বই আলোচনা/কাসিদ/ ইতিহাসের জীবন্ত দলিল/জিকরুর রেজা খানম

বইটা পড়ে শেষ করেছি গতরাতে। কিছুটা পড়েই মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেটা এখনও আছে। ইতিহাসে অনেক কথা লেখা থাকে, আবার অনেক কিছুই লেখা থাকে না, অলিখিত বিষয়ের অনেকটা ধরা পড়েছে এ উপন্যাসে। যারা পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সুর্য অস্তমিত হয়েছিল বলে মিথ্যা আত্মস্তুতিতে ভুগেন তারা কিছুটা হলেও বুঝবেন যে বাংলা কখনই স্বাধীন ছিল না। স্বাধীন ছিল না এই তথাকথিত নবাবরাও। তারাও নড়বড়ে হয়ে আসা দিল্লির ততোধিক দুর্বল মোগল বাদশাদের অধীন ছিলেন, বার্ষিক খাজনা প্রদানের বিনিময়ে যারা নবাবি করতেন তারা আর যাই হোক স্বাধীন নন। আর খাজনার পরিমানটাও নেহায়েত কম নয়।
এই মোঘল বাদশা এবং নবাবরা যে কি পরিমান অদক্ষ, অশিক্ষিত, অপরিনামদর্শী ও অদক্ষ ছিলেন সেটাও পাঠক বুঝতে পারবেন। এদের হাতে দেশ থাকলে এখনও আমাদের পাঁচশ বছর পিছিয়ে থাকতে হত, যেমনটি আমরা ইন্টারনেটের সুযোগ যথাসময়ে নেইনি বলে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলাম বিশ্বব্যাপী দ্রুত বর্ধনশীল চতুর্থ শিল্প বিপ্লব থেকে। তুলনাটা একারণে টানলাম যে ঐ সময়ে ইউরোপের রেনেসা আর প্রথম শিল্প বিপ্লব পুরা পৃথিবীকে এক ঝাঁকিতে মধ্যযুগ হতে আধুনিক যুগে এনে ফেলেছিল তার বিন্দুবিসর্গও এইসব অপদার্থ নবাব বাদশারা জানতেন না। জানার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও ছিল না। তারা ছিলেন পুরামাত্রায় উদাসীন ভোগ বিলাসে লিপ্ত এবং সেটা জনগনের পয়সায়, যে পয়সার কোন জবাবদিহিতা ছিল না।
মারাঠদের চরিত্র চিত্রন এ উপন্যাসে যথাযথ হলেও তা কিছুটা অপ্রতুল।
জগত শেঠ উমিচাঁদের মত স্বার্থান্বেষী দেশপ্রেমহীন কুটিল ব্যবসায়ী হিন্দু সম্প্রদায়ই অলক্ষে রাজত্বের অর্থনীতির যাবতীয় কলকাঠি নাড়াতেন এবং প্রয়োজনমত নিজের ব্যক্তিস্বার্থে গদী উল্টে ফেলতেন সেটাও চমতকার ফুটেছে। যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হাজার বছর পিছিয়ে থাকে এবং রাজা বাদশা নবাবরা সেদিকে বা প্রতিরক্ষার দিকে কোন নজরই দেন না সেদেশের ভাগ্য যে আফ্রকার মত হয়নি তাতে আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত।
এই রকম অপদার্থ নবাব যাদের থাকে তাদের হাত থেকে বৃটিশ বনিকেরা রাজদন্ড ছিনিয়ে নিয়ে শোষনের চরম রূপ দেখিয়ে দেবে তাতে আর আশ্চর্য কি! পাকিস্তান আমলে পুর্ব পাকিস্তান সীমান্ত ছিল পুরা অরক্ষিত। ভারত চিন মায়ানমার যে কেউ এক ঠেলায় দখল নিতে পারত, তেমনি মোঘল বা নবাব আমলে এতবড় ভারতবর্ষের বিশাল সমুদ্র উপকূল ছিল পুরোপুরি অরক্ষিত এবং নৌ বাহিনি দূরে থাক, একটা নৌকাও ছিল না।
যুগে যুগে কত যে বঞ্চনার ইতিহাস জমেছে তা বলে শেষ করা যাবে না। ‘কাসিদ’ সেখানে সত্যিই এক টুকরো লিপি বয়ে এনেছে যা ইতিহাসের আভাস জানায় ইংগিতে।
তবে সর্বাংগ সুন্দর হলেও একটু অপুর্ণতা রয়ে গেছে, সুলতানি আমল বলেন, মোঘল আমল বলেন আর নবাবি আমল বলেন, পুর্ববংগ ভয়ানকভাবে শোষিত হয়েছে, শুধু ভয়ানক নয় মারাত্মক রকম, যে পরিমান রাজস্ব বাংলা থেকে যেত তা রীতিমত অবিশ্বাস্য, শোষণে শোষণে এ অঞ্চলের মানুষ এতোই হতদরিদ্র হয়ে পড়েছিল যে তাদের ক্রয় ক্ষমতা বলতে কিছু ছিল না। এক টাকার মালিক হলেই তাকে ধনী বলা যেত, টাকা দূরে থাক সিক্কা মুদ্রার মালিকও তারা হতে পারেনি, তাদের বিনিময় চলত কড়িতে। গুটিকতেক সামন্ত ছাড়া আপামর জনসাধারণ ছিল কপর্দকহীন। কাসিদের শেষ পর্যায়ে কড়িতে কেনাবেচার কথা উল্লেখ আছে যদিও কিন্তু সাধারণ পাঠকের মূল কারণ অনুধাবন করতে অসুবিধা হবে।
মুর্শিদাবাদ কয়েকবার গিয়েছি, তন্ন তন্ন করে ঘুরেছি সর্বত্র। এই উপন্যাসের অনেক কিছুই সেখানকার লোকাল গাইড, যারা নিজেদের নবাব পরিবারের উত্তরসূরী বলে পরিচয় দেন, তাদের কাছ থেকে শুনেছি। তাই হয়ত উপন্যাসটি জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে আমার কাছে। অন্যদের কাছেও তেমনটি লাগবে বলেই আমার বিশ্বাস। নিজেদের ইতিহাস নব প্রজন্ম জানুক এই অভিপ্রায়ে বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।

বইয়ের নাম : কাসিদ
ধরণ : ঐতিহাসিক উপন্যাস
লেখক : জয়দীপ দে শাপলু
প্রকাশক : দেশ পাবলিকেশন্স
বিনিময় : ৫০০ টাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *