উপন্যাস

উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব দুই

বিল গৌরীপুরের দুই প্রতিবেশী বন্ধু অতুল আর নিরঞ্জন। হামাগুড়ি দেয়ার বয়স থেকে তাদের এক সংগে বেড়ে ওঠা। স্কুল কলেজের গন্ডি পার হয়ে আজ তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
অতুলের বাবা অবিনাশ সেন। বিল গৌরীপুরের একজন বিত্তশালী মানুষ। বাবার রেখে যাওয়া শত বিঘা জমি আর গৌরীপুর বাজারের গদি ঘর। একপাশে মহাজনী ব্যবসা, অন্য পাশে খুচরা বিক্রয় কেন্দ্র। গৌরী মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ দিকে তাকালে কয়েকটি বাড়ির পর চোখে পড়ে অবিনাশের বাড়ির উঁচু উঁচু টিনের ঘর। বাড়িতে তার বৃদ্ধ মা, স্ত্রী আর একমাত্র সন্তান। অর্থ বিত্ত আর জ্ঞান সব মিলিয়ে অবিনাশ অঘোষিত ভাবে গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা‌। সামাজিক বিষয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত নিতে প্রতিবেশীরা অবিনাশের উপরই নির্ভরশীল। অবিনাশের স্ত্রী রমা আমলা গ্রামের মেয়ে, সুগৃহিণী। যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। অবিনাশ যেদিন বিয়ে করে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে, সেদিন শাশুড়ী বৌয়ের মুখ দেখে বলেছিলেন, দেখরে! আমলা গ্রাম থেকে গৌরী আবার এসেছে আমাদের গ্রামে। আর্থিক স্বচ্ছলতা, শিক্ষা, সামাজিক কাজকর্ম অবিনাশের সামাজিক অবস্থানকে করেছে আরো মর্যাদা পূর্ণ। নামের শেষে যুক্ত হয়েছে বাবু।

নিরঞ্জনের বাবা নিশিকান্ত মন্ডল। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দশ শতাংশের একটি ভিটে ছাড়া আর কিছুই নাই। সংসার চলে অন্যের জমিতে কাজ ক’রে। সংসারে দীনতা থাকলেও স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সেও এরকম সুখী। ব্যবসা এবং কৃষিতে সে অবিনাশের প্রধান সহায়।
প্রতিবেশী হবার সুবাদে অতুল আর নিরঞ্জনের মতো অবিনাশ আর নিশিকান্তও বড় হয়েছে একসাথে, বাল্যকালে একই সাথে চলতো তাদের চলাফেরা, খেলাধুলা, লেখাপড়া। ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর নিশিকান্তের আর পড়াশুনা হয় নাই। নেমে পড়তে হয় বাবার সাথে কাজে। অবিনাশ মেট্রিক পাশ করে শুরু করে ব্যবসা।
হাড়ভাঙা খাটুনি করে সংসার চালিয়ে নিতে পারলেও অর্থনৈতিক দৃঢ়তা আসে নাই নিশিকান্তের সংসারে। যে সমাজে অর্থ সামাজিক মর্যাদার নিয়ামক, সে সমাজে তার নামটি বিকৃত হয়ে নিশিকান্ত হয়ে গেছে নিশে। সমবয়সী বা বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে একমাত্র অবিনাশই তাকে বাল্যকালের প্রিয় নাম নিশি বলে ডাকে।‌ সময়ের সাথে দুজনের জীবন যাপনে ভিন্নতা তৈরি হলেও বন্ধুত্ব কখনও ম্লান হয় নাই। দুজনের সম্পর্কটা এখনও সেই তুই তোকারির।

অবিনাশ আর নিশি বিয়েও করেছিল খুব কাছাকাছি সময়ে। দুজনের দুই সন্তান অতুল আর নিরঞ্জন। এদের জন্মও একই মাসে, বেড়ে ওঠাও একই সাথে। হাঁটা শেখার পর থেকেই দুজনের গলায় গলায় ভাব। স্কুলে যাওয়া, সারাদিনের হৈচৈ, খেলাধুলা, মাছ ধরা কিম্বা গৌরীর বুকে সাঁতার কাটা, সবই চলে এক সাথে।
নিশির বউ পদ্ম, প্রায় কাছাকাছি সময়ে বিয়ে হয়ে শশুর বাড়ী আসায় রমার সাথে তার গলায় গলায় ভাব। পারিবারিক অর্থনৈতিক তারতম্য তাদের ভাবে কোন বাঁধা হতে পারে নাই। অচেনা বাড়িতে নতুন বউ হয়ে আসার পর থেকেই বাবার বাড়ির নষ্টালজিক গল্প শোনার সাথী দুজন দুজনার।
নিরঞ্জনের প্রতি রমার ভালোবাসা আপন মায়ের মতো। নিরঞ্জনকে সে আদর করে ডাকে নিরু। নিরু রমাকে ডাকে যশোদা মা। দিনে দু-তিনবার যশোদা মায়ের সাথে দেখা না করলে নিরুর চলে না। স্কুল বন্ধের সময় সারাদিন কেটে যায় অতুলের সাথে খেলাধুলা করে। বাড়িতে খেতে আসারও দরকার হয় না, দিনে তিনবারের খাওয়াও হয়ে যায় যশোদা মায়ের কাছে, অতুলের সাথে এক সাথে পাশাপাশি বসে।

নিরুর প্রতি এত আদর ভালোবাসা দেখে পদ্ম বলে, এমন আদর-ভালোবাসা দিওনা রমাদি। শেষে কিন্তু বিপদে পড়বে।
রমা কোন রাখঢাক না রেখেই বলে, তোকে বলেছি না, যেদিন নিরু জোড় করে আমার বুকের দুধ খেয়েছে, সেদিন থেকে ও আমার আরেক ছেলে। ও আমার মাতৃত্ব আর ভালবাসা দুটোই আদায় করে নিয়েছে।
কয়েক বছর আগের কথা। একদিন ঘরের বারান্দায় বসে খই থেকে ধানের চোচা বেছে বের করছিল রমা। নিরু আর অতুল হামাগুড়ি দিয়ে খেলছিল রমার পাশে। পদ্ম ব্যস্ত ছিলো ঢেকিঘরে ধান ভানতে। একসময়ে রমা অতুলকে কোলে তুলে বুকের দুধ খাওয়াতে শুরু করে। তাই দেখে নিরু হামাগুড়ি দিতে দিতে চলে আসে রমার কোলের ভীতর, মুখ গুজে দেয় রমার স্তনে। রমা বঞ্চিত করেনি, দুধের বাট মুখে গুজে দিয়ে পদ্মকে ডেকে দেখায়, ও পদ্মদি দেখ তোমার ছেলে কি করছে।
ঢেকি ফেলে পদ্ম দৌঁড়ে এসে কোলেতুলে নিতে যায় ছেলেকে। কিন্তু বাঁধা দেয় রমা। বলে, নিও না পদ্মদি। অতুলের ভাগে কম পড়বে না। পদ্মর বিব্রত মুখ দেকে বলে, তুমি না হয় একদিন অতুলকে বুকের দুধ খাইয়ে শোধ বোধ করে দিও।
রমার কথা শুনে পদ্মর বুকের ভিতর খাঁ খাঁ করে ওঠে। সে রমাকে বলে, অমন কথা বলোনা রমাদি। তোমার মনও আছে, ধনও আছে। তুমি এ ভার সইতে পারবে। আমার মন থাকলেও ধন নাই দিদি, আমিতো এ ভার সইতে পারব না।
রমা হাত দিয়ে নিরুকে বুকে চেপে ধরে পদ্মর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ঠিক আছে তুমি না পারলে-দিও না। তাই বলে আমাকে সুখ থেকে বঞ্চিত করো না।
পদ্ম আর কোন কথা বলে না। মিটি মিটি হাসে আর দেখতে থাকে রমার বুক থেকে গদ গদ করে ছেলের দুধ খাওয়া। পদ্মর অমন তাকোনো দেখে রমা বলে, যাও দেখতে হবে না, তুমি তোমার কাজ করগে। আজ থেকে আমার দুই ছেলে। আমি হলাম নিরুর যশোদা মা। ওকে যশোদামা ডাকতে শেখাবে।
রমার কথা শুনে পদ্মর চোখের কোণে জল বেরিয়ে আসে পদ্মর। জল আড়াল করতে সে ফিরে আসে ঢেঁকিতে। আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে থাকে আর দূর থেকে দেখতে থাকে ছেলের কান্ড।

সেদিন থেকেই রমা নিরুর যশোদা মা। এরপর থেকে অতুল আর নিরুর জন্যে সব কিছু জোড়ায় জোড়ায়। জোড়া জামা, জোড়া প্যান্ট, জোড়া জুতা সব কিছু। বাড়ির মুড়ির কৌটা, ভাতের হাঁড়ি, গাছের আম, কলা, কাঁঠাল; সব কিছুতেই নিরুর সমান অধিকার। অবিনাশ রমাকে কত বলেছে, এত ভালোবাসা দিচ্ছ; পরে কিন্তু কষ্ট পাবে। রমার সোজা সাপটা উত্তর, ভবিষ্যতে কি পাব, কি না পাব সেই দুঃশ্চিন্তায় কী এখনকার সুখ নষ্ট করবো?
অবিনাশ রমাকে বোঝাবার চেষ্টা করে। দেখ নিশিকান্ত দিন আনে দিন খায়। এখন ফ্রি স্কুল আর নিরুও ছোট, তাই ছেলেকে স্কুলে পাটাচ্ছে। হাইস্কুলে পড়াশুনায় খরচ আছে। নিশিকান্তের সাধ্য নাই সেই খরচ চালানো। সংসারের টানাটানিতে নিরুকেও একসময় বাবার সাথে মাঠে ঘাটে কাজ শুরু করতে হবে। দেখবে একটু বড় হলেই নিশি ওকে মাঠের কাজে নামিয়ে দেবে। তখন কষ্ট পাবে।
রমার দাবি আরো বেড়ে যায়। কেন তুমি ওর পড়াশোনার খরচ চালাতে পারবে না! ওকে আমার বুকের দুধ খাইয়েছি, আমি ওর কষ্ঠ সহ্য করতে পারবো না। আমি যে ওর যশোদা মা। দেখনা অতুলও নিরু বলতে পাগল। রাতে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত আলাদা হয় না।
অবিনাশ আর কোন কথা বলে না। সময়ের সাথে স্ত্রীর এই আদরের ধনকে কখন যে নিজের বুকে তুলে নেয় সেটা নিজেও বোঝেনা।উ

Series Navigation<< উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসুউপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব তিন >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *