কবিতা

দুখু বাঙাল-এর নির্বাচিত দশ কবিতা

সূর্যোদয় হবেই একদিন

বিমারি মুরগির মতো সূর্যটা চোখ বুঝে আছে বহুকাল
পাখিরাও ঘৃণা ঝেড়ে আপন ডানায়, উড়ে গেছে আর কোনো দ্বীপে
মেঘেরা বর্ষণহীন— পাথর হয়ে আটকে আছে আকাশের গায়ে
যখন তখন লাশ পড়ে ঝরে যাওয়া জয়তুনের মতো
আগুনের কুণ্ডলীর ন্যায় এলিয়ে পড়ছে সব ভয়ার্ত শিশুর ক্রন্দন
গাজা এক লঙ্কাপুরী— বিপর্যস্ত ছাইয়ের নগর।

একটা আহত পাখির শুশ্রূষায় অথবা অভুক্ত একটি কুকুরের সেবায়
সর্বত্র ছড়িয়ে যায় ওদের মানবিকতা আর ব্যস্ততার ঢাক—
আরবরা আবার মানুষ নাকি, বড়জোর কুকুর-বেড়াল
ধন্য আজ দখলদার ভূমিদস্যুর আত্মরক্ষার অধিকারের বাণী
তবে কি সূর্য আর ফুটবে না পশ্চিম তীরে!
তবে কি পাখিরা আর ফিরবে না উপত্যকার জলপাইয়ের ডালে!

পিতৃভিটায় খাড়া হয়ে জীবন দেয় ফিলিস্তিনের দুরন্ত সন্তান
শতাব্দীর জীবনদান, গাসহা জীবনদান— মানবহত্যার এক ভঙ্গুর ক্যাসেট
ভূমধ্যসাগরের ঢেউগুলো মাথা তোলা সাপের মতো থির হয়ে আছে
মিশরের উদ্ধত সম্রাটকে একদিন এই জলধিই করেছিল গ্রাস
হায় মানববিধাতা, দখলদার ভূমিদস্যুর আত্মরক্ষার অধিকারের নামে
নালিশের এতটুকুন যায়গাও রাখলে না তুমি।

যে দেশে ঢিলছোড়া কিশোরের বাহু থেকে ঝরে যায় দ্রোহের আগুন
যে দেশে জলপাইগুলো প্রতিরোধ যোদ্ধার রাইফেলের বুলেট হয়ে যায়—
সে দেশে সূর্যোদয় হবেই একদিন।

মহাকাল দেয় যারে ডাক

সব পাতা ঝরে গিয়ে পাখি হয়, একদিন পাখি হয়ে যায়
বৈরাগ্য ছড়িয়ে এরা মাটিতেই সারাক্ষণ করে আর্তনাদ
তোমার বক্ষেই যদি দিলে ঠাঁই— জীবনের দুরন্ত আস্বাদ
নিজেকে হারায়ে তবে খুঁজে ফিরি নিশিদিন তোমার ছায়ায়।

দু-চারটে পাতা থাকে রাজহংসের মতো বড় অহংকারী
কৈলাস ছাড়িয়ে এরা উড়ে যায় উত্তরে কেবলই সুদূরে
ঝরে যায় রৌদ্ররং এইসব পাখিদের পালকে ও ঘাড়ে
পশ্চাতে বিরান ভূমি শূন্যতায় ছেয়ে যায় দীর্ঘ আহাজারি।

কবিতারা বাড়ি ফেরে একদিন হাসিমুখে কবির খাতায়
আলোঝরা সরোবরে ছায়া দেখে আপনার নিজেই অবাক
সে-ই পারে পাখি হয়ে উড়ে যেতে মহাকাল দেয় যারে ডাক
ডানা ঝাড়া অন্ধকার ঝরে যায় রাতদিন মাটির ছায়ায়।

তাকাও একবার তুমি

যে-দৃষ্টিতে তাকালে অঝরে মন্ত্রবাণী ঢেলে দেয় নিস্ফলা আকাশ
সে-দৃষ্টিতে তাকাও একবার
যে-দৃষ্টিতে তাকালে রাত সেও বনে যায় রমণীয় চুলের বিস্তার
সে-দৃষ্টিতে তাকাও একবার
যে-দৃষ্টিতে তাকালে পাখির ঝাঁকের মতো স্বপ্নেরা বাড়ি ফিরে আসে
সে-দৃষ্টিতে তাকাও একবার।

