উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব দুই
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব তিন
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিত বসু।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব নয়
দশ ও এগারো
জানুয়ারি মাস, স্কুলে ক্লাস তখনও পুরোপুরি শুরু হয় নাই। চলছে বাৎসরিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি। এরই মধ্যে সরকার থেকে স্কুলের জন্য এসেছে কিছু চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চ আর খেলার সামগ্রী। খেলার সামগ্রীর মধ্যে আছে ফুটবল। নতুন ফুটবলে পেয়ে ছাত্ররা আনন্দে আত্মহারা। ক্লাস টেনের ছাত্ররা উদ্যোগ নিয়েছে আন্তঃক্লাস ফুটবল খেলা আয়োজনের। খেলা হবে প্রত্যেক ক্লাসের সাথে প্রত্যেক ক্লাসের।
সারা মাস ব্যাপী টিফিনের সময় চলে খেলা। ক্লাস নাইন স্কুল হয় চ্যাম্পিয়ান। শেষের দিন অনুষ্ঠিত হয় ছাত্র বনাম শিক্ষক প্রীতি ম্যাচ। প্রাইমারি এবং হাই স্কুলের শিক্ষক মিলে নয় জনের টিম। আর সব ক্লাস থেকে ভাল খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি হয় ছাত্রদের টিম। অতুল এবং হান্নান সুযোগ পায় ছাত্রদের টিমে।
খেলা চলছে মাঠের মধ্যে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা; প্রতিপক্ষ স্যারদের হারাতে হবে। উত্তেজনা মাঠের মধ্যেও। এক সময় অতুল বল পেয়ে দৌঁড় দেয় প্রতিপক্ষের দিকে, দুই পাশে এগিয়ে যাচ্ছিল হান্নান এবং অন্য এক খেলোয়াড়। এক পর্যায়ে হান্নান বল চায় অতুলের কাছে, কিন্তু অতুল বল পাস দেয় অন্য খেলোয়াড়কে। হান্নান দৌড়ে গিয়ে অতুলকে চার্জ করে বসে, এই শালার মালাওন বল আমাকে দিলি না কেন? অতুল কোন উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ পরে খেলা শেষ হয়ে যায়।
খেলা শেষে স্কুল ঘরের সামনে চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল সিদ্দিক স্যার। কয়েকেজন ছাত্রের সাথে খেলার সময়ে ভুল ত্রুটি, মাঠের মধ্যে পড়ে যাওয়া এসব নিয়ে হাসাহাসি
করছিল। নিরু আর অতুল এগিয়ে আসে সিদ্দিক স্যারের দিকে। সিদ্দিক স্যার হাসি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে, তোমরা কিছু বলবে?
– হ্যাঁ স্যার। অতুল উত্তর দেয়।
– বল।
– হান্নান আমাকে খেলার মাঠে গালি দিয়েছে, অতুল অভিযোগ করে।
– কি গালি দিয়েছে।
– আমাকে মালাওন বলেছে।
– তাতে কি হয়েছে, তুমি যা, তাইতো বলেছে। সিদ্দিক স্যারের কথা শুনে থমকে যায় অতুল আর নিরু। কোন কথা বলতে পারে না। মুখ কালো করে চলে আসে। খেলায় ছাত্রদের বিজয়ের আনন্দ পুরোটাই মাটি হয়ে যায় অতুলের কাছে।
হান্নান দূর থেকে লক্ষ্য করছিল অতুল আর নিরুকে। যখন বুঝতে পারে সিদ্দিক স্যার ওদের নালিশ পাত্তা দেয় নাই, তখন হান্নান যেন পেয়ে বসে। ওদের দিকে এগিয়ে এসে বলে, কিরে শালার মালাই, নালিশ করে কয়টা বাশিল পেলি?
অতুল উত্তর দেয়, শালার নাড়্যে, আর একবার মালাই বললে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।
অতুলের মুখে নাড়্যে শব্দ শোনার পর হান্নান নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কি বললি, তোর এত বড় সাহস, আমাকে নাড়্যে বললি, তোর এতবড় সাহস। সে কথা বলতে বলতে আক্রমণ করে বসে অতুলকে।
অতুল আর নিরু দুইজন এক সাথে হান্নানকে প্রতিহত করে মাটিতে ফেলে দেয়। হান্নাদের বুকের উপর চেপে বসে অতুল। শহীদ দূর থেকে দৌঁড়ে এসে অতুলকে বুকের উপর থেকে টেনে তুলে। মারামারি দেখে সিদ্দিক স্যার এগিয়ে এসে ওদের আলাদা করে দেয়। ওরা ক্লাসে ফিরে আসে।
কিছুক্ষণ পর হেড মাস্টার বেত নিয়ে ক্লাসে আসেন। প্রথমে হান্নানকে জিজ্ঞাসা করেন, কি হয়েছে বলো।
– হান্নান বলে, ও আমাকে নাড়্যে বলে গালি দিয়েছিল।
– অতুল তুমি বলো। তুমি কি তাকে গালি দিয়েছ।
-হ্যাঁ স্যার, ও আমাকে আর নিরুকে কথায় কথায় মালাই বলে, আজ খেলার মাঠে ওকে বল পাস করি নাই বলে আমাকে মালাওন বলে গালি দিয়েছে। সিদ্দিক স্যারের কাছে আমি নালিশ করে যখন ক্লাসে আসছিলাম, ও আমাকে আবার গালি দিয়েছে।
হেড মাস্টার ঘটনা বুঝতে পেরে, দুজনের দুই হাতে দুটি করে বেতের বারি দিয়ে নির্দেশ দেয়, এ স্কুলে কেউ যদি কাউকে মালাওন কিম্বা নাড়ে বলে গালি দেয়, তাদেরকে এ স্কুল থেকে টিসি দিয়ে দেয়া হবে।
কিছুদিন পর হঠাৎ হান্নান আর স্কুলে আসে না। শহীদ জানায় ও মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে।
১১
গাফ্ফার মন্ডল। পাকিস্তান হবার পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে আঠারো বছর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন বয়সের ভারে আর নির্বাচনে দাঁড়ান না। চেয়রম্যান না থাকলেও লোকে তাকে এখনও চেয়ারম্যান সম্মোধন করে। তার বাড়িটিও এলাকায় চেয়ারম্যানের বাড়ি হিসাবে পরিচিত। বাড়িটি বাজারের অপর পাশে অবিনাশের বাড়ি থেকে পনর মিনিটের হাঁটা পথ। চেয়ারম্যানের বড় ছেলে তোফাজ্জেল আর অবিনাশের বন্ধুত্ব সেই স্কুল জীবন থেকে, দুজন মেট্রিক পাশও করেছে এক সংগে। তাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধুত্ব তিন প্রজন্মের। অবিনাশের ঠাকুরদার আমল থেকে। অবিনাশের বাবা অতুল সেনও ছিল চেয়ারম্যানের ব্ন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন সারা দেশে লুটপাট শুরু হয় তখন অবিনাশদের বাড়ির হালের গরু, দামি আসবাবপত্র নিরাপদে রাখার জন্য চেয়ারম্যানের বাড়িতে রাখা ছিল।
বিষয় আশয়, স্কুল প্রভৃতি সমাজের নানা বিষয় নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব মাঝে মাঝেই শলা পরামর্শে করেন অবিনাশের সাথে। আগে এগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন অবিনাশের বাবার সাথে। অমল সেন মারা যাবার পর এসব আলোচনা এখন অবিনাশের সাথেই করেন।
আলোচনা করতে চেয়ারম্যান হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন অবিনাশের দোকানে, আবার কখনো হাঁটতে হাঁটতে চলে যান অবিনাশের বাড়িতে। আবার কখনও কখনও
ছেলেকে দিয়ে খবর পাঠান অবিনাশকে দেখা করার জন্য।
চেয়ারম্যান সাহেব একদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে আসেন অবিনাশের দোকানে। চেয়ারম্যানকে আসতে দেখে গদি থেকে নেমে আসে অবিনাশ। দোকানের কোণায় রাখা চেয়ারটা গামছা দিয়ে মুছে বসতে দেয় চেয়ারম্যান সাহেবকে।
দোকনে বসা ছিল তপন। সময় কাটানোর জন্য সেও অবিনাশের সাথে দোকানে গিয়ে বসে, তপনদের সাথে পরিচয় হয় চেয়ারম্যান সাহেবের। শহরের খবরাখবর নিয় কথা হয় দুজনের মধ্যে। তারপর মুল কথায় আসেন চেয়ারম্যান সাহেব। অবিনাশকে উদ্দেশ্য করে বলেন, বকুলের বিয়ে ঠিক হয়েছে, শুনেছ নাকি অবিনাশ।
– হ্যাঁ, শুনেছিতো। আনন্দের খবর। অবিনাশ উত্তর দেয়।
– এলাম তোমাকে দাওয়াত দিতে।
– দাওয়াত নিলাম কাকা।
এবার বিয়েতে তোমাদের আমি পোলাও মাংস খাওয়াতে চাই। তুমি কি বলো?
এর আগে চার ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়েছেন চেয়ারম্যান সাহেব। নিমন্ত্রণে হিন্দুদের জন্য চিড়া, মুড়ি মিষ্টির ব্যবস্থা করেছেন। এবার তার ইচ্ছা হয়েছে গ্রামের সবাইকে পোলাও মাংস খাওয়াবেন।
– আমারতো কোন অসুবিধা নাই কাকা। আমি তো আপনাদের বাড়িতে সব সময়ই খায়। উত্তর দেয় অবিনাশ।
– তোমাদের স্বজাতি অন্য যারা আছে তাদের সবাইকে বলতে চাই।
– সেতো খুব ভালো কথা।
– কিন্তু তারা যদি পোলাও মাংসের দাওয়াত গ্রহণ না করে আমার জন্যেতো অপমান!
– আগে যেমন চিড়ে মুড়ির ব্যবস্থা করতেন, সেটাও সাথে রাখেন। কেউ যদি মাংস পোলাও খেতে না চায়, সে চিড়া মুড়ি খাবে।
– দুই ধরণের আয়োজন একটু ঝামেলা হয়ে যায় না।
– কাকা আমাদের মধ্যেতো অনেকেই পিঁয়াজ-রসুন, মাছ-মাংস খায় না। নিমন্ত্রণ দিলে তাদের জন্যেও কিছু রাখতে হবে। সেজন্য দুইটাই রাখেন। যার পোলাও মাংস খাবার ইচ্ছা হয় সে খাবে, যার ইচ্ছে হবে না সে চিড়ামুড়ি খাবে। বাড়িতে আত্নীয় স্বজনের জন্যেতো চিড়া মুড়ির ব্যবস্থা থাকবেই। আর সাথে মিষ্টিটা। যারা পোলাও মাংস খাবেনা তারা এতেই সন্তুষ্ট হবে। আপনার বাড়িতে নিমন্ত্রণ পেলে তারা এমনিতেই সম্মান বোধ করবে।
– চেয়ারম্যান সাহেব একমত হয়ে বলে, তুমি যেহেতু বলছো তাহলে তাই করবো, তা তুমি কিন্তু বরযাত্রী যেও অবিনাশ। চলনে তুমি থাকলে ছেলেপুলেরা গেটে সাহস পায়। আনন্দও পায়। তোমার মত সবাইতো ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না।
– কাকা, আমি যে এখন আর চলনে যাই না। কে কি বলে বসে।
– আমি শুনেছি অবিনাশ। মনার বিয়েতে তোমাকে অপমানিত হতে হয়েছে। আমি কনে পক্ষকে বলে দিয়েছি, আমার ছেলের বিয়েতে হিন্দু মুসলমান সবাই বরযাত্রি যাবে। বলেছি হিন্দুদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে।
অবিনাশের অর্থ প্রতিপত্তির সাথে আরেকটি দক্ষতা সে ইংরেজিতে ভালো কথা বলতে পারে। এ যোগ্যতা তাকে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে বেশ সাহায্য করে।
ইংরেজিতে কথা বলতে পারার কারণে এলাকার মুসলিম বিয়েগুলোতে ডাক পরে অবিনাশের। গ্রামের মান সম্মান বলে কথা। গ্রামের কোন মেয়ের বিয়েতে অবিনাশের উপস্থিতি অনেকটা অনিবার্য। মাঝে মাঝে বরযাত্রীও যেতে হয় অবিনাশকে। কিন্তু মনার বিয়ের পর সে এখন আর গেটে দাঁড়ায় না।
মনার বিয়েতে চলনে গিয়েছিল অবিনাশ। গেটে ইংরেজিতে প্রশ্নোত্তর পর্ব চালু হলে অবিনাশ কথা বলা শুরু করে। কনে পক্ষে যখন অবিনাশের সাথে পেরে উঠছিল না, তখন হঠাৎ ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠে, শালা মালাওনের বাচ্চা, তুই চুপ কর। অবিনাশ কথাটা শুনে চুপ করে যায়। বরযাত্রীদের ভিতর থেকে কেউ কেউ তীব্র প্রতিবাদ করে উঠে। সে মারামারি বাধার উপক্রম, অবিনাশ বর পক্ষকে থামিয়ে দেয়। এরপর থেকে অবিনাশ আর কোন বিয়ের গেটে দাঁড়ায় না।
অবিনাশ চেয়ারম্যান সাহেবকে আশ্বস্থ করে, আপনি যখন বলছেন, আমি যাব কাকা।
চেয়ারম্যান সাহেব বসা থেকে উঠতে উঠতে বলেন, আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন মিলে মিশে থাকতে চাই অবিনাশ। তুমি বরযাত্রী যেতে রাজি হওয়াতে আমি খুশি হয়েছি। তপন বাবাজিকে সাথে করে নিয়ে যেও, তোমারও দাওয়াত রইলো তপন। এসো কিন্তু বাবা, আসলে খুশি হবো।
ঠিক আছে কাকা, দাওয়াত নিলাম। তপন নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে। চেয়ারম্যান বিদায় নিয়ে চলে আসে।