উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব দুই
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব তিন
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিত বসু।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব নয়
আট ও নয়
মোকা পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক যুবক। গ্রামের ভিতর দিয়ে যখন সে চলাচল করে তখন সব সময় হাতে থাকে একটা খেজুর গাছ কাটা ছেন দা। মোকার বাবা ছিল শর্ষিনা পীরের মুরিদ। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় এলাকায় একটি দল তৈরি করে আশে পাশের গ্রামে লুট করে বেড়াত। মোকা সে সময় ছিল বাবার সঙ্গী।
মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় এসে একদিন রাতের বেলা রেট দেয় মোকাদের বাড়ি। দৌঁড়ে পালানোর সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ছোড়া গুলিতে মারা যায় মোকার বাবা। মোকা ধরা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ধরে নিয়ে আসে গৌরীপুর বাজারে এবং বেঁধে রাখে গাছের সাথে। পরদিন আশেপাশে গ্রামের মানুষ দল বেঁধে আসতে থাকে মোকাকে দেখেতে। যে গ্রামগুলোতে মোকারা লুট করেছিল তার একটি গ্রামের মানুষ এসে মোকার গলায় পড়িয়ে দেয় জুতার মালা। সারাদিন জুতার মালা পড়া অবস্থায় গাছের সাথে বান্ধা থাকে মোকা। রাতের বেলা মুক্তিযোদ্ধারা ওকে নিয়ে যায় বাবার কবর দেয়াতে। কবর দেবার পর কোন এক সময় সুযোগ বুঝে অন্ধকারের মধ্যে পালিয়ে যায় মোকা। এলাকায় রটে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সেও মারা গেছে। স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দেয়ার কিছুদিন পর এলাকায় ফিরে আসে সে।
পালিয়ে থাকার সময় মোকা দুটো কাজে খুব দক্ষতা অর্জন করে। একটি পশু জবাই করে মাংস তৈরি করা আর দ্বিতীয়টি মৃত মানুষের দাফন কাফন করা। গরু জবাই কিম্বা দাফন কাফনের সময় পীরের বাড়িতে থেকে কিভাবে এই কাজ শিখেছে, কে শিখিয়েছে, কে কবে গরুর লাথি খেয়ে ভিমরি ধরে পরে গিয়েছিল; সেই সব নষ্টালজিক গল্প শুনিয়ে খুব মজা পায়।
এলাকায় মুসলিম সম্প্রদায়ের কেউ মারা গেলে, সবার আগে এসে উপস্থিত হয় মোকা। আগ বাড়িয়ে শুরু করে দেয় মৃতদেহ সৎকারের কাজ। যুদ্ধের সময় লুটপাট করার কারণে গ্রামের মানুষ তাকে এড়িয়ে চলে এবং মনে মনে ঘৃণা করে। কিন্তু ঘৃণা সত্ত্বেও এই দুর্বল মূহুর্তে কেউ কিছু বলতে পারে না। আর নিজেকে পুনরায় গ্রহণযোগ্য করে তোলার মোক্ষম উপায় হিসাবে মোকাও কাজে লাগায় এই দুর্বল সময়কে।
সময়ের সাথে সাথে মোকা তার লক্ষ্যে অনেকটা সফলও হয়েছে। ধীরে ধীরে সেই তার প্রতি ঘৃণাও অনেকটা কমিয়ে এনেছে। এলাকার মানুষও এদুটি কাজে অনেকটা মোকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু চাল চলন কথাবার্তা সব সময় একটা হিন্দু বিদ্বেষী ভাব। সুযোগ পেলেই হিন্দুদের দেব দেবতা নিয়ে কটাক্ষ করে, গৌরী মেলায় কিম্বা মেলার মাঠে যাত্রা বা কবিগানে অংশগ্রহণ করতে এলাকার মানুষকে নিরুৎসাহিত করে।
পনরই আগস্টের পর মোকার কথাবার্তা, চালচলন হয়ে উঠে আরো উগ্র। সে প্রকাশ্যে শুরু করে হিন্দুদের টিজ করা। যখন দেখে গ্রামের হিন্দু পরিবারের কোন ছেলে বা মেয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, আর যদি দেখে বাচ্চার সাথে বয়স্ক কেউ নাই, তখন ওদের ডাকে মালাওনের বাচ্চা বলে। কখনও বাচ্চাদের সামনে ছড়া কাটে, হিন্দু হিন্দু তুলসীর পাতা-হিন্দুরা খায় গরুর মাথা। সে মনে করে দেশটা এখন আর বাংলাদেশ নাই, আবার পাকিস্তান হয়ে গেছে। আর পাকিস্তান মুসলমানদের দেশ, হিন্দুদের জন্য ভারত। হিন্দুরা ভারত চলে যাক। অচেনা হিন্দু লোক সামনে পড়লে তাদের লক্ষ্য করে বলে, কিরে হিন্দু তোদের বাপতো ভ্যা হয়ে গেছে, ইন্ডিয়া যাবি কবে। শেখ মুজিব খুন হওয়াকে বলে আল্লার প্রতিশোধ; বলে বেড়ায়, পাকিস্তান ছিল আল্লার দান। সেই পাকিস্তান ভাঙ্গছে শেখ মুজিব। আল্লাহ তার প্রতিশোধ নিয়েছে।
৯
সাত নভেম্বরের শুরু হয় নতুন ত্রাস। আর্মিরা শুরু করে গণগ্রেফতার আর নির্যাতন। যুবক বয়সের কাউকে রাস্তায় পেলে কোন কারেণ ছাড়াই তাকে পেটাতে পেটাতে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। রাতের বেলা বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি করে গ্রেফতার করতে থাকে মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি আর জাসদের কর্মীদের।
জেলা সদরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মনা বোসকে ধরে মারাত্মক নির্যাতন করে আর্মিরা। মনা বোসের অপরাধ সে কদিনে আগে ভারতে বেড়াতে গিয়েছিল। যেদিন মনা বোস ভারত থেকে ফিরে আসে, তার দুদিন পর দুপুরবেলা আর্মিরা আসে মনা বোসের বাড়ি। তাকে বাড়ির ভিতর থেকে ধরে নিয়ে আসে রাস্তায়। দুর থেকে মানুষ দেখতে থাকে আর্মি মনা বোসের সাথে কথা বলছে। হঠাৎ করে এক আর্মি তাকে পেটানো শুরু করে আর বলতে থাকে, শালা ইন্ডিয়ার দালাল। বাংলাদেশে থেকে ইন্ডিয়ার দালালী করো। এই দেশে ব্যবসা করো আর ভারতে টাকা পাচার করো। এক পর্য়ায়ে ষাটোর্ধ্ব মনা বোসকে নির্দেশ দেয় নারকেল গাছে ওঠার। বন্দুকের নলের ভয়ে নারকেল গাছে উঠতে চেষ্টা করে মনা বোস। উঠতে গিয়ে তার বুক, পেট, পায়ের চামড়া ছুলে রক্ত বের হতে থাকে। ভদ্রলোক সব সময় সাদা ধুতি পড়ে থাকত। তার সাদা ধুতি রক্তে লাল হয়ে যায়। কিছুদুর ওঠার পরে আর পারে না মনা বোস। নেমে আসে গাছ থেকে। নিচে নামার সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। আর্মিরা তাকে সেই অবস্থায় ফেলে চলে যায় গাড়িতে উঠে। এরপর বেছে বেছে বিত্তশালী হিন্দুদের কাছে করে শুরু করে চাঁদাবাজি। শহরের সব হিন্দু ব্যাবসায়ীরা গা ঢাকা দিতে থাকে।
একদিন রাতের বেলা মুক্তিযোদ্ধা তপন নাগ এসে উঠে অবিনাশের বাড়িতে। সে অবিনাশের দুর সম্পের্কের আত্মীয়, পিসতুতো বড় বোনের দেবর। ৭ নভেম্বরের পর শহরেই আত্মগোপন করেই ছিল। মনা বোসের ঘটনার পর আর সেখানে থাকার ঝুকি নেয় নাই, পালিয়ে এসেছে এখানে।
মুক্তিযুদ্ধের আগের থেকেই এ বাড়িতে আসা যাওয়া তপনের। পাক বাহিনী পদ্মা পার হয়ে জেলা সদরে ঢুকে পড়লে তপন পালিয়ে এসে প্রথমে এখানেই উঠেছিল। সর্বশেষ এসেছিল দেশ স্বাধীন হবার পর। তখন সে মুক্তিযোদ্ধা তপন নাগ, যুদ্ধজয়ী বীর।
দুপুর বেলা বাড়ির উঠোনে পত পত করে উড়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-হলুদ-সবুজ পতাকা। অবিনাশের বাবা বারান্দায় বসে রেডিও শুনছে। কাঁধে রাইফেল আর হাতে ব্যাগ নিয়ে একদিন দুপুর বেলা হাজির তপন নাগ। সাথে আরো দুই জন, তাদের কাঁধেও বন্দুক।
মুখে দাড়ি আর লম্বা চুল দেখে প্রথমে চিনতে পারে নাই অতুল। ভয় পেয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকে ফুচি দিয়ে দেখতে থাকে তাদেরে আসা। তপন কাকারা প্রথমে গিয়ে পতাকাকে স্যালুট করে, তারপর দাদুর পায়ের সামনে বন্দুক রেখে দাদুকে প্রনাম করে।
দাদুকে প্রণাম করা দেখে ভয় কেটে যায় অতুলের। দৌড়ে গিয়ে নিরুকে ডেকে নিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধা তপন কাকাকে দেখার জন্য। দুজনে কাছে এসে নিরাপদ দুরত্বে থেকে তপন কাকার দিয়ে তাকিয়ে থাকে। তপন কাকাও অভয় দিয়ে দুজনকে কাছে ডেকে কাছে নেয়।
এর আগে তপন কাকা যখন বেড়াতে এসেছে তখন ছড়া আর গল্প বলে শুনিয়েছে অতুল আর নিরুকে। এবার তার কাছে গল্প শোনার চেয়ে অতুল আর নিরুর বেশী ইচ্ছে করছে তাঁর হাতের রাইফেলটি ছুয়ে দেখতে । এজন্য দুজনে ঘুর ঘুর করতে থাকে তপন কাকার পাশে । তপন কাকা একসময় বুঝতে পারে অতুল আর নিরুর এবার আগ্রহ গল্প বা ছড়া নয়, আগ্রহ রাইফেলের প্রতি। সে একসময়ে কাছে ডেকে নিয়ে দেখায় কিভাবে গুলি ভরে, কিভাবে ট্রিগার টিপে। একদিন একটা রাইফেল হাতে নিয়েছিল অতুল। হাতে নিয়ে বলে, এমা! এতো অনেক ভারী। ব্ন্দুকের প্রতি আগ্রহ দেখে তপন কাকা একদিন বাঁশ আর কঞ্চি দিয়ে দুটি বন্দুক বানিয়ে দিয়েছিল অতুল আর নিরুকে । তারপর সবাই মিলে পাখি মারতে গিয়েছিল মাথা ফাটা বিলে।
অতুলের চোখে তপন কাকা মানে যুদ্ধের পর দেখা তপন কাকা। মুখ ভরা দাঁড়ি, কাঁধে রাইফেল, হাতে ব্যাগ। এবার তপন কাকার সাথে শুধু একটা ব্যাগ। তপন কাকার হাতে বন্দুক না দেখে অতুল এগিয়ে গিয়ে তপন কাকাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনার রাইফেল কই।
– রাইফেলতো জমা দিয়ে দিয়েছি। তপন কাকা উত্তর দেয়।
– কাছে জমা দিয়েছেন, অতুলের আবার প্রশ্ন
– সরকারের কাছে।
– ওটা তোমার বন্দুক ছিল না
-হ্যাঁ
-তাহলে জমা দিয়েছেন কেন?
-সরকার আমাকে দিয়েছিল যুদ্ধ করার জন্য, সরকার বলেছে ফেরত দিতে, তাই ফেরত দিয়ে দিয়েছি।
-ও সেটা তুমি টাকা দিয়ে কিনো নাই।
– না।
অতুল আর কোন প্রশ্ন করে না, শুধু উচ্চারণ করে ও!
একদিন অবিনাশের সাথে বসে আলাপ করছিল তপন। পাশে ছিল অতুল আর নিরু। বাবার সাথে আলোচনা করছিল দেশের কথা, বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা, জেলের ভিতরে হত্যার কথা। অতুল এক সময়ে বুঝতে পারে তপন কাকা আর্মির ভয়ে পালিয়ে এসেছে তাদের বাড়ি।