স জানো?
পুচ্চু একটা।
পুচ্চু! একটা ঘটনা আছে, শুনলে…।
কী, কী?
উঁহু।
পি−জ বলো।
উঁহু, আজ না, অন্যদিন বলব।
মাহবুবুল হাসান আরও কতক্ষণ চেষ্টা করল কিন্তু নুসরাত শারমিন ও বিষয়ে মুখ খুলল না। নুসরাত শারমিন বলল- আজ স্টেটাস দাওনি যে!
ঐ কথাটা কিন্তু বলবে।
বলব, বলব।.. স্টেটাস দাওনি কেন?
দেব। ভাবছি। ব্যাপারটা ঠিক গুছিয়ে আনতে পারছি না।
তুমি অনেক ভাবো, না?
কই আর!
আর অনেক পড়ো। আমার না পড়তে ইচ্ছা করে না। বলেছি, বই ঠিক করে দেব। সেভাবে সিরিয়াল করে পড়া শুরু করবে।
নাহ্, পড়ে কী হবে! পড়তে আমার সত্যি ইচ্ছা করে না।
তা হলে তোমার কী ইচ্ছা করে!
খুব সোজা। কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করে, যেখানে আমাকে কেউ চিনবে
না।
একদম মুখ ̄’র মতো বলে দিলে!
মাঝেমাঝেই ভাবি যে!
এখনো ভাবছ?
হুঁ।… এমন একটা জায়গা যেখানে আমাকে কেউ চিনবে না।
তোমার বুঝি মন খারাপ?
মাঝেমাঝে খুব মন খারাপ হয়। তখন কিছু ইচ্ছা করে না।
তখন কী করো?
বললাম না, তখন কিছু করতে ইচ্ছা করে না।… তখন ছাদে গিয়ে এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি।…জানো, আমাদের ছাদটা খুব সুন্দর। শহরের
মধ্যে, কিন্তু এত নির্জন…।
তাতে আমার কী? আমার দেখা হবে না।
বলা যায় না। হতেও পারে।
বলছ?
ওই যে বললাম, বলা যায় না।
তুমি এত হেঁয়ালি করো! কিছুই স্পষ্ট করো না।
তাই বুঝি! মাহবুবুল হাসানের বুঝি খুব রাগ হয়?…আহারে। ‘আহারে’ বলে সে মাহবুবুল হাসানের সাথে কথা বন্ধ করে নিজের ওয়ালে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ‘আরে কী হলো কোথায় গেলে’- তিনটা মেসেজ এলো মাহবুবুল হাসানের। সে তিনটা ওপেন করার বা উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। সে শুধু মনে মনে বলল, বলেছি না, আমি খেয়ালি মেয়ে!
সে মাহবুবুল হাসানকে নক করল তিনদিন পর। মাহবুবুল হাসান এমনভাবে ‘তুমি তুমি’ করতে আরম্ভ করল, তার মনে হলো সামনে থাকলে লোকটা তোতলাত।
আমি কী? সে জিজ্ঞেস করল।
তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে!
আমি! উঁহু, না।
তা হলে এতদিন কোথায় ছিলে তুমি!
আমার কি কাজ থাকতে পারে না, বলো?
তাই বলে একটা খবরও দেবে না আমাকে!
স্যরি।
স্যরি বললেই হয়ে গেল!…আমার সেল নো আছে তোমার কাছে…।
স্যরি।
তোমার সেল নো কবে দেবে?
দেব।
সে তো শুনছি চৌদ্দ বছর। কতদিন হলো বলছি নতুন ছবি আপলোড করো, তাও করছ না।
বলেছি তো, ছবির চেয়ে আসল নুসরাত অনেক সুন্দর।
কেমন সুন্দর? যখন কোথাও এসে দাঁড়াও, জায়গাটা আলো হয়ে যায়?
আরে, তুমি কবি নাকি?
এই এক কথাতেই কবি! এ রকম কত কথা…! আর আজকাল যে কবিতা লেখা হয়, আমি কেন, যে কেউ পারে।…তুমি কবিতা পড়বে?
তোমার লেখা হলে পড়ব।
তোমার জন্য কবিতা লিখতে হবে দেখছি!
লেখো না। আমার ভালো লাগবে।
লিখব।… আচ্ছা, সেদিন একটা কথা বলতে নিয়ে বললে না…।
আমি? কী?… শোনো, আমি অনেক কথাই বলি। গুরুত্ব দিও না।
বলছিলে না, মাঝেমাঝে তোমার একটা কথা ভেবে খুব অবাক লাগে।
বলেছিলাম!…নুসরাত শারমিন যে কত কী বলে…।
বলো না। কী ভেবে অবাক লাগে?
গেস করতে পারবে?
কঠিন।… আচ্ছা, খুব ওয়াইল্ড গেস। আমার তোমার এই যে পরিচয়…।
সেটা তো আছেই।
কী অদ্ভুতভাবে আমাদের পরিচয় হয়ে গেল, তাই না? কোথায় ছিলাম দুজন…।
আমার নিজের কথা ভাবতেই অবাক লাগে…।
হ্যাঁ, তুমি এই সেদিনও আমাকে চিনতেই না…।
আর তুমি বুঝি আমাকে চিনতে!… জানো, এখন শুধু আমাদের পরিচয়ের না, আমার নিজের কথা ভাবলেই অবাক লাগে!
তাই? কেন!
এই যে, আমি… আমি একটা মেয়ে, আমার চারপাশ, আমি আছি, খাচ্ছি-
দাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, টিভি দেখছি, বন্ধুদের সাথে দুষ্টুমি করছি…।
আমার সাথে চ্যাট করছ…।
হুঁ…। আবার ছোট ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করছি। আবার আমার একা
কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছা করছে…।
আমাকে নেবে না?
কোনো বিকালে আবার কফির মগ হাতে চলে যাচ্ছি ছাদে। কফি খেতে খেতে তাকিয়ে থাকছি দূরে…।
এ কথাটা মঞ্জুর বলল চম্পাকে- আমার ধারণা মেয়েটা বিকালে কফির মগ হাতে ছাদে যায়। কফি খায় আর দূরে তাকিয়ে থাকে।
কোন মেয়ে! চম্পা জিজ্ঞেস করল।
নুসরাত শারমিন।
নুসরাত শারমিন কে!… ওহো!… মানে?
মঞ্জুর একটু বোকার মতো হাসল- মানে নেই কোনো। মনে হলো আর কী।
ব্যাপার কী বলো তো?
ব্যাপার আবার কী!
তুমি নিজেই ভাবো। ভেবে দেখো।
এমনি। এমনি বলেছি তো।
যে নুসরাত শারমিনের কোনো অস্তিত্ব নেই, তুমি তার কথা আমাকে বলছ-
সে কফি খায় আর দূরে তাকিয়ে থাকে!
আহা, এ রকম হতে পারে না।
বলো, আর কী হতে পারে, বলো?
এই যে, তুমি রেগে যাও…।
একটা কথা বলি তোমাকে? একটা অনুরোধ? রাখবে?
বলো।
তুমি এই চ্যাপ্টারটা ক্লোজ করে দাও। মানে হয় না। সত্যি বলছি। ক্লোজ করো এটা।
করব। মঞ্জুর বলল।
মঞ্জুর যদিও বলল ‘করব’, তবে সে কথা রাখতে পারল না। এ অবশ্য কিছুদিন পরের ঘটনা। ছুটির দিন, মঞ্জুর আর চম্পা লাঞ্চ করেছে একসাথে।
তাদের পরিকল্পনা এ রকম- তারা টুকটাক শপিং করবে, বিকালের পর সিনেমা দেখবে একটা, তারপর বাসায়। তা লাঞ্চের পর কিছুটা সময় আছে হাতে, তারা কফি খাচ্ছিল আর নানা গল্প করছিল। তখন প্রসঙ্গ উঠেছিল। চম্পা বলেছিল,
সিনেমায় কিছু পার্শ্বচরিত্র থাকে, নায়ক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, বেখেয়াল, রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির নিচে পড়তে নিল, রাস্তায় একটা যানজট লেগে গেল, লোকজন ভিড় করল কয়েক মুহূর্তের জন্য। এরই মধ্যে দেখা গেল এক মা তার
ছেলে বা মেয়েকে নিয়ে রাস্তা পার হতে হতে ভিড়ের দিকে তাকাচ্ছে। একটুক্ষণ, আর একবারই, তারপর ঐ মহিলাকে আর দেখা যাবে না, সিনেমার দর্শকরা মাথা ঘামাবে না, কারণ শুধু ঐ দৃশ্য তৈরির জন্যই আরও অনেকের সাথে ঐ মহিলার
একপলকের আগমন। চম্পা বলেছিল- দেখো, সিনেমায় এ রকম কত চরিত্র, তুমি ভেবে দেখো এই প্রতিটি চরিত্রের আলাদা জীবন আছে, তাদের কাহিনী আছে, তাদের জীবনে ঘটনা আছে।
এভাবে ঘটনার কথা উঠেছিল, মানুষের জীবন আর ঘটনা, তারা বলছিল- কোন মানুষের জীবনে গল্প নেই, কোন মানুষের জীবনে ঘটনা নেই! এসব বলার ফাঁকে হঠাৎই মঞ্জুর বলল— আমি কনফার্ম, নুসরাত শারমিনের জীবনেও ঘটনা আছে।
চম্পাকে অবাক দেখাল— হঠাৎ নুসরাত শারমিনের জীবনে ঘটনা আছে বলার মানে?
আছে। মাহবুবুল হাসানকে সে কোনো এক ঘটনার ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু ঘটনাটা যে কী, তা কিছুতেই বলছে না।
চম্পা বলল— মঞ্জুর, প্লিজ…।
আমি নিজেও বোঝার চেষ্টা করছি ঘটনাটা কী হতে পারে।
চম্পা আবার বলল— মঞ্জুর, প্লিজ…। এবার সে এতটাই জোরে বলল, মঞ্জুর নিজেকে ঝেড়ে ফেলে তার দিকে তাকাল- কিছু বলবে?
মঞ্জুর, নুসরাত শারমিন তোমার বানানো একটা চরিত্র।
আহা, তাই বলে তার জীবনেও ঘটনা থাকবে না? তুমি ভাবো একবার, কত
কী হতে পারে…।
মঞ্জুর, আমি টায়ার্ড, আমি সত্যিই টায়ার্ড। তুমি এসব কী আরম্ভ করেছ!
আমি কী আরম্ভ করেছি!
তুমি নিজে বুঝতে পারছ না তুমি কী আরম্ভ করেছ?
আচ্ছা আচ্ছা, মাহবুবুল হাসান একটা ধাক্কা খেলেই… ব্যাটার সাহস কত যে…।
লাগবে না। আমার কথা শোনো তুমি, ঐ লোকের ধাক্কা খাওয়া লাগবে না।
মঞ্জুর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।
আমার কথা তুমি শোনো মঞ্জুর, খুব ঠাণ্ডা মাথায় শোনো। তুমি আজ, হ্যাঁ, তুমি আজই ঐ নুসরাত শারমিনের ফেক অ্যাকউন্ট বন্ধ করবে। ফাইনাল। তুমি বুঝতে পারছ আমি কী বলছি?
মঞ্জুর গম্ভীর মুখে বলল— পারছি। বুঝতে না পারার কিছুই নেই। বন্ধ করে দেব।
মঞ্জুর যদিও বলল বন্ধ করে দেব, সে বন্ধ করল না। তবে সে বুঝল কাজটা বিপদজনক হলো, এই যে সে বন্ধ করল না, এটা চম্পা জানলে ভয়ংকর রেগে যাবে। চম্পা রেগে যাবে, তার ওপর রেগে থাকবে, এটা কঠিন একটা ব্যাপার
হবে, মঞ্জুর এটাও বুঝতে পারল। তার মন খারাপ হলো। মন খারাপ করে সে মাহবুবুল হাসানকে বলল— আমার মনটা খুবই খারাপ, জানো?
মাহবুবুল হাসান ব্যস্ত হয়ে পড়ল— কেন কেন!
আমার ভালো লাগছে না। আমার মনে হচ্ছে আমি আর বেশিদিন নেই।
কী বলো এসব!
যা সত্যি, তা-ই বলি।
ছেলেমানুষ একটা।
আচ্ছা, আমি যদি না থাকি তোমার মন খারাপ হবে?
এসব বাজে কথা বাদ দাও সোনা।
আচ্ছা, আমি যদি অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাকটিভেট করি…।
করবে? কেন!
যদি করি…?
কী হয়েছে তোমার, বলবে?
বুঝতে পারছি না।
তোমার মন খারাপ। শোনো, তুমি আমার সাথে দেখা করো। প্লিজ, দেখা
করো।
করব।
করবে? আগেও কিন্তু বলেছ করবে, কিন্তু পরে এড়িয়ে গেছ।
না, দেখা করব। আমার ইচ্ছা করছে।
সত্যি বলছ?
সত্যি। আমি তোমার সাথে দেখা করব।
থ্যাঙ্ক ইউ, আলো।… সেল নম্বরটা দেবে?
দেব। তার আগে ঠিক করো কবে, কোথায় কখন?…আমি পরশু বিকালেফ্রি।
তারা দেখা করার জায়গা ও সময় ঠিক করল।
মাহবুবুল হাসান বলল— আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার কেমন যেন লাগছে!
আমারও না। কী আশ্চর্য আমি তোমার সাথে দেখা করতে যাব!
আমার এতদিনের অপেক্ষা… আমি কিন্তু তোমার হাতটা একটু ধরব…।
কী মনে হচ্ছে তোমার? কেউ… কেউ একজন তোমার সাথে দেখা করতে
আসবে?
হুঁ… হুঁ। কেউ একজন… কে সে?
শোনো। তুমি পৌঁছবে ৫টায়, আমি ৫টা ৫-এ। পৌঁছে আমি তোমাকে
মেসেজ দেব ফোনে।
মঞ্জুর পথের পাশের দোকান থেকে একটা সিম জোগাড় করল। তার দুটো
সেটের একটা সে কম ব্যবহার করে। মাহবুবুল হাসানের সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে সে সিমটা বদলে নতুন সিমটা লাগিয়ে নিল। নতুন সিম লাগিয়ে সে মাহবুবুল হাসানকে মেসেজ দিল- এই, এই এটা হচ্ছে আমার নাম্বার। আমি
কে চিনতে পারছ তো? কিছু ক্ষণের মধ্যে মেসেজের উত্তর এলো- তোমাকে
চিনতে পারব না!!! তারপর আরও একটা- আজ তোমার সাথে আমার দেখা
হবে, ভাবতেই…। কিছুক্ষণ পর আরেকটা মেসেজ- ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে
কিন্তু। কী করছ এখন?
মঞ্জুর ঠিক সময়ে পৌঁছল। ঘড়ি দেখল, যেখানে নুসরাত শারমিনের থাকার কথা, তার কিছুটা দূরে সে দাঁড়াল। এদিকওদিক তাকাল, সে সময় তার হঠাৎই মনে হলো, আচ্ছা, আমি কেন এসেছি! আমি কেন! আমার আসার কী দরকার ছিল! আমি ঘরে বসে থাকলেও মাহবুবুল হাসানের মেসেজ আসত, কোথায়, কোথায় তুমি- সে বারবার জানতে চাইত, আর সে, ‘এখন এখানে, এখানে একটু অসুবিধা, আমি ওখানে’ বলে বেশ কিছুটা ঘোরাঘুরি করাতে পারত মাহবুবুল হাসানকে। কীভাবে ছোটাছুটি আর অপেক্ষা করত মাহবুবুল হাসান, এ তো ঘরে বসেই অনুমান করা যেত, তারপর এক সময় শেষ মেসেজটা লিখত
সে- ভোদাই, বুঝেছিস, তুই একটা ভোদাই। তারপর সিমটা ফেলে দিত, ফেসবুক আইডিও ডিঅ্যাকটিভ করত। ওসব পারাই যেত যখন, তা হলে এসেছে
কেন সে, হ্যাঁ?
মেসেজ এলো ফোনে, আমি পৌঁছে গেছি। তুমি? সে উত্তর দিল- পৌঁছে গেছি। মার্কেটে ঢুকছি। তুমি? উত্তর এলো- যেখানে থাকার কথা আমি ঠিক সেখানে অপেক্ষা করছি।
হলুদ শার্ট। তুমি কি পেস্ট গ্রিন?
নুসরাত শারমিনের আসার কথা ওশান ব্লু জিন্সের প্যান্ট আর পেস্ট গ্রিন
লিলেনের শার্ট পরে। মাহবুবুল হাসানের পরনে থাকবে হলুদ শার্ট, রাফ কটনের।
সে উত্তল দিল হুঁ, পেস্ট গ্রিন। যাচ্ছি। থাকো।
মেসেজ পাঠিয়ে দিয়ে সে এদিকওদিক তাকাল আবার। মার্কেটের এ অংশে ভিড়, এরই মাঝে সে দেখার চেষ্টা করল। দেখার চেষ্টা করতে করতে সে
দাঁড়িয়ে থাকল কয়েক মিনিট। তারপর সে দোতলায় উঠে গেল। আবার মেসেজ এলো- কোথায়? মার্কেটে ঢুকলে এতক্ষণ লাগার কথা না নুসরাত। সে উত্তর দিল- এক মুরব্বি দাঁড়িয়ে আছেন ওখানে। তোমাকে এক পলক দেখলাম
বোধহয়। দোতলায় চলে এসো।
দোতলায়ও সে তাকাল এদিকওদিক। মৃদু পায়ে হাঁটল কিছুটা। হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করল। এর মধ্যেই আবারো মেসেজ এলো, আমি দোতলায়
বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। সে উত্তর দিল—তেতলায় এসো। ততক্ষণে সে নিজেও অবশ্য তেতলায় উঠে এসেছে।
তেতলায় সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। অপেক্ষা করল মানে সে ঘুরল, তাকাল, দেখল। তার চোখে পড়ল না। আবার মেসেজ এলো- তুমি কোথায়?
সত্যি করে বলো তো তুমি কোথায়?
পাঁচতলায় এসো তো প্লিজ।
তুমি কী আমার সাথে মজা করছ?
না না। মজা কেন করব। সত্যি, মজা না।
আমার ধারণা তুমি আমার ধৈর্য দেখছ। ঠিক আছে, তোমার জন্য আমার
ধৈর্যের অভাব নেই।
সে ততক্ষণে পাঁচতলার অনেকটাই ঘুরে ফেলেছে। তারপর ছয়তলা,
সাততলা, আটতলা।
এবার কোন তলায় তুমি?
আট।
এই পৌঁছে গেলাম বলে।
মঞ্জুর এক খামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। অনেক ভিড়। অনেক খাবারের দোকান। সে মৃদু পায়ে হাঁটতে লাগল। তার ফোন বাজতে লাগল। সে
ফোন ধরল না। মেসেজ এলো- আর না। এবার তুমি কোথায়, সত্যিই বলো
সোনা।
দেখছি।
দেখছি মানে!
সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সবাইকে। উঁকি মেরেও দেখল। ওশান ব্লু জিন্সের প্যান্ট আর পেস্ট গ্রিন শার্ট পরা কাউকে দেখল না সে। কাউকে তার নুসরাত শারমিন মনেও হলো না।
ফোন বাজলে সে বিরক্ত হয়ে ফোনের দিকে তাকাল। মেসেজ এলো— তুমি
কি আসেনি? সত্যি বলছি, তুমি নেই দেখে আমার একটুও ভালো লাগছে না।
সে উত্তর দিল- আমারও।
আবার মেসেজ এলো- মানে!… আলো, তুমি কি আসোনি?
তোমার কী মনে হয়?
আমার মনে হয় তুমি এসেছ।… তবে আমার সাথে মজা করবে বলে অন্য
পোশাকে এসেছ। তাই কী?
ফোন থেকে মুহূর্তের মধ্যে চোখ সরিয়ে মঞ্জুর এদিকওদিক তাকাল। এ কথাটা তার একবারও মনে হয়নি। মাহবুবুল হাসান বলল বলে মনে পড়ল। হ্যাঁ,
নুসরাত শারমিন যে দুষ্টু, মজা করার জন্য অন্য পোশাকে অন্যভাবে সে আসতেই পারে।
মঞ্জুরের উৎসুক চোখ তেমন কাউকে অবশ্য খুঁজে পেল না। তবে সে হতাশও বোধ করল না। সে ভিড় থেকে চোখ সরাল না। তার মনে হলো, ভিড়
ঠেলে, কিংবা হয়তো ভিড় ঠেলে নয়, একদম শূন্য থেকে হঠাৎ চলে আসবে নুসরাত শারমিন, বলবে- যেভাবে আসার কথা, সেভাবে আসিনি, অন্য পোশাকে এসেছি। মাহবুবুল হাসান চিনতেই পারবে না। তুমি কি পারছ?
মঞ্জুর জানে, সে তখন বলবে- কী বলো তুমি! কী বলো! আমি তোমাকে চিনতে পারব না!