উপন্যাস

উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিত বসু।। পর্ব সাত

সকালে দোকানে যাবার আগে রেড়িওটা ছেড়ে দিয়ে রান্না ঘরের বারান্দায় বসে খাচ্ছিল অবিনাশ। সামনে বসে রমা পরিবেশন করছিল খাবার। রেডিও ছাড়তেই শুনতে পায় ঘোষণা,“আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা এবং তার সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। দেশে সামরিক আইন ঘোষণা করা হয়েছে। খন্দকার মোস্তাক অস্থায়ী রাস্ট্রপতি হয়েছেন। বাংলাদেশ পুলিশ, বিডিআর ও রক্ষীবাহিনীর সীপাহী ভাই ও বোনেরা, আপনারা সবাই সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করুন। যাহারা অসহযোগিতা করবেন, দেশের বৃহত্তম স্বার্থে তাদের চরম দন্ড দেয়া হবে। রেডিও বাংলাদেশ, বাংলদেশ জিন্দাবাদ।“

অবিনাশের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। মনে হয় যেন শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। কি বলছে এসব! এ কিভাবে সম্ভব! সত্যি শুনছিতো! রেডিও সেন্টারের কাটাটা ঠিক যায়গায় আছে কিনা ভাল করে দেখে নেয় অবিনাশ। না ঢাকা বেতারইতো আছে, কোন ভুল নাই। সে কি করবে বুঝতে পারে না, দুঃশ্চিন্তা এসে ভর করে চোখে মুখে। খবর শুনে রমা শুধু উচ্চারণ করে, কি বলছে এসব! অতুলকে পাঠায় নিশিকান্তকে ডেকে আনতে। রেডিওটা অন করে ঘরে এসে বসে পড়ে চেয়ারে। রেডিওতে বাজতে থাকে। রমাও ঘরের কাজ ফেলে শুনতে থাকে রেডিও। রমা একসময় খেয়াল করে ঘোষণাটি আসছে রেডিও বাংলাদেশ নামক সেন্টার থেকে, বাংলাদেশ বেতার নয়। আর শেষে আর জয় বাংলা বলছে না; বলছে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।

রমা বলে উঠে, দেখ দেখ, এ সেন্টারতো ঢাকা বেতার নয়, অন্য কোন সেন্টার। নাম বলছে রেডিও বাংলাদেশ, উল্টা পাল্টা, জয় বাংলা বলছে না, বলছে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
অবিনাশ রেডিওটা কাছে নিয়ে দেখে নিয়ে বলে, না, ওটা ঢাকা বেতারই, ওরা মনে হয় বাংলাদেশ বেতারের নাম পাল্টে ফেলেছে। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে ওরা সবই পারে।
নিশিকান্ত মাঠে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অতুলের কাছে খবর পেয়ে চলে আসে। খবর শুনে একে একে পাড়ার সকলে এসে ভীড় করতে থাকে অতুলের দুয়ারে। সাবই স্তম্ভিত, উৎকন্ঠিত। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকে খবর।

রেডিও বাংলাদেশ হতে বার বার প্রচার হতে থাকে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। সারা দেশে কার্ফু জারি করা হয়েছে। এক সময়ে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ্ ঘোষণা দেয়, ‚নতুন সরকারের প্রতি আমরা আমাদের অবিচল আস্থা ও আনুগত্য জ্ঞাপন করছি। আমাদের সকল পর‌্যায়ের অফিসার ও জোয়ানদের মহামান্য রাস্ট্রপিত খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সুশৃঙ্খলভাবে নিজ নিজ কমান্ডারের নির্দেশ অনুযায়ী স্ব স্ব দায়ীত্বে নিযুক্ত থাকার নির্দেশ দিচ্ছি।“ এরপর একে একে বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, বিডিআর এবং পুলিশের প্রধানের একই ঘোষণা দিয়ে যায়।
অবিনাশের আর সেদিন দোকানে যাওয়া হয় নাই। সারাদিন কেটে যায় রেডিও বাংলাদেশ আর আকাশ বানীর খবর শুনে। বিকাল বেলা জানা যায়, শুধু শেখ মুজিব নয়, পরিাবরের সব সদস্যকে হত্যা করেছে সেনারা। বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে গেছে তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।

পরদিন সকালে গিয়ে দোকান খোলে অবিনাশ। বাজারের সবার মনের মধ্যে উৎকন্ঠা আর আতঙ্ক। কি হয়! কি হয়। ছোট ছোট জটলা। গ্রামের বাজার তাই কার্ফুর প্রভাব পড়ে নাই। কেউ কেউ বাজারে এসে কেনাকাটা করে আবার দ্রুত ফিরে যাচ্ছে। শুধু মোকা মিয়া অনেকটা বিজয়ের বেশে বুক ফুলিয়ে হেটে বেড়াচ্ছে, আর জটলার সামনে গিয়ে হাক চাড়ছে, কার্ফু চলছে, কার্ফু।
প্রতিদিন উৎকন্ঠা নিয়ে শুরু হয় দিন আর শেষ হয় খারাপ খবর নিয়ে। প্রতিদিন খবর শোনা যায় আজ এ গ্রেফতার হচ্ছে তো পরদিন আরেকজন গ্রেফতার হচ্ছে। যারা মোস্তাক সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে তাদের বড় পদ দেয়া হচ্ছে আর যারা সমর্থন করছে না তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। সপ্তাহ খানেক পর খবর শোনা যায় তাজউদ্দিন আহম্মেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, এম মনসুর আলীকে, গ্রেফতার করা হয়েছে । সেনা প্রধান শফিউল্লাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। নতুন সেনা প্রধান হয়েছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।

নভেম্বরের তিন তারিখ খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে হয় পাল্টা ক্যু। জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্ধী করে সেনাপ্রধানের দায়ীত্ব গ্রহণ করে সে। রাস্ট্রপতি হতে পদত্যাগ করে খন্দকার মোস্তাক, নতুন রাস্ট্রপতি হয় বিচারপতি আবু সায়েম। চার তারিখ বিকাল খেবর রটে যায় জেলের ভিতরে খুন হয়ে গেছে জাতয়ী চার নেতা।
সাত তারিখ কর্ণেল তাহের শত শত জাসদের নেতা কর্মী এবং তার সমর্থক সিপাহীদের নিয়ে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে জিয়াউর রহমানকে। ঐদিনই খুন হয়ে যায় খালেদ মোশাররফ। জিয়াউর রহমান আবার সেনা প্রধানের দায়ীত্ব গ্রহণ করে।
একদিন রাতের বেলা অবিনাশের বাড়ির সামনে দিয়ে একটি মিছিল যায়। মিছিলে একজন স্লোগান দিচ্ছে, জয় বাংলা – অন্যরা উত্তর দিচ্ছে কদুর জাঙ্গলা। একজন বলছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ-অন্যরা বলছে জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ। মিছিলে একটা গলা বেশ চেনা চেনা লাগছিল, মনে হচ্ছিল মোকার গলা। সে স্লোগানের লিড দিচ্ছিল।

Series Navigation<< উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব ছয়উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব আট >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *