কিশোর গল্প।। প্রথম প্রত্যাশা।। মোস্তাফিজুল হক
আবিদ আর কয়েকদিন পরই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। সে যখন
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব পড়ছিল, তখন ওর বাবা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোর্শেদ সাহেব পাশে এসে বসলেন। তিনি বললেন, “কী পড়ছ বাবা?”
আবিদ জবাবে বলল, “আইন্সটাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব পড়ছিলাম, বাবা। এখন একটু আয়েশ করব। আর সেটা হতে পারে, তোমার সাথে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা।”
“শোনো, মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আর সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনোবিজ্ঞানের নতুন ধারণা প্রদান মানব সভ্যতারউৎকর্ষ সাধনে রীতিমত বৈপ্লবিক সূচনা।”
“এরপরেও কি বিজ্ঞান চর্চায় কোনো দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব নেই, বাবা?” আবিদ ওর বাবাকে পাল্টা প্রশ্ন করে।
“কার্ল পপার এঁর নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছ? তিনি কিন্তু ঠিকই খেয়াল করেছিলেন, সকল বৈজ্ঞানিক অর্জন আসলে সমান নয়। এজন্যই তিনি বিজ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন বিজ্ঞানের দুটো শাখার একটা ‘প্রকৃত বিজ্ঞান’ বা ‘রিয়েল সায়েন্স’ অন্যটা ‘অসম্পূর্ণ বিজ্ঞান’ বা ‘সিউডো-সায়েন্স’। কার্ল পপার তাঁর ধারণা যাচাই করতে গিয়ে প্রকৃতিকে জানতে অনেক কিছুই শিখিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে আমরা আমাদের ধারণা ও তত্ত্বগুলোকে পরীক্ষা ও চ্যালেঞ্জ করতে পারি। শুধু তাই না, তা নিয়ে যেতে পারি সত্যের কাছাকাছি। আজ এরকমই একটা বিষয় গল্পের আদলে তোমাকে শোনাচ্ছি” বলেই মোর্শেদ সাহেব বলতে লাগলেন :
কোনোএক অচেনা পাহাড়ের পাদদেশে এক নীলকণ্ঠ পাখি রাজত্ব ঘোষণা করল। রূপস আর আর সৌন্দর্যের দিক থেকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পাখি নীলকণ্ঠ। তাই শালিক তাকে সহজেই রাজা মেনে নিল। রাজা কি? রীতিমতো কণ্ঠরাজ! না মেনে উপায় কী? এটি যে সৌন্দর্যের দিক থেকে একেবারেই আলাদা। শুনেছি এ জাতের পাখির আকার-আকৃতি একটু ছোট হয়। তবে এটির বেলায় পুরোই ব্যতিক্রম। বলতে গেলে অনেকটা দাঁড়কাকের মতো।
নীলকণ্ঠ পাখির ঘন বনজঙ্গল মোটেই পছন্দ নয়। যেন আড্ডাবাজ মানুষের মতো। অকাজের লোকগুলো যেমন এক কাপ চায়ের আশায় মানুষের সাথে আড্ডা জমিয়ে নিজের প্রশংসাটুকু আদায় করে নেয়, ঠিক সেরকম।
তেলতেলে পালক দেখে তেলাপোকা, ফড়িং সেই নীলকণ্ঠ পাখির কাছে ছুটে এলে আয়েশে আহার করে। ছোট ছোট পোকামাকড় এই পাখির প্রিয় খাবার। তাই মুক্ত ও খোলা মাঠে থাকতেই ঐ রাজা পাখিটার ভালো লাগে।
পাখিটার খানিকটা মাথামোটা! ঠিক মনেহয় বুঝিয়ে বলা হল না! আসলে দেহের তুলনায় ওটার মাথাটা একটু বড়। তবুও সৌন্দর্যের দিক থেকে অন্য পাখিরা এর ধারে-কাছেও নেই। এর শরীরে গাঢ় ও কিছুটা হালকা নীলাভ পালক রয়েছে। গলা ও বুকের পালকে খয়েরি ও বাদামি রঙের মিশেল। তবে পিঠের পালকের রঙ পোড়ামাটির মতো। মনেহয় বাদামি রঙের ফতোয়া গায়ে জড়িয়েছে।
নীলকণ্ঠ পাখির লেজ গাঢ় নীল। এই পাখির পায়ের রঙ ইটের মতো। ঠোঁট কালো। অনেকটাই তোমার দাদুর হাতের কালো রঙের লাঠিটার মতো। পায়ের পাতা হলদে। কণ্ঠে নীলের কোনো চিহ্নই নেই। তবুও পাখির নাম ‘নীলকণ্ঠ’!
তবে আজ আমি যে পাখিটা অর্থাৎ পাখিদের স্বঘোষিত যে রাজার কথা বলছি, ওটার কিন্তু ঠোঁট আর পা গোলাপি রঙের। তবে ওটার মাথার ঝুঁটি কালো রঙের। রূপকথার গল্পে শুনেছি, একসময় এই নীলকণ্ঠ পাখি মানুষ ছিল। এক যুবক দূরদেশে এক রাজার মুসাফির হলেন। তিনি সেই রাজ্যের রাজকন্যার দিকে কুদৃষ্টি দিলেন। রাজকুমারী তা বুঝতে পেরে তাকে নীল রঙের শরবত খেতে দিলেন। যুবক সানন্দে সেই শরবত গলাধঃকরণ করলেন। এর অল্পকিছু পরেই সেই যুবক অভিশপ্ত নীলকণ্ঠ পাখি হয়ে উড়ে যায়। অবশ্য এই গল্পেরও কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। তবে নীলকণ্ঠ পাখির উপস্থিতি চিরন্তন সত্য। গল্পের পাখি বলে কথা!
তারপর সেই পাখি সত্যিকার নীলকণ্ঠ পাখিদের সাথে ভাব জমিয়ে নিজেকে পাখি রাজ্যের রাজা ঘোষণা করল। তার ঘোষণায় বুকচিতিয়ে চলা কুচকুচে কালো ধূর্ত স্বভাবের ফিঙে নিজ রাজত্ব এই নীলকণ্ঠ পাখির হাতে সমর্পণ করল। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল ছোট্ট একটা দোয়েল পাখি ওর রাজত্ব মেনে নিল না! সে মনে করে দরাজ গলায় আওয়াজ করতে পারলেই তো আর পাখিদের রাজা হওয়া যায় না- তার জন্য থাকা চাই সুরেলা কণ্ঠ। কোকিল মনেকরে, এই পাখিদের কোনটা নারী আর কোনটা পুরুষ দেখে বোঝা যায় না। সুতরাং রাজা মানবো নাকি রানি মানবো? চাতকও ঠিক তাই মনেকরে। আর যাই কই? রাজার কানে পৌঁছে গেল সে খবর! একদল কাক আর শালিক এ খবরটা পৌঁছে দিয়ে রাজার মন্ত্রীও হয়ে গেল!
নীলকণ্ঠ পাখি যেন দেখতে সুন্দর আর ভরাট গলার স্বঘোষিত কবিদের মতো। তাদের যেমন সুন্দর অবয়ব আর দরাজ গলা আছে, কিন্তু নেই কবিতার মাধুর্য, তেমনি অপূর্ব এক রূপের পাখি হলেও নীলকণ্ঠের গানের গলা খুবই বিশ্রী। কোকিল পাখি কালো হলেও ওদের গানের গলা সুমধুর। আর নীলকণ্ঠ কি না আকর্ষণীয় দেহশ্রী নিয়েও কর্কশ! তারা ডাকে খাক, কাক, কাক শব্দ করে। ডাকলে মনে হয় চেঁচামেচি করছে। এ পাখিটির স্বভাব অনেকটাই হিংসুটে। নীলকণ্ঠ পাখির এক দম্পতির ঘরে অন্য দম্পতি প্রবেশ করলেই দুপক্ষের ঝগড়া বেধে যায়। ফলে এক দলের কাছাকাছি অন্য দল ভুলেও যায় না।
কাক আর নীলকণ্ঠের গলা প্রায় একই। এজন্য নীলকণ্ঠ কাককে খুব পছন্দ করে। একদিন ভোরে কা-কা-কা-কা করে একটা কাক নীলকণ্ঠ পাখির কাছে ছোটে এল। মানুষের কেউ কেউ সকাল বেলাই এমন কর্কশ আওয়াজ শুনে বিরক্ত হল। আবার কেউ বলল : আহা রে কী সুন্দর কাকডাকা ভোর!যাঁরা এইকথা বলেন, তাঁরা বিজ্ঞানী। কাকের কা-কা কণ্ঠ যতই কর্কশ হোক না কেন, কাক কিন্তু গায়ক পাখি। কারণ, পাখি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন কাকের গলায় ‘শব্দ যন্ত্র’ আছে। সুতরাং কাক গায়ক পাখি। এ দলে নাকি কর্কশ কণ্ঠের ‘দাড়িচাচা’ নাকি ‘হাঁড়িচাচা’? ওটাও আছে!
আবিদ কি অবাক হলে নাকি? এই যে, খুব চমৎকার গান গায় যে শিল্পী, তাঁকে আমরা কী বলি?
জবাবে আবিদ বলল, “কেন বাবা? আমরা তো সে শিল্পীর মিষ্টিমধুর গলার উপমা দিই কোকিলকণ্ঠী বলে?”
আবারও মোর্শেদ সাহেব বলে চলেছেন, “এখানেই ভুল, বাবা! কী যে নির্মম পরিহাস! বিজ্ঞানীরা কোকিলকে গায়ক পাখি হিসেবে স্বীকৃতিই দেয়নি! কারণ, যাদের গলায় শব্দ যন্ত্র নেই, ওরা আবার গায়ক পাখি হয় কী করে? হোক না সে যতই সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী।
তুমি তো, বসন্তবৌরীকে তো চেনোই। আমাদের বাড়ির পেছনের বটগাছে মিষ্টিসুরে গান গায়। এই যে এত মিষ্টি করে গান গায়, তবুও এটাও নাকি গায়ক পাখি না! এটারও গলায় যে শব্দ যন্ত্র নেই! প্রকৃতির এ কেমন অবিচার! বিজ্ঞানীদেরই বা কেমন নিরীক্ষা?”
আবিদ বলল, “এবার বৈজ্ঞানিক যুক্তির অসম্পূর্ণতা বুঝতে পেরেছি, বাবা। তাহলে কি নতুন কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না?”
মোর্শেদ সাহেব বললেন, “হ্যাঁ, তা তো হওয়া চাই-ই। এটা তোমাদের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের প্রথম প্রত্যাশা।”