বাগানের ফুল নয়, আত্মার গহন থেকে রং তুলে দাও
মস্তকপ্রসূত প্রেম নয়, অকৃপণ রোদ হয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও
তাকাতেই প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে সতীদাহে ঝাঁপ দেওয়ার মতো
তাকাও একবার তুমি, সেই দৃষ্টিতে তাকাও একবার।

রাজসিক প্রত্যাবর্তন

না-চেয়েই কোনোকিছু
যে-তোমার ডানপাশে সারাপথ ছায়া হয়ে হাঁটে
ভালোবাসার হিজাব-আবৃত্ত হয়ে মনে রেখো তারে।

না-পেয়েই কোনোকিছু
যে-তোমার ভুলটাকে ফুল বলে লড়ে সব ঘাটে
প্রেমের আলখেল্লা পরে একজীবন খুঁজিয়ো তাহারে।

না-ছুঁয়েই কোনোকিছু
যে-তোমার দুঃখরাতে হাতধরে নিয়ে যায় চাঁদোয়াসড়কে
বিরহের হাঁস হয়ে পাড়ি দিয়ো লক্ষ মাইল তাহারই অন্তরে।

শূন্য হাতে রাজসিক প্রত্যাবর্তন চিরদিন প্রেমেই মানায়।

দীর্ঘ হয়ে বেড়ে উঠি

বৃষ্টির ছোঁয়া পেলে হেসে ফেলে কুমারী মৃত্তিকা
পাখিরাও সখি সখি ডানা মেলে আকাশ ছায়ায়
জলের আশকারা পেয়ে বেঁচে থাকে মাছ
পথের কুকুর সেও লাই পেলে মাথায় উঠে বসে
আদর পেলে কতদূর যাওয়া যায়—
তা তোমার চেয়ে আর কে ভালো জানে বলো
না কাঁধের প্রহরী, না স্বয়ং ঈশ্বর
প্রশ্রয় দাও বলেই তোমার চুলের মতো বেড়ে উঠি
দীর্ঘ হয়ে বেড়ে উঠি সাড়ে তিনশো হাত।
তুমি ছাড়া এই গ্রহ— অনন্ত দুঃসহ কোনো রাত।

আঁধার বনাম অন্ধকার

দিতে চাও দিয়ো শাস্তি
মায়ের মূর্তির ন্যায় সাগরে ফেলিয়ো
ঢেউ হয়ে ফেনা হয়ে ছড়াইব সুরের কম্পন
হৃদকূপে ফেলিয়ো না একমাত্র এটুকু মিনতি।

দিতে চাও দিয়ো শাস্তি
সাড়ে তিন হাত মাটির গভীরে রেখো পুঁতে
ঘাস হয়ে ফুল হয়ে সাজাইব সমাধি প্রাঙ্গণ
হৃদকূপে ফেলিয়ো না একমাত্র এটুকু মিনতি।

পড়ে গেলে একবার হৃদকূপে কে পারে উঠিতে
আঁধারে আপত্তি নেই
অন্ধকারে ফেলিয়ো না অকারণ হাসিতে হাসিতে।

কতকাল হাত পেতে রবে

বেড়াল পুষি না আমি, আমার পোষ্যরা সব বাঘের সন্তান
শব্দের অরণ্যে যারা তিনবেলা লেফট-রাইট করে
ভাইরাসবিস্তৃত পৃথিবীতে শান্তির বিপরীতে যুদ্ধই সম্বল
যুদ্ধেই দেশে দেশে মানচিত্র বিবর্তিত হয়
যুদ্ধেই বাঙময় হয়ে উঠে স্বাধীনতার উড্ডীন পতাকা
যুদ্ধেই কার্পাসের মতো উড়তে থাকে জারের প্রাসাদ
যুদ্ধেই তাল বৃক্ষের পত্রের মতো বৃষ্টির পরশ পেয়ে
দিকে দিকে মুখরিত হয়ে ওঠে শান্তির বয়ান।

বেড়াল পুষি না আমি, আমার পোষ্যরা সব বাঘের সন্তান
হুকুমের অপেক্ষায় যারা আমার মুখের দিকে দৃষ্টি ফেলে রাখে
কখনো পর্বত যদি দাঁড়ায় সমুখে ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে যারা
কম্পমান করে তোলে থির পৃথিবীকে
আগামী পৃথিবীর অপেক্ষায় যারা প্রতিক্ষণ নিজেকে শাণিত করে
মুখোমুখি হতেই বশ্যতায় হাত তুলে দাঁড়িয়ে যায় তাতার বাহিনী
যা কিছু অর্জন এই মানুষের সবটাই যুদ্ধের ফসল
শান্তির দুয়ারে আর কতকাল পৃথিবীটা হাত পেতে রবে!

অনাগত সন্তানের নাম

পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে—
সারাক্ষণ তোমার চোখে চোখ রেখে বাঁচতে হবে জানি।
পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে—
তোমার পথে পুষ্পিত কণ্টক ফেলে বাঁচতে হবে জানি।
পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে—
তোমার বুকে বন্দুক তাক করে বাঁচতে হবে জানি।
হায়, এও কি বাঁচার কোনো নাম!
পৃথিবীতে গোলাপ চাষিরা আজ বড় প্রতারক!
প্রিয়তমা, আমার অনাগত সন্তানের নাম দিয়ো তুমি
কন্যা হলে নাম দিয়ো ফুলন দেবী— বিদ্রোহী ফুলন
পুত্র হলে, ফিলিস্তিনের বীর কিংবা শহিদের নাম—
আপন অস্তিত্ব লয়ে যুদ্ধের ময়দানে যারা চির-সংগ্রামী।
এখনো যুদ্ধের মাঠে আছি
ঝরবেই একদিন পৃথিবীতে বাঁধভাঙা বিজয়ের হাসি
হস্তীর মতো বিস্তৃত আঁধারের বিপরীতে
আমার সন্তান যেন বেছে নেয় সদর্পে আলোর গোঁড়ামি।

ভেটোর ছোবল

একজন যুদ্ধংদেহী নেতানিয়াহুর শতাব্দীর নিষ্ঠুর বুটের তলায় যখন একফোঁটা
গাজা পৃথিবীর মানচিত্রের সমান ক্ষত লয়ে আর্তনাদ করে, তখন মনে হতে
থাকে— মানুষ নামের সংজ্ঞাটিই বদলে গেল বুঝি।

আত্মরক্ষার একপেশে বয়ানপ্রদানকারী জগদ্বিধাতা যখন দখলদারিত্বসহ
ইসরায়েলের সকল দুষ্কর্মের অন্ধ সমর্থক হয়ে ওঠেন, তখন মনে হতে
থাকে— মানুষ নামের সংজ্ঞাটিই বদলে গেল বুঝি।

এক তরুণ সৈনিক যখন গাজা গণহত্যার প্রতিবাদে নিজ গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে
আত্মত্যাগে শামিল হন, তখন মনে হতে থাকে— মানুষ নামের সংজ্ঞাটি
সামান্যের জন্য বেঁচে গেল বুঝি ছিন্ন করে ভেটোর ছোবল।

সমুদ্রটা দেখা দিয়ে যায়

আমার শব্দ কিংবা শব্দরাজির কষ্ট নেই কোনো
এরা সব শ্রমধন্য— গায়ে যার ফুটে থাকে লবণকুসুম
হেঁটে হেঁটে যায় এরা আর্যত্বে সমাসীন পাঠকের বাড়ি
খুশি হয় গৃহকোণে গীতবিতান ধর্মীয় কেতাব
কিংবা নজরুলের বিদ্রোহী সম্বলিত অগ্নি-বীণ’ দেখে
বলা যায় পাঠদানে গুরুরাই বাড়ি বাড়ি ফেরে
পায়ে হেঁটে সমুদ্র দেখার ক্লেশ থাকে না এদের
সমুদ্রটা পদব্রজে ধীর লয়ে দেখা দিয়ে যায়।

আমার কবিতারা জরিপকারীর মতো পাঠককেই পড়ে
পড়ে তার যুগল চোখের ভাষা শ্রবণের ধারা এবং
হৃদয়ের জাহেরি বাতেনি সব অদ্ভুত লিখন
নিজেকে কর্তন করে দীর্ঘতর করে তুলে সৃষ্টির মিছিল
ফিরে আসতে কেটে আনে পাঠকের আধেকটা হৃদয়
ডাকাত স্বভাব কিনা অনুভবে মেলে ধরে শৌর্য পরিচয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *