ফারুক আহমেদ- এর কবিতা
আশ্চর্য নদী
আমার বালিশের নিচে চাপা পড়ে আছে একটা নদী
বিভোর ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠলে সে নদীর আর্তনাদ
শোনা যায়, শোনা যায় পরম্পরার আকুতি। তবে কখনো বালিশে
হাত ঢুকিয়ে নদীকে বের করে নিয়ে আসতে চাইলে
সে আর দৃশ্যে থাকে না—হয় অদৃশ্যে লোপাট।
আমি বারবার বলি, দৃশ্যতে আসো; হোক মেলবন্ধনের
নিপাট যোজন। অ্যাভিন্যুতে বৃষ্টি শেষে গাছের পাতাগুলো
যেমন চকচক করে, তেমনি তোমার উজ্জ্বল মুখ রচিত হোক,
বাদাম ভাঙার মতো আমাদের যোজন মুহূর্তগুলো ভেঙে ভেঙে
বের করে আনি সারাৎসার। অথচ নদী কোন দিক থেকে
কোন দিকে চলে গেল, শশাঙ্ক আর তাকে শাসন করতে পারল
না, বিপাশা নামে যে নদী, সেও মুখ থুবড়ে পড়ল এর সামনে।
জৈষ্ঠ্যের খরতাপে মাঠ ফেটে কৃষকের কপালে ছোট ছোট
অগণিত দেয়াল। অথচ তখনও বহমান ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ
তুলে বালিশের নিচে খেলছে আমার আশ্চর্য নদী। অন্যদিকে
দেখো, তোমার বালিশের নিচে আত্মার দীর্ঘ আকুতি। তার চেয়ে
বরং চলো আকুতি নদীতে ছেড়ে দিই, গোসল করুক, ভিজুক।
বর্ষা তো ঘড়ির কাঁটার মতো কৃতদাস হয়ে আসছে না।
তুমুল প্রেমের কবিতা- ২
অনেক রাত হয়ে গেছে, ব্যাগ ভরে যাওয়ার মতো রাত
অনেক রাত হয়েছে, কিন্তু ঘুম আসছে না;
ঘুমকে খুশি রাখার জন্য আমি ওকে নিয়ে দার্জিলিং
গিয়েছি, কলকাতা থেকে একটা ট্রাউজারও কিনে দিয়েছি।
অথচ এই ব্যাগ ভরে যাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি রাতে
ঘুম তার কাছে বসে আছে, তাকে নিয়েই ব্যস্ত আছে।
তাহলে আমি কী করব, অর্ধ ঘুমকে নিয়ে
আজ রাতটা পাড় করে দিব, নাকি রাতকে
বলবো ঘুম না আসা পর্যন্ত এই গোলার্ধে পড়ে থাকতে।
ঘুম যা শুরু করেছে, তা দেখে মনে হচ্ছে আমার ঘুমকে
পাওয়া আর বেকারের সরকারি চাকরি পাওয়া একই কথা।
ঘুমের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে সে আমার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন,
আমার ব্যাপারে হতাশ- তাই গার্ডিয়ানের কাছে গেছে।
দেখেন ঘুম, আপনি যার কাছে হুট করে চলে যান, তার ঘুম
কিন্তু আমার কাছে আসে না- তার ঘুম তার কাছে থাকে।
ফলে আপনি আমার নুন খান এবং অন্যের গুণ গান-
পৃথিবীতে এমন অহরহই ঘটে। কিন্তু আমার ঘুম এমন
ঘটাক- ঘাতকতা করুক, তা আমি চাই না। আমি
চাই ঘুমেরা দিনের বেলা পাহাড়ে-সমুদ্রে বেড়াতে যাবে,
সন্ধ্যায় শহরের গলিতে নেমে আসবে, আর রাতে আমার
চোখে। এভাবে অবধারিত শান্তির দিকে যেতে চাই
সমুদ্রবিলাস
শব্দ নাই, পঙ্ক্তি কোত্থেকে আসবে? নারিকেল পাতায় বারি খেয়ে কই দৃশ্য তো আমার উপর লুটিয়ে পড়ছে না! এমতাবস্থায় তুমি কবিতা চেয়ে বসলে আমি কড়া সুদে শব্দ ধার করে নিয়ে আসা ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না সপ্তাহে সপ্তাহে সুদের কিস্তি। তাতে তোমার অস্বস্তি, কোন মতে রাজিও না।
সমুদ্র কাউকে ফেরায় না। তবু ভেবেছিলাম আমি তাকালে সমুদ্র শুকিয়ে যাবে এবং এর যথার্থ সদ্ব্যবহার ঠিক ঠিক করবো। সমুদ্রের তল থেকে সবচেয়ে লাবণ্যধরা শব্দগুলো কুঁড়িয়ে নিয়ে কবিতার গলায় ঝুলিয়ে দেব। কিন্তু সমুদ্র শুকায়নি। ফলে বাধ্য হয়ে অথবা খানিকটা আবেগতাড়িত হয়ে বা এ ছিল নিয়তিনির্ধারিত আমি ঢেউয়ের গভীরে আমার হাত নিমজ্জিত করে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ঢেউ আমাকে ঘিরে নিল; অদ্ভূত নৃত্যের ভঙ্গিতে ঝনঝন, ঝনাৎঝনাৎ শব্দের মহুয়ায় নির্মাণ করে দিল কবিতার আকর। ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা সব ঢেউয়ের ভেতর থেকে ঢেউয়ের মতো ঝাপিয়ে পড়লো। বাহ রে বাহ, ঢেউ আমারে নিয়ে যা।
সমুদ্র কাউকে ফেরায় না; সমুদ্র কাউকে নেয়ও না নিয়ে ছেড়ে দেয়। তারপর শুধু লেগে থাকে সমুদ্রের ঢেউয়ের ঐশ্বর্য। থাকে? দরজায় সমুদ্রসকাল এসে নক করে, ঢেউ এসে, নারিকেল বাগান এসে, প্রবালের মতো কথা এসে। সব কিছুই। দরজা খুলে দিলে আমার ঘরেই তো সমুদ্র চলে আসবে। অথচ আর্দ্র হয়ে ঘনিয়ে আসে দুটা চোখ, মুখের ইতিহাস। এই ভাবে ঢেউয়ে ঢেউয়ে রচিত হয় সমুদ্রবিলাস।
ঘটনা
এক সঙ্গে দুটা ঘটনা পাশাপাশি কিছুদূর গিয়ে
বিভক্ত হয়ে যায়। দুটা ঘটনা কিছুদূর এক সঙ্গে চলার পর
বিভক্ত হওয়ার এতো কি প্রয়োজন, হু! কিন্তু সত্যি সত্যি
পাতা ঝরার দিনগুলোতে একটা ঘটনা আরেকটা
থেকে বিভক্ত হয়ে যায়, পাশাপাশি সিটে বহুদূর পথ পাড়ি
দিয়ে শেষে একটা আরেকটাকে বলে ‘আসি’।
যতবার সম্ভাবনা ক্ষেত দেখি, ততবার মনে হয় এসব
সম্ভাবনা ক্ষেতে ঘটনার চাষ হয়। কিছু সম্ভাবনা
চারা থাকতেই মারা যায় আর কিছু এমন সব
ঘটনার জন্ম দেয়; যার সঙ্গী ম্যাডাম নিরবধি,
যার সঙ্গে যায় ভূত্য নিরন্তর, যাকে বহন করে
বেড়ায় কলুরবলদ কাল। এইভাবে কবে জানি! কোন এক কালে,
এই ধরো তা গতকাল হতে পারে, একটু আগে বা আগের জন্মে-
একটি কালের নিয়তি নির্ধারিত সত্যেও মতো
এমন লাবণ্যময় ঘটনার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়।
নদীর মতো সহজাত প্রবাহমান এমন ঘটনা দেখে মনে হয়
হৃদয় ফুরে একটা শান্তির ফোয়ারা ভ্রমণে নামবে এক্ষণি।
মানুষ ভ্রমণশীল হোক, পাখি বা নদী, কিন্তু শান্তি কেন?
আহা, শান্তি তুমি ভ্রমণশীল বিহঙ্গের মতো হয়ে গেছো,
তোমার সঙ্গে ঘটনার জন্ম দিতে মানুষ সবচেয়ে উদ্গ্রীব।
অথচ তুমি এবং ঘটনা নিজ নিজ স্থানে থেকে কী এক
বিহ্বল প্রতিযোগীতার জন্ম দিচ্ছো ক্রমাগত।
ফারুক ভাইয়ের কবিতা মানেই সেরা!
সত্যিই মনোযোগ কাড়ে আপনার কবিতা!